ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-১৫

0
441

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১৫

‘ সেদিনটা আমি পাগল ছিলাম! হয়তো দিনটাই পাগল করেছিলো আমায়। দিকসারা শরীরে এটা ওটা কত কি করলাম। নাম পাল্টালাম নিজের! ভাঙলাম আমার মায়াবতীর বিয়ে। তাতে কি ভাব হলো? মায়াবতী’র যে আত্নসন্মান প্রখর। তাতে আচ লেগেছে, সে কষ্ট পেয়েছে, ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় শেষ হয়ে গেছে। এটা আমি বুঝতে পারলাম সেদিন’ই। যখন দেখেছিলাম তুমি আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা করছো। নিজের কাজের জন্য নিজেকেই তখন খুন করতে মন চাইলো। আমার মায়াবতী তো আমায় ভালোবাসে না! আদেও দেখেনি পর্যন্ত! সে কিভাবে মানবে আমার ভালোবাসা? পাগলামো? সেদিনের অবস্থান? সেদিনের কষ্ট? খুব কাছের মানুষকে হারাবার তীব্র ভয়েই এতো বড় নিচ কাজটা করতে হয় আমায়। তবুও প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলাম। আমি চাইলেই পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের দিন সবটা অস্বীকার করতে পারতাম। তোমায় না চেনার ভান ধরতে পারতাম। কিন্তু তোমারো তো জানা উচিত, কে করলো এত বড় পাপ কাজ? জানালাম! ইচ্ছাকৃত ভাবে বিয়ের কথাটাও বললাম। কিন্তু….’

একটানে এতগুলো কথা বলে থামলো আয়াত। ঘেমে গেছে আয়াতের শরীর। কন্ঠ কেমন ভাঙা। ইরা হতভম্ব! থমকে বসে রইলো চেয়ারে। তার চোখদুটি পড়ার টেবিলে স্থির। বুকে যেন জমছে ভয়ংকর রাগ। কোথাও আবার কষ্ট। এইটুকু কারন? এর জন্য তাকে সবার সামনে অপমানিত করা? ছিহ্! ইরা শক্ত, তিক্ন দৃষ্টিতে তাকায় আয়াতের দিকে। আয়াত ও তাকিয়ে। তবে তার মুখশ্রীতে কোনরকম বিভ্রান্তির চিহ্ন মাত্র নেই। ফ্যাকাশে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আয়াত। ইরা বুঝলো, এতো বড় কুকর্ম করেও অপরাধবোধ নেই আয়াতের মাঝে। এতটুকু অনুতপ্ত হয়নি আয়াত। ইরা কর্কশ গলায় বলে,

‘ ব্যাস? এতটুকু? তো আপনার মনে হয়নি যে পাপ কাজটা করেছেন তার শাস্তি পাওয়া উচিত? আর যে মায়াবতীকে ভালোবেসে বিয়ে ভেঙেছেন তাকে রেখেই তো আরেকজনকে বিয়ে করতে নিচ্ছিলেন। এই নাকি আপনার ভালোবাসা! হাহ্! ‘

আয়াতের স্বর নতজানু,

‘ আপাতদৃষ্টিতে দেখলে সবার’ই মনে হবে আয়াত চিট করেছে। বিয়ে নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল, আব্বু আমায় শাসালেন। বললেন, বিয়ে না করলে পিতা বলে যেন না ডাকি। তখনো কিন্তু ঠিক নয় বিয়েটা, সেই রাতে ফোন আসে তনয়ার। সে এ বিয়েতে রাজি নয়! আর আমাকেও বলা হলো যেন আমি না করে দেই। কিন্তু… ‘

আয়াতকে থামিয়ে দিলো ইরা। শক্ত গলায় বললো,

‘ কিন্তু আপনি আটকাননি। একবারও বলেননি আপনি রাজি নন! ‘

‘ ঠিক ধরেছো! যদি এতেই আমার শাস্তি হয় তাহলে আটকাবো কেন? ‘

ইরা চেয়ার ছাড়লো। ঘৃণায় রি রি করে উঠলো পুরো শরীর। একজন মানুষের এতো রুপ থাকতে পারে, সে সপ্নেও ভাবতে পারেনি। কিছুটা দূরে গিয়ে ঠাট্টা হেঁসে বললো ইরা,

‘ একজনকে অপবাদ দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করে নেওয়া বুঝি শাস্তি বলে? ‘

‘ না! বলে না। কিন্তু বিয়ে অব্ধি এগোনোর কারনটাকে হয়তো কিছু একটা বলে। ‘

ইরা তড়িৎ গতিতে পিছু ফিরলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘ মানে? ‘

আয়াতের অনিমেষ কন্ঠস্বর,

‘ মানেটা হলো এই, আমি জানতাম তুমি কুহুর বিয়েতে আসবে। কুহু ডাক ডোল পিটিয়ে আমায় বলে গেলো। তনয়া বললো, আমি বিয়ে না ভাঙলে সে পালিয়ে যাবে। তার হাত পা ধরলাম যেন এই কাজটা না করে। তাকে তোমার কথা বললাম! আমার পাপের কথা বললাম। তারপর তাকে বিয়ের আসর থেকে উঠে যাওয়ার পরামর্শটাও আমিই দিয়েছি। যেন তুমি স্বচক্ষে সেটা দেখো। আমার প্রতি তোমার ঘৃণাটা একটু হলেও কমে যেন। কিন্তু তনয়া ভিতু প্রকৃতির। এই ছোট্ট একটা কাজ করতে পারবে কি পারবে না এই নিয়ে তার কি দ্বিধা! তার উপর আবার ভয় ও ছিলো যদি বিয়েটা হয়ে যায়? মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলাম তনয়া পারবে না। হয়ে যাবে বিয়েটা! কিন্তু ওদিকে তোমরাও যে একই কাজ করতে বলেছো, এটা তো আর আমি বুঝিনি। ‘

এবার চোখদুটি ফেটে পড়লো চরম বিষ্ময়ে ইরার। অবাক চোখে তাকালো আয়াতের দিকে। মুখের কাঠিন্যতা মিলিয়ে গেলো কর্পূরের মতো। তাই তনয়া রাজি হয়েছিলো কুহু আর ইরার একটি বাক্যে? একবারও কি জিজ্ঞেস না করার কারন তার আগাম জানা? একটা মেয়ে নিজের হবু স্বামীকে বিয়ের দিন অপমান করবে, এতো কল্পনাতেও ভাবা দায়! কিন্তু কোনরকম প্রশ্ন না করেই রাজি হয় তনয়া। সবটা পরিষ্কার হলো ইরার কাছে। তবুও তার আয়াতকে সহ্য হচ্ছে না। রাগ হচ্ছে। তাকে নিজ হাতে খুন করে ফেলতে মন চাইছে।

‘ কিছু বলবে না? ‘

ইরা তাকিয়েই রইলো। আয়াতের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ইচ্ছে হলো না ইরার। বলার মতো কিছু না পেয়ে দাড়িয়ে রইলো সেখানে। আয়াত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। ইরার কাছে এসে বলে,

‘ আমি তোমায় ভালোবাসি ইরা। বিশ্বাস করো, খুব ভালোবাসি। ‘

এবার যেন ইরার চারপাশ কেঁপে উঠলো। শিউরে উঠলো শরীরের প্রতিটি লোম। ভালাবাসা শব্দটা বড্ড বেমানান আয়াতের মুখে। ভালো শোনাল না। তবুও কেন ইরার মন বলছে আয়াত মন থেকে বললো? ভালাবাসা থেকে বললো? ইরা তবুও বলার মতো কিছু পেলো না। কিন্তু তারপর ঘটে গেলো এক আশ্চর্য ঘটনা। এই ঘটনার অনেকটা দেখে ফেললেন ইলিমা। আয়াতের এ কথার পরই তিনি আওড়ে ওঠেন,

‘ এসব কি হচ্ছে ইরা? ‘

ইরা চমকালো। চমকালো আয়াত। ভয়ে আপনা আপনি পিছিয়ে গেলো কয়েকপা ইরা। অবাক নয়নে তাকালো নিজের ভাবীর দিকে। হাতে আয়াতের জন্য আনা নাস্তার ট্রে। তিনি সন্তর্পণে গিয়ে দাড়ালেন দুজনের মাঝে। চোখেমুখে আশ্চর্যতা নিয়ে বললেন,

‘ কি হলো? কিছু বলেছি আমি! তোমার ভাই জানে এইসব? ‘

ইরা থতমত খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। আয়াতের মাথা নত। ইলিমা ধমকে উঠলেন,

‘ বলো! কতদিন ধরে তোমাদের সম্পর্ক? ‘

‘ আসলে…আসলে…’ আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও বলে উঠতে পারলো না ইরা। আয়াত মাথা নত রেখেই বললো,

‘ ইরার আর আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি ইরাকে ভালোবাসি, ইরা আমায় নয়! ‘

ইলিমা তিক্ন দৃষ্টিতে পরখ করলেন দুজনকে। আয়াতকে বললেন,

‘ আমি তোমায় নয়, ইরাকে জিজ্ঞেস করেছি। ‘

‘ যে এই বিষয়ে জানে না। সে কি বলবে? আমায় বলুন! আমি আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। ‘

‘ তুমি কি বলছিলে একটু আগে? ‘

আয়াতের সহজ সিকারোক্তি, ‘ আপনার ননদকে ভালোবাসি আমি। ‘

‘ কতদিন যাবৎ? ‘

‘ তিন বছর! ‘

‘ কিছুদিন আগের ঘটনা জানো নিশ্চই? ‘

আয়াত ইরার দিকে তাকালো। ফ্যাকাশে মুখ ইরার। বললো,

‘ এসব তো মিথ্যে। ‘

‘ তুমি এখন যাও। ‘

আয়াত বুঝলো না হঠাৎ যেতে বলার কারণ। চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। ইলিমা ফের বললেন,

‘ যেতে বলেছি আমি। ‘

আবারো অসহায় চোখে ইলিমা আর ইরাকে দেখলো আয়াত। অতঃপর শার্টের কলার হাত দিয়ে বেরিয়ে গেলো আয়াত। আয়াত বেরোতেই ইলিমা ইরার ডান চেপে নিলো। টেনে বিছানায় বসিয়ে বলে উঠলো,

‘ এসব কি ইরা? আয়াত তোমায় ভালোবাসে? আর যে কথাগুলো বললো, এগুলো কি সত্য? ‘

‘ হুম। ‘

‘ তুমি আগে থেকে চেনো আয়াতকে? ‘

‘ চিনি। আগে বলো আমি যে কথাগুলো তোমায় এখন বলতে চলেছি তুমি কথাগুলো ভুলেও ভাই বা কাউকে বলবে না। ‘

‘ কি? ‘

ইরা বললো। একে একে সব খুলে বললো ইলিমাকে। আয়াতের পরিস্থিতি, নিজের অবস্থান! সবটা! ইলিমা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। ইরা এক দমে সবটা বলে তাকালো ইলিমার দিকে। ইলিমা কিছু বললেন না। মুখে গাম্ভীর্যের ছটা। শুধু বললেন,’ তোদের হচ্ছে! ‘

#চলবে….