ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-১৬

0
475

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১৬

মাটি ভর্তি মুকুল পড়ে। বাড়ির সামনের আম গাছটায় বুঝি এবার আর আমের দেখা মিলবে না।ইউক্যালিপটাস গাছগুলো মড়মড় করে ভাঙতে আরম্ভ করেছে তিব্র বাতাসে। বাইরে ঝড়ের বড্ড দাপট। থেকে থেকে কি এক গর্জন আকাশের! নিকষ কালো রজনীতে বিদ্ধস্ত আকাশ ভেঙে পড়ছে যেন। কান ফাটা গর্জনে শিউরে উঠছে শরীর। তারউপর বাতাস! ঘরের জানালা খোলা। পানি ছিটকে এসে ফ্লোরে পড়ে পড়ে পুকুর হওয়ার যোগার। বাইরের ঝড়ের থেকেও বড় ঝড় বয়ে চলেছে আয়াতের বুকে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। ইরাকে শতশত মেসেজ, কল করার পরও কোন রিপ্লাই আসেনি। তবে কি এই অব্ধি’ই তাদের সম্পর্ক? ব্যাস এতটুকুই তাদের গল্প? হয়তো! আর কি দেখা হবে না? হবে না কেনো? নিশ্চয়ই হবে। হতে হবেই! সব বলে কি ইরার কাছে আরও ঘৃণ্য বর্বরোচিত হলো আয়াত? এই প্রশ্নটাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আয়াতকে। আর ইলিমা কি সব বলে দিলো? কি হলো? চিন্তায় মাথা ব্যাথা করছে আয়াতের। সবসময় পরিপাটি থাকা আয়াত, আজ এতো এলোমেলো কেন? যেন সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু! তারমধ্যে তার মায়াবতী ও! এ বেদনা সহ্য হচ্ছে না আয়াতের। বিছানা থেকে উঠে জানালার ধারে গেলো আয়াত। সামনের আম গাছটার সব মুকুল পড়ে গেছে। বাইরের অবস্থা করুন। আয়াতের খুব খারাপ লাগছে। ঝড় মাথায় করেই মন চাইছে ছুটে ইরার কাছে যেতে।

কিছুক্ষণ পর আবারো বিছানায় এসে বসলো আয়াত। রুমে প্রবেশ করলেন ত্রপা বেগম। ছেলেকে অদ্ভুত ভাবে বিছানায় বসে থেকে তিনি অবাক হলেন। এই সময়টাতে আয়াতের কানে হেডফোন থাকবে। থেকেথেকে হাসবে, এতোকাল এমনি করে এসেছে আয়াত। কিন্তু আজ তার বিপরীত দেখে তিনি চমকে উঠলেন। ধির পায়ে ছেলের পাশে বসে ডাকলেন,

‘ আয়াত? ‘

শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো আয়াত। ত্রপা বেগম স্পষ্ট ছেলের চোখে পানি দেখলেন। তিনি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কি হয়েছে তোর? মন খারাপ? ‘

ব্যাস! এতটুকুতেই আবেগে ভেসে গেলো আয়াতের মন। ছোট বাচ্চার মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। দু’হাতে মায়ের কোমর জড়িয়ে নিলো। ত্রপা আশ্চর্য হয়ে বললেন,

‘ কিছু বলবি তো? কি হয়েছে? ‘

‘ মা…আমি পাপি! পাপ করেছি। বিশাল পাপ। ক্ষমার অযোগ্য। খুব একা লাগছে। ‘

ত্রপা বেগম কিছুই বুঝলেন না। শুধু অবাক হলেন ছেলের কান্ডে। এতো বড় ছেলেকে কিভাবে বাচ্চাদের মতো কাদছে! তিনি আলতো করে মাথায় হাত রাখলেন আয়াতের। বললেন,

‘ কি পাপ করেছিস? ‘

আয়াত আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো মাকে। আটকানো গলায় বললো,

‘ আমি একজনকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। তাকে পাওয়ার ইচ্ছে আমায় পাগল করে দিয়েছিলো। তখন শুধু ভেবেছিলাম ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সব করা যায়। সব! এমন জঘন্য একটা চিন্তা নিয়েই তোমার ছেলে খারাপ কাজ করেছে মা। ‘

‘ কি করেছিস বলবি তো? ‘

আয়াত আকস্মিক ছেড়ে দিলো ত্রপা বেগমকে। তিনি পাশে বসলেন। সরে যাওয়া হাত আবারো মাথায় রেখে মৃদু হেঁসে বললেন,

‘ কাউকে ভালোবাসিস? ‘

আয়াত ডান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছলো। মেঝের দিকে তাকিয়ে নতজানু হয়ে বললো,

‘ হুম। ‘

‘ ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে হলে যেকোনো কিছু করা যায়। তবে সবটা সবদিক দিয়ে বিবেচনা করে। এখন তুই যাকে ভালোবাসিস, তাকে পাবার জন্য তুই তোর ইচ্ছে মতো যা খুশি করতেই পারিস, যদি সেও তোকে চায়। বুঝলি? একপক্ষীয় ভালাবাসা কষ্টের, তবে এ কষ্টটা বোকা মানুষগুলোই সহ্য করে। এরা না পারে গিয়ে মনের কথা বলতে আর না পারে সহ্য করতে। একসময় এই ভালোবাসা বিষে রুপান্তরিত হয়। এদের তখন আর বিশ্বাস থাকে না ভালোবাসার প্রতি। তাদের কাছে তখন ভালোবাসা মানে শুধু কষ্ট। ‘

‘ এখন কি করবো আমি? আমি আর পারছি না আম্মু। খুব কষ্ট হচ্ছে, বিশ্বাস করো। আমি পারছি না। ‘

‘ ইরাকে ভালোবাসিস তুই তাইনা? ‘

আয়াত বিমুঢ় হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। ত্রপা বেগম তো বিশ্বাস’ই করেননি সেদিন। আজ হঠাৎ বুঝলেন কিভাবে? আয়াত চুপ রইলো। ত্রপা বেগমের বুঝতে বাকি নেই, আয়াত সত্যিই ভালোবাসে ইরাকে। তিনি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললেন। মাথা থেকে হাত সরিয়ে বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে।

বাইরে ঝড় ক্রমশ বাড়ছে। একটু পর পর বিজলির চমকে আলোকিত হয়ে উঠছে আবছা অন্ধকারে ঢাকা আয়াতের রুম। বেডের পাশে টি-টেবিলটায় পড়ে থাকা ফোনটা বেজে চলেছে ঘন্টাখানেক হলো। বৃষ্টির প্রচন্ড শব্দে কর্নকুহরে পৌছালো না আয়াতের। তার বুকেও চলছে ঝড়! বুক ফেটে আসছে। কিছুক্ষণ পর’ই আয়াতের মনে হলো তার ফোনটা বাজছে। আয়াত সেদিকে তাকাতেই দেখলো আসলেই তার ফোন বাজছে। তার মনে হলো ইরা ফোন করেছে। এইটুকু ক্ষুদ্র আশা নিয়েই আয়াত ছুটে গিয়ে ফোনটা হাতে নিলো। কিন্তু না! ইরার ফোন নয়! আকাশ ফোন করেছে। নিজেকে সামলে ফোন রিসিভ করলো আয়াত। আকাশ বললো,

‘ রবিন, কেমন আছো? ‘

আকাশ ছোট্ট একটা শ্বাস ছাড়লো। ছোট করেই বললো,

‘ রবিন নয়। আকাশ বলছি। ‘

‘ কিন্তু নাম্বারটা তো রবিনের। কে আপনি? ‘

ফোন হাতেই বিছানায় বসে পড়লো আকাশ। বললো,

‘ যাকে ফোন করেছেন। সেই আমি। আমি রবিন নই। আকাশ। এটাই আসল পরিচয় আমার। ‘

‘ এর মানে? ‘

‘ খুব’ই সোজা। আমি সেদিন আপনাকে মিথ্যে বলেছি। রবিন নামে আদেও আমি কাউকে চিনি না। আর ইরার নামে আপনাকে বলা সব কথা মিথ্যে ছিলো। ‘

ওপাড় থেকে ক্রুদ্ধ স্বর ভেসে আসে,

‘ এসব কি বলছেন আপনি? কেন করেছেন এমন? আমাদের বিয়েটা ভেঙে কি লাভ আপনার? ‘

আয়াত আকাশের উত্তর দিতে গিয়ে বুঝলো, তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। শ্বাস আটকে আসছে। দলা পাকিয়ে আসছে গলায়। চোখের পাতাদুটো স্যাতস্যাতে। আয়াত এধিক ওদিক তাকিয়ে চোখের পানি আটকালো। শান্ত গলাতেই বললো,

‘ লাভ? জিবনের সবথেকে বড় ক্ষতি ছিলো। ‘

‘ আপনার কথার মানে কিন্তু আমি বুঝছি না। এসব কেন আমাদের বলেছিলেন আপনি? ‘

‘ ইরাকে ভালোবাসতাম বলে। যাকে ভালোবাসি সে অন্য কারো হবে, এটা আমি মানতে পারিনি। ‘

প্রচন্ড ক্ষোবে ফোন কেটে দিলো আকাশ। আয়াত গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। তার হৃদপিণ্ড ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চারদিক থেকে সে একা হয়ে পড়ছে। আর একাকিত্বের কষ্ট অনেক!

ঝড় থেমেছে সন্ধ্যা সাতটার দিকে। রাত নয়টার পর’ও সেভাবেই শুয়ে আয়াত। একটু আগেই মেসেজ এসেছে, ‘আপনাকে ভাইয়া আসতে নিষেধ করেছেন! আর এ বিষয়ে ভাইয়া কথা বলতে চান না! তবুও যদি আপনার তরফ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা দেখেন ভাইয়া, তাহলে ফল ভালো হবে না।’ এই সামান্য কয়েক লাইনের পর আয়াতকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। সাথেসাথে নাম্বার, ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ব্লক করেছে ইরা। আরও খারাপ লাগছে আয়াতের। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে হৃদয়। নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো সারাটা রাত। কখনো এপাশ, আবার কখনো ওপাশ করে। পরের দিনটা ছিলো ঝলমলে। রৌদ্রময় দিন। আয়াতের যে অনেক কথা বলা বাকি, জানা বাকি। এভাবে সে তার মায়াবতীকে হারাতে পারবে না! তাদের প্রেমকাব্যে এখাতেই সমাপ্তি টানার অধিকার নেই ইরার। এখনো অনেক জবাব চাওয়া, দেওয়া বাকি। আয়াত ঠিক করলো, যাবে একবার ও বাড়ি। সকাল সাতটায় বের হয়ে গেলো বাড়ি থেকে আয়াত। কিন্তু তার ভাগ্যে হয়তো ছিলো না তার মায়াবতী, তার ভালোবাসা। তাইতো তাদের গল্পে নেমে এলো আরও এক প্রাচীর! শক্ত প্রাচীর! সীমাহীন দূরত্ব! ও বাড়িতে গিয়েই আয়াতের দেখা মিললো রিয়াদের সাথে। গার্ডেনে। রিয়াদের মুখ দেখে বোঝা গেলো না মনে কি চলছে। গম্ভীর স্বর,

‘ তুমি?এখানে? ‘

আয়াতের আকুতিভরা গলা,

‘ আমি জানি অনেক বড় ভুল করেছি। কিন্তু এর মানে কি এটা যে আমাদের দূরত্ব এতটা হবে? আমি ইরাকে ছাড়া বাঁচবো না! ‘

আয়াতের আকুতি, বুক ফাটা কষ্ট নিয়ে নিজের মনের ভাব বুঝিয়েও কাজ হলো না। রিয়াদ কিছুতেই এ নিয়ে কথা বাড়াতে রাজি নয়। আয়াতকে চলে যেতে বললো রিয়াদ। আয়াত শুনলো না। একটিবার ইরার সাথে কথা বলার জন্য রিয়াদকে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ডুকে পড়লো আয়াত। ভেতরে যেতেই সে স্তব্ধ! পা দুটি অসর হয়ে এলো। নিজের চোক্ষে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো আয়াতের। তার কাছ থেকে দূরে, অনেক দূরে পাঠানোর তোরজোর চলছে। একটু বাদেই ইরার ফ্লাইট!

#চলবে…..