ইস্ক পর্ব-০৩

0
625

#ইস্ক
#সাদিয়া


তিতিল ধীর গলায় বিড়বিড় করল “ইয়াদ।”

ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল সে। ভেতরটা কেমন করছে সে বুঝাতে পারবে না। কাঁপা গলায় বলল “আ আপনি এসেছেন?”

তিতিলের কাজে কলি পিছন ফিরে তাকাল। তার মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠে। সে তার আপা কে বলল “আপা এইহানে কেউ নাই।”
কপালে ভাঁজ তুলে তিতিল সামনে তাকাতেই চারিদিক শূন্য দেখতে পায়। বুক টা মোচড় দিয়ে উঠে। চোখের পানি টা এবার টুপ করে পড়েই গেল। তিতিল নিচে ধপ করে বসতেই কলি চেঁচিয়ে বলে উঠে “আপা।”

মানব শূন্য জায়গায় তিতিল চিৎকার করে কাঁদছে। তার কান্নার হৃদয় কাঁপা শব্দে কিছু পাখি উড়ে যায় ওখান থেকে। কলি পাথরের মতো তাকিয়ে আছে। হাটু ভাঁজ করে তিতিল কেঁদেই চলেছে। গলা ছেড়ে চিৎকার করে মনের চাঁপা যন্ত্রণা টা ঝেড়ে ফেলছে সে। বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে এলেও অদ্ভুত রকম একটা শান্তি পাচ্ছে সে। চুপচাপ বসে আছে তিতিল। ভাবমূর্তি বলছে প্রাণ শূন্য একটা বস্তু পড়ে আছে। কলি ভয়ে ভয়ে ডাকল তিতিল কে। বার কয়েক ডাকার পর সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কলির দিকে। কলি আতকে উঠল। ভয় পেয়ে সে বুকে থুথু দিল। তিতিল আবার আগের মতো করে শূন্যে তাকিয়ে আছে ফোলা ঢলে পড়া চোখ দুটো নিয়ে। সবুজ খেতটা তার কাছে ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।

কলি দৌড়ে তার মা কে নিয়ে এলো। রাস্তায় সখিনা অনেক বকলেন মেয়েকে এখানে নিয়ে আসার কারণে। কলি সেই জায়গায় সখিনা কে নিয়ে যাওয়ার আগেই দেখতে পেল তিতিল হলুদ কাপড়ে এগিয়ে আসছে। সখিনা কলি দুজনে দাঁড়িয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। মৃদু গলায় সখিনা ডাকলেন “তিতিল।”

“আমি ঠিক আছি একেবারে। বাড়ি চলো।”
তিতিল আবার ধীর পায়ে হাটতে লাগল। তাকে বেশ অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সখিনা তিতিল কে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। রাগে মেয়ের পিঠে এক ঘা দিয়ে তার পিছু ধরল।

তিতিল নিজের ঘরে এসে সেই যে ঘুমিয়েছিল রাতে আর উঠেনি। সকালে তার বাবা তাকে ডেকে তুলে।

“আম্মা ওতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাও তুমি?”

“সকাল হয়ে গেছে খুঁজই পাই নি আব্বা।”

“হাত মুখ ধুইয়া আও এক লগে খাইয়াম।”

“আচ্ছা।”

তিতিল ঘরে গিয়ে ব্যাগ থেকে ব্রাশ বের করল। সত্যিই কাল রাতের মতো ঘুম বিয়ের পর থেকে হয়নি তার। কালকের ওই চিৎকার করা কান্নায় চাঁপা কষ্টটাকে আকাশে বাতাসের সাথে উড়িয়ে দিয়ে খানিক মন হালকা হলো। স্মিত হেসে তিতিল কলপাড়ে গেল হাত মুখ ধুতে।

—-
আজও যখন তিতিল কলিকে বলল হাটতে যেতে তখন কলি সুন্দর করে না করে দিয়েছে। তবুও সে জোর করে নদীর রাস্তা ধরে হাটছে। টলটলে পানির ধ্বনিতে মৃদু হেটে উঠল তিতিল। কোথা থেকে যেন রাজিব হাজির। হঠাৎ সামনে আসায় তিতিল ভরকে গেল। কপাল কুঁচকে সামনে তাকাতেই পথ কাটিয়ে যেতে চাইলেও রাজিব তার পথ আটকায়।

“তিতিল তুই কি এহোনো ওই বাড়ি পইড়া থাকবি?”

“….

“তিতিল ফিরা আই না আমার কাছে। খুব ভালা রাহাম তোরে।”

“পথ ছাড়েন রাজিব ভাই।”

“আমারে কেরে কষ্ট দিতাছোস তুই? তুই জানোস না আমি তোরে কতটা ভালোবাসি। আর তুই..”

পাশ থেকে কলি বলে উঠল “ওই বেটা আপা কইতাছে না পথ ছাড়তে?”

“একদম বেশি কথা কইবি না কইলাম কলি।”

“কতা না হুনলে তো কওন লাগবই রাজিব ভাই।”

তিতিল কড়া গলায় কলি কে ডাকল। চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। তারপর শান্ত গলায় রাজিব কে বলল,
“দেখেন রাজিব ভাই আমার জীবন টা উল্টপাল্ট হয়ে গেছে। আমার এই ছন্নছাড়া জীবনের ধারেকাছেও আসবেন না আপনি। আপনাকে একটা কথা আবারো পরিষ্কার করে বলে দেই আমার বিয়ে একবার হয়ে গেছে সেটা যেমনি হোক। মৃত্যুর আগের আর বিয়ে করব না আমি। আমার আশা না করে আপনি বিয়ে করে সুখী হন। আপনি খুব ভালো মানুষ আর আপনার জন্যে গ্রামের অনেকে পাগল। অনেকের বাবা আপনার সাথে মেয়ে বিয়ে দিতেও রাজি। যেটা হবার নয় তার আশায় বসে থাকা নিহাতই নির্বোধের কাজ। আপনি শিক্ষিত হয়েও অবুঝের মতো কাজ করবেন না। আমাকে আর বিরক্ত করতে আসবে না রাজিব ভাই। ভালো থাকুন।”
তিতিল দ্রুত পায়ে সে স্থান ত্যাগ করল।রাজিবের চোখ দিয়ে টলটল করে পানি পড়ছে। তিতিল যদি তাকে আশা না দেখাত তাহলে কি সে দেখত? মন ভাঙ্গার কষ্ট সহ্য করা দুষ্কর। অনেক ভালোবাসে সে তিতিল কে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে করুণ চোখে তিতিলের যাওয়া দেখল তারপর নাক টেনে নিজের রাস্তা ধরল।

মাটির রাস্তা ধরে হাটছে তিতিল। মুখে তাচ্ছিল্যের আভা। রাজিব নামের ছেলেটা তাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসে তা সে জানে। অনেকবার তার মনের কথা বলেছে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে কয়েকবার। উত্তরে সে বলেছিল “রাজিব ভাই আপনি এত অস্থির হবেন না। আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আমার যদি আপনার ঘরে যাওয়ার থাকে এমনি যাবো। আপনি প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব বলে আমাকে বিব্রত করবেন না। আপনার যা বলার আব্বা কে গিয়ে বলবেন।”
কিন্তু রাজিব তো সময় পেলোই না। তার আগেই তো রেহেলা বেগম এসে ছেলের জন্যে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সেই ছেলেই ছেড়ে চলে গেল। তাচ্ছিল্যের হাসি বড় হয় তার। মনে মনে বিড়বিড় করে ‘কি অদ্ভুত ভাগ্যের লিলাখেলা। যে আমাকে ভালেবাসে তাকে আমি চাই না। আর যাকে আমি ভালোবাসি সে আমাকেই চায় না। কি সুন্দর সমীকরণ।”

তোমাকে দেখার লাগি
পথ চেয়ে আমি বসে আছি,
আসবে কবে তুমি প্রিয়,
তৃষ্ণায় আমার হৃদয় চূর্ণ।
বুক পিঞ্জরে জ্বলছে আগুন পুড়ছি আমি
বৃষ্টি হয়ে এসো তুমি সুহৃত্
নিভাও আগুন ডালো বারি।
তৃপ্ত করে চুপটি করে বসাও ক্রোরে
আদর সোহাগে টুইটুম্ভুর করে তুলো মোরে।
শুধাও কেন ওমন করি,
ভেতরে ভেতরে জ্বলে মরি
প্রতিবাক্যে আমি বলব হেসে,
তোমাকে দেখার তৃষ্ণা বুঝি রইবে আমার আমৃত্যু ধরে।

তিতিল বাড়িতে এসেই আৎকে উঠল। ভেতরটা কেমন রুরু করছে। ছলছল চোখ নিয়ে স্তব্ধ হয়ে পা এটে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত বিষয় নিয়েও অবাক হওয়াটা অনৈসর্গিকই বৈকি। এমনটা তো হওয়ারই ছিল!

চলবে♥