ইস্ক পর্ব-০৪

0
588

#ইস্ক
#সাদিয়া


তিতিল তো আগে থেকেই জানত না চাইতেও তাকে আবার ও বাড়ি ফিরতে হবে। রেহেলা বেগম এসেছেন বাড়িতে। বেশ কিছুদিন হলো সে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে না বলেই এসেছেন। কাল থেকে নিজের ফোন টাও বন্ধ করে রেখেছে মেয়েটা। আর যে ও বাড়ি ফিরতে চায় না। অগোছালো জীবন টা না হয় এমনি থাক।
ত্রাসগতিতে তিতিল এগিয়ে গেল। আজকালকার যুগে এমন শাশুড়ি পাওয়া দুষ্কর। এমনটা বোধহয় স্বামী ঠিক নয় বলেই হয়তো পেয়েছে। কিন্তু মায়ের মতো শাশুড়ির মুখে মুখে কি করে না করবে সেটা নিয়েই নানান চিন্তায় এতটা নুয়ে গেছে পা সামনে এগুচ্ছে না। তিতিল কে দেখতে পেয়ে রেহেলা ডাকলেন।
“আমার তিতিল মা।”

সংবিৎ হয়ে এলো সে। টান হয়ে দাঁড়িয়ে স্নেহের তৃষ্ণায় চাতক পাখির সুরে বলল “আম্মা।” রেহেলা হাত বাড়িয়ে দিতেই অশ্রু ভরা নয়নে তিতিল খানিক ঝাপটে ধরল গিয়ে। জিজ্ঞেস করল
“কেমন আছেন আম্মা?”

“তোকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারি বল?”

তিতিল জবাব দিল না। দম নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল “ইনা আপু কেমন আছে?”

“ভালো আছে। আসার সময় বারবার বলে দিয়েছে তোকে না নিয়ে যেন না ফিরি।”

“….
মুখ কালো হয়ে এলো মেয়েটার। মুখের ভাষা উবে গেছে যেন। রেহেলা বেগম বললেন,
“ইনা অফিসের জন্যে আসতে পারে নি। কিন্তু তোকে মিস করছে।”

স্মিত হাসল তিতিল। বলল,
“হিমা কেমন আছে আম্মা?”

“হিমার কথা আর বলিস না মা। এই শরীর নিয়েও আসার জন্যে যা পাগল হয়ে গিয়েছিল। আমিই না করেছি গ্রামের রাস্তার ঝাঁকিতে আরো কষ্ট হবে ওর। তুই তো জানিসই প্রতিমাসের এই সময়টা পেটের কতটা তীব্র ব্যথা সে সহ্য করে।”

“ভালো হয়েছে আম্মা আনেন নি। নয়তো আরো কষ্ট হতো।”

“হ্যাঁ। যা তুই এবার তৈরি হয়ে নে মা। অনেকটা পথ যেতে হবে তো ড্রাইভার অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে।”

জোর করে হাসি তুলা মুখটা শুকনো পাতার মতো শুকিয়ে গেছে। একটু ছোঁয়া পেলেই বুঝি মচমচ করে ভেঙ্গে যাবে। তিতিল কিছু বলার আগেই পাশ থেকে সখিনা বলে উঠলেন,
“বিয়াইন আইজ যাইবান গা কিতা কইন? আইজ থাকবাইন আমরার বাড়িত। কাইল যাইবাইন।”

তিনি হেসে জবাব দিলেন “এটা সম্ভব না বেয়ান। আমাকে আজই ফিরতে হবে। হিমা অসুস্থ একা বাড়িতে। তিতিল আসছিল না ফোনটাও বন্ধ ছিল বলে তাড়াতাড়ি চলে এলাম। অন্য দিন এসে অনেক দিন থেকে যাবো।”

তিতিলের বাবা কাঁধ থেকে গামছা টা নামিয়ে বললেন,
“বিয়াইন এমনে আপনি যাইবাইন গা এইডা আমি মানতারতাছি না। আপনি খাইয়া পরে যাইবাইন।”

“বেয়ান তাহলে খুব দেরি হয়ে যাবে। আমি অন্য দিন সবাই কে নিয়ে আসব।”

“একটুআধটু দেরি হইলে কিছু হইত না বিয়াইন। আমি বাজারো যাইতাছি। এহনি আইয়া পরাম।”

তিতিলের বাবা যাওয়ার আগেই তিতিল বলল,
“দাঁড়াও আব্বা। তোমাদের সবার সাথে আমার কথা আছে একটা।”

সবাই তিতিলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কি বলে তার আশায়। তিতিল কে চুপ থাকতে দেখে তার বাবা বললেন,
“কি কথা আম্মা?”

“…

রেহেলা বেগম বললেন,
“তিতিল কি বলবি তুই?”

তিতিল তখনো চুপ। এক পাশে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রয়েছেন সখিনা। তিতিল সবার দিকে তাকাল। তারপর মাথাটা নুয়ে বললো,
“আম্মা আমি আর ঢাকা ফিরব না।”

চমকে উঠল তার কথায় সবাই। রেহেলা বেগম সঙ্গেসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি বলছিস এসব তিতিল?”

“….

রব্বানি মিয়া কপালে অনেক গুলি ভাঁজ নিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আম্মা কি কইতাছো তুমি? কিছু হইছে?”

“….

“কিরে তিতিল বল কিছু।” বললেন রেহেলা বেগম।

নীরবতা ভেঙ্গে তিতিল বলল,
“এখানে বলার কি আছে আব্বা? সবটাই তো সবার জানার। আমি ও বাড়ি গিয়ে কি করব? এতদিন ছিলাম আম্মা আর ইনা আপু হিমার জন্যে। এখন আম্মার ছেলে আসবেন দেশে। উনি এসে ডিভোর্স দিলেই তো শেষ। তাহলে আমার ও বাড়ি যেতে হবে কেন। সাইন টা না হয় এখান থেকেই দিয়ে অধ্যায় টা চুকালাম।”

ধমক আর রাগান্বিত স্বরে রেহেলা বেগম ডাকলেন “তিতিল।”
মেয়েটা ভয় মিশ্রিত নয়নে রেহেলা বেগমের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নত করে আনল। তারও কি আর কম কষ্ট হচ্ছে?

“আমার ছেলে তোমায় ডিভোর্স দিবে কি দিবে না সেটা আমার ছেলেই বুঝবে তুমি না। আর তোমার সাথে আমার ছেলের ডিভোর্স এখনো হয় নি। হলে সেটা পরে দেখা যাবে। এখনো তুমি আমার ছেলের বউ আমার পুত্রবধূ। আর সময় নষ্ট না করে যাও তৈরি হয়ে নাও। এখনি রওনা হবো আমরা।”

রেহেলা বেগমের মুখে কড়া কথার আভাস পেয়ে তিতিলের বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। বুক উপচে কান্না এলেও চেঁপে রাখার বহু চেষ্টা করছে সে। ধরে আসা গলায় সে শুধু বলল “আ আম্মা।” তিতিল কে কথা বলতে না দিয়ে রেহেলা বললেন,
“যা বললাম তা করো।”

তিতিল ঠাই দাঁড়িয়ে আছে মাথা নুয়ে। তখন রব্বানি বললেন,
“বিয়াইন আমার আম্মা এইতা কিতা কয়? ডি ডিফোসের কথা? এইডা মানে তো তালাকনামা না? ওহন তো অনেকের মুহে হুনি এই কতা। কিন্তু আমার ছেড়ি এইতা কি কয় বিয়াইন?”

রেহেলা বেগম মুখের আগের সেই কঠিন রাগী ভাব বজায় রেখে বললেন,
“আপনাকে আমি পরে বলছি সবটা।”
কথা থামিয়ে তিনি তিতিলের দিকে তাকালেন। বললেন,
“তোমাকে কি বললাম তিতিল? যাও তৈরি হয়ে নাও।”

চোখের পানিটা আড়াল করে তিতিল চুপচাপ তার ঘরে চলে গেল। কান্নায় ফেটে পড়ল আবার চাঁপা কষ্টে। ভেতরের তার এই উত্তপ্ত যন্ত্রণা টা কেউ দেখতে কেন চায় না? চোখের পানি একের পর এক বাঁধাহীন গড়াচ্ছে।

গাড়িতে রেহেলা বেগম একটা কথাও বললেন না তিতিলের সাথে। শক্ত কঠিন একটা আবরণে উনার মুখ আবৃত। তিতিল কয়েক বারই চেয়ে দেখেছে, কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু সাহসে ধরে নি।

—-
বাড়ি ফিরার দুইদিন পর তিতিল সাহস করে রেহেলা বেগমের ঘরে গেলেন। উনার হাতে রবীন্দ্রনাথের “চোখেরবালি।” হঠাৎ বুকটা আতকে উঠল উপন্যাসটার দিকে চোখ পড়ে। আশালতার মতো হয়ে যাবে না তো তার জীবন টা? সত্যি কি মহেন্দ্রের মতো ইয়াদের জীবনেও কোনো বিনোদিনী এসে তার জায়গাটা আস্তেআস্তে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসবে ছলনাময়ীর মতো? ভাবতেই শিউরে উঠল সারা শরীর। অবশ্য মহেন্দ্র তো প্রথম দিকে নিজের স্ত্রী কে ভালোবাসত। পরে না বিনোদিনী মহেন্দ্রের মাথা আর মন দুটোই দখলে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ইয়াদ তো আর তাকে ভালোবাসে নি। তাই আশালতা হওয়ার কি আছে? এমনিতে সে আশালতার স্বভাবেরই। কিন্তু ভবিষ্যতে কি হবে চিন্তায় মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে।

রেহেলা তিতিল কে শূন্যে তাকিয়ে মুখে অদ্ভুত হাসির আভা দেখে ডাকলেন।
“তিতিল।”

তিতিল বাস্তবে ফিরে। এগিয়ে গেল উনার কাছে। বলল,
“আম্মা।”

“কিছু কি বলবি?”

“আম্মা আপনি আমার উপর রেগে আছেন?”

“….

“মাফ করে দেন আম্মা। আমি তো কষ্টে..”

“তিতিল মা তোর উপর আমি রাগ করি নি। কষ্ট পেয়েছিলাম। আর আমার সবসময়ই মনে হয় তোর কষ্ট গুলি আমার কারণেই।”

“এমন না আম্মা।”

“আড়াল করার দরকারই বা কি তিতিল? তুইও তো জানিসই। আর শুন আল্লাহ কখন কি চায় কে জানে বল তো? ভবিষ্যৎ কি হবে তা একমাত্র মহান আল্লাহ তা’য়ালাই ভালো জানেন। এত অগ্রিমও ভাবতে নেই।”

“কিন্তু আম্মা এবার তো ডিভোর্স টা হয়েই যাবে। তারপর তো আমি…”

“হয়নি তো? কে বলতে পারে আমার ইয়াদ তোকে ডিভোর্স দিতেই চাইল না।”

মুখে তার কার্টুন হাসি ফুটে উঠে। রেহেলা বেগম তার গালে হাত দিয়ে বললেন,
“মনে আশা রাখ মা। মনের নিবে আশা প্রদীপ কে আঁকড়ে ধর ঝড়ো হাওয়ার থেকে। দেখবি ঝড় কমে গেলে এই নিবে আসা প্রদীপই আলোকিত করবে তোকে।”

“….

“চিন্তা করিস না। তোকে একটা কথা বলার আছে।”
বলে মুচকি হাসলেন রেহেলা। আর তিতিল কপালে দাগ কেটে তাকিয়ে রয়েছে সেই কথা শুনার চেষ্টায়।

দৌড়ে তিতিল নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাতেই নোনাজল এসে ভিড় করেছে। বুকের ভেতর ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। সত্যি এবার কি সময় ফুরিয়ে এলো এখানে? তিতিল অস্পষ্ট চোখে ঘরের দিকে চোখ বুলাল। ঘরটা তো ইয়াদের। এতদিন তার রুমেই তো সে ছিল। এবার বুঝি প্রহর শেষ হলো। দুই বছরে তো মায়াই জন্মে গেছে এই ঘরের প্রতি। এবার গিয়ে অন্য কোথাও সে রইবে কি করে। ভেবেই আরো কান্নায় চোখ দুটি চিপচিপে হয়ে এলো তার। আর তো এই ঘরে তার আর থাকা হবে না। কাল ইয়াদ আসছে যে।

চলবে♥