উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-১৯+২০+২১

0
190

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৯
_________________

সে রাতে আর ইরতিজার ঘুম হলো না। মাথার ভিতর শুধু ক্যানিয়লের চিন্তা বিরাজ করেছে। মারামারির দৃশ্যটা চোখে ভাসতেই গা ছমছম করে উঠেছে। ক্যানিয়ল আসলেই সন্ত্রাসী? প্রশ্নটা ভাবতেই খুব ভয় করে, মন খারাপও হয়!
ক্যানিয়লের ব্যাপারে সর্বপ্রথম রিশনকে জিজ্ঞেস করলো ইরতিজা। রিশনের সাথে মর্নিং ওয়াকে বের হয়েছিল। তখন হঠাৎ প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা, ক্যানিয়ল কি সন্ত্রাসী?”

প্রশ্নটা শুনে দাঁড়িয়ে যায় রিশন। ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইরতিজার দিকে। মনে মনে কী যেন ভাবে ক্ষণকাল। তারপর বলে,
“ক্যানির ব্যাপারে একটা কথাও বলবো না আমি। মুড নেই ওর ব্যাপারে কথা বলার।”
বলে ইরতিজাকে রেখে সে দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায়। ইরতিজা ব্যাপারটার কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। রিশন ক্যানিয়লের প্রতি এতটাই বিরক্ত যে ওর ব্যাপারে কথা বলতেই অনিচ্ছা?
ভার্সিটি এসে একই প্রশ্ন করলো আবার জুহিকে। জুহি প্রশ্নটা শুনে খানিক মৌন থেকে বললো,
“না, ও সন্ত্রাসী নয়, ওকে ঠিক সন্ত্রাসী বলা যায় না। কিন্তু ওর কাজকর্ম আবার সন্ত্রাসীদের মতোই।”
এই ব্যাপারে শুধু এটুকু বলেই প্রস্থান করে জুহি। আসল ব্যাপারটা ভালো করে জানা হয় না তাই। অন্তঃকরণে জানার কৌতূহল খুঁড়ে খুঁড়ে খেতে থাকে ইরতিজাকে। কার কাছে জিজ্ঞেস করবে ক্যানিয়লের ব্যাপারে? সামুরা নিশ্চয়ই সবকিছু ভালো করে বলতে পারবে। কিন্তু ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের ব্যাপারে এমন কথা জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে?
দিশেহারা লাগতে লাগলো ইরতিজার। ক্যানিয়ল একজন সন্ত্রাসী এটা কিছুতেই মানতে পারছে না সে।
করিডোর ধরে এলোপাতাড়ি পা ফেলে হেঁটে আসছিল ইরতিজা। মাথায় কালো হিজাব। হিজাব ছাড়া এখন সে কোথাও বের হয় না। বের হলে যদি ক্যানিয়লের সাথে দেখা হয়ে যায়? তাহলেই তো ক্যানিয়ল বলবে,
‘তোমার মাথার হিজাব কোথায় পাকিস্টানি গার্ল?’

ওই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারবে না কিছুতেই। সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে যায় ওই প্রশ্নটা শুনলে।
অকস্মাৎ পিছন থেকে অন্যমনা ইরতিজাকে ধাক্কা দিয়ে করিডোর থেকে ক্লাসরুমে ঢুকালো কেউ। ঘটনাটা আকস্মিক ঘটায় ইরতিজা প্রথমে বুঝতে পারলো না এমন কে করলো। ক্যানিয়লকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তুমি?”

“তোমাকে মে/রে ফেলবো পাকিস্টানি গার্ল!” ফিসফিসানি সুরে বললো ক্যানিয়ল।

কথাটা শুনে ইরতিজা হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠলো। কেমন অভিমানও হলো। বললো,
“কেন মারবে আমাকে? কী অপরাধ আমার? আমার গায়ে হাত দিলে আমিও নিশ্চুপ বসে থাকবো না।”

ক্যানিয়ল ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বললো,
“তোমার মতো ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে কী করতে পারবে?”
প্রশ্ন করে ইরতিজার উত্তরের অপেক্ষা করলো না ক্যানিয়ল, সাবধানী কণ্ঠে বললো,
“লিসন, গতকাল যা দেখেছো ওটা যদি প্রকাশ করো তাহলে…”

ঠক ঠক করে টোকা পড়লো দরজায়। থেমে গেল ক্যানিয়ল। দরজায় তাকিয়ে দেখলো লেকচারার স্টিভেন দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা সুঠাম দেহের অধিকারী স্টিভেন। দেখতেও সুদর্শন। ক্যানিয়ল বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে বললো,
“উফ, সব সময় সব জায়গায় তুমি আমাকে বিরক্ত করতে চলে আসো। কী প্রয়োজন?”

“প্রফেসর ব্রুস তোমাকে ডাকছে।”

ক্যানিয়ল দরজার দিকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো,
“কেন?”

“কেন সেটা তুমি ভালোই জানো ক্যানি।”

“না জানি না তো আমি।” কেমন কাঁধ নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো ক্যানিয়ল, নির্বিকার ভাবে।

“আর্থার আর ওর ফ্রেন্ডসদের মেরেছো, তোমার সাথে তোমার দুই ক্লাসমেটও ছিল। এ খবর লিক হয়ে গিয়েছে।”

কথাটা শুনে ক্যানিয়লের মাঝে ভাবান্তর হলো না তেমন। নির্বিকার ভাবেই বললো,
“আমি যাব না প্রফেসর ব্রুসের কাছে। তার ওই এক ঘ্যান ঘ্যান শুনতে ভালো লাগে না। তাকে গিয়ে বলো, ক্যানি তোমার সাথে দেখা করবে না।”

ক্যানিয়ল ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। ইরতিজা ভাবছে ক্যানিয়ল কত বড়ো বেয়াদব! প্রফেসরের কথা পর্যন্ত শোনে না!

“তুমি কে?” স্টিভেনের কথায় হকচকিয়ে গেল ইরতিজা। আমতা কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“আমি ইরতিজা।”

স্টিভেন নাম নিয়ে অত আগ্রহ দেখালো না। বললো,
“ক্যানি কি তোমায় মেরেছে?”

ইরতিজা চমকে উঠলো। চোখ স্ফীত হয়ে উঠলো তার।
“ক্যানিয়ল মেয়েদেরও মারে?”

“মারে না বলেই তো তোমাকে এখানে দেখে অবাক হচ্ছি!”

স্টিভেন সরু চোখে ইরতিজাকে দেখে চলে গেল। অবাকচিত্তে দাঁড়িয়ে রইল ইরতিজা। চারপাশে কী হচ্ছে, কী চলছে কিছু বুঝতে পারছে না সে। ক্যানিয়লের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সবকিছু কেমন ওলটপালট লাগছে।

_________________

ভোরের পাখি টুইটুই করে ডাকছে। ক্যানিয়লের রুমের পশ্চিমা জানালার কাছে থাকা ডালটায় বসে ডাকছে পাখিটা। ক্যানিয়ল কিছুক্ষণ ধরে দেখে চলছে পাখিটাকে। এন্ডারসন হাউজে যেদিনই আসে সেদিনই এই পাখিটার দেখা মেলে। পাখিটা আরও কিছুক্ষণ বসে থাকার পর উড়ে গেল। ক্যানিয়লও জানালার কাছ থেকে সরে রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে ঢুকলো। কফি বানালো। এরপর এলো লিভিং রুমে। লিভিং রুমে হাত পা বাঁধা অবস্থায় দুজন মোটাসোটা লোক ম্যাট্রেসের উপর ঘুমিয়ে আছে। এই দুজন গতরাতে প্রবেশ করেছিল এন্ডারসন হাউজে। ক্যানিয়লকে ঘুমের মাঝে আঘাত করতে চেয়েছিল, কিন্তু ক্যানিয়ল তার আগেই সজাগ হয়ে আঘাতটা প্রতিরোধ করে। তারপর হালকা মারধর হয় এই দুজনের সাথে। ক্যানিয়ল শুধু ঘাড়ে একটু ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু এই দুজনের অবস্থা করুণ। প্রচুর আঘাত পেয়েছে এরা। ক্যানিয়ল পা দিয়ে একজনকে ঠেলে বললো,
“হেই, ওয়েক আপ।”

লোকটা নড়েচড়ে সজাগ হয়ে উঠলো। চোখ খুলে ক্যানিয়লকে দেখেই ধরফড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো সে। অপর ব্যক্তিটাকেও জাগিয়ে তুললো।
ক্যানিয়ল দুজনের সামনে কফির কাপটা রেখে বললো,
“খেয়ে নাও, তোমাদের ব্রেকফাস্ট।”

প্রথম জাগ্রত হওয়া লোকটা অসহায় চোখ তুলে বললো,
“শুধু এককাপ কফি? আমরা সংখ্যায় তো দুজন।”

“তাহলে কি দুই কাপ চাও? যে লোকটাকে মারতে এসেছিলে সেই লোকটা তোমাদের ঘুম থেকে উঠিয়েই এক কাপ মিষ্টি কফি উপহার দিচ্ছে, এমন ঘটনা তো বিরল পৃথিবীর বুকে।”

লোক দুটোর চেহারা নেতিয়ে পড়লো।
দরজায় কলিং বেলের শব্দ শোনা গেল এরই মধ্যে। দরজা খুলতে গেল ক্যানিয়ল। মি. হেনরি এসেছে। রাতেই খবর পেয়ে ছুটে আসতে চেয়েছিল সে। ক্যানিয়ল বলেছে সকালে আসতে।
এসেই সে লোক দুটোর গায়ে কয়েকটা চ’ড়-থা’প্পড় মারলো। ক্যানিয়ল বললো,
“থামো মি. হেনরি। আমি বাইরে বের হচ্ছি। তুমি ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করো। কিছু প্রকাশ না করলে চুরির দায়ে পুলিশে দেবে।”

“চুরি? ওদের সাথে তো অ্যাটম টু মার্ডার কেস যায়!”
বলতে বলতে মি. হেনরির চোখ কফির কাপটার উপর পড়লো হঠাৎ। সে ভ্রু কুঁচকে অবাধ বিস্ময়ে তাকালো ক্যানিয়লের দিকে।
“তুমি ওদের কফি খেতে দিয়েছো?”

ক্যানিয়ল হেসে বললো,
“দিয়েছিলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে না এটা এখন আর ওদের প্রয়োজন আছে। কারণ ইতোমধ্যে তুমি ওদের কিছু খাইয়ে দিয়েছো। এক কাজ করো, কফিটা তুমি খেয়ে নাও।”
ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ক্যানিয়ল।

________________

“সকাল সকাল আপনি রেডমন্ড এসেছেন কেন?”
সকালবেলা সাজিদকে দেখে ইরতিজা খুবই বিরক্তবোধ করলো।

“তাহলে কি এখন চলে যাব?”

“এসেছেন কেন?”

“ইচ্ছা হয়েছিল তাই।”

“মিথ্যা, আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন।”

সাজিদ অবাক হলো। ইরতিজা নিজেও যে অবাক হয়নি তা নয়। তার হঠাৎই মনে হয়েছে সাজিদ তাকে দেখতেই এসেছে। আর মুখ ফসকে সেটা বলেও ফেলেছে!

“তোমাকে দেখতে আসা তো দোষের কিছু নয়, হতেই পারে আমি তোমাকে দেখতে এসেছি।”

“আমার অবজেকশন এখানেই, আপনি কেন আমাকে দেখতে আসবেন? আমার মতো খারাপ মেয়েকে দেখে দিন শুরু হলে আপনার গোটা দিনটা খারাপ কাটবে।”

“আমার সাথে উলটোটা ঘটে। এই যে তোমাকে দেখলাম, আমার দিন এখন ভালো কাটবে।”

ইরতিজা হঠাৎ করে বললো,
“আমি আপনাকে বিয়ে করবো না, সুতরাং আমাকে দেখতে আসার কিছু নেই। আমি আপনার হবু বউ না যে আমাকে আপনি দেখতে আসবেন। আমি আপনার হবু বউ এমন কোনো প্রমাণ নেই।” ইরতিজা নিজের হাতের অনামিকা দেখিয়ে বললো,
“দেখুন, আপনার দেওয়া আংটি আমি খুলে রেখেছি। সেই কবে খুলে রেখেছি, আর পরিনি। এখন আমি আর আপনার হবু বউ নেই।”

সাজিদ স্মিত হেসে বললো,
“বোকা মেয়েরা কি এত সুন্দর হয় ইরতিজা?”

ইরতিজা অবাক হয়ে বললো,
“মানে? হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন এলো? কোত্থেকে এলো?”

সাজিদ ইরতিজার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,
“আমি কিন্তু তোমাকে দেখতে আসিনি। আমি এসেছি আমার এক কলিগ আমাকে নিমন্ত্রণ করেছে সেখানে। তবে তোমাকে দেখতে এসেছি এই কথাটা অতটাও ভুল ছিল না। পথে যদি আমাদের দেখা না হতো তাহলে তোমার বাড়িতে গিয়েই তোমাকে দেখে আসতাম।”

ক্যানিয়ল বেশ কিছুক্ষণ ধরে ইরতিজাকে লক্ষ করছে। একটা পাকিস্তানি ছেলের সাথে সেই থেকে কথা বলছে ইরতিজা। ছেলেটাকে ইরতিজার কাছ থেকে সরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল। গাড়িটা ওদের থেকে খানিক দূরে দাঁড় করানো। কথার সমাপ্তি ঘটেছে বোধহয়। ক্যানিয়ল ইরতিজাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো ছিল। পিছন থেকে এগিয়ে এলো ইরতিজার দিকে। বললো,
“হেই, ছেলেটা কে?”

ইরতিজা আচমকা শুনতে পাওয়া কণ্ঠে চমকে পিছন ফিরলো। সোজা সাপ্টা জবাব দিলো,
“আমার উডবি হাসব্যান্ড।”

ক্যানিয়ল হাসলো। তার হাসিতে প্রকাশ পেল ইরতিজা মিথ্যা বলছে এবং তা সে বিশ্বাস করেনি। কেনই বা বিশ্বাস করবে? মেয়েটা তো মিথ্যাবাদী! তার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে সেই যে মিথ্যা উডবি হাসব্যান্ডের গল্প বানিয়েছিল সেটা এখন অবধি বহাল রেখেছে! সে সাজিদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“ও কি তোমার ভাই?”

ইরতিজার চোখে-মুখে বিস্ফোরণ ঘটলো। ক্যানিয়ল সাজিদকে তার ভাই বলছে? ইরতিজা কিছু বলবে তার আগেই ক্যানিয়ল সাজিদকে ডেকে উঠলো,
“হেই…”

সাজিদ গাড়ির দরজা খোলার পর ডাক শুনতে পেয়ে থামলো। পিছনে তাকিয়ে দেখলো ইরতিজার পাশে একটা ইংরেজ ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ছেলেটা তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি ইজার বিগ ব্রো?”

প্রশ্নটা শুনে সাজিদ ভ্রুকুটি করলো। তাকালো ইরতিজার দিকে। মনে মনে কী যেন ভেবে নিলো। ক্ষণকাল বাদেই তার অধরে নিঝুম হাসির রেখাপাত ঘটলো। অতঃপর আবার ক্যানিয়লের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি ওর বিগ ব্রো এটাই কি বলেছে ও?”

ক্যানিয়লের জবাবের অপেক্ষা না করে সাজিদ ইরতিজার দিকে চেয়ে বললো,
“তখন বোকা মেয়ে কথাটায় তুমি উল্লেখ ছিলে।”
বলে হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠে বসলো সাজিদ।
ইরতিজা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। পাশ থেকে শোনা গেল ক্যানিয়লের কণ্ঠ,
“তোমরা পাকিস্টানিরা সময়-অসময়ে শুধু উর্ডু ভাষা ইউজ করো। এটা অনুচিত।”

ইরতিজা কটমট করে তাকালো ক্যানিয়লের দিকে। ক্যানিয়ল হেসে বললো,
“তোমার এত মিথ্যা বলাও অনুচিত। তোমার ভাই কষ্ট পেয়েছে মনে।”

“ও আমার ভাই নয়।”

“না হলে না, আমি কি বলছি ও তোমার ভাই? আজব!”

ক্যানিয়ল পা বাড়ালো সামনে। কতকদূর গিয়ে থেমে বললো,
“গতকাল বিকেলে আমি তোমাদের এরিয়ায় থাকা আমার বাড়িটায় গিয়েছিলাম। সিঁড়িতে কারো জুতার ছাপ দেখেছি। ওটা তুমি ছিলে তাই না?”

ইরতিজা চমকে গেল। হ্যাঁ, গিয়েছিল সে ক্যানিয়লের বাড়িতে। ক্যানিয়ল সন্ত্রাসী কি না এই ব্যাপারটা তাকে খুব ভাবাচ্ছিল, তাই ওই বাড়িতে কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পায় কি না দেখতে গিয়েছিল। না, কিছুই দেখতে পায়নি। বাইরে থেকে কীই বা দেখতে পাবে। কিছু থাকলেও থাকবে ঘরের ভিতর। কিন্তু জুতার ছাপ কীভাবে পড়েছে সিঁড়িতে? গতকাল বৃষ্টি ছিল, কোনো রকমভাবে জুতায় কাঁদা লেগে গিয়েছিল না কি? সে খুব সহজে কথাটা অস্বীকার করে গেল,
“আমি তোমার বাড়িতে যাইনি। ওটা আমি ছিলাম না।”

“লুকিয়ে-চুরিয়ে লাভ নেই। আমি শুরু থেকেই ধরতে পেরেছিলাম তোমার ব্যাপার-স্যাপার। তুমি আমার প্রেমে পড়েছো। এটা প্রকাশিত। দয়া করে আর কখনও আমার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করো না। মানুষজন দেখতে পেলে কলঙ্ক লাগবে আমার গায়ে!”

ইরতিজার ঠোঁট একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ছেলেটা তার গায়ে মিথ্যা অপবাদের দাগ লাগিয়ে দিচ্ছে!

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২০
_________________

বর্ষণমুখর দিন। আকাশের রং ধূসর। কাচের জানালায় আছড়ে পড়ছে বৃষ্টি। ক্যানিয়ল ভার্সিটিতে প্রবেশ করার পথে বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছে। তবে অতটা ভেজেনি। পোশাক বলতে গেলে শুষ্ক আছে। হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো ঝেড়ে নেওয়ার ব্যস্তক্ষণে দু চোখ গিয়ে আটক হলো ইরতিজার উপর। ইরতিজা জানালার পাশে থাকা টেবিলে একলা বসে রয়েছে। এ সময়ে ক্যান্টিনে বলতে গেলে তেমন স্টুডেন্টদের উপস্থিতি নেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকজন বসে রয়েছে। ক্যানিয়লের ওষ্ঠকোণের বাঁ দিকটা ঈষৎ চওড়া হলো। এসে ইরতিজার সামনের চেয়ারটায় বসে বললো,
“যথেষ্ট হয়েছে, বন্ধ করো এটা। লোকজন দেখছে তো।”

ইরতিজার বিস্মিত মনটা নড়েচড়ে উঠলো।
“কী দেখছে লোকজন?”

“এই যে, আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলে।”

হাতেনাতে ধরা খাওয়ার মতো অবস্থা অনুভব হলো ইরতিজার। এ কথা সত্য সে তাকিয়ে ছিল ক্যানিয়লের দিকে। কিন্তু তাই বলে কি ফ্যালফ্যাল করে? প্রতিবাদ করে উঠলো সে,
“আমি তোমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম না।”

“অবশ্যই ছিলে। আমি তোমাকে সাবধান করছি গার্ল, এমন করে তাকিয়ে থাকবে না। তুমি যেমনভাবে তাকিয়ে থাকো তাতে মানুষজন দেখলে মনে করবে আমাদের মধ্যে রিলেশনশিপ চলছে। আর এটা মনে করলে আমার প্রেস্টিজ কোথায় গিয়ে ঠেকবে নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারছো?”

ক্যানিয়ল এইমাত্র ছোটো করলো তাকে। ইরতিজা চুপচাপ ব্যাপারটা হজম করে নেওয়ার চেষ্টা করলো। যদিও কথাটা বদহজম হয়ে এর প্রতিবাদ বেরিয়ে আসতে চাইছিল তার গলা ছুটে। সে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
“পাজি!”

“কী বললে?”

“তুমি যা তোমাকে সেটাই বলা হয়েছে।”

“আমি কী? কী বলেছো তুমি?”

ইরতিজা ভেংচি কেটে চুপ রইল।
ক্যানিয়ল গভীর বিরক্ত মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
“মাঝে মাঝে তোমাদের মাতৃভাষাটা মাথায় পেইন ধরিয়ে দেয়। মানে তোমরা পাকিস্টানিরা কথায় কথায় উর্ডু ব্যবহার না করে থাকতে পারো না, তাই না? আমি জানি আমাকে খারাপ মিন করে কিছু বলেছো তুমি। সমস্যা নেই, আশা রাখি ওটা অতটাও খারাপ ছিল না। আর খারাপ থাকলেও সমস্যা নেই। আমি মোটামুটি ধরনের খারাপ বলতে গেলে।”
ক্যানিয়ল ক্যান্টিনের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
“তোমার সাথের প্লে গার্লটা কোথায়? সবসময় তো তোমার সাথেই বডিগার্ডের মতো ঘুর ঘুর করে।”

ইরতিজা রুষিত কণ্ঠে বললো,
“ওকে প্লে গার্ল বলো কেন তুমি?”

“কারণ ও প্লে গার্ল।”

“ও মোটেই প্লে গার্ল নয়।”

“অবশ্যই ও প্লে গার্ল! অনেক প্রমাণ পেয়েছি এ ব্যাপারে। প্রমাণ আমার নিজের সাথেও ঘটেছে। জানো, আগে ও আমাকে দেখলেই কেমন কেমন করে যেন তাকাতো! মূলত আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতো। কিন্তু ওর ওই চাহনিতে মনে হতো আমার পুরো শরীরে কেউ পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! ওর চাহনি সহ্য না করতে পেরে একদিন ওকে ডিরেক্ট বললাম, ‘লিসন প্লে-গার্ল, আমার দিকে আর কখনও এরকমভাবে তাকাবে না। আমি ডক্টরদের পছন্দ করি না, নইলে ডক্টর দিয়ে সার্জারি করিয়ে তোমার চেহারা হতে চোখ অদৃশ্য করে দিতাম! তোমার চেহারায় চোখের কোনো অস্তিত্ব থাকতো না আর’।”

বিভীষিকাময় কথায় ইরতিজার শরীর শিরশির করে উঠলো। অথচ অন্যদিকে ক্যানিয়লের মুখ একেবারে প্রাঞ্জল।
ভয় বিষয়টা জ্বলে উঠে আবার নিভু নিভু করছে ইরতিজার মাঝে। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সে ক্যানিয়লকে প্রশ্ন করে ফেললো,
“ক্যানিয়ল, তুমি কি আসলেই সন্ত্রাসী?”

ক্যানিয়ল প্রশ্নটা শুনে চোখ সরু করলো। বাঁকা চোখে চেয়ে বললো,
“যদি সন্ত্রাসী হই তাহলে কী করবে?”

“কিছু করবো না, শুধু জানতে চাইছি।”

ক্যানিয়লের দু চোখ সন্দিহান। বললো,
“উহুঁ, মনে হচ্ছে তুমি কিছু করবে। কী করবে?”
হঠাৎই ক্যানিয়লের চোখ-মুখ সচকিত হয়ে উঠলো। আতঙ্কিত গলায় বললো,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরার চিন্তা ভাবনা করছো না তো?”

ইরতিজার দুই ভ্রুর মধ্যস্থলে ভাঁজ পড়লো।
“কী?”

“মনে হচ্ছে তুমি এটাই করবে। আমি যদি সন্ত্রাসী হই তাহলে আমায় জড়িয়ে ধরবে তুমি। তোমার কি সন্ত্রাসী ছেলে পছন্দ?”

ইরতিজা ক্যানিয়লের কথা বিশেষ গায়ে মাখলো না। ক্যানিয়ল এসব কথা বলে মূল বিষয় ঢাকা দিতে চাচ্ছে বোধহয়। সে স্বতন্ত্র কণ্ঠে বললো,
“সেদিন ওই ছেলেগুলোকে কেন মেরেছিলে? ওদের কী অপরাধ ছিল যার কারণে এত মেরেছো ওদের?”

“এটা জানা কি এতটাই জরুরি তোমার জন্য?”

“হ্যাঁ, আমি কৌতূহল বোধ করছি।”

“ওদের কেন মেরেছি এটা সবাই জানে, তুমি জানো না এটা তোমার ব্যর্থতা। এই সামান্য ব্যাপারটা আমার বলে জানিয়ে দেওয়া সমীচীন দেখায় না।”
ক্যানিয়ল যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আর হ্যাঁ, সন্ত্রাসী ছেলেদের এত পছন্দ করো না। সন্ত্রাসীরা ভালো হয় না। ওরা ভালো হয় না বলে যে ভালো হিসেবে আমাকে ধরে নেবে এটাও করো না। কারণ আমাকে ভালো মনে হলেও আমি আসলে অতটাও ভালো নই।”

ক্যানিয়ল মৃদু হেসে চলে গেল।

ইরতিজা কিছুক্ষণ ক্যানিয়লের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। তারপর মোবাইল বের করে কল দিলো জুহির কাছে। রিং হওয়ার একটু পরই কল রিসিভ হলো। ইরতিজা বললো,
“তুমি কোথায়?”

“সেকেন্ড ফ্লোরের করিডোরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। তুমি কোথায়? ক্লাস থেকে বের হয়ে কোথায় চলে গিয়েছো?”

ইরতিজা কিন্তু ক্যান্টিনে আসার আগে বলে এসেছিল জুহিকে। কিন্তু মেয়েটার মনে নেই সেই কথা। যাক গে, যার জন্য কল দেওয়া। ইরতিজা বললো,
“ক্যানিয়ল ওই ছেলেগুলোকে কেন মেরেছিল?”

“কোন ছেলে? আর্থা…”

“হ্যাঁ, আর্থার আর ওর বন্ধুদের কেন মেরেছিল?”

“কারণ ওরা সারাহ নামের একটা মেয়েকে উত্যক্ত করেছিল। ইট’স আ বুলিং কেস! আর্থারদের মারার আগে লিওন নামের একটা ছেলেকে হ্যারেজ করার জন্য ম্যাক আর হোয়াইটকেও মেরেছিল ক্যানি। ও প্রায়শই এমন মারধর করে থাকে। এসব ব্যাপার যত এড়িয়ে চলা যায় ততই ভালো। কিন্তু তুমি হঠাৎ ক্যানিকে নিয়ে এত ভাবছো কেন? হঠাৎ ওকে নিয়ে এত আগ্রহ কেন দেখা যাচ্ছে তোমার মাঝে? তুমি ঠিক আছো?”
জুহির গলা চিন্তিত।

ইরতিজা ঢিমে গলায় উত্তর দিলো,
“আমাকে কি বেঠিক লাগছে তোমার কাছে?”

জুহি প্রত্যুত্তর দিলো না।
“রিশনকে দেখতে পাচ্ছি না। ওর খোঁজ করতে যাচ্ছি আমি। তুমি ক্লাসে এসো, দেখা হবে ক্লাসে।”

জুহি কল কেটে দেওয়ার পর ইরতিজা বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগলো। ক্যানিয়ল কি দুর্বলদের হয়ে শক্তিশালীদের সাথে লড়লো? বিষয়টা একদিক থেকে ভালো, তবুও এটা ঠিক করেনি। সে নিজে কেন এর শাস্তি দেবে? আইনি সহায়তা তো নিতে পারে। ইরতিজার মনে পড়লো ক্যানিয়ল বলেছিল সে পুলিশ আর ডক্টরদের ঘৃণা করে। পুলিশ আর ডক্টর ঘৃণা করে কেন? ভাবনার বিষয় তো! ইরতিজা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো ক্যান্টিন থেকে। ক্যানিয়লকে দেখতে পেল। বেশিদূর চলে যায়নি।
ইরতিজা দৌড়ে এসে ক্যানিয়লের পাশে দাঁড়াতেই থেমে গেল ক্যানিয়ল। চেয়ে দেখলো ইরতিজা হাঁপাচ্ছে। এবং তাকে প্রশ্ন করলো,
“তুমি পুলিশ এবং ডক্টর ঘৃণা করো কেন?”

ক্যানিয়ল বিস্ময়পূর্ণ অক্ষিতে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে সে কি ভাবছে ভাবনাটা একান্ত তার শরণাপন্ন। কালো হিজাবে বেষ্টিত শ্যামবরণ কোমল মুখটিতে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। অতঃপর ইরতিজার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“তুমি আমাকে পছন্দ করো কেন?”

হৃদয় দোর খুলে গেল ইরতিজার। খোলা দোর দিয়ে হুড়মুড় করে পাগলা শীতল হাওয়া প্রবেশ করে হৃদয় উপকূলে শৈত্যপ্রবাহ বইয়ে দিলো। হৃদয়ের সকল অনুভূতি, কার্যকলাপ শীতল রূপ নিলো, জমে গেল বরফের মতো। স্থির চিত্ত, দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে রইল ক্যানিয়লের মুখপানে।
ক্যানিয়ল বললো,
“পরশু রাতে আমার বাড়িতে দুজন আততায়ী প্রবেশ করেছিল! তারা যখন আমায় আক্রমণ করতে চেয়েছিল তখন আমি খানিক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ঘাবড়ানোর পরিমাণটা কম ছিল। তখন যতটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি এখন ঘাবড়ে যাচ্ছি আমি! হ্যাঁ, হঠাৎই তোমার সামনে আমি খুব ঘাবড়ে যাচ্ছি পাকিস্টানি গার্ল!”

ইরতিজা একই রকম তাকিয়ে রইল। ক্যানিয়ল অলিন্দের কর্ণারে এগিয়ে এসে বৃষ্টির পানি ধরলো হাত বাড়িয়ে। পানিটুকু ছুঁড়ে মারলো ইরতিজার মুখে।
ঠান্ডা পানির ঝাপটায় ইরতিজা কেঁপে উঠলো। কেটে গেল স্তব্ধতাও।

“বৃষ্টি পছন্দ করো ইজা?” ক্যানিয়ল প্রশ্ন করলো।

ইরতিজা দুই পাশে মাথা নাড়লো। যার অর্থ ‘না’।

“কেন পছন্দ করো না?”

“অনেক অপছন্দের কারণ থাকে না।”

ইরতিজা ঘুরে পা বাড়ালে ক্যানিয়ল বলে উঠলো,
“তাহলে তো অনেক পছন্দেরও কারণ থাকে না। আমাকে পছন্দ করো এটাও কি কারণহীন? না কি অনেক বড়ো একটা কারণ আছে?”

ইরতিজা ক্যানিয়লের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ক্যানিয়লের কথা শেষ হতেই দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল। তার দিনগুলো ইদানিং স্বাভাবিকতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না। কেমন অস্বাভাবিক যায়!

_________________

আন্দ্রেজ ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে মার্টাকে পছন্দ করে, ব্যাপারটা আজ জানতে পারলো ইরতিজা। রিশনের কাছে শুনেছিল জুহি পছন্দ করে আন্দ্রেজকে, আর আজ শুনলো আন্দ্রেজ পছন্দ করে মার্টাকে। ইরতিজা জুহির জন্য খারাপ লাগা অনুভব করলো। সে আসলেই জুহির চোখে আন্দ্রেজের জন্য প্রকৃত অনুভূতি লক্ষ করেছে।
আন্দ্রেজ মার্টাকে পছন্দ করে এ ব্যাপারটা আন্দ্রেজই বলেছে। ইরতিজা তখন একা ছিল, কথায় কথায় এ ব্যাপারটাও শেয়ার করেছে আন্দ্রেজ। সব শোনার পর ইরতিজা বললো,
“তো তুমি মার্টাকে এ ব্যাপারে বলেছো কিছু?”

“না। বলবো না এ ব্যাপারে কিছু। এটা বলার মতোও না।”
আন্দ্রেজ নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে ভারাক্রান্ত মনে বললো,
“যখন থেকে আমার পায়ের এই অবস্থা হলো তখন থেকেই নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ অনুভব হয়েছে আমার! তুচ্ছ মানুষ সাধারণত বেশি তাচ্ছিল্যের শিকার হয়। আমার পছন্দটা অন্যরকম থাকবে, অপ্রকাশিত! অপ্রকাশিত অনুভূতি তিক্ত নয়। বরং মিষ্টি একটা ব্যাপার আছে এর মাঝে। এটা উপলব্ধি করতে ভালো লাগে। যারা নিজের অনুভূতি অপ্রকাশিত রাখে তারা বুঝতে পারে এর মিষ্টতা!”

ইরতিজার একবার বলতে ইচ্ছা হলো জুহির কথা, কিন্তু বলতে পারল না। কেমন দমবন্ধ লাগছিল এমন মুহূর্তে। ঠিক সময়ে সাজিদের কলটা এসে তাকে দমবন্ধ অবস্থা থেকে টেনে তুললো। সে আন্দ্রেজকে রেখে চলে এলো ক্যাম্পাসের এক প্রান্তে। এখানে চেরি গাছ আছে। এখন এ গাছে ফুল নেই। বসন্ত এলেই ফুলে ফুলে ভরে যাবে সব গাছ। একটা চেরি গাছের নিচে দাঁড়ালো ইরতিজা।
কল রিসিভ করে শুনতে পেল সাজিদের ব্যস্ত কণ্ঠ,
“তোমার সাথে পরে কথা হবে ইরতিজা, গুরুত্বপূর্ণ ডাক পড়েছে, যেতে হবে।”
সাজিদ কল কেটে দিলো।

ইরতিজা অবাক। সাজিদ কী করলো এইমাত্র? কল দিলো, আবার কীসব বলে কল কেটেও দিলো? এই মানুষটা এমন কেন? ক্লান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো ইরতিজা। এই লোকটা যদি সত্যিই তার হাসব্যান্ড হতো তাহলে কী হতো? সারাক্ষণ বোধহয় ক্লান্তি, হতাশা আর বিরক্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করেই জীবন যেত!

কয়েক মিনিট পার হওয়ার পর ফোনটা আবার বেজে উঠলো। মা কল দিয়েছে।

“তুমি কি এখন বাসায় আসতে পারবে?”

“এখন? বাসায়? কেন?”

“এলেই তো দেখতে পাবে, প্রশ্ন করছো কেন?”

“এমনভাবে যখন বলছো নিশ্চয়ই আর্জেন্ট?”

“হুম, একজন তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।”

থমকে গেল ইরতিজা। সর্বপ্রথম জোনাসের নামটা মনে পড়লো তার। ভাঁজ পড়লো কপালে। জোনাস এসেছে? ছেলেটা আবার কেন এলো? তাও আবার একেবারে বাড়িতে!

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২১
_________________

আততায়ী লোক দুটো সম্পূর্ণ একদিন বন্দি অবস্থায় ছিল এন্ডারসন হাউজের বেজমেন্টে। আজ সকালে ছাড়া পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষমেশ সে চিন্তা নাকচ করেছে ক্যানিয়ল। লোক দুটোকে মারধর করে আটকে রেখেও বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। কারণ, তারা তেমন কিছুই জানে না। লিডারের কথায় তারা ক্যানিয়লকে আক্রমণ করে ওর মনে ভয় ঢোকানোর কাজে নিযুক্ত হয়েছিল। তারা কেবলই হুকুম পালন করার জন্য এসেছিল। কার নির্দেশে তাদের গ্যাং এই কাজ করছে সে ব্যাপারে কিছুই জানে না তারা। একজন আততায়ীর ফোনে তাদের লিডারের কল এসেছিল। ক্যানিয়ল কল ধরে অনেকক্ষণ যাবৎ বকাবকি করেছে লোকটাকে। অতঃপর এক সময় ক্লান্ত হয়ে গিয়ে শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে বলেছে,
“দেখো, আমাকে বলে দাও, কার হয়ে এমন করছো? ট্রাস্ট করো, তোমরা কেউই বিপদে পড়বে না। তোমাদের সাথে কিছুই করবো না আমি। বরং বলে দিলে সুরক্ষিত থাকবে।”

ওপাশ থেকে কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“বলে দিলে আমাদের কাস্টমারের সাথে আমাদের প্রতারণা করা হবে। আর এমন হলে এটা আমাদের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন করবে। ভালো হয় যদি তুমি আমাদের কথা অনুযায়ী কাজ করো। তুমি তোমার ড্যাডকে…”

লোকটার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিরক্ত হয়ে লাইন কেটে দেয় ক্যানিয়ল। মি. হেনরির দিকে তাকিয়ে বলে,
“এরা কেমন গ্যাং মি. হেনরি? এত বকবক করে কেন এরা? এদেরকে তো আমার ছ‍্যাঁচড়া গ্যাং বলে মনে হচ্ছে!”

মি. হেনরি কিছু না বলে বিশেষ কিছু চিন্তা করতে থাকে। এক সময় বলে,
“আমার মিসেস ইয়াদা আর মিসেস সালেমকে সন্দেহ হচ্ছে ক্যানি!”

ক্যানিয়ল সচকিত চোখে তাকায়,
“এই দুইজনকেই কেন সন্দেহ হচ্ছে তোমার?”

“কারণ ওরা বলেছিল ওদের বস বোধহয় কোনো মহিলার সাথেই এসব ব্যাপার নিয়ে কথা বলছিল। যদিও এটা অতটা শিওর নয় ওরা।”

ক্যানিয়ল চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল।
“তো এটা তুমি আগে বলোনি কেন আমাকে?”

“তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে যেয়ো না। আমরা শিওর নই। আরও অপেক্ষা করে দেখতে হবে আমাদের।”

“তুমি অপেক্ষা করো, আর ভাবো। আমি যাচ্ছি।”

ক্যানিয়ল ওভার জ্যাকেট পরতে পরতে দরজার দিকে এগোলো।

“কোথায় যাচ্ছ তুমি?” প্রশ্ন করলো মি. হেনরি।

“কিছু কেনাকাটা করার আছে আমার।” বলতে বলতে দরজার কাছে দাঁড়ালো সে। হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বললো,
“ওহ, মি. হেনরি!”

মি. হেনরি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। ক্যানিয়ল খানিক ইতস্তত কণ্ঠে বললো,
“তুমি কি আমাকে ভালো কোনো উর্ডু ভাষা শেখার বই সংগ্রহ করে দিতে পারবে? বা সহজে উর্ডু শেখা যায় এমন কোনো অ্যাপস ডাউনলোড করতে পারবে?”

মি. হেনরি ভ্রু কুঁচকে বললো,
“হঠাৎ তোমার উর্দু শেখার এত তাগিদ কেন? এমন তো না যে নেক্সট ট্রিপে আমাদের পাকিস্টান যাওয়ার কোনো প্ল্যান আছে। উর্দু শিখে কী করবে?”

“মানুষজন আমাকে উর্ডুতে গালাগালি করে! গালির মিনিংটা জানতে আগ্রহী আমি।”

মি. হেনরির কুঁচকানো ভ্রু অধিক কুঁচকে গেল,
“উর্দুতে গালাগালি করে তোমাকে? কারা?”

ক্যানিয়ল ঠোঁট টেনে নিভৃত হেসে বললো,
“একটা ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে!”

“ওই মেয়েটা?”

ক্যানিয়ল মাথা নেড়ে বললো,
“হু, ছাড়ো ওসব। আমি নিজেই উর্ডুর ব্যবস্থা করে ফেলবো।”

ক্যানিয়ল যেতে নিলেই মি. হেনরি বললো,
“কী গালি দিয়েছে তোমাকে? আমাকে বলো। আমি তো কিছু কিছু উর্দু ভাষা পারি। দেখি এর ইংলিশ মিনিংটা জানা আছে কি না আমার।”

ক্যানিয়ল মনে করার চেষ্টা করে বললো,
“পা…পাপ্পা…নো নো…পা…পাজাইই। ইয়াহ পাজাইইই।”

“কী?”

“এরকমই ছিল গালিটা।”

মি. হেনরি চিন্তায় পড়ে গেল। ‘পাজাইইই’ জিনিসটা কী হতে পারে?
ক্যানিয়ল মি. হেনরির মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়ে ঢিমে গলায় বললো,
“ঠিক আছে, তুমি ভাবতে থাকো। যাচ্ছি আমি।”

ক্যানিয়ল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা শপে এসেছে। আজব হলেও সত্যি যে সে হিজাব কিনতে এসেছে। তাও এমন একজনের জন্য হিজাব কিনতে এসেছে যা দুর্ভাবনীয়! যে মেয়েটাকে ভালো করে চেনে না, জানে না, সেই মেয়েটার জন্য হিজাব কিনতে এসেছে সে! হঠাৎ কী হলো তার? ভাবছে সেই সকাল থেকেই। কিঞ্চিৎ পাগলামিতে ধরেছে বোধহয়!

_________________

যতটা ব্যস্ত হয়ে বাসায় ছুটে এসেছিল ইরতিজা, আসার পর ততটাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল জোনাস এসেছে, কিন্তু এসেছিল অর্টন। অর্টনকে দেখে যেন কয়েক মুহূর্ত পাথর হয়ে গিয়েছিল সে। এই ছেলেটা এতকিছুর পরও তার সাথে দেখা করতে আসতে পারে ধারণা ছিল না।
অর্টন সিয়াটল এসেছিল একটা কাজে। যাওয়ার আগে ভাবলো সিয়াটল যখন এসে গেছে ইরতিজার সাথে একবার দেখা করে তারপরই নিউ ইয়র্ক ফিরুক। ইরতিজার সাথে দেখা করে গতকাল বিকেলের ফ্লাইটেই চলে গিয়েছে।
অর্টনের সাথে ইরতিজার কথোপকথন ছিল স্বাভাবিক। যতটা সম্ভব স্বাভাবিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করছিল। তাও কোথায় যেন একটা অস্বস্তির কাঁটা রয়েই গিয়েছিল। বাবা তখন বাসায় ছিল না, কেবল মা একা ছিল।
বাবা বাসায় ফেরার পর বললেন,
“অর্টন এসেছিল বাসায়?”

ইরতিজা খানিক জড়তা নিয়ে বললো,
“হুম।”

“কী বলে গেছে?”

“তেমন কিছুই বলেনি। টুকটাক কথাবার্তা শুধু। মানে কুশল বিনিময় আরকি।”

“অস্বস্তি হচ্ছিল তোমার ওর সাথে কথা বলতে?”

“হচ্ছিল একটুখানি।”

“ও তোমার সাথে দেখা করতে আসায় তোমার কি আনন্দবোধ হয়েছিল?”

ইরতিজা বাবার প্রতিটা প্রশ্নেই চমকাচ্ছে। বাবা এমন করে জেরা করছে কেন তাকে? তাও সে শান্ত কণ্ঠে সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল,
“না।”

আজাদ চৌধুরী একটু হেসে বললেন,
“কাল ছুটির দিন। দুপুরে সাজিদ আসবে। নিমন্ত্রণ করেছি ওকে।”

ইরতিজা অযথাই চমকে উঠলো,
“কেন?”

“নিমন্ত্রণ কেন করে মানুষ?”

“জানি না।” বোকার মতোই কথাটা বলে ফেললো।

জানালা দিয়ে মি. ফলক্রফটের বাসার সামনের আপেল গাছটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এসব ভাবছিল ইরতিজা। সকালের সোনালি রোদ আদুরে পরশ বুলাচ্ছে লাল আপেলগুলোর উপর। শুনেছে মেরিমুর পার্কেও না কি আপেল গাছ আছে। থোকায় থোকায় আপেল ধরে তাতে। অতি শ্রীঘই একবার পার্কে গিয়ে সেই আপেল খেয়ে আসতে চায় সে।
বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে এনে জানালার কাচ বন্ধ করে দিলো ইরতিজা। বাড়িতে রান্নাবান্না চলছে। খাবারের লোভনীয় ঘ্রাণ ঘুরঘুর করছে বাড়ির এক কোণা থেকে আরেক কোণা। একটু পর…হয়তোবা এখনই এসে পড়বে সাজিদ।

সাজিদ এসে গেল একটু পরই। একা আসেনি, সাথে তার এক বন্ধুও এসেছে। বন্ধুর নাম আরমান। ইন্ডিয়ায় বাড়ি। তার সাথে ইরতিজার এই প্রথম দেখা। সে ইরতিজাকে দেখেই সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম ভাবি।”

ভাবি সম্বোধনে তটস্থ অনুভব করলো ইরতিজা। তাকালো সাজিদের দিকে। সাজিদের চেহারা প্রাঞ্জল, সে স্বাভাবিক। কিন্তু ইরতিজার কাছে ভাবি ডাকটা মোটেই স্বাভাবিক লাগেনি। সাজিদের সাথে কি তার বিয়ে হয়ে গেছে যে লোকটা তাকে ভাবি ডাকবে? সুন্দর করে আপুই তো ডাকতে পারতো। যাই হোক, ইরতিজা এ নিয়ে কিছু বললো না, মুখে একটু হাসি টেনে শুধু সালামের উত্তর দিলো।

খাওয়া-দাওয়ার পালা সারা হলো সর্বপ্রথম। তারপর খোশগল্পের আসর বসলো। খোশগল্পের কিছুক্ষণ পর সাজিদ ইরতিজাকে বাড়ির বাইরে ডেকে নিয়ে গেল।

“এখানে এসেছি কেন আমরা?” ইরতিজার প্রশ্ন।

সাজিদ একটা গিফট বক্স বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“নেবে? নাকি নেবে না?”

“কী আছে এর ভিতর?”

“ছোটো একটা নেকলেস।”

“আমাকে কেন দিচ্ছেন?”

“বর হিসাবে হবু বউকে কিছু উপহার দিতেই পারি।”

“কিন্তু আমি নেবো না এটা। যে কেউ কিছু একটা দিলেই সেটা আমি গ্রহণ করতে পারি না।”

সাজিদ স্মিত হাসলো। তা দেখে ইরতিজা বললো,
“আমি কি হাসার কথা বলেছি?”

“হয়তো বলোনি, আবার বলেছো।”

ইরতিজা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললো,
“স্যরি! আমি নিতে পারলাম না আপনার গিফটটা। আপনার এইমাত্র বলা কথাটা আপনার গিফট নেওয়ার আগ্রহ পুরোপুরি কমিয়ে দিয়েছে।”

ইরতিজা বাসায় প্রবেশের জন্য পা বাড়ালো। কয়েক পা হেঁটে আসা মাত্রই সাজিদ পিছন থেকে এসে বক্সের ভিতর থাকা নেকলেসটা পরিয়ে দিলো ওর গলায়। থেমে গেল ইরতিজা। সাজিদের এমন আচরণ স্তব্ধীভূত করে দিলো তাকে। নেকলেস পরানো হলে সাজিদ সামনে এসে বললো,
“আপনি মোটেও ভালো মেয়ে নন ইরতিজা।”

“আপনি আবারও আমাকে ‘আপনি’ করে বলছেন। এই তুমি, এই আপনি! দুটো সম্বোধনের জগাখিচুড়ি পাকাতে চান আপনি? যা বলার একটা বলে সম্মোধন করেন।”

“এই মুহূর্তে আপনাকে আপনি ছাড়া অন্য কিছু সম্বোধন করতে পারছি না। আচ্ছা আপনি বলুন, কোন সম্বোধনটা কম আপন মনে হয়? যেটাতে কম আপন মনে হয় সেটা বলেই ডাকবো আপনাকে।”

ইরতিজার খুব রাগ লাগছে হঠাৎ করে। বললো,
“তুই ডাকটা আমার সবচেয়ে বেশি আপন লাগে।”

“তার মানে ‘আপনি’, ‘তুমি’ দুটোই আমার জন্য উন্মুক্ত। তাহলে আমি আপাতত ‘আপনি’তেই থাকছি। আপনার মনে আছে, যেদিন আপনারা সিয়াটলের ফ্লাইট ধরেছিলেন সেদিন সকালে আপনার ফ্রেন্ড জোনাস এসেছিল আপনাদের বাড়িতে?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে।”

“ও আপনাকে একটা গিফট দিয়েছিল। আমার খুব আগ্রহ হয়েছিল গিফটটা নিয়ে। জানার ইচ্ছা হলেও আমি কখনও জিজ্ঞেস করিনি ওই গিফট বক্সে কী গিফট ছিল। আজ খুব করে জানতে ইচ্ছা করছে, এবং আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, আপনার ওই ফ্রেন্ড কী গিফট দিয়েছিল আপনাকে?”

“ওই গিফট বক্সটা ফাঁকা ছিল, কোনো গিফট ছিল না ওটার ভিতর।”

সাজিদ একটু ধাক্কা খেলো। অবিশ্বাস্য সুরে বললো,
“কোনো গিফট ছিল না?”

“না। ও আমাকে ঘৃণা করে। বলতে পারেন খালি গিফট বক্স দিয়ে ও আমাকে ঘৃণা করে এটারই একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।”
কথাটা সাজিদের কাছে প্রকাশ করতে গিয়ে হঠাৎ একটু কষ্ট অনুভব করলো ইরতিজা।

“কিন্তু আমার মনে হয় না আপনার ফ্রেন্ড আপনাকে ঘৃণা করে।”

“শুনুন, ও আমার ফ্রেন্ড নয়। অনেক আগেই আমাদের ফ্রেন্ডশিপের ইতি ঘটে গেছে! বলতে পারেন আমরা এখন একে অপরের শত্রু।”

“কখনো কখনো কিছু শত্রুরা মিত্রর থেকেও অধিক আপন হয়।”

“কী?” সাজিদ অস্পষ্ট গলায় বলার কারণে ঠিক ভাবে শুনতে পেল না ইরতিজা।

“আপনি অর্টনকে পছন্দ করেন?”

সাজিদ হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন করায় বিস্মিত হলো ইরতিজা। বললো,
“কী যা-তা বলছেন!”

“পছন্দ করেন না অর্টনকে? তাহলে কি জোনাসকে পছন্দ করেন?”

ইরতিজা খুব খ্যাপা অনুভব করছে। সাজিদ হঠাৎ এসব প্রশ্ন করে কী প্রমাণ করতে চাইছে? বললো,
“এসব কী আজেবাজে প্রশ্ন করছেন আপনি?”

“আজেবাজে প্রশ্ন হলেও আশা রাখছি এর উত্তরটা দেবেন আপনি। ভালোবাসেন জোনাসকে?”

ইরতিজা উত্তর দিলো না। হঠাৎ এত অস্থির, রাগ কেন অনুভব করছে নিজেই বুঝতে পারছে না।
সাজিদ ইরতিজাকে নিশ্চুপ দেখে বললো,
“উত্তর দেবেন না? তাহলে কি আমি ধরে নেবো আপনি আসলেই জোনাসকে…”

“অবশ্যই না…” সাজিদের কথার মাঝেই প্রায় উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলো ইরতিজা।
“অবশ্যই আমি জোনাসকে ভালোবাসি না। আগেও কখনও ভালোবাসিনি, আর ভবিষ্যতেও ওকে ভালোবাসার কোনো সম্ভাবনা নেই। যার কারণে আমার জীবনে এত কিছু ঘটে গেছে, আমার এনগেজমেন্ট পর্যন্ত আমার চোখের পলকে হয়ে গেছে, তাকে অবশ্যই আমি ভালোবাসতে পারি না। ও আমার কাছে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি! অযথাই ওকে আমার প্রেমিক ভেবে ভুল করবেন না।”

সাজিদ কিয়ৎক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে রইল ইরতিজার দিকে। ইরতিজার দৃপ্তকণ্ঠে বলা দৃঢ়তা জড়িত কথাগুলো শুনতে ভালো লেগেছে তার। তবুও কোথাও একটা সংশয় বহাল রয়ে যাচ্ছে। বললো,
“আপনি প্রতিটা কথা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, কিন্তু আজবভাবে আপনার দৃঢ়তা জড়িত কথাগুলোও আমার কাছে দুর্বল মনে হচ্ছে। এটা কেবল আমার ভ্রম কি না বুঝতে পারছি না!”
সাজিদ সরল হাসির মাধ্যমে ব্যাপারটা ঢাকা দিয়ে বললো,
“আপনি জোনাসকে ঘৃণা করলেও আমি কিন্তু ওকে খুব পছন্দ করি। আমার কাছ থেকে ওর একটা থ্যাংকস প্রাপ্য।”

ইরতিজা চোখ কপালে তুলে বললো,
“কেন?”

সাজিদ এবার একটু অন্য রকম হেসে বললো,
“কারণ আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পিছনে ওর বিরাট একটা অবদান আছে। ওর ক্যামেরাবন্দি করা ছবির কারণেই তো এতকিছু হলো।”
সাজিদ হাসতে হাসতে বাসায় প্রবেশের জন্য এগোতে লাগলো। লন থেকে সিঁড়িতে কেবল এক পা রাখতেই ইরতিজা বললো,
“আপনি কি ভাবছেন আপনার সাথেই আমার বিয়ে হবে? আমি আপনাকে কখনোই বিয়ে করবো না। সত্যিই বিয়ে করবো না আপনাকে। এ বিয়েতে আমার কোনো মত নেই!”

সাজিদ তাকালো। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
“আমাকে বিয়ে করবেন না, অর্টনকেও না কি পছন্দ করেন না, আবার বললেন জোনাসকেও ঘৃণা করেন! তাহলে আপনি ঠিক কাকে বিয়ে করবেন? উমমম…সেদিন যার কাছে আমাকে ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন তাকে বিয়ে করবেন না কি?”
কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দিলো সাজিদ। কৌতুকপূর্ণ হাসি হাসতে হাসতেই ঢুকে গেল ঘরের অভ্যন্তরে।

কিন্তু তার ওই কৌতুকপূর্ণ কথা ইরতিজাকে স্তব্ধীকৃত নির্বাক করে দিলো। সাজিদ এইমাত্র ক্যানিয়লের কথা বললো?

(চলবে)