উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
191

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৬
_________________

রিশন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পর লক্ষ করলো ইরতিজা তার সাথে নেই। তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে গেল সে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো ইরতিজা উপরে সিঁড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে ডাকলো,
“টিজা, তুমি এখনও ওখানে কেন? এসো তাড়াতাড়ি।”

রিশনের উচ্চ কণ্ঠস্বর প্রবেশ করতে পারলো না ইরতিজার কর্ণকুহরে। এই মুহূর্তে সে হতবিহ্বল। অদ্ভুত এক দমবন্ধকর অনুভূতি তার হৃদয় ঠেসে ধরেছে। ক্যানিয়ল নিজের মাথার টুপি তার মাথায় পরিয়ে দিতেই এমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো তার। কেমন অদ্ভুত, কেন অদ্ভুত, এই প্রশ্নগুলোর কোনো ব্যাখ্যা আপাতত তার মনঃক্ষেত্রে জমা নেই। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ইরতিজা। রিশনের কথা তার অন্যমনস্ক চেতনায় প্রভাব ফেলতে না পারলেও, ক্যানিয়লের কথা মুহূর্তে তাকে জাগতিক হুঁশে ফিরিয়ে আনলো,
“রিশন তোমার জন্য সঠিক নয় ইজা!”

ক্যানিয়লের কথাটায় গরমিল আছে, খুব বড়ো গরমিল আছে। গরমিল কথাটার সহজ ধারা ধরতে সক্ষম না হয়ে ইরতিজা বললো,
“মানে?”

“মানে হলো-তুমি হচ্ছো আধা পাগল, আর রিশন হচ্ছে পুরো পাগল। আধা পাগল আর পুরো পাগলের মধ্যে প্রেমটা সুন্দর না হয়ে বরং আরও বাজে দেখায়। হয় তুমি পুরো পাগল হও, না হয় রিশনকে পুরো পাগল থেকে আধা পাগল বানাও। তারপর ডেট করবে দুজন। আর কখনও যেন না দেখি তোমরা দুজন এক ক্যাটাগরির না হয়ে ডেটে বের হয়েছো। যদি দেখি তাহলে দুজনকেই এই উইন্টারের মাঝে লেকের ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখবো।”

ইরতিজার মুখ ঈষৎ হা হয়ে গেল। স্ফীত চোখে চেয়ে বললো,
“না জেনে কথা বলা কি তোমার অভ্যাস? রিশন আমার ভাই। ও আমার আপন ভাইয়ের মতো।”

ক্যানিয়ল সূক্ষ্ম চোখে বললো,
“ভাই?”
প্রশ্নটা করার পর হঠাৎই তার অধরে অবজ্ঞাত হাসি লেগে গেল। বললো,
“তুমি কোন ধরনের প্রাণী সেটা ভাবছি!”

ইরতিজা ভ্রু কুঞ্চন করে বললো,
“হোয়াট ডু ইউ মিন?”

“তোমার মতো মিথ্যাবাদী মেয়ে এই প্রথম দেখলাম। প্রেমিককে বিনা দ্বিধায় ভাই বললে। সাংঘাতিক তো তুমি! যাই হোক, ডেট করতে আর কখনও এই ট্রি হাউজে আসবে না।”

“তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো?”
ইরতিজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও ভারি বিরক্ত কণ্ঠে বললো রিশন। উপরের কথোপকথন সে শুনতে পাচ্ছে না। না হলে ক্যানিয়লের সাথে হয়তো আবারও বিশাল আকারের তর্ক-বিতর্ক শুরু হতো তার।
ইরতিজা হঠাৎ পিছন ঘুরে রিশনের দিকে তাকিয়েই জোর গলায় বলতে শুরু করলো,
“তুমি আমার ভাই রিশন। তুমি আমার আপন ভাইয়ের মতো। কেউ যাচ্ছেতাই বললেই তুমি অন্য কিছু হয়ে যাবে না!”

দ্রুততার সঙ্গে কথাগুলো বলে দ্রুতপদে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো ইরতিজা। বিস্ময়বিমূঢ় রিশনের এক হাত ধরে টেনে নিয়ে দ্রুতগামী পা ফেলে চলে গেল।

হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ক্যানিয়ল আর সামুরা। সামুরা এতক্ষণে একটা কথাও বলেনি। কখন কী বলবে বুঝে উঠতে পারেনি বিধায় চুপ ছিল একদম। এখনও তার মুখে কোনো কথা ফুঁটলো না।

ক্যানিয়ল বললো,
“আজকাল যেখানে-সেখানে পাগলি ঘুরে বেড়াচ্ছে সামুরা, সাবধানে থাকবে।”
এরপর একটু নীরব থেকে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলো সে,
“ক্রেজি গার্ল!”

___________________

সকালে ক্যানিয়লের ঘুম ভাঙলো হুমকির কল পেয়ে। আজ অনেকদিন হলো সে এমন হুমকির কল পাচ্ছে। হুমকিটা এমন–যদি ক্যানিয়ল বাবার কোম্পানিটা নিজের নামে করে নেয় তাহলে এর জন্য ক্যানিয়লকে অনেক ভুগতে হবে। জীবন সংশয়ে পড়বে তার। কলার তাকে কোম্পানিটা গ্রহণ না করতে সাবধান করছে। এরপরও যদি ক্যানিয়ল সেটা গ্রহণ করে তাহলে তারা ধীরে ধীরে ক্যানিয়লকে মৃত্যুর স্বাদ উপলব্ধি করাবে। মূল কথা হলো তারা ক্যানিয়লকে কোম্পানিটা নিজের নামে না করার জন্য হুমকি দিচ্ছে। হঠাৎ এমন শত্রু কোত্থেকে জন্ম নিলো জানে না ক্যানিয়ল। মাঝে মধ্যে তাকে ফলো করে লোকগুলো। সে ধারণা করেছে মূলত একটা গ্যাং তাকে ফোন করে এমন সব হুমকি দিচ্ছে এবং তার উপর নজর রাখছে। কিন্তু তাদের দিয়ে কাজটা কে করাচ্ছে এটা হচ্ছে ভাবনার বিষয়।
যে লোকটার কারণে ইরতিজার সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল সেই লোকটাও ছিল ওই গ্যাংয়েরই একজন সদস্য। ইরতিজাকেও তো সে প্রথমে ওই গ্যাংয়ের সদস্য ভেবে ভুল করেছিল। বিষয়টা মাঝে মাঝে খুব ভাবায় তাকে। সে চায় না বাবার কোনো কোম্পানির দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ুক। কিন্তু বাবা নিজের একটা কোম্পানি যে তার নামে করে দেবে এটা নিশ্চিত। আর সেটা ছোটো ধরনের কোম্পানি না হয়ে বড়ো ধরনের কোম্পানি হবে এটাও অজানা নয়। কে চাচ্ছে না সে ওই কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করুক? এটা কি তার ভাইদের মধ্যে কেউ? হতে পারে!
ভাইয়েরা এমনিতেও তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। সেখানে বিজনেস ক্ষেত্রে তার কোনো অবদান না থাকলেও ভালো কোম্পানির একটা যদি সে পেয়ে যায় তাহলে তাদের অবজেকশন তো থাকবেই। কিন্তু কে করাচ্ছে কাজটা?
বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাথায় যন্ত্রণা ধরে গেল ক্যানিয়লের। রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে এলো।
কিচেনে উপস্থিত ছিলেন মুহাম্মদ ইসহাকের দ্বিতীয় স্ত্রী, মানে ক্যানিয়লের দ্বিতীয় সৎ মা মিসেস ইয়াদা। ইয়াদার পরনে লম্বা গাউন। মাথায় হিজাব। সে বেশিরভাগ সময় মাথায় হিজাব পরে থাকে। স্নিগ্ধ সৌন্দর্য পরিলক্ষিত হয় তার মাঝে। তবে তার বাইরেটা সুন্দর হলেও, তার ভিতরটাকে অসুন্দর বলে মনে হয় ক্যানিয়লের।
মিসেস ইয়াদা ক্যানিয়লকে দেখা মাত্রই মুখ বিকৃত করে ফেললেন।
ক্যানিয়লের প্রতি তার গভীর বিরক্ত ছাপিয়ে থাকে সব সময়। এই ব্যাপারটা ছোটো বেলা থেকে খেয়াল করে আসছে ক্যানিয়ল। এখন আর এসবে তার কিছু যায় আসে না। শুধু মাঝে মাঝে হৃদয়ভার হয়ে পরিতাপের নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। ক্যানিয়ল একটা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল নিয়ে কিচেন থেকে বের হওয়ার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে টেবিলে থাকা মিসেস ইয়াদার ধুয়ে রাখা আপেলগুলো ফেলে দিলো ফ্লোরে।
ইয়াদা পিছন থেকে ক্ষুব্ধ বাঘের মতো হুংকার করে উঠলো,
“এটা তুমি কী করেছো ছেলে?”

“আমি স্যরি মাদার ইয়াদা! এটা আমি ইচ্ছাকৃতভাবে করিনি, ভুলে হয়েছে। মানুষ ভুল করবে এটা কেউ ঠেকাতে পারবে না।”

ক্যানিয়ল বের হয়ে গেল। একেবারে বাড়ির বাইরে এসে থামলো সে। আজকের রোদ, প্রকৃতি সব কিছু বেশ মিষ্টি লাগছে। মনোহারিত্ব জড়ানো ঠেকছে! ইচ্ছা করছে এই প্রকৃতিতে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে।
কিন্তু নিশ্চিন্ত মন পাচ্ছে না, চিন্তাটা আলপিনের মতো আঘাত করছে অন্তঃকরণে। কে তাকে হুমকি দিচ্ছে সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় সে। পরিবারেরই কেউ হবে! হুমকি দেওয়ার বিষয়টা ড্যাডকে জানায়নি। ড্যাড সব শুনে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। যা ক্যানিয়ল একদমই চায় না। পুলিশের প্রতি তার ক্ষোভ অনেক পুরোনো। সতেরো বছর বয়সে এই ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল।

ক্যানিয়ল দুই চুমুক পানীয় পান করে বোতলটা ছুঁড়ে ফেললো ঘাসের মাঝে। আকাশের অবিন্যস্ত নীলে তাকিয়ে অবসন্ন নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তায় তাকাতেই খুব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখলো। একটা মেয়ে আর একটা ছেলে সাইকেলে যাচ্ছে। মেয়েটা বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে আছে ছেলেটাকে। সম্ভবত এরা প্রেমিক-প্রেমিকা। ক্যানিয়লের মিরান্ডাকে মনে পড়লো। মিরান্ডা একদিন সাইকেলে ঘুরতে চেয়েছিল তার সাথে। কিন্তু সে মিরান্ডাকে নিয়ে যায়নি সাইকেল ভ্রমণে। ব্যস্ততা না থাকলেও ব্যস্ততার বাহানা দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিল। মিরান্ডা এখন দেশে নেই। গতকালই ইংল্যান্ড চলে গিয়েছে। ক্যানিয়লের মন খারাপ হলো। কেন মিরান্ডাকে ভালোবাসতে পারে না সে? তার মনে মিরান্ডার জন্য সুন্দর একটা অনুভূতি কেন জন্ম নেয় না? মিরান্ডার মতো একটা মেয়েকে অবশ্যই ভালোবাসা উচিত তার। কিন্তু মিরান্ডার প্রতি অনুভূতিটা কেন আসে না? ভালোবাসার অনুভূতি কি এতটাই দুর্লভ?
ক্যানিয়লের ইচ্ছা করলো আজকে সাইকেলে করে ঘুরতে যেতে। আবহাওয়া যেহেতু আজ খুবই প্রাণবন্ত। ক্যানিয়লের সাইকেল নেই এখন। সামুরার আছে। সামুরার সাইকেল করেই ঘুরবে। বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো ক্যানিয়ল।
সময় নষ্ট না করে সামুরার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সামুরা বাসায় থাকলে সামুরাকে সাথে নিয়ে বের হতো। সামুরা সিয়াটল গিয়েছে এক বন্ধুর সাথে।
ক্যানিয়ল ঠিক করলো এখন মেরিমুর পার্কে যাবে। পার্কটা বাসা থেকে বেশি দূরে নয়।

রাস্তার পাশে বেঞ্চিতে যে মেয়েটা বসা ছিল ওটা কি ইরতিজা ছিল না?
এই মাত্র একটা মেয়েকে অতিক্রম করে এসেছে ক্যানিয়ল। ওটা সম্ভবত ইরতিজাই ছিল। খেয়াল করে দেখেনি, খেয়াল হলো অতিক্রম করে আসার পর। মেয়েটাকে এখানে-সেখানে-ওখানে সবখানে দেখা যায়। যেখানেই যাওয়া হোক সেখানেই মেয়েটাকে দেখতে পায় সে। এর কারণ কী? ভেবে পাচ্ছে না ক্যানিয়ল।
হঠাৎ মনে হলো সে একা কেন সাইকেলে ঘুরছে? সাথে একজন সঙ্গী থাকলে ভালো হতো। ওই পাগল মেয়েটাকে সঙ্গী হিসেবে সাথে নেবে না কি? হোক মেয়েটা পাগল, সঙ্গী হিসেবে একজন সাথে থাকলে মন্দ হয় না। ক্যানিয়ল সাইকেল ঘুরিয়ে ফেললো।
এসে থামলো ইরতিজার সামনে। ডাকলো,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল!”

হঠাৎ ডাক শুনতে পেয়ে তাকালো ইরতিজা। তার কানে ফোন ধরা। কথা বলছিল সাজিদের সাথে। হাঁটতে বের হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় বেঞ্চিতে বসেছিল। সাজিদ কল দিলো এ সময়। খানিক সময় হয়েছে এখানে বসে আছে। ক্যানিয়লকে পাত্তা দিলো না সে। বলতে গেলে একই জায়গার বাসিন্দা তারা এখন। দেখা হতেই পারে। এ নিয়ে বিস্মিত হলো না। চোখ সরিয়ে নিয়ে আগের মতো কথা বলতে লাগলো,
“তো আপনি কালকে বেলভিউ যাবেন?”

সাজিদ উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ। তুমি যাবে না কি সাথে?”

“আমি…”
বলতে পারলো না ইরতিজা। এর আগেই ক্যানিয়ল রুষিত স্বরে বলে উঠলো,
“তুমি অহংকার দেখাচ্ছ?”

ইরতিজা আবার তাকালো ক্যানিয়লের দিকে। খুব রাগ অনুভব হলো তার। সাজিদের সাথে কথা চালিয়ে যাওয়ার মন পেল না। ক্যানিয়লকে এড়িয়ে যাওয়ারও ধারাটা অব্যাহত রাখতে পারলো না। কলে থাকা সাজিদকে বললো,
“আমি আপনার সাথে পরে কথা বলবো। হঠাৎ করে এক কালপ্রিটের সাথে দেখা হয়েছে। ওর সাথে সাক্ষাৎটা সেরে নিই।”

সাজিদের কিছু বলার অপেক্ষা না করে কল কেটে দিলো ইরতিজা।

বাংলাতে কথা বলায় কিছু বোধগম্য হয়নি ক্যানিয়লের। কিন্তু বাংলার ভিতর থেকে সে ঠিকই কালপ্রিট শব্দটা ধরতে পেরেছে। বললো,
“কালপ্রিট? কালপ্রিট শব্দটা জড়িয়ে উর্ডুতে কী বললে তুমি?”

ইরতিজা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ক্যানিয়লের প্রশ্নে কর্ণপাত না করে বললো,
“একজন মানুষের পার্সোনাল সময়ে তুমি কীভাবে ডিস্টার্ব করতে পারো? দেখোনি আমি ফোনালাপে ব্যস্ত ছিলাম? দেখেও কীভাবে ডাকলে?”

“ও-হো, এটাকে পার্সোনাল সময় বলে? তো ফোনালাপে কার সাথে এত ব্যস্ত ছিলে?”

“তোমাকে কেন বলবো? ইট’স অ্যা পার্সোনাল ম্যাটার।”

ক্যানিয়ল হাসলো। হাসার কারণে চোখ দুটো ছোটো হয়ে আরও সুন্দর দেখালো। ওই চোখেতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ইরতিজার। ক্যানিয়ল বললো,
“লেট’স গো।”

ইরতিজা ক্যানিয়লের কথা ঠিক বুঝতে পারলো না,
“মানে?”

“তুমি কি সাইকেল ভ্রমণে যেতে ইচ্ছুক? হলে চলো।”

সাইকেলের দিকে ইশারা করলো ক্যানিয়ল।

ইরতিজা অবাক হলো। ক্যানিয়ল তাকে সাইকেলে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে? এটা কি শোনার ভুল?

“আমি তোমার সাথে কেন যাব? তুমি কি মজা করছো আমার সাথে?”

“আমি মজা করি না, করতে জানি না। আমি সিরিয়াস মানুষ। আমার সব কিছুই সিরিয়াস চলে। চলো।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার একটা হাত ধরতে চাইলেই ইরতিজা সরে গিয়ে বললো,
“ডোন্ট টাচ মি! আমি তোমার সাথে যাব না। আমি পাগল নই যে আমি তোমার সাথে যাব।”

ইরতিজা এখান হতে প্রস্থান করার জন্য পা বাড়ালেই ক্যানিয়ল যাওয়ার পথে বাধা দিয়ে বললো,
“তুমি তো পাগলই পাকিস্টানি গার্ল! নতুন করে আর কী পাগল হবে? ওই রাতে বলেছিলাম না, তুমি হলে আধা পাগল?”

ইরতিজার মাঝে মুহূর্তে একটা রাগ তরতর করে বেড়ে উঠলো। সে ক্যানিয়লের দিকে আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলবে তার আগে ক্যানিয়ল এক কদম এগিয়ে এসে তার মাথায় হস্ত পরশ বুলিয়ে বললো,
“তুমি কত ভালো পাকিস্টানি গার্ল! এত ভালো কেন তুমি? তুমি কি জানো তুমি একটা মিষ্টি মেয়ে?”

ক্যানিয়লের কথায় ইরতিজার সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সে ছিল রাগান্বিত, কিন্তু এখন খেয়ে গেল ভ্যাবাচ্যাকা!
ক্যানিয়ল বললো,
“আরে, এতদিন তোমার সাথে যা করেছি ওগুলো তো ছিল ফান। আমি মানুষটা মোটেই সিরিয়াস না ইজা। মজা করা ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারি না। ওগুলো নিতান্তই মজা ছিল। তোমাকে তো আমি বন্ধু ভাবী।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে একহাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি কি আমার বন্ধু হবে ইজা?”

ইরতিজা অবাক। বিস্ময়ের সুবিশাল ও গভীর অর্ণবে তলিয়ে যাচ্ছে সে। মুখে গাঢ় বিস্ময়ের ছাপ পড়ে রয়েছে। ক্যানিয়ল এতদিন তার সাথে মজা করেছে? ইরতিজা বিস্ময়ে ডুবে রইল কিছুক্ষণ। ক্যানিয়লের বাড়ানো হাতটার দিকে তাকালো। কেউ নিজ থেকে বন্ধুত্ব করতে চাইলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? ইরতিজা খানিক ভেবে ক্যানিয়লের সাথে হ্যান্ডশেক করে একটু হাসার চেষ্টা করলো। যদিও তার মন সংশয়।

ক্যানিয়ল প্রসন্ন হেসে বললো,
“সো লেট’স গো। এখন তো আমরা বন্ধু। একে অপরের সাথে ঘুরতে যেতেই পারি। মেরিমুর পার্কে যাব।”

মেরিমুর পার্ক! নামটা শুনেছে ইরতিজা। কিন্তু এখনও যাওয়া হয়নি। সেখানে যাবে ক্যানিয়লের সাথে?
ক্যানিয়ল ইরতিজাকে ভাবাভাবীর সময় দিলো না। হাত ধরে নিয়ে এলো সাইকেলের কাছে। সে নিজে হেলমেট পরেনি, ইরতিজাকে পরিয়ে দিতো। কিন্তু ইরতিজার মাথায় সুন্দরভাবে একটা ওড়না দেওয়া আছে দেখে আর পরালো না। সিটে উঠে বসলো। ইরতিজাও উঠে বসলো পিছনে। তার ইতস্তত বোধ হচ্ছে। ইতস্তত বোধটা কেটে গেল ক্যানিয়লের কথায়, যখন ক্যানিয়ল একটু আগের বিনীত ছেলে থেকে পুনরায় অতীতের পাজি ছেলে রূপে ফিরে এলো। সে ইরতিজাকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“আমাকে ধরে বসার চেষ্টা করবে না নীচু মানসিকতার মেয়ে! আমি ভীষণ স্পেশাল! যে কেউ আমাকে স্পর্শ করলে সেটাও আমার জীবনে বড়ো একটা অপমান বলে গণ্য হবে। অতএব একদম ধরে বসার চেষ্টা করবে না। নতুবা তোমার সুন্দর হাত দুটি আমি হকিস্টিকের আঘাতে ভে/ঙে দেবো!”

ইরতিজা বিস্ময়ে তরান্বিত। দু চোখে বিস্ময় স্ফীত হয়ে উঠছে। এইমাত্র কী শুনলো সে? একটু আগের ক্যানিয়লের সাথে তো এই পাজি ক্যানিয়লের কোনো সাদৃশ্য নেই। ইরতিজা বললো,
“একটু আগেই তো তুমি বললে, তুমি…”

“ওগুলো তো শুধু তোমাকে সাইকেলে উঠানোর জন্য বলেছি। কিন্তু এখন যখন তুমি একবার সাইকেলে উঠেই গিয়েছো তখন আর কী উপায়…”

ক্যানিয়ল কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই সাইকেল চালাতে শুরু করলো। সাইকেলের চলন গতি এত দ্রুত যে ইরতিজা দুই হাতের বেষ্টনে ক্যানিয়লকে জড়িয়ে ধরতে বাধ্য।
সামনে থেকে ক্যানিয়লের কণ্ঠ কানে ভেসে এলো,
“তোমার দেখছি হাত ভা/ঙারও ভয় নেই!”

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৭
_________________

ক্যানিয়ল হাতের ক্ষত স্থান পানি দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছে। কপালের এক পাশও হালকা কেটে গিয়েছে তার। রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে তার মুখ। পাগল মেয়েটাকে সাইকেলে উঠানো খুব বড়ো ভুল ছিল। মেয়েটা আসলেই পাগল! সাইকেল থেকে নামার জন্য অমন জেদ না ধরলে কি আজ সাইকেল নিয়ে রাস্তায় পড়তে হতো? আহত হতে হতো? কেন সঙ্গী হিসেবে মেয়েটাকে সাইকেলে নিয়েছিল? ক্যানিয়লের আফসোস হচ্ছে কাজটা করার জন্য।
মেয়েটা শুধু যে সাইকেল থেকে নামার জন্য জেদ করেছিল সেটাই নয়, ক্যানিয়ল সাইকেল না থামানোয় সে পিছন থেকে ক্যানিয়লকে হাত দ্বারা আঘাতও করেছে! এরপরই ঘটলো এক্সিডেন্ট! সাইকেল পড়লো, সেই সাথে সাইকেলে থাকা মানুষ দুজনও পড়ে গেল! ক্যানিয়ল বিশ্বাস করতে পারছে না সে একটা মেয়ের দ্বারা আজ আহত হয়েছে! পিঠ ব্যথা করছে। মেয়েটা খুব জোরে আঘাত করেছে কি না।
মেয়েটাকে কিছু বলারও সুযোগ পায়নি। কিছু বলার আগেই মেয়েটা দৌড়ে চলে গিয়েছে। তবে পরে দেখা হলে অবশ্যই ছাড় পাবে না পাগল মেয়েটা। নির্ঘাত হকিস্টিকের আঘাতে মা/থা ফাটিয়ে দেবে!
দরজা খোলার শব্দ কানে এলে সচকিত হয়ে উঠলো সে। পানির কল বন্ধ করে বেরিয়ে এলো। মাদার সোফিয়া প্রবেশ করেছে রুমে। সে এগিয়ে এসে ক্যানিয়লের সামনে থামলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কপালের কাটা অংশটার দিকে। তারপর হাত বাড়িয়ে স্থানটা ছুঁয়ে বললো,
“কাকে মেরেছো আজকে?”

“কাউকে না।”

“তাহলে কীভাবে আঘাত পেয়েছো?”

“সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে।”

সোফিয়ার মুখ থেকে কালো ছায়া উঠে গেল। হেসে বললেন,
“সাইকেল চালাতে তুমি এখনও পারদর্শী হয়ে উঠতে পারোনি উমরান?”

“ছিলাম পারদর্শী, কিন্তু একজন অনভিজ্ঞ বানিয়ে দিলো।”

সোফিয়া চোখ সরু করে তাকালেন। বুঝতে পারলেন না ক্যানিয়লের কথা। মুখটা আবারও আঁধারে ঢাকা পড়লো। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়াতে এমন অভিব্যক্তি তার। বললেন,
“মমকে মিস করো উমরান?”

প্রশ্নটা শুনে ধাক্কা খেলো ক্যানিয়ল। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,
“হঠাৎ হঠাৎ এই প্রশ্নটা কেন করো মাদার সোফিয়া?”

“কারণ তুমি সব সময় এটার ভুল উত্তর দাও। সঠিক উত্তরটা কবে শুনতে পাবো সেটাই পরীক্ষা করি। এবারও কি উত্তরটা ভুলই থাকবে?”

“ভুল নয়, ওটাই সঠিক। তাকে আমি ঘৃণা করি, মিস নয়!”

ক্যানিয়ল দরজার দিকে পা বাড়ালো। সোফিয়া পিছন থেকে বললেন,
“তাহলে এন্ডারসন হাউজে ওয়ারড্রোবের ভিতর তোমার মমের ছবি কেন দেখা যায় উমরান?”

ক্যানিয়ল থমকে দাঁড়ালো।
_________________

পা যন্ত্রণা করছে, ঔষধ লাগানোর পরও ব্যথা কমেনি। পাজি ছেলেটার জন্য আজ সাইকেল থেকে পড়েছে! ছেলেটা এত পাজি! ভাবলেও শরীরে ঝিরঝির করে রাগ কাঁপন ধরাচ্ছে।
ইরতিজা হাত বাড়িয়ে আগুনের তাপ নিলো। বাসার সামনে আগুন জ্বালিয়েছে রিশন। আগুনের উষ্ণতা শীতকে অনেকটাই বিতাড়িত করেছে। রিশনের দিকে তাকালো ইরতিজা। রিশন ভিডিয়ো এডিট করছে। সে এখনও ক্ষুব্ধ ক্যানিয়লের উপর। ক্যানিয়লের জন্য ওইদিন জোনাকির ভিডিয়ো শ্যুট করতে পারেনি। ইরতিজা ক্ষুদ্রশ্বাস ত্যাগ করলো। ক্যানিয়ল যে পাজি এটাই তার নমুনা। সকলের সাথে ঝগড়া করে, ঝামেলা করে!
দূরে চোখ পড়লো ইরতিজার। জুহিকে আসতে দেখলো। সে উঠে এগিয়ে এলো জুহির দিকে। পায়ে যন্ত্রণা অনুভব হলেও হাঁটতে তেমন সমস্যা হয় না।

“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আন্দ্রেজ তোমাকে অনেকবার কল দিয়েছে। রিং হওয়ার পরও কল রিসিভ করোনি তুমি।”

জুহির মেজাজ চটা। থিওডোর নামের একটা ছেলের উপর ভীষণ ক্ষ্যাপা সে। ছেলেটার সাথে আজকেই বন্ধুত্ব হয়েছিল তার। ছেলেটা পর্যটক, রেডমন্ড ঘুরতে এসেছে। রাতে জুহির সাথে ডিনার করবে বলেছিল। হ্যাঁ, বলেছিল তো ভালো কথা। জুহিও বেশ খুশি হয়েছিল। খুশি মনে সে ডিনার করতে গিয়েছিল। ছেলেটা নিজের অর্থ খরচ করে খাওয়াবে তাকে এমনটাই তো হওয়ার ছিল। কিন্তু ছেলেটা এতটাই চতুর যে নিজের ডলার খরচ না করে তাকে দিয়ে বিল মিটিয়েছে! সে কিছু বলতেও পারেনি, কিছু করতেও পারেনি। চুপচাপ বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে এসেছে। আজকের পর থেকে ওই ছেলের সাথে আর বন্ধুত্ব রাখবে না। আজকেই বন্ধুত্ব হয়েছিল, আজকেই বন্ধুত্বের সমাপ্তি টানবে।
জুহি রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“কেন? ওই খোঁড়া ছেলে আমাকে কেন কল দিয়েছে? দিলেই কি আমার রিসিভ করতে হবে? যখন মার্টার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তখন আমার কথা মনে থাকে না?”

জুহি আর দাঁড়ালো না, ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ইরতিজা তাকিয়ে রইল ওর পথের দিকে। মনে মনে বললো,
“আজব তো!”

রিশন পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করছিল। ইরতিজাকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে ডাকলো। ইরতিজা এগিয়ে গিয়ে ওর পাশের চেয়ারে বসলো। রিশন বললো,
“তুমি কি জানো আমার বোন আন্দ্রেজকে ভালোবাসে?”

“হোয়াট?” কথাটা শোনামাত্র বিস্ময়ের ধ্বনি বেরিয়ে এলো ইরতিজার মুখ থেকে।

“হ্যাঁ। আমি জানি না ও কেন আন্দ্রেজকে পছন্দ করে! এত ছেলে থাকতে আন্দ্রেজই কেন হবে? তুমি এর কারণ জানো?”

“তুমি মজা করছো রিশন।” কথাটা কেন যেন বিশ্বাস হলো না ইরতিজার।

রিশনের মন অসন্তুষ্ট হলো। হঠাৎই খুব বিরক্তবোধ করলো সে। উঠে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে বললো,
“তোমরা মেয়ে জাতিটাই কেমন যেন! কোনো কিছু বুঝিয়ে ওঠা যায় না তোমাদের।”

বলে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল।
ইরতিজা হতবাক হয়ে বসে রইল। তার দিনগুলো আজকাল খুবই বাজে যাচ্ছে!

_________________

আজ ইউনিভার্সিটিতে বসে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সিদ্ধান্তটা হচ্ছে বন্ধুরা মিলে ‘Rattlesnake lake’ ঘুরতে যাবে আগামীকাল। দুপুরে রওনা হবে, ফিরবে সন্ধ্যায়। এই দলে মোট নয়জন যুক্ত হয়েছে। দলের ভিতর সামুরাও আছে। সামুরা ছেলেটা খুব ভালো, ইরতিজা বুঝতে পেরেছে এ কদিনে। দুই দুই বার আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে সে তার ফ্যামিলির আচরণে।
ইরতিজা ক্লাসে বসে বসে ভাবছিল সামুরাকে নিয়ে। ক্লাসের ভিতর বেশিরভাগ আসনই ফাঁকা। সবাই ক্যাম্পাসের এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। ইরতিজার পাশে জুহি প্রয়োজনীয় একটা জিনিস নোট করে নিচ্ছে। হঠাৎ দরজায় ক্যানিয়ল এসে দাঁড়ালো।

“ইজা!”

শান্তস্বরের ডাকটা কানে আসতেই গায়ের প্রতিটা লোম খাড়া হয়ে উঠলো ইরতিজার। সে ডাক অনুসরণ করে তাকালো। ক্লাসরুমে উপস্থিত সকল চোখই এখন ক্যানিয়লের উপর নিবদ্ধ। এত জনের দৃষ্টির অন্তর্গত হয়ে ক্যানিয়লের অস্বস্তি বোধ হলো। সে ইরতিজাকে বললো,
“এদিকে এসো। তোমার সাথে ইম্পরট্যান্ট কথা আছে।”

উপস্থিত সকলের চোখেই কৌতূহল। জুহি অবাক হয়ে ইরতিজার মুখপানে চাইলো। ইরতিজা তাকানো ক্যানিয়লের দিকে। বললো,
“যাব না।”

ক্যানিয়ল রেগে গেল। মুখচ্ছটা রাগের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটালো। সে গম্ভীর কণ্ঠে নির্দেশ করলো,
“এসো।”

“তুমি যাও এখান থেকে।”

জুহি ইরতিজার সাথে তাল মিলালো। ক্যানিয়লকে বললো,
“হ্যাঁ তুমি যাও। টিজাকে কেন ডাকছো? ও কেন যাবে তোমার সাথে? তুমি চলে যাও। টিজা যাবে না তোমার সাথে।”

ক্যানিয়ল ভারি বিরক্ত নিয়ে তাকালো জুহির দিকে।
“তুমি চুপ করো প্লে গার্ল!”

অপমানে থমথম করে উঠলো জুহির ভিতরটা। ক্লাসে উপস্থিত মানুষজনের মাঝে তাকে ‘প্লে গার্ল’ বলে সম্বোধন করলো ক্যানিয়ল? জুহি একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো গোটা রুমের উপর।

ক্যানিয়ল আবার বললো,
“দ্রুত এসো পাকিস্টানি গার্ল, এটা খুবই ইম্পরট্যান্ট কথা।”

“যাব না আমি, তুমি যাও এখান থেকে।”

“হ্যাঁ, যাবে না ও। যেতে চাইলেও আমি যেতে দেবো না।” জুহি বললো।

ক্যানিয়ল চোখ সরিয়ে নিয়ে বিরক্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। অনন্তর আবার তাকালো ইরতিজার দিকে। ইরতিজার মাথায় হিজাব নেই। চুল স্বল্প বিনুনি করা। ইরতিজাকে এমন দেখতে ভালো লাগলো না তার।

“তাহলে তুমি আসবে না?”

ইরতিজা কিছু বললো না।
ক্যানিয়ল নির্বিকার বললো,
“ঠিক আছে, আসতে হবে না তোমার। আমিই টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসবো।”
বলে সে প্রস্থান করলো।

ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছিল ইরতিজা, জুহি। গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। গেট থেকে কিছুটা দূরে থাকাকালীন গেট দিয়ে প্রবেশ ঘটলো ক্যানিয়লের। আচমকা কেমন ভয় ছমছম করে উঠলো ইরতিজার মাঝে। সে দৃষ্টি নামিয়ে হাঁটতে থাকলো।
ক্যানিয়ল যখন ইরতিজার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ ইরতিজার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। পিছন থেকে হাতে টান পড়তেই পিছন ঘুরে যেতে হলো ইরতিজার। ক্যানিয়ল হাঁটা অব্যাহত রেখেছিল। অতএব বাধ্য হয়েই ইরতিজাকে ওর সাথে পা মিলিয়ে চলতে হলো। জুহি পিছন থেকে ডেকে উঠলো,
“হেই!”

ক্যানিয়ল থামলো না। ইরতিজাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। পায়ের গতি দ্রুত তার। ইরতিজার হাতটা খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হচ্ছে ইরতিজার।

“ছাড়ো আমায়।”

কথাটা কান অবধিও যেন পৌঁছালো না ক্যানিয়লের।
জুহি কী করবে বুঝতে না পেরে দৌড়ে এলো ওদের পিছন পিছন। কিন্তু ওদের ধরতে পারলো না। ক্যানিয়ল ইরতিজাকে নিয়ে লাইব্রেরি রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো।
দরজার কপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় থমকে যেতে হলো জুহির। তবে সে স্থির রইল না, দুই হাত দিয়ে অনবরত দরজার গায়ে আঘাত করে বললো,
“হেই, তুমি কি পাগল? টিজাকে ওভাবে টেনে নিয়ে এসেছো কেন? দরজা বন্ধ করেছো কেন? হেই, খোলো দরজা। খোলো বলছি।”
জুহির কণ্ঠ অস্থির।

ইরতিজা দরজার দিকে এগোনো দিলেই ক্যানিয়ল বাধা দিলো।
ইরতিজা রক্তচক্ষুতে তাকালো ক্যানিয়লের দিকে।

“তুমি তোমার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ ক্যানিয়ল! খুব অতিরিক্ত করে ফেলছো তুমি। আমাকে যেতে দাও।”

“যেতে দেবো বলে কি টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এসেছি? বলেছিলাম তো টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসবো। সাবধান থাকোনি কেন?”

ইরতিজা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
সহসা ক্যানিয়লের মাঝেও রাগের ছটা লাগলো। ইরতিজার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“তুমি মেয়েটা ঠিক কী বলো তো? তুমি কি আসলেই ওই গ্যাংয়ের সাথে জড়িত? সাইকেল থেকে ফেলে দিয়েছো আমায়! পিঠেও আঘাত করেছো পিঠ এখনও ব্যথা করছে। তুমি কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে দিয়েছো আমার গায়ে। লুক অ্যাট দিস…”

কপালের কাটা অংশটা দেখিয়ে দিলো ক্যানিয়ল।
“আমি মানুষজনকে কী করে বলবো যে এই ক্ষত একটা মেয়ে আমাকে সাইকেল থেকে ফেলে দেওয়ার কারণে হয়েছে?”

জুহির উত্তেজনা বেড়ে চলছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। জুহির পিছনে আরও কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা দেখতে। জুহি আবারও করাঘাত করে বললো,
“হেই, তুমি কী করছো টিজার সাথে? দরজা খোলো। টিচার ডাকতে বাধ্য করো না আমায়।”

“এই কলঙ্ক কীভাবে মুছবে পাকিস্টানি গার্ল? তোমাকে মেরে ফেললে কি এই কলঙ্ক মুছবে? তোমাকে মেরে ফেললে তো তোমার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। যার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না তার দ্বারা পাওয়া আঘাতেও নিশ্চয়ই কোনো কলঙ্ক খচিত থাকবে না। তোমাকে কি আমি মেরে ফেলবো?”

“তোমার সকল কথাই সন্ত্রাসীদের মতো! তুমি আসলেই সন্ত্রাসী। তোমাকে পুলিশে দেওয়া প্রয়োজন।”

ক্যানিয়ল হেসে ফেললো। বললো,
“আর তোমাকে মেন্টাল প্রিজনে পাঠানো প্রয়োজন।”
একটু থেমে হতাশার দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
“চেয়েছিলাম হকিস্টিক দিয়ে তোমার মা/থা ফা’টি’য়ে দেবো।”
বলতে বলতে পুরু একটা বই দিয়ে ইরতিজার মাথায় আঘাত করতে নিয়েও আঘাত করলো না।
“কিন্তু মত পরিবর্তন হয়ে গেল। যাও করলাম না তোমায় আঘাত। মেয়েদের এমনিতেও আমি অপছন্দ করি। আঘাত করলে পছন্দের মানুষদেরই করতে হয়, অপছন্দের মানুষদের নয়।”

ক্যানিয়ল সরে গেল কাছ থেকে। বইটা বুক সেলফে রেখে দরজার দিকে অগ্রসর হলো। দরজার কাছে গিয়ে আবার থামলো কিছু একটা মনে পড়তে। পিঠের ব্যাগ থেকে একটা সাদা হিজাব বের করলো। পিছন ফিরে ইরতিজাকে বললো,
“তোমার মাথায় হিজাব কেন নেই পাকিস্টানি গার্ল?”

ইরতিজা হঠাৎ এমন প্রশ্নে তটস্থ বোধ করলো।

ক্যানিয়ল এগিয়ে এলো কাছে। হাতের হিজাবটা ইরতিজার মাথায় এক প্যাঁচ দিয়ে জড়িয়ে দিয়ে বললো,
“ভালোভাবে পরে নেবে এটা।”

ইরতিজা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল। চলে গেল ক্যানিয়ল। দরজা খুলতেই যেন নিজের প্রাণ ফিরে পেল জুহি। তার দমবন্ধ হয়ে আসছিল এতক্ষণ ধরে। ক্যানিয়ল বের হতেই সে ব্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“টিজার সাথে কী করেছো তুমি? হুহ? কী করেছো?”

ক্যানিয়ল জুহির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে স্তব্ধ ইরতিজাকে দেখলো। তারপর জুহির দিকে তাকিয়ে ওষ্ঠকোণে অদ্ভুত হাসির রেখাপাত ঘটিয়ে জুহির কানে কানে বললো,
“তোমার কাজিনের সাথে খুব বাজে কিছু করেছি আমি। দেখবে কয়েকদিন যাবৎ কেবল আমিতেই ডুবে থাকবে ও। টেনে-হিঁচড়েও উঠাতে পারবে না ওকে।”

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৮
_________________

জুহিকে কথাটা মজা করে বলেছিল ক্যানিয়ল, কিন্তু এই মজা করে বলা কথাটা যে আজবভাবে সত্যি হয়ে যাবে সেটা কে জানতো? গতকাল থেকে ক্যানিয়লকে ভেবে যাচ্ছে ইরতিজা। না, ছেলেটাকে যতটা খারাপ ভাবা হয়েছিল ছেলেটা আসলে অতটাও খারাপ নয়। গতকালকের ঘটনা থেকে এটুকু আঁচ হয়েছে ইরতিজার। গতকাল থেকেই সে কেমন নিঝুম-নিস্পন্দ! কারো সাথে তেমন কোনো কথা বলে না। একা একা থাকে। নিজের অভিব্যক্তি দেখে ইরতিজা নিজেই ভীষণ বিস্মিত। তবে বিস্মিতভাব দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না তার মাঝে। সে আবারও ভেসে ওঠে নিঝুম-নিস্পন্দ উদাসী হাওয়ায়।

দুপুরে রওনা হলো ‘Rattlesnak lake’ এর উদ্দেশ্যে। ওদের গাড়িতে চারজন যাত্রী। ইরতিজা, জুহি, রিশন এবং আন্দ্রেজ।
হাইওয়ে ধরে ওদের গাড়িটা এগিয়ে চলছে। ইরতিজা বসে আছে পিছনের আসনে, ওর পাশে জুহি। ইরতিজা আজ থ্রি পিস, হিজাব পরেছে। ক্যানিয়লের দেওয়া সেই হিজাবটা পরেছে। এটা পরতেই ভালো লাগলো কেন যেন!
রাস্তায় বের হওয়ার পরেই নিঝুম মন হঠাৎ চাঞ্চল্যকর হয়ে উঠলো ইরতিজার। প্রকৃতি দেখার নেশায় মত্ত হয়ে উঠেছে চিত্ত। কোন দিক রেখে কোন দিক দেখবে দিশেহারা লাগছে। ঝাপসা কুয়াশায় জড়ানো পাহাড় কী অপূর্ব! একটু গাড়ি নিয়ে বের হলেই পাহাড়ের নজরকাড়া সৌন্দর্য নজর কেড়ে নেয়।
ইরতিজার চোখ রাস্তার কর্ণারে গেল। স্নো ফল হয়েছিল, রাস্তার কর্ণারে জমে আছে বরফ। আজকে বোধহয় মাইনাস ওয়ান চলছে। অনেক ঠান্ডা।
চল্লিশ মিনিটের ভিতরই পৌঁছে গেল ওরা গন্তব্যে। গাড়ি থেকে বের হতেই তাপহীন রোদ আবেশী স্পর্শ বুলিয়ে দিলো চুল, মুখমণ্ডল ও গায়ের পোশাকে। এখানেও বরফ জমে আছে। ঘাসের উপর ছড়িয়ে আছে বরফের সাদা আস্তরণ। এখান থেকে একটু হেঁটে গেলেই লেক দেখা যাবে।
লেকের ধারে এসে দেখা মিললো বাকি বন্ধুদের। সকলেরই এই সময় উচ্ছ্বসিত থাকার কথা ছিল। ব্যস্ত থাকার কথা ছিল ফটোশ্যুট নিয়ে। কিন্তু একটা কারণে সকলের মুখই গম্ভীর, বেজার! লেকের ধারে সময় কাটানোর প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে এসেছে বাকি বন্ধুরা। চেয়ার, ছোটো টেবিল, খাদ্যদ্রব্য, মাদুর, খাদ্য প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র সব কিছু নিয়ে এসেছে। কিন্তু সর্বপ্রথম ওদের দৃষ্টি বাকি সবকিছু ডিঙিয়ে চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটার উপর পড়লো। চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আরাম করে বসে আছে সে।
জুহি অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“হোয়াট দ্য হেল! হোয়াট এম আই সি? তুমি এখানে কেন ক্যানি?”

জুহির কথা কর্ণধারে পৌঁছাতেই চোখ খুললো ক্যানিয়ল। তার কমলা রঙা অক্ষি প্রথমেই অবলোকন করলো নীল সাদায় সজ্জিত আকাশ। এরপর ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো জুহির দিকে। জুহির পাশাপাশি ইরতিজা, রিশন, আন্দ্রেজকেও দেখতে পেল। ঠোঁট টেনে হেসে ইরতিজাকে দেখিয়ে বললো,
“ইজা আসতে বলেছে আমাকে।”

ইরতিজা চমকে উঠলো ক্যানিয়লের মিথ্যা কথা শুনে। ততক্ষণে উপস্থিত সবার দৃষ্টি এসে পড়েছে ইরতিজার উপর। ইরতিজার ভিতরটা কাঁপছে। বিনা অপরাধে হৃদয়ের এমন কম্পমান অবস্থা আসলেই খুব ভয়ংকর। জুহি প্রথমে বিস্ময় নিয়ে ইরতিজার দিকে তাকালেও ক্যানিয়লের কথাটা যে মিথ্যা এটা অনায়াসে বুঝে গেল। বললো,
“মিথ্যা বলার জন্য মাধ্যম হিসাবে আর কাউকে পেলে না? টিজা তোমাকে আসতে বলবে কেন? ও তোমাকে ঘৃণা করে!”

ক্যানিয়ল কেমন মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“আচ্ছা! ঘৃণা করে? তাহলে আমার দেওয়া হিজাব ও কেন পরে আছে এখনও?”

সবাই আবারও ইরতিজার দিকে তাকালো। ক্যানিয়ল প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“আমাকে তুমি ঘৃণা করো পাকিস্টানি গার্ল?”

ক্যানিয়লের প্রশ্নটা হৃদয় উপকূল স্তব্ধ করে দিলো ইরতিজার। পরক্ষণেই বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করে শব্দ হতে লাগলো। এখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকাও অসম্ভব মনে হলো, কিন্তু এখান থেকে চলে যাওয়ার তো উপায় নেই তার। বাধ্যতামূলক দাঁড়িয়ে রইল।

ক্যানিয়লের আগমন কারো কাছেই ভালো লাগার কোনো বিষয় নয়। সবাই বিতৃষ্ণা অনুভব করছে। সবচেয়ে বিতৃষ্ণা, অস্বস্তিতে আছে সামুরা। ঘুরতে আসার কথাটা ক্যানিয়লকে জানানোই ভুল ছিল তার। সে একদমই চায়নি ক্যানিয়ল তার সাথে আসুক। কারণ এখানে ইরতিজা, রিশন থাকবে। ইরতিজার সাথে যে ক্যানিয়লের ঝগড়াপূর্ণ সম্পর্ক সেটা সে বুঝতে পেরে গিয়েছে। কিন্তু ক্যানিয়লকে সে সরাসরি কিছু বলতে পারেনি। এখন কি এখানে খুব বড়ো ঝামেলা বাঁধবে?

“আমরা এখানে ঘুরতে এসেছি, কোনো রকম ঝামেলা করতে চাচ্ছি না তাই। তুমি চলে গেলেই আমরা সবাই খুশি হবো।” রিশন বললো। ক্যানিয়লকে দেখে সে ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে গেলেও শান্ত ভাবে ব্যাপারটার সমাধান করতে চাইলো।

“কিন্তু আমি তো তোমাদের সবাইকে খুশি করতে চাইছি না। আমার কোনো ইচ্ছা নেই তোমাদেরকে খুশি করার। অন্যের খুশি নিয়ে আমি ভাবী না। আমার খুশিটাই ইম্পরট্যান্ট আমার কাছে।”

সবাই বুঝতে পারলো ক্যানিয়লকে বুঝিয়ে লাভ হবে না। তাই সবাই এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়লো যে যার মতো করে লেক দেখার উদ্দেশ্যে। জুহিও ইরতিজার হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে গেল দূরে।
ইরতিজা মুগ্ধ নয়নে দৃষ্টি মেলে দিলো প্রকৃতি পানে। লেকটা পাহাড়ে বেষ্টিত। দুই পাশ দিয়ে পাহাড় ঘিরে রেখেছে। পাহাড় এবং নীল-সাদা আকাশের প্রতিচ্ছবি লেকের পানিতে পড়ে অন্য রকম সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। দূর পাহাড়ের উপর বরফ পড়েছে দেখা যাচ্ছে। ইরতিজার ইচ্ছা হলো ডানা মেলে উড়ে উড়ে দেখে পাহাড়গুলো। কিন্তু ডানা দুটোই যে নেই!
নীল জল টলমল করছে। এই জলে হঠাৎই ভেজার শখ জাগলো ইরতিজার। আনমনে কথাটা ভাবার কিয়ৎক্ষণ পর আচমকা পানির ঝাপটা এসে মুখ ভিজিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে নিতে হলো ইরতিজার। চোখ মেলে এক জোড়া কমলা রঙা চোখের হাসি দেখতে পেল। খারাপ লাগলো না ইরতিজার। বরং অদ্ভুতভাবে তার ক্যানিয়লের করা দুষ্টুমিটা ভালো লাগলো। অধর কোণ খানিক প্রশস্ত হলো এই ভালো লাগা থেকে।

ইরতিজার ঠোঁটের কোণে নির্মল হাস্যভাব লক্ষ করে ভ্রু কুঁচকে গেল ক্যানিয়লের। অবাক চিত্তে বললো,
“হাসছো কেন তুমি?”

মিলিয়ে গেল ইরতিজার হাসি। নিজের কাছে নিজের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো। হ্যাঁ সেটাই তো, হাসছে কেন সে? ক্যানিয়লের দিকে বিচলিত চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
“কোথায় হাসলাম?”

“স্পষ্ট দেখেছি তোমাকে হাসতে।”
ক্যানিয়ল চোখ সরু করে সন্দ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
“তুমি সত্যিই পাগল নও তো গার্ল?”

“তুমি পাগল!”

ক্যানিয়ল হেসে বললো,
“পাগল হলে ভালো হতো, কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত আমি তা নই।”

ক্যানিয়ল এমনভাবে বললো যেন পাগল না হতে পেরে তার ভীষণ আফসোস হচ্ছে।
ইরতিজা ভ্রু কুঞ্চন করে চেয়ে রইল।

জুহি ইরতিজার কাছ থেকে সরে আন্দ্রেজের কাছে এসেছিল। এখন ইরতিজার দিকে চোখ পড়তে ওর সামনে ক্যানিয়লকে দেখতে পেল। খুব রাগ হলো তার। সে হনহন করে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ইরতিজার একহাত ধরে বললো,
“ওদিকে চলো।”

জুহি ইরতিজাকে নিয়ে যেতে লাগলো। ক্যানিয়ল বললো,
“আমাকে অবহেলা করছো প্লে গার্ল? এতে কিন্তু আমি একটুও দুঃখ অনুভব করছি না। কারণ আমি অবহেলায় বাড়ন্ত! অবহেলা অগ্রাহ্য করতে জানি আমি।”

ক্যানিয়লের কথাগুলো জুহি বিশেষ গায়ে না মাখলেও কথাগুলো ইরতিজা ভালো করে খেয়াল করলো। একটা লাইন বিশেষভাবে প্রভাব ফেললো তার মস্তিষ্কে, ‘কারণ আমি অবহেলায় বাড়ন্ত!’ এটার মানে কী?

ক্যানিয়ল থাকলো না বেশিক্ষণ। যাওয়ার আগে সামুরাকে কী যেন বলে গেল। আর যাওয়ার ক্ষণে বললো ইরতিজাকে। ইরতিজা তখন চেয়ারে বসে ছিল। হাতে ছিল একটা সাদা বুনোফুল। ইরতিজার দিকে এগিয়ে এসে ওর মাথার উপর শূন্যে হাত রেখে বললো,
“এখন আর তোমার চুলগুলো চাইলেই হাত দিয়ে এলোমেলো করে দেওয়া যাবে না পাকিস্টানি গার্ল।”
বলে সে আপন মনে হাসতে হাসতে চলে গেল।
ইরতিজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল যতক্ষণ না ক্যানিয়ল চোখের আড়াল হয়ে গেল।
তার নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকার ধরন এবার পরিবর্তন হলো ফোনের রিংটোনের শব্দে। মোবাইল বের করে সাজিদের নামটা দেখতে পেল। সাজিদের নাম দেখে ইরতিজার শরীর দুর্বল হয়ে এলো। হঠাৎ খুব ক্লান্ত অনুভব করলো সে। কল রিসিভ করে কথা বলতে খুব ক্লান্ত লাগছে। কল রিসিভ না করে মোবাইল সাইলেন্ট করে চোখ বুজলো সে। সাজিদের জন্য আসলেই মেয়ে খোঁজা শুরু করবে কি না ভাবছে। লোকটার জন্য একটা মেয়ে খুঁজে পেলেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যেতো। ঝামেলা আর ভালো লাগছে না! কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে সাজিদকে একটা ম্যাসেজ টাইপ করতে লাগলো,
‘আগামী তিন দিনের ভিতরই আপনার জন্য বউ খোঁজার কাজ সম্পন্ন করবো সাজিদ। আপনার হবু বউ পরিচয়ে থাকতে একদম…”

ইরতিজার ম্যাসেজ টাইপিংয়ের মধ্যেই হঠাৎ জোনাসের ম্যাসেজ এলো। কী-বোর্ডে চলিত হাত থেমে গেল ইরতিজার। সে সাজিদকে ম্যাসেজ না পাঠিয়ে জোনাসের ম্যাসেজ সিন করলো। চোখ ছানাবড়া হলো তার। শুধু চোখই বিস্মিত হলো, না সাথে মনও বিস্মিত হয়েছে বোঝা গেল না। জোনাস একটা মেয়ের সাথে সেলফি পাঠিয়েছে তাকে। সাথে দিয়েছে একটা ম্যাসেজ,
‘পিকটা কেমন টিজা? সুন্দর না? এটা আমার গার্লফ্রেন্ড। প্রোপোজ করার পর তোমার মতো রিজেক্ট করে দেয়নি, বরং সাদরে গ্রহণ করেছে।’

_______________

বাবার পাশে বসে আছে ইরতিজা। কেমন মনমরা দেখাচ্ছে তাকে। হৃদয় কালো পুঞ্জমেঘ ঢেকে ফেলছে। মানুষ সর্বদা তার সাথে মজা করে। সে কি মজার পাত্রী? কেন এরকম মজা করলো জোনাস? ইরতিজা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। নিউ ইয়র্কের ফ্রেন্ড নাবাকে কল দিয়ে জেনেছে ইরতিজা–জোনাসের কারো সাথে রিলেশনশিপ তৈরি হয়নি। জোনাস যার সাথে ছবি দিয়েছে ওটা জোনাসের কাজিন।

আজাদ চৌধুরী এতক্ষণ চুপ ছিলেন। তার মেয়ে সাধারণত মন খারাপ থাকলে এমন নীরব থাকে। চেয়েছিলেন কিছু বলবেন না, কিন্তু আবার প্রশ্ন করলেন,
“কী হয়েছে তোমার?”

“আব্বু…” মন্থর ক্লান্ত কণ্ঠে ডাকলো ইরতিজা।

“বলো।”

“আমি সাজিদ আহসানকে বিয়ে করবো না!”

আজাদ চৌধুরী বিচলিত হলেন না। শান্তভাবে প্রশ্ন করলেন,
“কেন?”

এই প্রশ্নের উত্তর নেই। কেন জানে না। শুধু জানে সাজিদকে সে কখনোই বিয়ে করতে পারবে না। উঠে দাঁড়ালো ইরতিজা। বললো,
“ওনাকে বিয়ে না করার কোনো কারণ নেই, তারপরও ওনাকে বিয়ে করবো না আমি।”

“আচ্ছা?”

“হ্যাঁ।”

আজাদ চৌধুরীও উঠে দাঁড়ালেন। বেশ শান্ত স্বরে বললেন,
“আর কখনও এমন করে বলবে না। এটা ছেলেখেলা নয়।”

সে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ইরতিজা বললো,
“হ্যাঁ এটা ছেলেখেলা নয়। আর আমিও ছেলেমানুষি করছি না। আব্বু…”

ডেকেও আর সাড়া পাওয়া গেল না আজাদ চৌধুরীর। অসহায়ত্ব বোধ ইরতিজার ভিতরকে একেবারে দুর্বল করে দিলো। বুক চিরে দুর্বল নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। আকাশের দিকে তাকালো। সন্ধ্যাতারা মিটমিট করে জ্বলছে। মৃদু বাতাস বইছে। আজ শীত অনেক কম। বেশি পুরু কাপড় জড়ানোর প্রয়োজন পড়েনি। ইরতিজা ঘাসে মোড়ানো জমিন পেরিয়ে রাস্তায় উঠে এলো। হাঁটতে লাগলো শিথিল পা ফেলে। নিজের জীবনটাকে কেমন এলোমেলো, অগোছালো মনে হয়!
কতক্ষণ হেঁটেছে, কতটুকু হেঁটে এসেছে খেয়াল নেই ইরতিজার। কানে ভেসে আসা অদ্ভুত ধরনের শব্দে সে দাঁড়িয়ে গেল। ভালোভাবে শব্দ অনুধাবন করার চেষ্টা করলো। কেমন হট্টগোলপূর্ণ শব্দ। মনে হচ্ছে কেউ কাউকে আঘাত করছে। পালাক্রমে আঘাত-প্রতিঘাত চলছে। কোথায় হচ্ছে এই হট্টগোল? ইরতিজা আশেপাশে তাকালো। শব্দটা মূলত সামনে থেকে আসছে। সামনে রাস্তার বাম দিকে যে বাঁক আছে ওখানে হচ্ছে। ইরতিজার হঠাৎ ভয় করতে লাগলো। তবুও ভয়ে কৌতূহল কমলো না। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। রাস্তার বাঁকের মুখে এসে দাঁড়াতেই সামনের দৃশ্যটা দেখে বিস্ময়ে চোখ বিস্ফোরিত হলো তার। হ্যাঁ সত্যিই মারামারি চলছে এখানে! হকিস্টিক দিয়ে সোনালি চুলের ছেলেটাকে যে মানুষটা আঘাত করে চলেছে সে তো ইরতিজার পরিচিত। পুরো বিষয়টা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল ইরতিজা। এখানে মোট ছয়-সাতজন উপস্থিত। একে অপরকে আঘাত করতে ব্যস্ত এরা। ইরতিজার চোখ সবাইকে উপেক্ষা করে একজনের উপরই স্থির হয়ে আছে। পুরো দৃশ্যটা তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়েছে। সোনালি চুলের ছেলেটাকে দুর্বল হয়ে পড়ে যেতে দেখা গেল। ইরতিজার পরিচিত মানুষটা তার দিকে ফিরলো ঠিক তখনই। মানুষটার দৃষ্টি সব সময়ের মতো পরিচিত মনে হলো না। খুব ভয়ঙ্কর লাগলো। রক্তহিম করা চাহনিতে বললো,
“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমিও কি মার খেতে চাও পাকিস্টানি গার্ল?”

কথাটায় ইরতিজার হৃৎপিণ্ড আঁতকে উঠলো। এতটাই ভয় পেল যে দৌড়ে চলে এলো ওখান থেকে।

(চলবে)