উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-৮+৯

0
226

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৮
__________________

ক্যানিয়লের যখন ঘুম ভাঙে তখন তার শরীর ছিল ঘর্মাক্ত। দরদর করে ঘাম ঝরছিল তার শরীর থেকে। কাঁপছিল শরীর। স্বপ্ন দেখেছে সে। স্বপ্নটা মারাত্মক না হলেও এটা তার কাছে অতি মারাত্মক। সে দেখেছে একজনের চলে যাওয়া, দেখেছে একটা ছোটো ছেলের একাকী কষ্টে থাকার দৃশ্য। এই স্বপ্নটা এখনও পীড়া দেয় তাকে ভাবতে অবাক লাগে! শ্বাসভারী হয়ে বুক দ্রুত ওঠানামা করছিল। ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করলো ক্যানিয়ল। ধূসর রঙের গেঞ্জির উপর কালো হুডিটা পরে নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখ দুটো লাল দেখাচ্ছে। চেহারাটা ফ্যাকাশে, চুল উশখুশ। দেখে ক্যানিয়লের নিজেরই বিরক্ত বোধ হলো। ঢুকে গেল ওয়াশরুমে।
ওয়াশরুম থেকে যখন বের হলো তখন তার ফোনটা বাজছে। মোবাইলের কাছে এসে দেখলো ‘Little brother’ লেখা নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিসিভ করে বললো,
“কী খবর?”

“কোথায় আছো তুমি?”

“মাই সেকেন্ড হোম, আই মিন এন্ডারসন হাউজে আছি। কোনো প্রয়োজন?”

“এখনই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দাও।”

“কেন?”

“মাদার বেলা এসেছে…”

ক্যানিয়লের ভ্রু অপ্রতিভ কুঁচকে উঠলো। কল কাটার পর সে এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে একটা কালো পুরু কোট চাপিয়ে বের হলো এন্ডারসন হাউজ থেকে। গাড়িটা বাড়ির সামনে পার্ক করা। রিমোট চেপে লক খুলে দ্রুত গাড়িতে ঢুকলো। তার মেইন বাড়ি এখান থেকে পনেরো মিনিটের পথ। যেতে যেতে তার মাথায় যে প্রশ্ন জাগ্রত হলো, তা হলো- মিস বেলা লিমাস এখানে কেন এসেছে?
মিস বেলা লিমাসের সাথে ক্যানিয়লের শেষ দেখা হয়েছিল আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে। ক্যানিয়লের সব মনে আছে। সেদিন মিস বেলার সাথে সে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ আচরণ করেছিল। মিস বেলা ইউরোপ চলে যাবে বিধায় দেখা করতে এসেছিল। সেদিন ক্যানিয়ল বলেছিল, আর জীবনে কোনোদিন যেন মিস বেলা তার মুখোমুখি এসে না দাঁড়ায়। বেলা লিমাসের মুখ দেখতেও তার ঘৃণা হয়। এই ঘৃণার থেকে চির জীবনের জন্য যেন মুক্তি পায় সে। হ্যাঁ, এসব বলেছিল! কিন্তু বেলা লিমাস ইউরোপ থেকে ফিরে তার সাথে দেখা করতে এসেছে। কেন এসেছে? সে আসলেই ঘৃণা বোধ করে মিস বেলা লিমাসের প্রতি।
বাড়ির সামনের রোডে গাড়ি থামালো ক্যানিয়ল। মিস বেলা লিমাসকে দেখতে পেয়েছে। রাস্তার পার্শ্বে একাকী দাঁড়িয়ে আছে। ক্যানিয়লকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে বেলা লিমাসের মুখে হাসি ফুঁটলো। ক্যানিয়লের দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে ওর গালে হাতের পরশ বুলিয়ে বললো,
“কেমন আছো ক্যানিয়ল?”

ক্যানিয়ল বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“স্টপ ইট…” বলে বেলা লিমাসের হাতটা সরিয়ে দিয়ে প্রায় চ্যাঁচানো গলায় বললো,
“কেন এসেছো তুমি এখানে? বলেছিলাম না আমার সাথে আর কখনও দেখা করার চেষ্টা করবে না? দেখা করার জন্য একেবারে এই বাড়িতে এসে কীভাবে উপস্থিত হয়েছো? লজ্জা করছে না তোমার? আমার তো লজ্জা করছে! প্লিজ, তুমি চলে গেলেই খুশি হবো।”

বেলা লিমাসের চোখে অশ্রু টলমল করছে। কণ্ঠে কষ্টের ফোয়ারা নিয়ে বললো,
“এরকম করে বলো না ক্যানিয়ল। ইউরোপ থেকে ফিরেই তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি, আর তুমি…”

“না, কোনো প্রয়োজন তো নেই আমাকে এরকম ভাবে দেখতে আসার। নিষেধই তো করে দিয়েছি আমাকে দেখতে আসবে না। যখন তোমার আমাকে দেখার প্রয়োজন ছিল তখন দেখোনি। এখন আর আমাকে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি নিজেকে নিজে দেখতে পারি এখন।”

মিস বেলার মুখে আর কথা ফোঁটে না। শুধু চোখ ফেঁটে এক ফোঁটা স্বচ্ছ নয়ন জল গড়িয়ে পড়লো।
ক্যানিয়লের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। হৃদয় মুমূর্ষু। এই মুমূর্ষু অবস্থায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছে। বললো,
“ড্যাড নিশ্চয়ই দেখেনি তোমায়। সে দেখার আগেই চলে যাও। আমি চাই না ড্যাড তোমার মুখ দর্শন করুক।”

মিস বেলা ঈষৎ মাথা দোলালো। হাতের গোলাপি ফিতায় বাঁধা কালো বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“টেইক ইট।”

“অন্যের কাছ থেকে কিছু নিই না। বিশেষ করে যাকে ঘৃণা করি তার কাছ থেকে তো কিছু নেবোই না। আমার যা খুশি তা আমি নিজেই কিনতে পারি।”

ক্যানিয়ল উপহার গ্রহণ না করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গাড়ি স্টার্ট করে বাড়ির ভিতর ঢুকলো। পুরোনো ক্ষততে আগুনের উত্তাপ লেগেছে। ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় জ্বলছে।
গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে নামলো ক্যানিয়ল।
সামুরা গ্যারেজে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাইকে জিজ্ঞেস করলো,
“দেখা হয়েছে?”

“হলো।”

“ইউনিভার্সিটি যাবে না মনে হচ্ছে?”

“না।”

সামুরাকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ক্যানিয়ল চলে গেল।
সামুরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির রিমোট চাপলো।

______________

রাতে শীত বাড়ে। আজ তো আবার তুষারপাত হয়েছিল। গায়ে মোটা উষ্ণ কাপড় না জড়ালে শীত থেকে বাঁচা দায়। তুষারপাত মারাত্মক ছিল না, হালকা ছিল। রাস্তা থেকে তুষারপাত অপসারণ করা হয়েছে। রাতের রাস্তায় হাঁটছে ইরতিজা। পাশে জুহি। জুহি বকবক করে চলছে। নিজের ফ্রেন্ড সার্কেল সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। আজ ইরতিজা ভার্সিটি গিয়েছিল। এরপর থেকে নিয়মিত যাবে। সেই আন্দ্রেজ নামের ছেলেটাকে আজ দেখেছে। ছেলেটার জন্য মায়া অনুভব হয় তার। কী ভীষণ ভালো ছেলেটা! মিশুক। জুহির প্রত্যেকটা ফ্রেন্ডকেই মিশুক দেখেছে সে। শুধু একজনকে কেমন একটু লাগলো। মেয়েটার নাম, অ্যানডি। মেয়েটা বোধহয় পছন্দ করেনি তাকে। তাতে কিছু যায় আসে না ইরতিজার। একটা মানুষকে যে সবার ভালো লাগতে হবে এর কোনো মানে নেই।
আশেপাশের জাগতিক সব কিছুর মাঝে ইরতিজার মনে বার বার জোনাস উঁকি দিয়ে উঠছে। ছেলেটা তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। সেদিন ফোন করে ওসব বলার পর কী যেন হয়েছে ইরতিজার। বার বার তার মন স্মরণ করে চলছে জোনাসকে। অথচ কথা ছিল কী? কথা ছিল সে মনে করবে না জোনাসকে। ওদিকে সাজিদও ফিরে আসবে খুব শীঘ্রই। সাজিদের প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায়নি। মনে হচ্ছে সাজিদ ফিরে আসলে সে খুশি, অখুশি কিছুই হবে না।
ইরতিজার খুব কাছ থেকেই একটা সাইকেল পাশ কাটিয়ে গেল। ইরতিজা এবং জুহি চোখের পলকে ঘটে যেতে দেখলো একটা দুর্ঘটনা। ইরতিজার পাশ থেকে যে সাইকেলটা গিয়েছিল সেটা একটু সামনে যেতেই পড়ে গিয়েছে। ইরতিজা, জুহি জায়গাতেই দাঁড়িয়ে গেল। সাইকেল চালক সাইকেল থেকে একটু দূরে ছিটকে পড়েছে। একটু আর্তনাদ করতে শোনা গেল। উঠতে উঠতে একটু সময় লাগলো তার। ব্যথা পায়নি তেমন। শক্ত শরীরে খুব সহজে ব্যথা লাগেও না। সে উঠে দাঁড়িয়ে যখন সম্মুখে তাকালো ইরতিজা চমকে উঠলো। সেই সেরা পাজি ছেলেটা না?
ক্যানিয়ল ওদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“পিছন থেকে কে ধাক্কা দিয়েছে আমাকে?”
ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“পাকিস্টানি গার্ল, তুমি করেছো এটা? না কি তুমি?”
শেষ প্রশ্নটা জুহির দিকে ছুঁড়লো।

ইরতিজা হতভম্ব। নিজে নিজে সাইকেল নিয়ে পড়ে বলছে তাকে ধাক্কা দিয়েছে কে! জুহি পাশ থেকে বললো,
“তুমি ভুল করছো। তোমাকে কেউ ধাক্কা দেয়নি। তুমি এমনিতেই পড়ে গিয়েছো!”

ক্যানিয়ল অতি বিরক্তির সহিত জুহির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমাকে ভুল ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করো না। তুমি কি ভেবেছো, তোমাকে আমি চিনি না? ইউ আর আ প্লে গার্ল!”

বিস্ময়ে জুহির মুখ হা হয়ে গেল,
“আমাকে বলছো?”

“ইয়াহ, ইউ আর আ প্লে গার্ল!”
ক্যানিয়ল এ বিষয়ে কথা বাড়তে না দিয়ে বললো,
“আমি স্পষ্ট পিঠে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করেছি। ওই হাত যে তোমাদের কোনো একজনের হাত এটা স্পষ্ট। বলো, কে দিয়েছো ধাক্কা? হেই পাকিস্টানি গার্ল, তুমি করেছো এটা? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এটা তুমিই করেছো। শ্বাস রোধ করে মারতে না পেরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে মারতে চাও? আমার ধারণা তো বিন্দুমাত্র মিথ্যা নয়। তুমি আসলেই একজন আততায়ী! কী সাংঘাতিক, ধাক্কা দিয়ে মারতে চাও!”

ইরতিজার মেজাজ চটে গেল,
“দেখো আমরা কেউই তোমাকে ধাক্কা দিইনি। নিজে নিজে সাইকেল নিয়ে পড়েছো। আর আমি পাকিস্তানি নই, আমি বাংলাদেশি। বাংলাদেশ থেকে এসেছি আমি।”
ইরতিজা লক্ষ করেছে ছেলেটা তাকে ‘পাকিস্তানি গার্ল’ বলে। শারীরিক রূপ দেখে, না কি পোশাক দেখে এমন ভাবছে বুঝতে পারছে না। কী দেখে যে কী ভাবছে সেই ভালো জানে!

ক্যানিয়ল চোখ সরু করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দেখলো ইরতিজাকে। বললো,
“তুমি পাকিস্টানি নও?”

“না।”

“মিথ্যা বলছো। তুমি অবশ্যই পাকিস্টানি।”

“আমি বলছি আমি পাকিস্তানি নই, তারপরও তুমি বলবে আমি পাকিস্তানি?”

“আমি শিওর তুমি পাকিস্টানি। থাক, এ টপিক বাদ দিই। ধাক্কা কে দিয়েছো সেটা বলো? তুমিই দিয়েছো, তাই না?”

ইরতিজা রেগে গিয়ে কটমট করে তাকালো।
ক্যানিয়ল বললো,
“এরকম করে তাকিয়ো না। ডাক্তারদের আমি অপছন্দ করি, নয়তো তোমার চোখ ডাক্তারের মাধ্যমে তু’লে ফেলতাম!”

জুহি গর্জে উঠে বললো,
“তুমি কার সামনে কাকে কী বলছো ক্যানি? ও আমার কাজিন। আমার কাজিনকে এমন করে বললে আমি মোটেও সহ্য করবো না।”

“ও-হো, তোমার কাজিন? বংশ গতই তাহলে তোমরা বাজে!”

জুহি কিছু বলার জন্য মুখ খোলা দিলেই ক্যানিয়ল থামিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমার কাজিনকে বলে দাও, আমি মানুষটা…”
ক্যানিয়ল থামলো। অদ্ভুত ভাবে হেসে বললো,
“তুমি তো জানো আমি কেমন! সেটাই ওকে বলবে। নিজের গ্যাংয়ের কথায় যদি ও বার বার এমন করে তাহলে হাত-পা একটাও আস্ত রাখবো না।”

ক্যানিয়ল অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। যেতে যেতে সাইকেলের কাছে গিয়ে সজোরে একটা লাথি মারলো সাইকেলের গায়ে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে এক সময় চোখের অদৃশ্য হয়ে গেল।

ইরতিজা অনিমেষ তাকিয়ে ছিল। জুহির কথায় ধ্যান ভাঙলো,
“তুমি যে পাজি ছেলেটার কথা বলেছিলে সেটা কি এই ক্যানিয়ল?”

“হ্যাঁ, এই ছেলেটা।”

জুহি কিছু বললো না, কেমন অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। ইরতিজা বললো,
“তুমি চেনো এই ছেলেটাকে? কীভাবে চেনো?”

“রেডমন্ডে থাকি, ওকে চেনা এমন কী ব্যাপার?”

“হ্যাঁ, সেটা ঠিক।”

জুহি একটু কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“ইউ নো টিজা? ক্যানিয়ল কিন্তু মুসলিম।”

বিস্ময় স্ফূর্ত হলো ইরতিজার চোখে। মুখ ফসকেও বিস্ময়ের ধ্বনি বেরিয়ে এলো,
“মুসলিম?”

জুহি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।

“কিন্তু ওর নাম তো ক্যানিয়ল।”

“তো? ক্যানিয়ল নাম হতে পারে না?”

“আমি তো ভেবেছিলাম ও ক্রিশ্চিয়ান। নাম শুনেও তো কেমন ক্রিশ্চিয়ান ক্রিশ্চিয়ান মনে হয়। একটা মুসলিম ছেলের নাম ক্যানিয়ল হতে যাবে কেন? তুমি কি মজা করছো আমার সাথে?”

“ও আসলেই মুসলিম। শুনেছিলাম ওর দাদা পনেরো বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ক্যানিয়ল নামটা দিয়ে কি আর ধর্ম যাচাই করা যায়? হতেই পারে এ নাম। আর ক্যানিয়ল তো ওর নিক নেম। ওর আসল নাম তো অন্য কিছু।”

ইরতিজা বিস্মিত, অবাঞ্ছিত। সে ভাবতেই পারেনি ওই পাজি ছেলেটা মুসলিম হতে পারে। এটা ভাবনায় আসারও কথা নয়। জিজ্ঞেস করলো,
“আসল নাম কী তাহলে?”

“আসল নাম…আসল নাম হচ্ছে…ওই…ওই…” বলতে গিয়ে থতমত খেতে লাগলো জুহি। আসল নাম কী ক্যানিয়লের? মনে পড়ছে না। ইরতিজার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,
“আসল নাম তো মনে পড়ছে না।”

নামটা জানতে না পেরে ইরতিজার খারাপ লাগলো। রাস্তায় পড়ে থাকা সাইকেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সাইকেলটার কী করবে? এভাবে ফেলে রেখে গেল কেন সাইকেলটা?”

জুহি সাইকেলটার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। ইরতিজাকে বললো,
“এসো এটাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে রাখি।”

বাড়ি ফিরে দেখলো মা রান্না করছে। সাহায্য করার জন্য ইরতিজা রান্নাঘরে ঢুকলো। কী করবে জিজ্ঞেস করলে মা প্রথমে কিছু বললো না। তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করার পর বললো,
“পেঁয়াজ কাটো।”

ইরতিজা চপিং বোর্ডের উপর পেঁয়াজ রেখে কাটতে লাগলো। একটুর ভিতরই চোখে জল থলথল করে উঠলো। তবুও কাজ থামলো না। পেঁয়াজ কাটাকালীন শারমিন আহমেদ ইরতিজার হাত লক্ষ করলেন। হাতে আংটি না দেখে বললেন,
“তোমার হাতের আংটি কোথায় ইরতিজা?”

ইরতিজা ঘাবড়ে গেল। উত্তর তৈরি করা কিন্তু অপ্রস্তুত ভাবটা চলেই এলো তার মাঝে। এতদিন যখন কেউ খেয়াল করেনি বিষয়টা, আজকে কেন করতে হলো তাহলে? অপ্রস্তুত ভাবটা গিলে বললো,
“আঙুলে দাগ পড়ে যাচ্ছিল, তাই খুলে রেখেছিলাম।”

শারমিন ইরতিজার হাতটা হঠাৎ নিজের হাতে নিয়ে এলেন। হাত ভালো করে দেখে বললেন,
“কোথায় তোমার আঙুলে দাগ?”

ইরতিজার ভয় করতে লাগলো। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছিল। এমন সময় লিভিং রুম থেকে ডাকটা দুঃসময়ের বন্ধু হয়ে ছুটে এলো,
“টিজা…”

রিশনের গলা। ইরতিজা ব্যাপারটা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে বললো,
“রিশন ডাকছে।”
বলে মায়ের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে এনে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো দ্রুত।
লিভিং রুমে এসে দেখলো নওরিন ফিরে এসেছে। রিশনের সাথেই গিয়েছিল শপিং মলে। রিশন ইরতিজার গলায় একটা নীল স্কার্ফ পেঁচিয়ে দিয়ে বললো,
“আমার চ্যানেলের ভিডিয়োগুলো এখনও দেখোনি তুমি। সব ভিডিয়োগুলো দেখবে কিন্তু, ঠিক আছে?”

রিশন দু হাত দিয়ে ইরতিজার দুই গাল টেনে দিয়ে হেসে চলে গেল।
ইরতিজা অপলক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। রিশন আবারও তার গাল টেনে দিয়েছে! সত্যিই বাচ্চা ভাবে না কি তাকে? আর স্কার্ফ দিয়ে ভিডিয়ো দেখার কথা কেন বললো? ভিডিয়ো যাতে দেখে সেজন্য কি ঘুষ দিলো?

_________________

ফজরে সালাত আদায়ের জন্য আব্বু ডেকে দেওয়ার পর আর ঘুম হয়নি ইরতিজার। নামাজ পড়ে বাসার ভিতর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেছে। এরপর রিশন যখন ওয়াকিংয়ের জন্য বাইরে বের হচ্ছিল তখন ওর সাথে বের হয়েছিল। ওয়াকিং শেষে বাসায় ফিরে অবাক হলো ইরতিজা। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল হাস্যজ্জ্বল মানব মুখটির দিকে। অকারণেই হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে চললো!

(চলবে)

_________
#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৯
__________________

“আমি কি ভূত? না কি অদ্ভুত কোনো প্রাণী? এরকম ভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

সাজিদের কথায় সম্বিৎ ফিরলো ইরতিজার। বললো,
“আপনি এখানে কীভাবে?”

“যেভাবে থাকা যায়।”

ইরতিজা কয়েক কদম এগিয়ে এলো। সাজিদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে ইরতিজার মুখোমুখি হলো।
ইরতিজা বললো,
“আপনার সাথে তো গতরাতে কথা হয়েছিল আমার। বলেছিলেন আপনি নিউ ইয়র্ক আছেন। তিন দিনের আগে ফিরবেন না। কিন্তু এখন যখন আপনি এখানে, তাহলে তো কাল সিয়াটল থেকে আমাকে কল করেছিলেন। মিথ্যা কেন বললেন আপনি?”

“বলে ভালো করিনি? সারপ্রাইজড হওনি?”

“না, হইনি। মিথ্যা কথা আমি পছন্দ করি না।”

ইরতিজা নিজের কাছেই নিজে ভীষণ লজ্জিত হলো। এ কথা তার মুখে ঠিক মানায় না। সে নিজেও তো বউ খুঁজে দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে সাজিদকে মিথ্যা বলে। ইরতিজার চেহারা তিতকুটে রূপ নিলো। সাজিদ আরও তেতো ভাব ঢেলে দিয়ে বললো,
“হাতের আংটি খুলে রেখেছো?”

এটা তো প্রশ্ন নয়, সাক্ষাৎ বিষ হয়ে কানে ঢুকলো ইরতিজার। অন্তর পর্যন্ত বিষাক্ত হয়ে উঠলো বিষের প্রকোপে।
“হ্যাঁ খুলে রেখেছি। খুলে রাখতেই পারি। এটা একান্ত আমার ইচ্ছা। এটা নিয়ে আবার প্রশ্ন করার কী আছে?”
ইরতিজা বিষয়টা এড়াতে বললো,
“আপনাকে কিছু খেতে দিয়েছে?”

“আপনাদের সাথে ব্রেকফাস্ট করবো।”

“ভালো…”
বলে রুমের দিকে অগ্রসর হলো ইরতিজা। এরপর দ্রুত শাওয়ার সেরে নিলো। রুমে ঢুকে দেখলো সাজিদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

“কী করছেন?” প্রশ্ন করলো ইরতিজা।

সাজিদ ঘুরে তাকালো। এগিয়ে এলো ইরতিজার কাছে। ইরতিজার খুলে রাখা আংটি ওর আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বললো,
“সব সময় পরে থাকবেন। আর কখনও যেন এই আঙুলটা আংটি ছাড়া না দেখি।”

ইরতিজা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। লোকটা কি তাকে হুকুম করছে? তাকে হুকুম করার অধিকার কোথায় পায়? ইরতিজা এ সম্মন্ধে কিছু বলতে চাইলেই সাজিদ তার আগে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
ইরতিজা ব্রেকফাস্ট করার মুড হারালো। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বের হলো রুম থেকে। লোকটা তাকে হুকুম করার সাহস করে কীভাবে? হুকুম মানতে কি সে বাধ্য? আংটি আবারও খুলে রেখেছে। দেখবে কী হয় তাতে!

“তুমি বাইরে বের হচ্ছো, ব্রেকফাস্ট করবে না?”
হঠাৎই আব্বুর প্রশ্ন কানে এলো।

ইরতিজা পিছন ফিরে দেখলো আব্বু তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ইরতিজা বললো,
“ক্যান্টিনে করে নেবো।”

“সাজিদ এসেছে, তোমার অবশ্যই আমাদের সাথে বসে ব্রেকফাস্ট করে যাওয়া উচিত।”

ইরতিজা কিছু বলার আগেই শারমিন আহমেদ এসে বললেন,
“এক পা’ও নড়বে না কোথাও। ব্রেকফাস্ট করে তারপরই বাসা থেকে বের হবে। নয়তো আজ পুরো দিনে বাসার কোনো খাবার তুমি পাবে না।”
কাঠ কাঠ কথাগুলো বলে চলে গেলেন শারমিন। ইরতিজাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। ইরতিজা বাবার দিকে তাকালো। বাবা বললেন,
“এসো।”

বাধ্য হয়ে ব্রেকফাস্টটা সেরে নিতে হলো ইরতিজার। বাসা থেকে বের হলো সাজিদের সাথে। সাজিদ বললো,
“এসো, তোমাকে ড্রপ করে দিই।”

“থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু আমি আপনার সাথে যাব না।”

“কেন?”

“আমি জুহির সাথে যাব…আপু…”
নওরিনকে বাসা থেকে বের হতে দেখে ডাকলো ইরতিজা।

সাজিদ বললো,
“বোনকে কেন ডাকছো? আমার সাথে একা যেতে কি তোমার অস্বস্তি হবে? না কি ভয় পাচ্ছ?”

“আপনি কি ভয়ের মানুষ যে আপনাকে ভয় পাবো? উল্টো আপনার আমাকে ভয় পাওয়া উচিত।”

“কেন?”

“কারণ আমি মানুষটাই ভয় পাওয়ার মতো। ভীষণ ডেঞ্জারাস!”
বাঁকা হেসে চাচার ঘরে যাওয়ার জন্য ঘুরলো ইরতিজা। সাজিদ পিছন থেকে বলে উঠলো,
“আপনি মানুষটা বেহায়া ইরতিজা! আংটিটা আপনি খুলে রেখেছেন!”

ইরতিজা দাঁড়িয়ে গেল। নওরিন সাজিদের কথা শুনতে পেয়ে মুখ টিপে হাসলো।
এমন একটা অপমানের জন্য প্রস্তুত ছিল না ইরতিজা। রাগ-কষ্টে এখান থেকে ছুটে পালাতে ইচ্ছা করলো তার। বোনের সামনে এরকম অপমান কী করে করতে পারলো? একা থাকলে অনেক কিছু বলতো সাজিদকে। কিন্তু নওরিন থাকায় দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিলো। চুপচাপ এগিয়ে গেল ঘরের দিকে।

__________________

ঘাসের উপর নরম রোদের আলতো ছোঁয়া। রোদের উজ্জ্বলতা মেখে আছে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। ইরতিজা একা একা লনে বসে আশপাশে চোখ বুলাচ্ছে। জুহি তার দলবল নিয়ে কোথায় একটা চলে গেছে। ইরতিজাকে ডেকেছিল। সে যায়নি, যেতে ঠিক ভালো লাগেনি। তার চেয়ে এখানে বসে বসে ক্যাম্পাস দেখছে এটাই ভালো। ক্রাচে ভর দিয়ে কারো এগিয়ে আসার শব্দ ভেসে আসছিল কানে। ইরতিজার একবার চেয়ে দেখতেও ইচ্ছা হয়নি। জানে এটা আন্দ্রেজ। ইরতিজা তাকালো যখন আন্দ্রেজ তাকে ডাকলো,
“টিজা!”

তাকালো ইরতিজা। ‘টিজা’ তার আমেরিকা ভার্সন নাম হয়ে গিয়েছে। ইরতিজা উচ্চারণ করতে হিমশিম খায় বলে ছোটো করে সবাই ‘টিজা’ সম্বোধন করে। ভালো লাগে ‘টিজা’ সম্বোধনটা। তবে একজনের মুখে শুনতে একটু বেশি ভালো লাগে। আশ্চর্য রকম ভাবে যাকে ঘৃণা করে তার মুখেই শুনতে বেশি ভালো লাগে!
আন্দ্রেজ হাস্য মুখে মিষ্টি রঙের একটা ফুল বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“টেইক ইট টিজা।”

ইরতিজাও হাসি মুখে ফুল নিয়ে বললো,
“থ্যাঙ্ক ইউ।”

“এটা আমাদের ক্যাম্পাসেরই ফুল। অসংখ্য ফুল আছে এখানে। বসন্ত এলেই দেখতে পাবে। চেরি ব্লসমের গাছগুলো তো দেখেছো, তাই না?”

ইরতিজা মাথা দোলালো।

“বসন্ত পর্যন্ত ওয়েট করো চেরি দেখার জন্য।”

আন্দ্রেজ আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে গেল। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো ইরতিজা ঠাঁয় তাকিয়ে রইল। ছেলেটাকে এরকম হাঁটতে দেখলেই কষ্টের আলপিন ফুঁটে ওঠে হৃদয়ে। অন্যমনস্ক হয়ে গেল ইরতিজা। তাকিয়েই রইল। চোখের পলক পড়লো না। হঠাৎ ঘাড়ের পিছন থেকে একটা কণ্ঠ ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“আমাকে ফলো করতে করতে এখান অবধি এসে গিয়েছো?”

ধ্যান ভাঙলেই চমকে উঠে পিছনে তাকালো ইরতিজা। একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেল। কমলা রঙা চোখ দুটো চরম বিরক্ত নিয়ে তাকে দেখছে। ইরতিজা উঠে গেল বসা থেকে। ব্যাগটা পিঠে নিলো। ক্যানিয়লকে এখানে দেখে ভীষণ অবাক সে। এই সেরা পাজি এখানে কেন?

ক্যানিয়ল ভ্রু সংকুচিত করে ইরতিজার মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি একজন আততায়ী। কিন্তু এখন তো দেখছি তোমার মতলব ভিন্ন…”

“মানে?” গভীর বিস্ময় খচিত শব্দটা মুখ ছুটে বেরিয়ে এলো ইরতিজার।

ক্যানিয়ল সংকুচিত ভ্রু নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইরতিজাকে দেখলো ক্ষণকাল। তারপর ভ্রু জোড়া প্রসারিত করে বললো,
“আমার মতো সুদর্শন ছেলে দেখলেই কি প্রেমে পড়ে যেতে হবে তোমার?”

ইরতিজার বিস্ময় আকাশ ছুঁয়ে গেল,
“কী?”

ক্যানিয়ল অন্তঃ মাঝে অহংবোধ এনে বললো,
“লিসন, আমি একজন বড়ো লোক মানুষ! সোনার চামচ মুখে নিয়ে আমার জন্ম। যার-তার প্রেমে পড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সো আমার প্রেমে পড়ে কোনো লাভ নেই তোমার। একেবারে কোনো লাভই নেই।”

ক্ষিপ্রতার একটা ঢেউ ক্রমশ হেলেদুলে উঠছে ইরতিজার মাঝে। সেই ঢেউ সমুদ্র উপকূলে আঘাত হানলেই ইরতিজা বললো,
“আমি কি বলেছি আমি তোমার প্রেমে পড়েছি? ভাবো কী তুমি নিজেকে? কোন কারণে আমি তোমার প্রেমে পড়বো? আজব! মুখ সামলিয়ে কথা বলবে!”

ক্যানিয়ল ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বললো,
“অপরাধী কখনও স্বীকার করতে চায় না সে অপরাধ করেছে। আর তুমি তো প্রথম দেখাতেই মিথ্যাবাদী পরিচয় দিয়েছো।”

ইরতিজা মুখ খুলতে নিলেই ক্যানিয়ল হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আমার এনগেজড হয়ে গেছে। আমার উডবি ওয়াইফ দারুণ সুন্দর। তুমি তার সৌন্দর্যের কাছে অতি তুচ্ছ। আমার প্রেমে পড়া তোমার ঠিক মানায় না। দ্রুত তোমার মন থেকে আমার জন্য প্রেম অপসারণ করো।”

বলে ইরতিজার পাশ কাটিয়ে চলে গেল ক্যানিয়ল।
ইরতিজা পিছন থেকে বড়ো গলায় বললো,
“আমারও এনগেজড হয়েছে। আমার উডবি হাসব্যান্ডও অনেক সুদর্শন। নিজের সুদর্শন এবং ভালো উডবি হাসব্যান্ড থাকতে তোমার মতো পাজি ছেলের প্রেমে কেন পড়বো আমি? আমাকে কি পাগল ভাবো?”

ক্যানিয়ল বাঁকা চোখে পিছন ফিরে তাকালো। ইরতিজার আঙুল শূন্য দেখে হেসে বললো,
“মেয়েরা গল্প বানাতে দারুণ পারদর্শী! তুমি বোধহয় একটু বেশিই পারদর্শী পাকিস্টানি গার্ল।”

“আমি পাকিস্তানি নই।”

“তুমি পাকিস্টানি।”

“আমি বলছি তো, ‘না’।” বিরক্তি ঝরে পড়লো ইরতিজার গলায়।

ক্যানিয়ল ইরতিজার মাথা লক্ষ করে বললো,
“আজকে হিজাব পরোনি কেন?”
বলেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। দুই হাত প্রয়োগ করে এলোমেলো করে দিলো ইরতিজার চুল। এত দ্রুত এটা ঘটলো যে ইরতিজা কিছু বলারও সুযোগ পেল না। যখন বললো তখন তার পরিপাটি চুল অগোছালো।

“এটা কী করেছো তুমি?”
ঘটনাটায় এতটাই খারাপ লাগা অনুভব করলো যে, বিন্দু বিন্দু পানি কণিকা ভিড় জমালো ইরতিজার চোখের কোলে।

ক্যানিয়ল তা লক্ষ করে বললো,
“বলেছিলাম না তুমি একটা ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে? জাস্ট সহ্যযোগ্য নও তুমি। বিরক্তিকর!”

ক্যানিয়ল যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে দিলো। ইরতিজা ব্যস্ত হয়ে পড়লো চুল ঠিক করতে। দুই হাত দিয়ে কোনো রকম গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। হঠাৎ একটা কথা মনে উদয়মান হলো তার। ডাকলো ক্যানিয়লকে,
“শোনো।”

ক্যানিয়ল দাঁড়িয়ে পিছন ফিরলো।

ছেলেটা তার সাথে যা করেছে তাতে প্রশ্নটা একেবারেই করা উচিত নয়। কিন্তু কৌতূহল হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি মুসলিম?”

ক্যানিয়ল ওষ্ঠাধরে ফিচেল হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“কেন? মুসলিম হলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে?”

ক্যানিয়লের প্রত্যুত্তরে মুখ ভোঁতা হয়ে এলো ইরতিজার। রাগে কিড়মিড় করে বললো,
“বেয়াদব!”

ক্যানিয়লের ওষ্ঠ হতে হাসি মুছে মুখ কঠিন হলো। বললো,
“কী বললে? আবারও উর্ডু?”

ইরতিজা এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে এলো ওখান থেকে। জুহি আর ওর বন্ধুরা ঢুকছে ক্যাম্পাসে। ইরতিজা ওদের দেখে এগিয়ে এলো। বেথ নামের একটা মেয়ে বললো,
“তোমার চুলের এই অবস্থা কেন টিজা?”

“আসলে…” থেমে এলো ইরতিজার কণ্ঠ। কোনো উত্তর নেই তার কাছে। ক্যানিয়ল তার চুলের এই অবস্থা ঘটিয়েছে এটা কি বলা যায়? শুনলে সবাই হাসাহাসি করবে!

ইরতিজা অন্য কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টালো। কথাবার্তা চলতে লাগলো। তবে এই আসরে জুহি যে থেকেও অনুপস্থিত এটা অনেকেরই খেয়াল হলো না। সব সময়ের বকবক করতে থাকা মেয়েটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারো কথার দিকে ভ্রুক্ষেপও নেই তার। সে তাকিয়ে আছে দূরে আন্দ্রেজের দিকে। একটা চাপা রাগ অন্তঃকরণের সর্বত্র গ্রাস করে ফেলছে তার। ওই শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী মার্টার দিকে এরকম মুগ্ধতা নিয়ে কেন তাকিয়ে আছে আন্দ্রেজ? পছন্দ করে বলে কি নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে হবে? জুহি চুপচাপ নিজের দলের কাছ থেকে দূরে সরে এলো। এসে আন্দ্রেজের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“এটা তুমি ঠিক করছো না আন্দ্রেজ। এটা ইভটিজিং!”

আন্দ্রেজ বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“হোয়াট?”

“একটা মেয়ের দিকে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকাও ইভটিজিংয়ের ভিতরই পড়ে।”

“তাহলে তো বলতে হয় এদিক দিয়ে তুমি ভীষণ এগিয়ে।”

“মানে? কী বোঝালে এই কথা দ্বারা? আমি কি মেয়েতে আগ্রহী যে আমি এদিক দিয়ে এগিয়ে থাকবো?”

“সর্বদা যে ছেলেদের পটানোর চেষ্টায় থাকো সেটা ইউনিভার্সিটির অনেক অংশই জানে।”

আন্দ্রেজ জানে এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে জুহির সাথে তার তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যাবে। তাই এটা কাটাতে সে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। চলে আসতে আসতে শুনলো জুহির ক্ষুব্ধ কণ্ঠ,
“তোমাকে আমি আজ এই মুহূর্তে আমার ফ্রেন্ড সার্কেল থেকে বয়কট করলাম আন্দ্রেজ। আর কখনও আমার সামনে পড়বে না তুমি। আই হেইট ইউ!”

_________________

চিরকুটটার কথা একদম মনে ছিল না ইরতিজার। আজ ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার সময় ক্যানিয়ল তাকে হঠাৎ আলতো কণ্ঠে পিছন থেকে ডাকে,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল!”

পিছন ফিরলেই হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দেয় সে। ইরতিজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে কিছু না বলে শুধু হেসে চলে যায় ক্যানিয়ল। চিরকুট যে দিয়েছে এটা কেউ খেয়াল করেনি। ইরতিজা চাইছিল ওই সময়ই চিরকুটটা খুলে দেখবে, কিন্তু আবার কী ভেবেই পিছিয়ে যায়। কী না কী লিখেছে চিরকুটে এ ভেবে আর দেখারই ইচ্ছা হয়নি। ইরতিজা বুঝতে পারছে না ওই পাজি ছেলেটার সাথে তার এত কেন দেখা হচ্ছে? দুদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিল, আর আজ ভার্সিটিতে দেখলো। আজবভাবে কেন ছেলেটার এই ভার্সিটিতেই পড়তে হবে? জুহির কাছ থেকে জেনেছে, ক্যানিয়ল তাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র।

আকাশের গায়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র নক্ষত্র। নেইবরহুডদের বাড়িতে আলো জ্বলছে। সামনা-সামনি একটা বাড়ির সামনে পাতাহীন গাছ আছে। এই গাছটার পাতা ঝরে গেছে শীতের কারণে। গাছটার গায়ে জ্বলছে এখন রঙিন লণ্ঠন। অনেকগুলো লণ্ঠন টাঙানো হয়েছে ডালের সাথে। বাড়িটার মানুষজন বেশ শৌখিনপূর্ণ বলতে হয়। ইরতিজা চোখ সরিয়ে আনলো জানালা থেকে। চিরকুটটা খুলে দেখা উচিত। ব্যাগের ভিতর আছে। কী লিখেছে পাজি ছেলেটা কে জানে! অপমানজনক কিছু লিখে থাকলে এর শোধ কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দেবে। সে মোটেও অত সহজ মেয়ে নয়। চিরকুট বের করে ভাঁজ খুললো ইরতিজা। ইংলিশ অক্ষরে সুন্দর লেখাটা ফুঁটে আছে,
‘ইয়াহ, আই অ্যাম মুসলিম।
মাই নেম ইজ মুহাম্মদ উমরান ইবনে ইসহাক! ইউ ক্যান কল মি ক্যানিয়ল।’

এর একটু নিচে ছোটো অক্ষরে লেখা,
‘আচ্ছা, তোমার নাম কী?
ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে না কি?’

এর নিচেই আবার লেখা,
‘আমার প্রেমে পড়েছো ভালো কথা, তাড়াতাড়ি ভুলে যাও। আমাকে মনে রাখার যোগ্য নও তুমি। আমি ভীষণ স্পেশাল! তুমি এতটাই তুচ্ছ যে, তুমি আমার প্রেমে পড়েছো ভাবতে আমার লজ্জা হচ্ছে! সবাই যদি জেনে যায় তুমি আমার প্রেমে পড়েছো, তাহলে লোক সমাজে মুখ দেখানোর পরিস্থিতি থাকবে না আমার।’

(চলবে)
___________