উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-১০+১১+১২

0
214

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১০
__________________

কুয়াশার দল উড়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের আশপাশ দিয়ে। পাহাড়ের গায়ে তুষারের সাদা ছোঁয়া। আজ তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে। খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশকৃত দৈত্য হাওয়া শরীর ছুঁয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠছে লোম। প্রকৃতির এই শীতলতা শরীরে প্রভাব ফেললেও, মন অবধি পৌঁছতে পারছে না। মনের অবস্থা এখন কেমন? অগোছালো, এলোপাথাড়ি!
ক্যানিয়লের গায়ে মাত্র সাদা নরমাল একটা টি-শার্ট। ইচ্ছাকৃত সে এমন দাঁড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে পাহাড়ের ভিউ দেখছিল, আর ভাবছিল মিস বেলা লিমাসকে নিয়ে। মিস বেলা লিমাসকে নিয়ে ভাবতে গেলে হৃদয়ভার হয় তার। বিদঘুটে একটা কষ্ট গ্রাস করে নেয় হৃদয়ের খুঁটিনাটি। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো ক্যানিয়লের। পানির ঝাপটা এসে ঝাপসা করে দিলো দৃষ্টি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার কাচ টেনে দিলো। এসে বসলো কাউচে। তার সামনে দেয়ালে বিশাল আকৃতির একটা ছবি টানানো। ভাবলেশহীন চোখে ক্ষণ মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। ভাবলেশহীন! এতটুকু ভাবনা তার মন মাঝে জাগ্রত হলো না। সহসা এক সময় হেসে উঠলো। ছবিটা তার পরিবারের। সে সহ পরিবারের প্রতিটা সদস্য ছবির মাঝে উপস্থিত। এটা তোলা হয়েছিল গত বছরের উইন্টারে। ছবিটার একটা কপি সে বাধাই করে টাঙিয়ে রেখেছে এখানে। তার পরিবার যে খুব আজব একটা কারখানা এটা মানতে বাধ্য সে। তার বাবা মুহাম্মদ ইসহাক ইবনে মাসউদ, যে কি না চারটা বিয়ে সম্পন্ন করেছে! প্রথম স্ত্রী সোফিয়া নিঃসন্তান! সোফিয়া নিঃসন্তান হওয়ার দরুণ সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল ইয়াদাকে। ইয়াদার ঘরে দুই ছেলে এক মেয়ে। তৃতীয় বিয়ে করতে হয়েছিল ট্রাপে পড়ে, নাইলা সালেমকে। নাইলা সালেম ক্রিশ্চিয়ান ধর্মাবলম্বী ছিল। মুহাম্মদ ইসহাককে বিয়ে করার পূর্বে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। নাইলা সালেমেরও দুই ছেলে, এক মেয়ে। চতুর্থ বিয়ে যাকে করেছিল সেও ছিল ক্রিশ্চিয়ান। বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তার নাম বেলা লিমাস। বেলা লিমাসের এক পুত্র সন্তান হয়েছিল। বেলা লিমাস ছিল অল্প বয়সী। যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স ছিল সতেরো। আঠারো বছর বয়সে সে পুত্র সন্তানের জননী হয়েছিল।
মুহাম্মদ ইসহাক বিয়ে করেছিল চারটা। কিন্তু এখন তার ঘরে স্ত্রী আছে তিনজন। একজন চলে গেছে। চতুর্থ স্ত্রী, বেলা লিমাস। সে চলে গেলেও রেখে গেছে তার পুত্র সন্তান ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়লের বয়স তখন আট বছর। আট বছর বয়সে কতটুকু বড়ো ছিল সে? বড়ো তো ছিল না, ছোটো ছিল। মা চলে যাওয়ার পর ছোটো ক্যানিয়ল ডুবে গিয়েছিল এক সমুদ্র বিষাদে। কষ্ট, যন্ত্রণার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল তার চরণপানে। অতি কষ্টে সেই ঢেউ সামলে নিতে শিখেছে। ক্যানিয়লের স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটার কথা, যেদিন তার মা চলে গিয়েছিল রাজ প্রাসাদের মতো প্রাচুর্য ছেড়ে। বিষাদগ্রস্ত ছোটো রাজপুত্রকে একলা রেখে গিয়েছিল রাজ প্রাসাদে। সেদিন সে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। ঘুমের কড়া নড়েছিল মায়ের আলতো ডাকে,
“ক্যানি…ক্যানিয়ল!”

চোখ খুলে পিটপিট করে মায়ের দিকে তাকালো ক্যানিয়ল। অস্ফুট স্বরের শব্দটা মুখ ফুঁটে বেরিয়ে এলো,
“মম!”

উঠে বসলো সে। মায়ের মুখটা ভালো করে দেখে হৃৎপিণ্ড কম্পিত হলো। মায়ের চোখে অশ্রু টলমলে। জলের ফোয়ারা নেমে যাচ্ছে গন্ডদেশ পেরিয়ে। ছোটো ক্যানিয়ল উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কেন কাঁদছো মম?”

মা তাকে সন্তর্পণে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
“ড্যাডের কাছে ভালো থাকবে ক্যানিয়ল। এই জায়গাটা আমার জন্য নয়। এখানে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার। মুক্ত ভাবে নিঃশ্বাস নিতে হলে আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।”

“মম…” অবুঝ শিশুর মতো ডাকলো ক্যানিয়ল।

“আমার সাথে গেলে শুধু কষ্টই পাবে জীবনে! ড্যাডের কাছে থাকলে সুখী থাকবে। মাদার সোফিয়াও তোমায় ভালোবাসবে…”
বেলা লিমাস একটু থেমে বললেন,
“মম তোমায় অনেক ভালোবাসে ক্যানিয়ল, অনেক।”
ছেলের কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিলেন বেলা লিমাস। তারপর ছেলেকে বাহু বন্ধন হতে মুক্ত করে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। ক্যানিয়ল স্তব্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। শরীর মৃদু কাঁপছে তার। চোখের কোল বেয়ে শান্ত জলধারা চুপিসারে নেমে যায়। বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে সব কিছু যখন এলোমেলো করে দিলো, তখন সে চিৎকার করে ডেকে উঠলো,
“মম…”

অতীতের দৃশ্য হতে বেরিয়ে এলো ক্যানিয়ল। ওষ্ঠে দুর্বোধ্য হাসির রেখা জল ছলছল চোখের সাথে অদ্ভুত দেখালো। হাসতে হাসতে মুখে উচ্চারণ করলো,
“তুমি আমাকে ভালোবাসতে না মম!”

ঘর থেকে বের হয়ে অলিন্দে এসে দাঁড়ালো। এক কামরার ছোট্ট একটা ঘর। অনেক উঁচুতে। সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে উঠতে হয়। এটাকে সাধারণত ট্রি হাউজ বলে। এখান থেকে দেখা যায় একটু দূরে স্বচ্ছ জলের লেক। দেখা যায় বিশাল অরণ্য। অনেক বুনো ফুলের সাক্ষাৎ ঘটবে এই অরণ্যে। একেক জাতের ফুল নিজ সৌন্দর্য নিয়ে ফুঁটে থাকে। এর মাঝে ক্যানিয়লের সবচেয়ে পছন্দের হচ্ছে ভায়োলেট রঙের ফুল। ফুলটার নাম অজানা। তাই সে নিজে এর একটা নামকরণ করেছে, ‘ভায়োবিন’! নামটা একটু অদ্ভুত শোনালেও তার ভালো লাগে। ট্রি হাউজের পাশেই একটা গাছের সাথে দোলনা তৈরি করেছে। সে নিজে না। লিটল ব্রাদার সামুরা তৈরি করেছে। সামুরা ভাই-বোনদের ভিতর সবচেয়ে কনিষ্ঠতম। মিসেস নাইলা সালেমের সন্তান সে। ভাই-বোনদের ভিতর এই একজনকেই পেয়েছে যাকে দেখলে মনে হয় এ সত্যিই ভালোবাসে তাকে। ক্যানিয়ল টের পায় সামুরার হৃদয়ে তার জন্য ভালোবাসার সরল একটা স্থান আছে। অন্য ভাই বোনদের কেউ সত্যিকার অর্থে তাকে ভালোবাসে কি না জানে না। তবে ড্যাড যে তাকে সর্বাপেক্ষা একটু বেশি ভালোবাসে এটা সে জানে।
সম্পত্তি নিয়ে সকল ভাই-বোনদের মাঝেই একটা প্রতিযোগিতা মূলক মনোভাব বিরাজ করে সর্বদা। এই মনোভাব থেকে শুধু তার আর সামুরার নামটাই বোধহয় বাদ পড়বে। ড্যাড তার নামে সম্পত্তির বড়ো একটা অংশ লিখে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে। কিন্তু ক্যানিয়ল সেটা চায় না। কারণ সম্পত্তির বড়ো একটা অংশ যদি তার নামে লিখে দেওয়া হয় তবে সেটা কেউই মানবে না। ভাই-বোনদের সাথে বিরোধে জড়াতে চায় না সে। ড্যাডকে বলে দিয়েছে, সম্পত্তির সবচেয়ে ক্ষুদ্র ভাগটা তাকে এবং সামুরাকে দিলেই হবে। যেহেতু সে এবং সামুরা কেউই বিজনেস ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখেনি, সেহেতু এটাই তাদের প্রাপ্য। কিন্তু ড্যাড কথাটা মেনে নেয়নি। বুক চিরে হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ক্যানিয়লের।
ট্রি হাউজে আর থাকবে না। বাড়ি ফিরে যেতে হবে। গতকাল বিকেল থেকে সে এখানে আছে। অবসর সময়ে মাঝে মাঝে আসে এখানটায়। ভেবেছিল রাত্রিকালে জোনাকি দলের দেখা পাবে। কিন্তু আজব! তিনটা-চারটা জোনাকি ছাড়া আর জোনাকির দেখা পায়নি। মাঝে মাঝে এত এত জোনাকি এসে এখানটায় ভিড় করে যে সেই সময়টার বর্ণনা দিতে পারবে না ক্যানিয়ল। তখন সে শুধু মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করে জোনাকিদের ওড়া-উড়ি। নির্জন অরণ্যে একা জোনাকিদের সাথে কাটানো রাত্রিগুলো প্রতিবারই রোমাঞ্চকর হয়।

যাওয়ার আগে এক কাপ কফি বানিয়ে খেয়ে গেল ক্যানিয়ল। আর কিছুটি পেটে পড়েনি। গাড়ি পার্ক করে রেখে এসেছিল ট্রি হাউজ থেকে অনেকটা দূরে। এদিকে গাড়ি নিয়ে আসার কোনো ওয়ে নেই।
নিজ বাড়ি থেকে যখন চৌদ্দ-পনেরো মিনিট দূরত্বে তখন রাস্তায় দেখা হয়ে গেল ছিঁচকাঁদুনে মেয়ের সাথে। মেয়েটাকে পিছন থেকে দেখেছে সে। দেখে নিমেষেই কীভাবে যেন চিনে গেল। হাঁটার ধরনটা মূলত তাকে ধারণা দিয়েছে। দুষ্টু চিন্তার উদয় ঘটলো ক্যানিয়লের মস্তিষ্কে। সে গাড়ির কাচ নামিয়ে হাত বাড়ালো বাইরে। যখন মেয়েটার নিকটে চলে এলো, তখন বাড়ানো হাতটা দিয়ে মেয়েটার মাথায় থাকা শীত টুপিটা এক টানে খুলে হাতে নিয়ে এলো। পিছন থেকে ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো,
“হেই!”

গাড়িতে ব্রেক কষলো ক্যানিয়ল। জানালা দিয়ে মুখ বের করে পিছনে তাকালো।
ইরতিজার কপাল সংকুচিত হলো। ক্যানিয়লকে সে মোটেই আশা করেনি এটা তার চেহারাই বলে দিচ্ছে।
ক্যানিয়ল উচ্চৈঃস্বরে জানতে চাইলো,
“হোয়াট?”

“তুমি আমার মাথার টুপি নিয়ে গিয়েছো।”

ক্যানিয়ল হাতে থাকা টুপিটা দেখিয়ে বললো,
“এটা?”

“হ্যাঁ, ওটা।”

ক্যানিয়ল টুপিটা নিজের মাথায় পরে নিয়ে বললো,
“আমি কি মেয়ে টুপিতে দেখতে সুন্দর লাগছি?”
বলে ওষ্ঠ বাঁকিয়ে কেমন অদ্ভুত হেসে মাথা গাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একটু সামনে এগোতেই ইরতিজা পিছন থেকে চিৎকার করে উঠলো,
“স্টপ…”

গাড়ি থামলো। একটু পর গাড়ি থেকে নামতে দেখা গেল ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়ল বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে?”

ইরতিজা তড়িৎ গতিতে এগিয়ে এলো। এসেই হাত বাড়ালো ক্যানিয়লের মাথার দিকে। উদ্দেশ্য টুপি খুলে আনবে। কিন্তু ক্যানিয়ল ইরতিজার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে বললো,
“আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে হাত ভে/ঙে দেবো, আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বলে ইরতিজার হাতটা ছিটকিয়ে সরিয়ে দিলো।

ইরতিজার মুখ রাগে কম্পিত হচ্ছে। ছেলেটা তার মাথার টুপি চুরি করে নিয়ে গেছে, আবার বলছে হাত ভে/ঙে দেবে? এত সাহস?
ক্যানিয়ল ইরতিজার রাগান্বিত দৃষ্টি লক্ষ করে বললো,
“এরকম করে তাকাবে না, চোখের প্রতি মায়া করো। নয়তো চোখ বরাবর ঘু/সি মে/রে চোখের অবস্থা খা’রা’প বানিয়ে দেবো।”

“তুমি কি মানুষ? না কি অমানুষ?” রাগে কাঁপছে ইরতিজা।

“মানুষ মানুষই, অমানুষ কীভাবে হয়?”

“নিজেকে দেখলেই উত্তরটা পেয়ে যাওয়া উচিত তোমার। জীবনে কখনও আর তোমার সামনে পড়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই তোমার সাথেই কেন দেখা হয়ে যাচ্ছে? তোমার মতো পাজি একটা মানুষের সাথে দেখা হোক কখনও চাই না। তোমার সাথে যার একবার দেখা হয়েছে সেটাও তার জীবনে চরম একটা ভুল ছিল বলে আমার ধারণা। সেখানে এই ভুলটা কয়েকবার ঘটে গিয়েছে আমার জীবনে। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আমার। এত খারাপ কেন তুমি? কেন এত অহংকারী? কেন এত বেয়াদব?”
সবটুকু কথা শেষ করে শান্তি অনুভব করলো ইরতিজা। কালে কালে সে কম কিছু বলেনি।

“কারণ বড়ো লোকদের এটাই ফ্যাশন। তাদের ভালোর পাশাপাশি খারাপ হতে হবে, অহংকারী হতে হবে, বেয়াদব হতে হবে। তুমি গরিব দেখে শুধু ঝগড়া করতে জানো। আর কোনো গুণাগুণ নেই তোমার মাঝে।”

“তোমার এই অহংকার থাকবে না দেখো, একদিন ঠিকই ধ্বংস হবে।”

“তখন তোমার কাছ থেকে না হয় একটু ঝগড়া করার ট্রেনিং নেবো।” শ্লেষাত্মক হাসলো ক্যানিয়ল।

“আমার টুপি ফেরত দাও।”

“নীচু মন মানসিকতার মেয়ে! সামান্য একটা টুপির জন্য যে এমন করে সে যে কতটা নীচু মন-মানসিকতার সেটা দেখলেই বোঝা যায়। তোমার এই নোংরা টুপি রাখার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।”

ইরতিজা দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। চাইলে সে এখন ছেলেটার প্রতিটা কথার দাঁত ভাঙা জবাব দিতে পারে। নীচু মন-মানসিকতার মেয়ে বলার সাহসও ভুলিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সে কিছু বলবে না। কারণ, কারো শত্রু রূপে সে থাকতে চায় না। জীবনে শত্রু নামক ব্যক্তিগুলো খুব ভয়ানক হয়!

ইরতিজার থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না এলে ক্যানিয়ল বললো,
“পাকিস্টানি গার্লের নাম কী?”

ইচ্ছা তো করছিল ‘আমি পাকিস্তানি নই’ বলে ভুল ভাঙিয়ে দেয়। কিন্তু আর কতবার কথাটা বোঝাবে একে? দরকার নেই বোঝানোর। যা ভাবার তাই ভাবুক। ইরতিজা উত্তর দিলো,
“আমার নাম ইরতিজা।”

ঠিক ভাবে শুনতে না পেয়ে মানুষ যেমন প্রশ্ন করে তেমনভাবে প্রশ্ন করলো ক্যানিয়ল,
“হ্যাঁ? কী?”

“ইরতিজা।”

“ইরি…ইরি…হোয়াট?”

“ইরতিজা…”

“ইরিইটিইজা?”

“…’টিজা’! টিজা আমার নাম।”
উপায় না পেয়ে আমেরিকান ভার্সন নামটাই বললো ইরতিজা।

ক্যানিয়ল হেসে উঠলো,
“টিজা? এত বাজে নাম নিয়ে ঘোরো তুমি? কী অর্থ এই নামের?”

ইরতিজা কটমট করে তাকিয়ে বললো,
“মুখ সামলে কথা বলবে।”

“এ নাম চলবে না। আগে কী যেন একটা নাম বলেছিলে না? ইরুইটা না কী যেন? ওটা বলো আবার।”

“ওটা বুঝতে বুঝতে তোমার দাঁত ভেঙে যাবে।”

“উফ, পাকিস্টানি মেয়েদের নাম এত কঠিন হয় আমি জানতাম না।”
ক্যানিয়ল হাত দেখিয়ে বললো,
“এখানে লিখে দাও তোমার নাম। ইরু…উহুঁ, ইরি। ওটা লিখে দাও।”

“কী দিয়ে লিখে দেবো?”

ক্যানিয়ল গাড়ি থেকে একটা পেন বের করে দিলো।

ইরতিজা ক্যানিয়লের হাতে লিখলো,
“Irtija.”

ক্যানিয়ল চোখ বাঁকিয়ে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গি করে নামটা দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
“ইজা!”
ক্যানিয়লের উচ্চারণটা, ‘ইজ-আহ’ এর মতো শোনালো।

“কী?”

“তোমার নাম। আমি দিলাম। আজ থেকে তোমার নিক নেম ‘ইজা’।”

“কিন্তু আমার নিক নেম আছে। ওটাই সুন্দর।”

“হোক ইজা অসুন্দর। এই অসুন্দর ডাকই তোমার শুনতে হবে।”

গাড়িতে উঠে বসলো ক্যানিয়ল। মাথা থেকে টুপিটা খুলে ইরতিজার দিকে ছুঁড়ে মারার জন্য হাত প্রস্তুত করলো। কিন্তু ছুঁড়ে মারলো না। গাড়ির দরজা টেনে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। ইরতিজা বললো,
“আরে…”

আর কিছু বলার সুযোগ পেল না, তার আগেই গাড়ি নিয়ে ছুট দিলো ক্যানিয়ল। ইরতিজার আর টুপিটা ফিরে পাওয়া হলো না। ছেলেটা কোন ধরনের পাজি ভেবে পাচ্ছে না সে!

______________

ঘুম পলায়ন করতে চাইছে মোবাইলের বিরক্তিকর রিংটোনের শব্দে। এত রাতে কে কল দেয়? প্রশ্নটা মনে জাগতেই জোনাসের নাম মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। জোনাস? ইরতিজার ঘুম পলায়ন করলো সম্পূর্ণ রূপে। পাশ ফিরে মোবাইল হাতে নিয়ে কল রিসিভ করলো।

“কেমন আছো সুইটহার্ট?”

উত্তর দিলো না ইরতিজা। ‘সুইটহার্ট’ শব্দটা শুনে অকস্মাৎ চোখের কোণে জল জমলো। কেন জমলো? যথোপযুক্ত উত্তর নেই এর।

“ইউ নো, আজ আমি ড্রিংক করেছি?”

কোনো কথা বললো না ইরতিজা। শুধু মনে মনে ভাবলো, কেন ড্রিংক করেছে জোনাস? ড্রিংক করা পছন্দ করে না সে।

“আমি কল দিলেই তুমি কেন কল রিসিভ করো টিজা? এটা কিন্তু একদম ঠিক করো না।”

“হুম, ভুল করি কল রিসিভ করে।”

“তুমি কেন এই ভুলটা করো জানো?”

ইরতিজা জানে জোনাস কী বলবে। জোনাস যেটা বলবে আসলে সেটা সত্যি নয়। ইরতিজা বললো,
“জানি না, আর জানতেও চাই না।”

“কিন্তু তবুও তোমাকে জানাতে হবে। তুমি এই ভুলটা করো কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো। ভালোবাসলেই সচরাচর এমন ভুল করে মানুষ। তুমিও করছো। ঠিক করছো না।” জোনাসের কথা কেমন জড়ানো। ড্রিংক করেছে বিধায় এমন শোনাচ্ছে ওর কথা।

“আচ্ছা টিজা, আমি যদি রেডমন্ড তোমার কাছে চলে আসি তাহলে কেমন হয়? ভালো হয় না এটা খুব? রেডমন্ড এসে আমি একটা নতুন সাইকেল কিনবো। সেই সাইকেলে তোমায় নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। নিউ ইয়র্কে তোমায় নিয়ে ঘোরার ইচ্ছাটা পূরণ হয়নি, রেডমন্ডে তোমায় নিয়ে সাইকেলে ঘুরতে চাইলে তুমি কি এবারও আমার ইচ্ছা অপূর্ণ রাখবে?”

নেশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছেতাই বলছে! এমনটাই মনে হলো ইরতিজার। তবে সেই সাথে কষ্টও হচ্ছে তার। ছেলেটা এমন পাগলামিপূর্ণ কথা কেন বলে?

“তোমার কথা শুনে তোমাকে একজন পাগল মনে হচ্ছে জন।”

জোনাস অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো। অনেকক্ষণ বাদে সেই হাসির সমাপ্তি ঘটলে বললো,
“আমি তো পাগলই টিজা। কেউ একজন খুব যত্ন করে আমাকে পাগল বানিয়েছে। এমনটা কেন হলো? আমি নিজেও নিজের কাছ থেকে এটা আশা করতে পারছি না। আমি তো তোমাকে ঘৃণা করি। তাহলে কেন তোমায় ভুলে থাকতে পারি না? কত যত্ন করে আমাকে পাগল বানিয়েছো দেখো টিজা!”

ইরতিজার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়লো। পাগল আসলে সে নিজে হয়ে যাচ্ছে মনে হয়। হ্যাঁ, বেশ টের পাচ্ছে এটা। আর না হলে জোনাসের জন্য তার মন এমন করছে কেন? ভালো তো সে বাসে না জোনাসকে, তবুও হৃদয়ে এমন কষ্ট কেন হয়? জোনাসের আর একটা কথা শোনারও শক্তি, ইচ্ছা তার নেই। তাই কল কেটে ফোন সুইচ অফ করে রাখলো। বালিশটা আঁকড়ে ধরলো শক্ত বাঁধনে। মনে মনে একটা কথার উপরই জোর দিলো, সে ভালোবাসে না জোনাসকে!

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১১
__________________

আজাদ চৌধুরী মেয়ের পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। কিচেনে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে নওরিন। পায়ে ভীষণ চোট লেগেছে। নওরিনের দু চোখ জলে ল্যাপ্টানো। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে শারমিন আহমেদের দিকে। ইরতিজাও লিভিং রুমের এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নওরিন যখন মায়ের দিকে তাকায় তখন নওরিনের চোখে স্পষ্ট ক্রোধ দেখতে পায় সে। নওরিনের ক্রোধপূর্ণ দৃষ্টি দেখে ইরতিজার কষ্ট অনুভব হয়। কেন তার মাকে এমন ক্রোধপূর্ণ দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হবে?

নওরিনের রাগ ক্রমশ চড়া হয়ে উঠছে। সে শারমিন আহমেদকে উদ্দেশ্য করে শক্ত কণ্ঠে বাবাকে বললো,
“ওনার জন্য আজ আমি আঘাত পেলাম আব্বু। ওনাকে বলে দাও, যদি উনি কাজ করেন তাহলে যেন সেটা সাবধানে করেন। না হলে ওনার কাজ করার কোনো দরকার নেই।”

আজাদ চৌধুরী শীতল কণ্ঠে মেয়েকে শুধালেন,
“নিশ্চুপ থাকো নওরিন।”

“কেন নিশ্চুপ থাকবো? কিচেনে অয়েল পড়ে থাকলে সেটা সে পরিষ্কার করবে না? কেন করলো না? কেন ভুলে গেল সেটা করতে?”

ব্যান্ডেজ কমপ্লিট। আজাদ চৌধুরী মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“সামান্য অয়েলে পা পিছলে পড়ে গিয়েছো, এটা নিয়ে কি সিনক্রিয়েট করা উচিত হবে?”

শারমিন আহমেদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
“ভুল হয়েছে আমার, এরপর থেকে অবশ্যই সাবধান থাকবো আমি।”

মায়ের এমন নীচু কথা শুনে হৃদয়ে কঠিন বৃহৎ পাথরের চাপ অনুভব করলো ইরতিজা। এটা সহ্য যোগ্য হলো না তার কাছে। সে এগিয়ে এসে বোনকে বললো,
“এমন ভুল তো যে কারোরই হতে পারে। তুমিও তো করতে পারতে এমন ভুল। এটা নিয়ে মাকে এমন করে কথা বলা কি উচিত হচ্ছে তোমার?”

নওরিন অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
“তুমি চুপ করো।”

“হ্যাঁ, আমার তো চুপ করে যেতেই হবে। কথা বলার অধিকার তো আমার নেই।”

মায়ের দিকে চাইলো ইরতিজা। মা তার দিকেই তাকানো। কঠিন মুখে তাকিয়ে আছে। কঠিন চোখ জোড়ার দৃষ্টি বোধগম্য হচ্ছে তার। মা তাকে চোখ দিয়ে সাবধান করছে,
‘চুপ করো। একটা কথাও বলো না আর।’

ইরতিজার কান্না পেল। হৃদয় ধ্বস হচ্ছে। চোখে অশ্রু আটক রেখে সে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। দু চোখে বারিধারা ঝরছে। এত তিক্ত, বিদঘুটে কষ্টটা কেন মাঝে মাঝে জেগে ওঠে বক্ষস্থলে? এটা তো একটা পরিবার। বাবা যেমন তার বাবা, মা যেমন মা, তেমনি তো তা নওরিনেরও। তবুও নওরিন এমন কেন করে?

বাসা থেকে বের হয়েই কান্নারত মেয়েটাকে দেখতে পেল রিশন। অবাকের ছোঁয়া লাগলো অন্তঃকরণে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কাঁদছো কেন টিজা?”

ইরতিজা কান্না আড়াল করলো না। জলের ধারা যেমনি নামছিল তেমনিই নামতে থাকলো। বললো,
“আমি এমনিই কাঁদছি।”

“বিনা কারণে কেউ কাঁদে?”

“পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা বিনা কারণেই কাঁদে। আমিও ওরকম।”
ইরতিজার হঠাৎ ক্যানিয়লের বলা ‘ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে’ কথাটা মনে পড়লো। বলে ফেললো,
“আমি ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে রিশন! বুঝলে? আমি ছিঁচকাঁদুনে!”

আর দাঁড়ালো না ইরতিজা, যেদিকে চোখ গেল সেদিকেই পা বাড়িয়ে দিলো সে।
রিশন অবুঝ মন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বললো না। ব্যাপারটা আসলে কী সেটা যাচাইয়ের জন্য ইরতিজাদের বাসায় প্রবেশ করলো ও।
আজাদ চৌধুরী অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তৈরিই ছিল সে, নওরিন পায়ে চোট পাওয়ায় একটু সময় নিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। শার্টের উপর কালো কোটটা চাপিয়ে নিলো সে।
নওরিন সোফায় বসে আছে। পায়ে ব্যান্ডেজ।

“পায়ে কী হয়েছে তোমার?” নওরিনকে প্রশ্ন করলো রিশন।

আজাদ চৌধুরী উত্তর দিলেন,
“পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে।”

“কীভাবে?”

“কাজ না করতে জানা লোকজন ঘরের ভিতর থাকলে এটা সহজেই ঘটা সম্ভব।” গমগম করে উত্তর দিলো নওরিন।

কথাটা শুনতে অসহ্য লাগলো আজাদ চৌধুরীর। সে মেয়ের দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“এসো, তোমাকে রুমে নিয়ে যাই।”

নওরিন কোনো কথা না বলে বাবার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পায়ের উপর চাপ পড়তেই যন্ত্রণা করে উঠলো। আজাদ চৌধুরী রুমে নিয়ে গেল ওকে। শারমিনও অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি। তৈরি হওয়ার জন্য রুমে গিয়েছিলেন। লিভিং রুমে এসে রিশনকে দেখে হেসে বললেন,
“ব্রেকফাস্ট করেছো?”

রিশন ঠোঁটে বাধ্য হাসি ফুঁটিয়ে মাথা দোলালো। ভীষণ একটা গরমিল অনুভব করছে সে। এ বাসা থেকে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। তার মনে দুটো প্রশ্ন ঘুরছে। ইরতিজা কাঁদলো কেন ওরকম? আর নওরিন ওই সময় কাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেছিল?

_____________________

সামুরা ছেলেটাকে ভালোই লাগে ইরতিজার। ছেলেটার সাথে ফ্রেন্ডশিপ হয়েছে তিনদিন আগে। ক্লাসে সাক্ষাৎ হয়েছিল। ছেলেটা মিশুক, সরল প্রকৃতির। এই মুহূর্তে সে যেখানে আছে এটা সামুরার বাসা। বিকেলে একলা হাঁটতে বের হয়েছিল। রাস্তায় সামুরার সাথে দেখা হওয়ায় সামুরা এক প্রকার জোর করে তাকে বাসায় নিয়ে এলো। তাদের এরিয়া থেকে সামুরাদের বাসা এত কাছে জানতো না।
সে আছে এখন লিভিং রুমে। বিশাল বড়ো লিভিং রুম। সব জায়গায় চাকচিক্য আর আভিজাত্যের ছোঁয়া। এ যেন এক রাজপ্রাসাদ। দামি দামি সব আসবাবপত্র চোখে পড়ছে। ইলেকট্রিক লাইট জ্বলছে অনেকগুলো। ইরতিজা কথার ফাঁকে ফাঁকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে সব কিছু দেখছে। সামুরা যে ধনী পরিবারের এটা আগেই জেনেছিল সে। ইরতিজার এখানে বসে থাকতে একটু অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। এত চাকচিক্য প্রাচুর্যের মাঝে নিজেকে হঠাৎই বেমানান মনে হচ্ছে তার।
এ বাসায় আসার পর এ পর্যন্ত মোট আট জন মানুষের দর্শন পেয়েছে। এর মাঝে তিন জন ছিল মধ্য বয়স্ক মহিলা। দুই জন মাথায় হিজাব পরিহিত ছিল। হ্যাঁ, সামুরা মুসলিম পরিবারের। রেডমন্ড আসার পর তার দুইজন বিদেশি মুসলিমের সাথে দেখা হয়েছে। ক্যানিয়ল এবং সামুরা!
সামুরার বাবাকেও দেখেছে। তবে ইরতিজা বুঝতে পারছে না ওই তিনজন মহিলা কারা? একজন না হয় সামুরার মা, বাকি দুজন? কী হয় সামুরার? সামুরাকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও একটা বাধা উপলব্ধি করেছে সে। বাকি যে চারজনকে দেখেছে তারা ছিল যুবক-যুবতী। মূলত সামুরার ভাই-বোন হবে। কিন্তু চারটা ভাই-বোন? অবশ্য চারটা ভাই-বোন তো থাকতেই পারে। সামুরার ঠিক কয়জন ভাই-বোন আছে সে জানে না।
যারা এই লিভিং রুম থেকে আসা যাওয়া করছে তাদের বেশিরভাগেরই কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না ইরতিজার উপর। শুধু তিনজনের দৃষ্টি পড়েছিল। একজন নাইলা সালেম, দ্বিতীয়জন উইন্টার, তৃতীয়জন সোফিয়া রামি। নাইলা সালেমকে অহংকারী ধরনের মনে হয়েছে ইরতিজার। মহিলার কথাতেই সে অহংকারের ছোঁয়া অনুভব করেছে। ইরতিজাকে দেখেই সে চোখ বাঁকিয়ে বলেছিল,
“এটা কে সামুরা?”

সামুরা সরল হেসে উত্তর দেয়,
“ও আমার ফ্রেন্ড, টিজা।”

উত্তরটা শুনেই সে মুখ গোঁজ করে বলে,
“বাসায় যাকে-তাকে নিয়ে আসবে না এটা তোমাকে বলা হয়েছিল কি না? কেন নিয়ে এসেছো এই মেয়েকে? তোমার ড্যাড এটা দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবে না।”

এটুকু বলে দাপটের সাথে হেঁটে অভ্যন্তরে চলে যায় নাইলা সালেম। ইরতিজা তখনই বুঝে গিয়েছিল এই মহিলা অহংকারী। আচ্ছা, বড়োলোক হলেই কি মানুষ অহংকারী হয়? না, হয় না তো। সামুরা তো অহংকারী নয়। সোফিয়া নামের মহিলাটাও অহংকারের বিপরীত। সে তো অহংকার দেখালো না। সে তো সুন্দর ভাবে কথা বলে গেল। তবে উইন্টার মেয়েটার মাঝে অহংকারের ধূসর একটা পর্দা জড়িয়ে আছে, সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছে।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামাকালীন সোফায় চোখ পড়তেই ঝটকা খেলো ক্যানিয়ল। চোখের পাতা বন্ধ করে আবার খুললো। হ্যাঁ, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। কফির মগ হাতে যে মেয়েটা তার ভাইয়ের সাথে কথা বলছে এটা সেই ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটা! আসলেই কি তাই? না কি ভ্রম হচ্ছে? না ভ্রম-ট্রম কিছু নয়, এটা বাস্তব। সিঁড়ির ধাপ দ্রুত গতিতে ভেঙে নিচে নামলো ক্যানিয়ল। ইরতিজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“ওহ মাই গড! তুমি আমাকে ফলো করতে করতে এখান অবধি চলে এসেছো? প্রথমে ইউনিভার্সিটি, এখন ইউনিভার্সিটি থেকে সোজা হোম। ইউ আর সো ডেঞ্জারাস!”
ক্যানিয়লের খেয়াল হলো সামুরা ইরতিজার পাশে বসে আছে। সে সামুরার হাত ধরে ইরতিজার পাশ থেকে উঠিয়ে বললো,
“তুমি কোন আক্কেলে এই মেয়ের পাশে বসেছো? তুমি জানো, সে খুব ভয়ানক? এর কাছ থেকে যত দূরে থাকবে ততই মঙ্গল। আমাকে ফলো করতে করতে সে বাড়িতে এসে গেছে!”

ইরতিজা হা হয়ে দেখছে। এটা কি সত্যিই ক্যানিয়ল? কিন্তু ক্যানিয়ল এখানে কীভাবে থাকতে পারে? এটা তো সামুরার বাসা। সামুরার বাসায় ক্যানিয়ল…মানে ক্যানিয়ল কীভাবে… ইরতিজার চিন্তাধারা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ক্যানিয়লও কি সামুরার ভাই হয় না কি? ইরতিজার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। এই পাজি ছেলেটার ভাই সামুরা?

ভাইয়ের কোথাও ভুল হচ্ছে বুঝতে পেরে সামুরা বললো,
“ও তোমাকে ফলো করে কীভাবে বাড়িতে আসবে? ও তো নিজ ইচ্ছায় আমাদের বাড়িতে আসেনি। আমি ওকে নিয়ে এসেছি।”

ক্যানিয়ল সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
“তুমি?”

“হ্যাঁ, ও আমার ফ্রেন্ড। ভার্সিটিতে আমাদের মিট হয়েছিল।”

ক্যানিয়ল অবাক হয়ে তাকালো ইরতিজার দিকে। ইরতিজার মাঝে দাপট ভাব কাজ করছে। সামুরা দিয়েছে নিজের ভাইয়ের মুখ বন্ধ করে।

“তুমি এসো আমার সাথে।”
ক্যানিয়ল সামুরার হাত ধরে টেনে আনলো ওকে লিভিংরুমের এক কর্ণারে। ইরতিজার থেকে দূরে সরে এসেছে আরকি।
ক্যানিয়ল উচ্চৈঃস্বরে বললো,
“এটা তুমি কী করেছো সামুরা? ওই নীচু মন মানসিকতার মেয়েটাকে বাড়িতে এনেছো কোন আক্কেলে? সে সামান্য একটা টুপির জন্য কাঙালপনা করেছে। সে কতটা নীচু মন মানসিকতার বুঝতে পারছো? তুমি ভুলে যাও কেন আমরা বড়োলোক? যাকে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা আমাদের শোভা পায় না।”

ক্যানিয়লের প্রতিটা কথা স্পষ্ট কানে এসেছে ইরতিজার। ভাইকে নিয়ে দূরে সরে গেলেও মূলত সে ইরতিজাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলছে কথাগুলো। অপমানে ইরতিজার মাটির সাথে মিশে যাওয়ার অবস্থা। ইচ্ছা করছে এক দৌড়ে এখান থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে এখানে ঠাঁয় বসিয়ে রাখলো। মনে মনে বললো সে,
‘ভাইকে নিয়ে যখন দূরেই সরে গেলি তাহলে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো কেন বলছিস পাজি ছেলে? শুনিয়ে শুনিয়েই যখন কথাগুলো বলবি তখন দূরে যাওয়ার কী দরকার ছিল? সামনে বসেই বলতি!’

সামুরা লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভাইয়ের এক হাতে মৃদু চাপ দিয়ে কণ্ঠ নিচু করে বললো,
“এটা তুমি কী করছো? আস্তে বলো। শুনতে পাবে ও।”

“তো? এখন ওর জন্য কি আমার ফিসফিস করে কথা বলতে হবে? এটা আমার ক্যারেক্টারের সাথে যায় না। যে মেয়ে সামান্য একটা টুপির জন্য কাঙাল, সে মেয়ের জন্য আমি ফিসফিস করে কথা বলতে পারবো না। তুমি ওকে বাড়িতে নিয়ে এসে মোটেও উচিত কাজ করোনি। তাড়াতাড়ি ওকে ওর বাড়িতে পাঠিয়ে দাও।”

সামুরা লজ্জায় দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। তার ভাই হঠাৎ এমন কেন করছে বুঝতে পারছে না। জীবনে কখনও তো এমন করতে দেখেনি। তাহলে হঠাৎ কী হলো?
ক্যানিয়লের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। সামুরাকে এমন করতে দেখেও কোনো পরিবর্তন সাধিত হলো না তার মাঝে। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। দুই ধাপ উঠে কী মনে হতেই থামলো আবার। ইরতিজার দিকে তাকালো। মেয়েটা অপমানে রিক্ত হয়ে বসে আছে। ক্যানিয়ল ডাকলো,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল!”

ইরতিজা রক্তিম চোখ জোড়া মেলে তাকালো।

“এখনও এরকম বসে আছো কীভাবে? তোমার তো এতক্ষণে কেঁদে দেওয়া উচিত ছিল। ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে!”
কথাটা বলে ক্যানিয়ল আর দাঁড়ালো না।

ইরতিজা সত্যি সত্যি এবার কেঁদে দিলো। এই অপমান সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। এক মুহূর্ত আর এখানে বসে থাকা যায় না। ইরতিজা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই সামুরা পিছন থেকে টেনে ধরলো তার এক হাত।
“স্টপ টিজা।”

“হাত ছাড়ো সামুরা। আমি আর এক সেকেন্ডও এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। এমন অপমান বোধ আমি আর কোনোদিন করিনি! অপমান করবে বলেই কি আমাকে নিয়ে এসেছিলে এখানে? ছাড়ো হাত। আমি যদি জানতাম ওই বেয়াদব, পাজি ছেলেটা তোমার ভাই, তাহলে ভুলেও পা রাখতাম না এখানে। চরম ভুল করেছি এখানে এসে!”

“স্যরি টিজা! আমি বুঝতে পারছি এটা খুব অপমানজনক একটা বিষয় ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার ভাই এরকম নয়। জানি না হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করলো! তুমি প্লিজ এরকম ভাবে চলে যেয়ো না।”

“হাত ছাড়ো।”

ইরতিজা হাত ছাড়িয়ে যাওয়া দিলে আবারও সামুরা হাত টেনে ধরলো।
“তুমি এরকম ভাবে চলে যেতে পারো না টিজা। তুমি এরকম ভাবে চলে গেলে সেটা আমার আত্মসম্মানে লাগবে। কারণ আমি তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম। তুমি যাবে ঠিক আছে, আমি তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসবো। একা একা যাবে না তুমি। এমনিতেও এখন রাত হয়ে গিয়েছে। একা যেতে অসুবিধা হবে তোমার।”

ইরতিজা একটু নরম হলো। সামুরা সেটা বুঝতে পেরে বললো,
“আমি তোমাকে নিয়ে যাব, ও কে?”

“সামুরা…”
পিছন থেকে নাইলা সালেমের কণ্ঠ শোনা গেল।

সামুরা পিছন ফিরলে সে বললো,
“এদিকে এসো, ইম্পরট্যান্ট কথা আছে।”

“পরে। আগে ওকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে আসি।”

নাইলা অসন্তোষ হয়ে বললেন,
“সব কিছু তোমার কেন করতে হবে? এসব কাজের জন্য কি তোমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে?”

ক্যানিয়ল সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিল। কিচেনের দিকে পা বাড়ালেই ডাকলেন নাইলা,
“ক্যানি!”

ক্যানিয়ল দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো প্রয়োজনে ডাকছো মাদার সালেম?”

“এই মেয়েটাকে ওর বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে এসো।”

“দুঃখিত, এটা পারবো না আমি।”
বলে কিচেন নয়, বাসা থেকে বের হয়ে গেল ক্যানিয়ল।

নাইলা সালেমের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো রাগে। ক্যানিয়ল ছেলেটা কথার অবাধ্য হওয়ারও দুঃসাহস করছে ইদানিং। সে সামুরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার সাথে এসো।”

“কিন্তু টিজা…”

“আমি একা চলে যাব।” এত অপমানের পর আর সত্যিই দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না ইরতিজার পক্ষে। সে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে দিলো। সামুরা ডাকলো,
“টিজা…”

থামলো না ইরতিজা। দু চোখ বেয়ে উষ্ণ অশ্রু নেমে যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা করছে, আর কখনও যেন ক্যানিয়ল অথবা এই নাইলা সালেমের সাথে তার দেখা না হয়। কিন্তু আদৌ কি তার এই প্রার্থনা কবুল হবে?
বিশাল ঘরটা পেরিয়ে কেবল বাইরে পা রাখলো ইরতিজা। এর মাঝেই হাত ধরে কেউ একজন হ্যাঁচকা টান দিলো। হৃৎপিণ্ড গলার কাছে উঠে এলো ইরতিজার। একটা বলিষ্ঠ হাত তার মাথাটা দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। বললো,
“একা একা যাওয়ার চেষ্টা করলে পা ভে/ঙে দেবো মেয়ে!”

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১২
_________________

পুরুষালি কণ্ঠের নির্মম কথাটাতে বক্ষৎপঞ্জরে কাঁপন ধরলো। কাঁপন মূলত আগেই ধরে গিয়েছিল আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনায়। ইরতিজা একটা ভীতি ঘোর থেকেই বললো,
“কী?”

পিছন থেকে একটা মুখ তার কানের নিকটে এগিয়ে এসে বললো,
“তুমি চেনো না আমাকে, জানো না আমি কেমন। খুব ভংয়কর আমি! তোমাকে আঘাত করতে একটুও কষ্ট হবে না আমার।”

“তা কেনই বা হবে? তুমি তো একটা মনুষ্যত্বহীন অ…”
কথা শেষ করার আগেই মুখ ছুটে একটা মৃদু ব্যথার আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ইরতিজার। ক্যানিয়ল তার মাথা আরও সজোরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরেছে। একটুও নড়তে পারছে না সে। পিছন ফিরে একবার পাশবিক ক্যানিয়লকে দেখার চেষ্টা করছে।

“এটা আমার বাড়ি, তোমার বক্তৃতা দেওয়ার স্থান নয় এটা। আস্তে কথা বলো।” ইরতিজার কণ্ঠ উচ্চ হয়ে উঠছিল বিধায় সাবধান করলো ক্যানিয়ল।
ইরতিজাকে টেনে গ্যারেজে নিয়ে এসে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। নিজে বসলো ড্রাইভিং সিটে। পিছনের আসনে ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এবার বলো, কী বলতে চাইছিলে তখন?”

ইরতিজার দৃষ্টি ক্রুর। পারলে দৃষ্টি দিয়েই ক্যানিয়লের সমস্ত অহংকার ধ্বংস করে দেয়। ক্রোধে কিড়মিড় করে বললো,
“আমি পারলে তোমাকে চ’ড় মারতাম।”
কথাটা বলতে একটু ভয় হলো না, গলাও কাঁপলো না।

কথাটা শোনার পর ক্যানিয়ল নির্বিকার রইল। ভাবলেশহীন বললো,
“এটা তুমি কখনোই পারবে না। আমার গায়ে হাত তোলা যেন-তেন ব্যাপার নয়। যারা আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করেছে প্রত্যেকের অবস্থাই খারাপ হয়েছে। এমন করার চেষ্টা করলে তোমারও অবস্থা খারাপ হবে। তোমার এই সুন্দর হাত, নখ, পা, সুন্দর চেহারার কিছুই আর সুন্দর থাকবে না।”

“সন্ত্রাসী না কি তুমি?” সন্দ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ইরতিজা।

ক্যানিয়ল ওষ্ঠাধর বাঁকিয়ে অদ্ভুত হেসে বললো,
“ওরকমই কিছু।”

ইরতিজার মাঝে ভয় ঝিলিক দিয়ে উঠলো। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল ক্যানিয়লের দিকে। ক্যানিয়ল গাড়ি স্টার্ট করলো।
আসার পথে ইরতিজাকে জিজ্ঞেস করেনি ওর বাসা কোথায়। ইরতিজা দেখলো ক্যানিয়ল নিজ থেকেই তাদের এরিয়ায় প্রবেশ করেছে। গাড়ি বাসার সামনে এলেই ইরতিজা বললো,
“এখানে থামাও।”

কিন্তু ক্যানিয়ল থামালো না। ইরতিজার কথা শুনতে পেল কি না বোঝা গেল না। সে গাড়ি থামালো আরও কিছুটা দূর এসে। ইরতিজা বললো,
“তুমি আমার বাসা অতিক্রম করে চলে এসেছো। আমার বাসা এখান থেকে একটু পিছনে।”

ক্যানিয়ল গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললো,
“অতিক্রম করে আসিনি। ঠিক বাসার সামনেই এসেছি।”

ইরতিজা দ্রুত নেমে পড়লো।

ক্যানিয়ল হাতের ইশারায় সামনের বাড়িটা দেখিয়ে বললো,
“ইট’স মাই হাউজ।”

ইরতিজা চমকিত হলো। একবার বাড়িটা আর একবার ক্যানিয়লকে দেখে বললো,
“তোমার বাসা মানে?”

“আমার মানে আমার। এটা আমার নামে উইল করা। ভিতরে চলো।”

ইরতিজা অবাক! ক্যানিয়লের বাড়ি তাদের এরিয়ায়? তাও আবার তাদের বাসা থেকে এখানে হেঁটে আসতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগে। ঘুরে দেখেছিল তো পুরো এরিয়াটা। এই বাড়িটাও দেখেছে।

“কী হলো? দাঁড়িয়ে কেন? এসো।” সামনে থেকে ক্যানিয়লের গলা ভেসে এলো। সে নিজ বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার লকও খুলে ফেলেছে ইতোমধ্যে।
ইরতিজা কিঞ্চিৎ বিস্মিত। ছেলেটা তাকে ডাকছে কেন? বললো,
“আমি কেন তোমার বাসায় প্রবেশ করবো? কোন প্রয়োজনে?”

“প্রতিদান দেবে। এতটা পথ যে তোমাকে গাড়িতে নিয়ে এলাম, প্রতিদান স্বরূপ আমাকে রাতের রান্না করে দেবে।”

“কী?”

“আমি একই কথা দুইবার বলি না। আর তোমাকেও দ্বিতীয়বার ডাকবো না। প্রথম ডাকেই এসো।”

ক্যানিয়ল ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। ইরতিজা চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু ক্যানিয়লের বাসাটা কেমন তা দেখতে ইচ্ছা হলো। সে কৌতূহল, জড়তা নিয়ে এসে পা রাখলো ঘরে। প্রথমেই চোখ গেল দেয়ালে। তার দ্বিধা হলো, এটা আসলেই পেইন্টিং তো? দেয়াল জুড়ে বিশাল একটা সমুদ্র পৃষ্ঠের চিত্র অঙ্কন করা। কে বলবে যে এটা পেইন্টিং? দেখে মনে হচ্ছে আসলেই সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে আছে।
সে আশপাশে একবার চোখ বুলালো। প্রথমেই যা নজরে পড়লো তা দেখে একটু শিহরিত হলো। দেয়ালের এক পাশে কতকগুলো হকিস্টিক রাখা। ইরতিজা কোন এক আকর্ষণ বলে যেন এগিয়ে গেল ওদিকে। কাছাকাছি এসে যেতেই পায়ের তলায় কী একটা চাপা পড়ে মৃদু আওয়াজ করলো। একটা হকিস্টিক পড়ে রয়েছে, সেই হকিস্টিকের উপর পা পড়েছে। ইরতিজা হাতে তুলে নিলো হকিস্টিকটা। হকিস্টিকের গায়ে লাল রঙের একটা দাগ প্রত্যক্ষ করে অন্তর কেঁপে উঠলো। এটা কী? রক্তের দাগ?
যে মুহূর্তে ইরতিজা এই প্রশ্নটা ভাবলো ঠিক তখনই তার হাত থেকে হকিস্টিক কেড়ে নিলো ক্যানিয়ল।

“আমার ঘরের কোনো জিনিসপত্র স্পর্শ করবে না।”
বলে হকিস্টিকটা অন্যান্য হকিস্টিকের মাঝে ছুঁড়ে ফেললো।

ইরতিজার মাঝে সুচারু একটা ভয় বিরাজ করছে। ক্যানিয়লের বাসায় এত হকিস্টিক কেন? আর তাতে রক্তই বা কেন? ওটা কি মানুষের রক্ত?

“ইজা…” ক্যানিয়লের ডাক ইরতিজার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো।
ইরতিজা তাকালো। ক্যানিয়ল আর্মচেয়ারে বসে প্রশ্ন করছে,
“বাড়িতে থাকাকালীন যা যা বলেছিলাম তাতে কি তোমার খারাপ লেগেছে?”

ইরতিজার মস্তিষ্ক মুহূর্তে নিজের খেয়াল পরিবর্তন করলো। ক্যানিয়লের সদ্য বলা কথাটা মস্তিষ্কের সর্বত্র জাগ্রত হয়ে উঠলো তার। মনে পড়লো ক্যানিয়ল এবং নাইলা সালেমের কাছ থেকে পাওয়া অপমানগুলো। বিষাক্ত হলো মন। ক্যানিয়ল মূলত নাইলা সালেমের কারণে এমন অহংকারী আর বাজে হয়েছে! নাইলা সালেম তো ওর মা। মায়ের একটা ধারা সন্তান হিসাবে সে পেতেই পারে। কিন্তু ধারাটা তিনগুণ বেশি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বিরাজ করছে ক্যানিয়লের মাঝে। নিশ্চয়ই ক্যানিয়লের বাবা খুব ভালো মানুষ। যার কারণে সামুরা অমন ভালো হয়েছে। ক্যানিয়লের প্রশ্নের কী উত্তর দেওয়া যায় ভাবছে। এত কিছু বলে অপমান করে এখন জিজ্ঞেস করছে তোমার খারাপ লেগেছে কি না! আরে শুধু কি খারাপ? খারাপের চেয়েও বেশি খারাপ লাগা অনুভব হয়েছে। ইরতিজা কিছু উত্তর দেওয়ার আগে ক্যানিয়লই বললো,
“আসল কথা কি জানো? আমি মেয়েদের পছন্দ করি না। কোনো এক কারণে মেয়েদের অপছন্দ আমার। যাদের পছন্দ করি না তাদের সাথে আচরণ সুন্দর হবে না এটাই স্বাভাবিক!”

ইরতিজা বিস্মিত হলো! কেন মেয়েদের অপছন্দ করে ক্যানিয়ল?

“কেন মেয়েদের অপছন্দ করো?” প্রশ্নটা সরাসরি ক্যানিয়লকেই করলো।

“সবাই সব কিছু পছন্দ করে না। কিছু জিনিস পছন্দের হলে কিছু জিনিস অপছন্দের হবে। এটাই বাস্তবিক দিক।”

ইরতিজা কিছু বলতে পারলো না তার আগেই ক্যানিয়ল বললো,
“কিচেন ওইদিকে, যাও।”

“আমাকে কি তোমার নিজ বাসার মেইড মনে হয়?”

ক্যানিয়ল ফোঁস করে নিশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
“নীচু মন মানসিকতার মেয়েরা প্রতিদান দিতে জানে না! তুমি প্লিজ বের হয়ে যাও আমার বাসা থেকে। তোমার পদচারণ পড়ায় আমার দামি ঘরটা হু হু করে কেঁদে উঠছে।”

“আমি নিজ থেকে তোমার বাসায় আসিনি। তুমি আসতে বলেছো।”

ইরতিজা বাকবিতন্ডা না করে চলে এলো। বাকবিতন্ডা যত এড়িয়ে চলা যায় ততই জীবন সুন্দর হবে বলে আশা করে সে। সে সব সময়ই ঝগড়া-বিবাদ পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করে।
আকাশ আজ একেবারে পরিষ্কার। কয়েকটা নক্ষত্রও নজরে পড়েছে। রাত তাই শীতের মাত্রা বেশি। এখান থেকেই তাদের বাসায় আলো জ্বলছে তা দেখা যাচ্ছে। ইরতিজা রাস্তায় পা রাখতেই হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো। এটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, তবে গভীর এক কৌতূহলের অংশ এটা। সে ফিরে এলো আবার ক্যানিয়লের কাছে।

“আবার এসেছো কেন? তুমি চলে যাওয়ার পর আবার হুট করে ফিরে আসো কেন বলো তো?” ক্যানিয়ল সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় ফ্লোরে উঠছিল। নিচে পদধ্বনির শব্দ শুনে তাকিয়ে ইরতিজাকে দেখে বললো কথাটা।

ইরতিজা ক্যানিয়লের কথা গ্রাহ্য না করে বললো,
“আচ্ছা, তোমাদের বাড়িতে অত মানুষজন কেন? তোমার মম বাদে আরও দুজন মহিলাকে দেখেছিলাম, ওনারা কি তোমার আন্ট?”

“অন্যের পরিবার নিয়ে না ভাবলেও চলবে তোমার। আমাদের বাড়িতে অত মানুষ কেন সেটা আমরা বুঝবো।”
ক্যানিয়ল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললো,
“না, তারা আমার আন্ট নয়। তারা হলো আমার ড্যাডের স্ত্রী!”

“মানে?”

ক্যানিয়ল দাঁড়িয়ে বললো,
“আমার ড্যাড চারটা বিয়ে করেছে। তুমি যাদের দেখেছো তারা হলো আমার স্টেপমম। সামুরা আমার স্টেপব্রাদার। আমার মোট ছয়জন সৎ-ভাইবোন আছে। আপন কেউ নেই। আমার মমের শুধু একটি মাত্রই পুত্র সন্তান, আর সেটা আমি।”

ক্যানিয়ল আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল। ইরতিজা সবটা শোনার পর বিস্ময়ে বিমূঢ়! এটা কী শুনলো সে?

________________

“আমাদের এরিয়ায় ক্যানিয়লের বাড়ি আছে এটা তুমি আগে কেন আমাকে বলোনি জুহি?”

“বলার মতো কোনো অবস্থার সৃষ্টি হয়নি দেখে বলিনি।”

“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ওর বাবা চার বিয়ে করেছে। এটা কি আসলেই সত্যি?”

“হুম এটা সত্যি। আমি একজনকে চিনতাম যে দশ বিয়ে করেছে!”

“দশ?” বিস্ময়ের গতি বাড়লো ইরতিজার।

“হুম। লোকটার নাম ছিল ওয়ার্নার ভেলি।”

“আচ্ছা, তুমি কি জানো ওই চারজনের ভিতর ক্যানিয়লের মা কে?”

“না, এটা জানি না। এটা নিশ্চিতভাবে তেমন কেউই বলতে পারবে না মনে হচ্ছে। এটা আমি জিজ্ঞেসও করিনি কারো কাছে কোনোদিন। তবে ধারণা করেছি মিসেস সোফিয়া ওর মা হতে পারে।”

ইরতিজার চোখে সোফিয়া রামির স্বচ্ছ মুখখানি ক্ষণিকের জন্য ধরা দিয়ে আবার অদৃশ্য হলো। ইরতিজার মন মানতে পারলো না ক্যানিয়ল সোফিয়া রামির ছেলে। মনের ভাব সে প্রকাশ করে ফেললো,
“আমি এটা মানতে পারছি না। ওই সুন্দর মহিলাটির ছেলে হতে পারে না ক্যানিয়ল।”

জুহি নীরব রইল। সময় গড়ালো খানিকটা। ইরতিজা বললো,
“আচ্ছা রাখছি। ক্যানিয়লের পরিবার নিয়ে ভেবে আমাদের কোনো লাভ হবে না।”

জুহির কিছু বলার অপেক্ষা না করেই কল কাটলো ইরতিজা। লাইব্রেরির কাচের দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকালো। বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়িগুঁড়ি। বিকেলের সময়টাও সন্ধ্যাক্ষণ মনে হচ্ছে। রাস্তা দিয়ে হেডলাইট জ্বলা গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে। কিছু মানুষ মাথায় ছাতা দিয়ে বৃষ্টি আড়াল করে হাঁটছে। প্রকৃতির যেন বিষণ্ণ রূপ। বিষণ্ণ প্রকৃতির মাঝে চিন্তাটা ধূসর মেঘের মতো বিরাজ করছে ইরতিজার অন্তঃকরণে। ক্যানিয়লের ফ্যামিলিটা কেমন তালগোল পাকানো। ওটা নিয়ে ভাবতে গেলে ভাবনা ক্রমশ জট পাকিয়ে যায়। তবে এই ভাবনার চেয়েও তার কাছে বড়ো ভাবনার বিষয় হলো, ক্যানিয়লের বাসায় অত হকিস্টিক কেন? আর তাতে রক্তই বা কেন? ক্যানিয়ল কি আসলেই একজন সন্ত্রাসী? ওই হকিস্টিক দিয়ে কি সে মানুষকে মারধর করে? শিরশিরে একটা অনুভূতি হলো ইরতিজার।
লাইব্রেরি থেকে যখন বের হলো তখন সন্ধ্যা ঝেঁকে বসেছে প্রকৃতিতে। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, কিন্তু সর্বত্র এখনও রয়ে গিয়েছে বৃষ্টির চিহ্ন। কালো পিচের রাস্তা বৃষ্টি ভেজা। ইরতিজা চরণ ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের বাসা থেকে লাইব্রেরি মাত্র কিছু মিনিটের মতো পথ। ফুফু কল দিয়েছিল। এই মানুষটার সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছা হয় না তার। কথা বলতে গেলে কী একটা কাঁটার মতো যেন বক্ষে এসে বিঁধে। টুকটাক কথা বলেই কথা সমাপ্ত করেছে। নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে আসছিল ইরতিজা। সামনে আকস্মিক একটা দুর্ঘটনা তার জন্য অপেক্ষারত সেটা কে জানতো! এরিয়ায় প্রবেশের কিছুক্ষণ পরই অকস্মাৎ পিছন থেকে কেউ একজন মুখ চেপে ধরলো ইরতিজার। থেমে গেল তার হৃদস্পন্দন। প্রথম মুহূর্তে কিছু বুঝতে পারলো না। চিৎকার করার চেষ্টা করলে শুধু অদ্ভুত ধরনের আওয়াজই বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। আশেপাশে কেউ নেইও যে ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করবে। মুখ চেপে ধরা লোকটা ইরতিজাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানে না ইরতিজা। বাধা দেওয়ায় চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। লোকটার কাছে তার শক্তি অতি তুচ্ছ। ইরতিজা দু চোখে দেখছে শুধু অন্ধকার। তার মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে মৃত্যু তার অতি সন্নিকটে। একটু পর কি সে মারা যাবে এই লোকটার হাতে? তার এমন কেন মনে হচ্ছে যে একটু পরই তার জীবনে মৃত্যু নামবে?

(চলবে)