এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০৫

0
178

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৫
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
তেজী,ঝগড়াটে মেয়েটাকে এভাবে ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে দেখে সায়ন হতভম্ব হয়ে গেলো। সে তো ভেবেছিলো রুমে আসা মাত্র রূপন্তী ঝগড়া শুরু করে দিবে।কিন্তু এই মেয়ে তো কাঁদছে। ন্যাকা কান্না নয়,ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যে কেউ এই কান্না দেখে বলবে যে মেয়েটা কষ্ট পেয়ে কাঁদছে।কিন্তু কিসের কষ্ট?!
কিঞ্চিৎ অস্বস্তি ঘিরে ধরলো সায়নকে।প্রথমত যেই মেয়েটাকে সে সহ্য করতে পারে না, সে ই এখন তার একমাত্র অর্ধাঙ্গিনী। দ্বিতীয়ত যে মেয়েটা কোনোদিন ঝগড়া বাদে সুন্দর করে দুটো কথা বলে নি,সেই মেয়েটা এখন কাঁদছে।
সায়ন কি করবে এখন?রূপন্তীর কান্না থামানোর জন্য এগিয়ে যাবে?নাকি এই রুড মেয়েটার প্রতি বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামিয়ে নিজের কাজ করবে?!
প্রথমটাই করলো সে। ক্রন্দনরত বধূ বেশে থাকা মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলো।মাঝখানে দুই হাতের মতো জায়গা রেখে দাঁড়ালো।গলা ঝেড়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– কাঁদছিস কেনো?
কাজ হলো।রূপন্তী একটু দমলো।কয়েকে মিনিটের মাঝেই সে নিজেকে সামলে নিলো।সায়ন ততক্ষন নীরব ভূমিকা পালন করলো।
রূপন্তী নিজেকে সামলে কোনোমতে বলল,
– কিছু না।শুধু নিজের জীবনের প্রতি তাচ্ছিল্য আসছিলো।
তারপর মাথা উঁচু করে সায়নের দিকে তাকালো।বলল,
– তুই ফ্রেশ হতে চাইলে হতে পারিস। রেস্ট ও দরকার যেহেতু এত বড় জার্নি করেছিস। আমাকে নিয়ে মাথা ঘামানো লাগবেনা।বর্তমান, ভবিষ্যত কোনো কালেই না।

রূপন্তীর ত্যাড়া কথায় সায়নের মেজাজ কিঞ্চিৎ খারাপ হলেও সেটা প্রকাশ করলো না।সে আসলেই খুব টায়ার্ড। এখন অযথা এই বেয়াদব মেয়েটার সাথে ঝগড়া করার শক্তি বা তেল কোনোটাই তার নেই।
আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
রূপন্তীও উঠে দাঁড়ালো। শাড়িতে হাসফাস লাগছে।এগিয়ে গিয়ে নিজের লাগেজ খুললো।একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করতে করতেই সায়ন বের হলো ওয়াশরুমে থেকে। রূপন্তীও আর দেরি করলো না। নিজের ফেসওয়াশ হাতে জামাকাপড় সহ ওয়াশরুমে চলে গেলো।পনেরো মিনিটের মাঝে গোসল সেড়ে বের হলো।লাগেজ থেকে ময়েশ্চারাইজার নিয়ে মুখে মাখালো।বিছানায় তাকিয়ে সায়নকে শোয়া দেখে আবার কান্না চলে আসলো। এই শ’য়’তা’নের সাথে বেড শেয়ার করতে হবে আজ থেকে?!
বিয়েটা তো সে মেনে নিতে পারছে না।সায়নও মনে হয় পারছে না।কিভাবে পারবে?শত্রুদের মাঝে কি কখনো ভালোবাসা হয়?!
যেভাবেই হোক এই হুট করে জুড়ে যাওয়া সম্পর্কের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে হবে।যেই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই সেই সম্পর্কটা অযথা টেনে নেওয়ার কোনো মানে হয় না!

আপাতত কিছু বলল না।এসব নিয়ে পরে কথা বলবে ঠিক করলো।বারান্দায় টাওয়েল মেলে এসে নিজের শাড়ি,ব্লাউজ ভাজ করলো।গয়না গুলো গুছিয়ে রাখলো।এরপর সায়নের দিকে তাকিয়ে খুবই নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– সায়ন?একটা সাহায্য করতে পারবি?
সায়ন এমন মিনতির সুর শুনে একটু অবাকই হলো। তবে সেটা প্রকাশ না করে বলল,
– বল?
রূপন্তী একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল,
– আমার একটু আরাদ্ধার সাথে কথা বলা দরকার।ফোনে চার্জ নেই, কল দিতে পারছি না। একটু দেখবি?
– কিন্তু ওরা তো মেবি ঘুমিয়ে পড়েছে।
– তবুও একটা কল দিয়ে দেখ না!
সায়ন আর কিছু বলল না। কল দিলো আরাদ্ধাকে।কিন্তু সে ধরলো না।
সায়ন কান থেকে ফোন নামিয়ে মাথা নাড়ালো।যার অর্থ কল ধরছে না।
রূপন্তী তপ্তশ্বাস ফেললো একটা।আরাদ্ধার সাথে কথা বললে একটু হালকা হতে পারতো।
সায়ন শুয়ে পড়েছে।রূপন্তীও আর কিছু না বলে বিছানার আরেকদিকে শুয়ে পড়লো।কিছু একটা মনে পড়তেই হুট করে বিছানা কাঁপিয়ে উঠে বসলো।ওকে এভাবে উঠে বসতে দেখে সায়নও উঠে বসলো।কি হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই রূপন্তী তর্জনী তাক করলো ওর দিকে। তারপর আঙুলটাকে নাচাতে নাচাতে কঠিন গলায় বলল,
– বউ হয়েছি মানলাম।তোর জন্য হালাল সেটাও মানলাম।কিন্তু খবরদার আমার গায়ে তোর হাত পা’র ছোয়া যাতে না পাই।পেলে একদম মেরে ফেলবো।
সায়নে ক্লান্ত মস্তিষ্ক কথাটা ধরতে একটু সময় নিলো।কিন্তু কথার মানে বোঝার সাথে সাথে তার সারা শরীর রাগে জ্বলে উঠলো। এই অ’স’ভ্য মেয়েটা তাকে রীতিমতো অপমান করছে।
সেও দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– আর আমি তো তোকে চুমু খাবো।
বলেই ঠাশ করে রূপন্তীর গালে থাপ্পড় মেরে দিলো।রূপন্তী পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখার মতো করে সায়নের দিকে তাকালো।
এক, দুই,তিন!!
ব্যাস!তৃতীয়, চতুর্থ সব বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো চৌধুরী বাড়ির দোতলার এই ঘরের বিছানায়। প্রায় পনেরো বিশ মিনিট পর ক্লান্ত হয়ে দুজন হাফাতে লাগলো।সায়নের গালে রূপন্তীর নখের আচড়।রূপন্তীর গালে পাঁচ আঙুলের দাগ।
শেষে সায়ন আর না পারতে হাফাতে হাফাতে বলল,
– আজ এতটুকু পর্যন্ত রইলো।নেহায়েত আজ ক্লান্ত।নাহলে এতক্ষনে তোকে খুন করে ফেলতাম।
এবার রূপন্তী উত্তরে বলল,
– হ তোকে তো আমি চুমু খাইতাম।
আজকের মতো শেষ অগ্নি চাহনি আদান-প্রদান করে দুজনেই ধাম করে শুয়ে পড়লো।সায়ন হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প অফ করে দিলো।ঘুটঘুটে অন্ধকার তাদের বাধ্য করলো গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যেতে। ক্লান্ত মানুষ দুটো খেয়াল করলো না তারা মাঝে বর্ডার হিসেবে বালিশ রাখতে ভুলে গিয়েছে।

নতুন জায়গা হওয়াতে রূপন্তীর ঘুম বেশ তাড়াতাড়ি ভেঙে গেলো।উঠেই আগে চেক করলো নিজের অবস্থান।না সব ঠিকঠাক আছে।সায়ন বিছানার অপরপাশে উল্টা হয়ে ঘুমাচ্ছে।রূপন্তী স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
রূপন্তী ওয়াশরুমে ঢুকতেই সায়ন ঘুরে তাকালো সেদিকে। অতঃপর হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে।এই মেয়ে তো ঢ্যাং ঢ্যাং করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।অথচ একটু আগেই একদম তার কোলের ভিতর ঢুকে ঘুমাচ্ছিলো।সায়ন বেশি বর্বরতা হয়ে যাবে বলে রূপন্তীকে ছুড়ে মারেনি। তারও ঘুম ভেঙেছে মাত্র আধ ঘন্টা আগে।এরপর রূপন্তীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ওদিক ফিরে শোয়ার কিছুক্ষনের মাঝে রূপন্তী উঠে গেছে। আল্লাহ রক্ষা করেছে সে তাড়াতাড়ি মেয়টাকে সরিয়ে দিয়েছিলো।নাহলে তাকেই পিটিয়ে মেরে ফেলতো।কিন্তু পরের একই ঘটনা ঘটলে সে মেয়েটাকে ছুড়ে মারবে বলে ঠিক করলো।
এসব ভেবে আবারও শুয়ে পড়লো ঘুমানোর উদ্দ্যেশ্যে। অথচ সে নিজেও জানলো না যে সারারাত কোলবালিশ ভেবে সে রূপন্তীকে বুকে জড়িয়ে ধরে আরামের ঘুম ঘুমিয়েছে।
.
রূপন্তী রুম থেক বের হয়ে একটু ইতিউতি করলো। নামবে নাকি নামবে না বুঝতে পারছে না।শেষমেশ সে নামার সিদ্ধান্ত নিলো৷ধীরে ধীরে নামলো সে।বাড়িটা বেশ সুন্দর। অনেকটা ওয়েস্টার্ন কান্ট্রির বাসাগুলোর লে-আউট ফলো করা হয়েছে।
নিচে নেমে দাঁড়াতেই খেয়াল করলো কিচেনে তার শ্বাশুড়ি অর্থাৎ সায়নের মা ইতিমধ্যে কাজ করছে।রূপন্তীকে দেখে তিনি এক গাল হেসে এগিয়ে আসলেন।তবে পুত্রবধূকে বিয়ের পর প্রথম সকালেই গায়ে টিশার্ট,ট্রাইউজার দেখেই একটু মন ক্ষুন্ন হলেন। পরবর্তীতেই মনে হলো মেয়েটা এই পৃথিবীর বুকে সম্পূর্ণ একা।তাকে এসব বোঝানোর মতো কেও ছিলো না।অতঃপর তিনি ঠিক করলেন রূপন্তীকে ছেলের বউ নয়, মেয়ে হিসেবে ভালোবাসবেন।
রূপন্তীর কাছে এসে তিনি একবার দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির দিকে তাকালেন।অতঃপর রূপন্তীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– রাতে ঘুম হয়েছে?শুয়েছো তো অনেক দেরি করে। এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে যে?
রূপন্তীর অস্বস্তিবোধ হলেও মহিলার নরম কণ্ঠ শুনে মৃদু স্বরে বলল,
– আসলে নতুন জায়গা হওয়াতে ঘুমটা তাড়াতাড়ি ভেঙেছে।তবে যতক্ষন ঘুমিয়েছি ততক্ষন ভালো ঘুম হয়েছে।
– আচ্ছা।এখন তো মাত্র সাড়ে আটটা বাজে৷ সবাই নয়টার দিকে নামবে।চলো তোমাকে বাড়ির চারপাশটা একটু ঘুরিয়ে আনি।
রূপন্তী মাথা নেড়ে সায় জানালো।তখন জয়া কাছে এসে মেয়েটার এলোমেলো চুলগুলো গোছাতে গোছাতে বললেন,
– মামনি, এখন তো বের হবো,বাড়ির বাহিরে অনেক গার্ডস আছে। তোমার লাগেজে দেখবে থ্রিপিস রাখা আছে। সেখান থেকে একটা পড়ে আসো। অথবা তোমার কাছে যদি কোনো কামিজ বা কূর্তা থাকে সেটা পড়ে আসো। গলায় একটা স্কার্ফ ঝুলালে তো আরও ভালো।
রূপন্তী কোনো একটা কারনে জয়ার কথা উপেক্ষা করতে পারলো না।বরং সে জয়ার স্নেহে, আহ্লাদে আরো দূর্বল হয়ে পরলো।হালকা হেসে সে তার রুমের দিকে অগ্রসর হলো।তার মন অজান্তেই জয়াকে নিজের মায়ের স্থান দিয়ে দিলো।এবং সে টের পেলো এই অল্প আদরেই জয়াকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। তার কাছে নিজের সব ব্যাপার খুলে বলা যাবে বলে মনে হলো।
আচ্ছা?তাকে কি ভালোবাসার কাঙাল বলা যায়?নাহলে এত অল্প স্নেহে তার মতো তেজি, পাথর মনের মেয়ের চোখ অশ্রুতে টইটুম্বর হয়?!
#চলবে।