একটি জটিল প্রেমের গল্প পর্ব-১১

0
294

#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-১১

সমূদ্র নিজে অশান্ত হলেও বোধহয় অনেক অশান্ত মনই শান্ত করে দিতে পারে। আর নতুন সূর্যোদয় সেই মনের শান্তির সাথে জুড়ে দেয় নতুন আশার আলো। ভাগ্যে বোধহয় লেখা ছিল, নয়তো কে জানত এক কার্তিক মাসের হালকা হিমেল মিষ্টি সকালটা আমি আর আফ্রিতা একসাথে দেখব? তাও কোনো ঝগড়া-বিবাদ ছাড়াই?

এখানে আসার পর দুটো দিন পেরিয়ে গেছে কেমন করে জানি না৷ চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে উড়ে যাওয়া দিন দুটো ধরে রাখতে চেষ্টা করতে করতেই কেটে গেল। রয়ে গেল অল্প ক’টা স্মৃতি৷ আফ্রিতার সাথে এই দু’দিন একেবারেই কথাবার্তা হয়নি। চোখাচোখি হয়েছে শুধু। শেষ কথা হয়েছিল বাস থেকে নামার সময়। ওর ব্যাগটা নামিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলাম৷ বিরিয়ানি কাহিনীর পর আমার ইচ্ছে হয়নি ওর সাথে কথা বলার৷ সত্যি অভিমান হয়েছিল। আমার মতো পেটুককে না দিয়ে খেয়ে নিল! কী স্বার্থপর মেয়ে! আফ্রিতাও কাজটা করে ফেলে বোধহয় খানিকটা আত্মগ্লানিতে ভুগছিল। বাস থেকে নামার সময় নিজে যেচে কথা বলেছে৷ আমি পাত্তা দেইনি বলে চুপসে গেছে কিছুটা। এরপর থেকে কেউ কারো সাথে কথা বলছি না।

আজ ঘটনা কী করে যেন এলোমেলো হয়ে গেল। রাতে ঘুম হয়নি। নতুন জায়গায় আমার ঘুম হয় না। প্রথম দু’রাত জার্নির ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসলেও গতরাতে আর এলো না। শেষে ভাবলাম শুধু শুধু শুয়ে না থেকে সূর্যোদয় দেখে আসি। ভেবেই জামাকাপড় পরে বের হয়ে এলাম। সৈকতে এসে দেখি আফ্রিতা। কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে দূর থেকে দেখার পর থেকে ওর কাছাকাছি আসার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় ও আবছা আলোতে আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। এমনকি আমিও। আমরা পাশাপাশি দাঁড়ালাম। বিষে বিষক্ষয় হয়ে গেছে বোধহয়। দু’জনার বাজে ব্যবহার কাটাকাটি হয়ে গেছে। এখন আর কারো ইচ্ছে নেই অন্যকে খোঁচা মেরে কথা বলার।

আমরা পাশাপাশি দাঁড়াতেই সূর্যটা একটু একটু করে আঁধারের বুকে জেগে উঠতে শুরু করল। একটা কমলা আভা আকাশময় ছড়িয়ে দিল ভোরের বার্তা। সময়টা ভারি মন কেমনের। আফ্রিতা নিজের অজান্তেই আমার একটা হাত চেপে ধরল। আমার কী যে ভালো লাগল! মনে মনে সমূদ্রকে বললাম, “তুমি এত জাদুকরী কেন!”

অবশ্য আফ্রিতা একটু পরেই আমার হাত ছেড়ে দিল। সূর্যোদয় শেষে ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকল দূরে। আমিই এগিয়ে গেলাম।

“কেমন কাটছে?”

“ভালো। তোমার?”

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম আফ্রিতার মুখে তুমি শুনে। কথাই বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ। আফ্রিতা আমার চোখের দিকে চেয়ে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। আমি হেসে ফেললাম৷ আফ্রিতাও।

তারপর অনেক গল্প হলো। খুব স্বাভাবিক দুটো মানুষের প্রথম দেখায় যেমন গল্প হয় তেমন গল্প। আফ্রিতাকে আবিষ্কার করলাম সম্পূর্ণ নতুন একটা রূপে, খুব মিষ্টি মেয়ে হিসেবে, যে গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলে, সামনের মানুষটার পছন্দ অপছন্দ বুঝে চলতে জানে। আমার ঠিক বিশ্বাস হতে চাইল না। বার বার মনে হতে লাগল এসব আফ্রিতার চাল নয় তো? আবার ইচ্ছে করে আমাকে নিয়ে খেলছে না তো? কথা শুনে যদিও তা মনে হচ্ছে না। তবু বড্ড বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।

আমার চুলগুলো এখনো অত বড় হয়নি। ছোট ছেট চুলেই হাত চালাচ্ছি। মন একটু অশান্ত থাকলে এরকমই করতে থাকি বার বার।

আফ্রিতা হঠাৎ প্রশ্ন করল, “তুমি চুল কেটে ফেলেছিলে কেন?”

আমি কী যেন একটা ভাবছিলাম। ওর প্রশ্নে খানিক চমকে গিয়ে বললাম, “তুমি আমাকে তুমি বলছ ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে!”

আফ্রিতা একটু হেসে বলল, “সরি। তোমাকে অনেক কথাই বলার আছে। তার আগে যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলো!”

“কেন চুল ফেলে দিয়ে খারাপ লাগছে?”

“হ্যাঁ, খুব।” আফ্রিতা স্পষ্ট জবাব দিল, “তোমার চুলগুলো সুন্দর ছিল।” বলেই খানিক লাল হয়ে গেল। তবে এত দ্রুত সামলে নিল যে চোখের ভুল নাকি বুঝতে পারলাম না।

আমি একটু হেসে বললাম, “তোমার সাথে রাগ করেই চুল ফেলে দিয়েছি।”

আফ্রিতা জোরে হেসে ফেলল, “আমিও তাই ভেবেছিলাম।”

আমার খুব ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি সেদিন আকিব ভাইয়ের প্রেমিকার সাথে সেই কাজটা কেন করতে চেয়েছিল, কিন্তু করতে পারলাম না। আকিব ভাইকে ও এখনো পছন্দ করে কি না সেটাও জানা হলো না। আমরা অনেকক্ষণ সৈকতে হাঁটাহাঁটি করে ক্ষুধা লাগার পর চলে গেলাম একটা রেস্টুরেন্টে। বাইরে থেলে কুঁড়েঘরের মতো দেখতে হলেও রেস্টুরেন্টের ভেতর বেশ আধুনিক। খাবারও ভালো। খেতে খেতে আফ্রিতা বলল, “শুনেছি তুমি নাকি এখন বইটই পড়ো?”

“একটু আধটু।”

“তোমার সেদিনের কবিতা আবৃত্তি বাজে হয়েছিল, তবে তোমার চেষ্টাটা ভালো লেগেছে।”

আমি ওর অসংলগ্ন কথাবার্তার খেই ধরতে পারলাম না। আরও গুলিয়ে যেতে থাকল সবকিছু। আফ্রিতাও খোলাখুলি কিছু বলছে না। খাওয়ার পর আবার একটু হাঁটাহাঁটি করে হোটেলে ফিরব, তখন দেখি দলের বাকিরা মাত্র উঠে আসছে। হোটেলের সামনে গিয়ে আফ্রিতা বলল, “শোন, আমি এতক্ষণ তোর সাথে একটু নাটক করলাম৷ খুব মন চাইছিল বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে। কিন্তু কেউ তো নাই, তাই তোকে দিয়ে শখ পূরণের একটু চেষ্টা করেছিলাম৷ যদিও চেষ্টাটা ব্যর্থ ছিল। তুই বয়ফ্রেন্ড হিসেবে একেবারেই বাজে। যাই, একটু ঘুমাব। গতরাতে ঘুম হয়নি।”

আমি বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে মনে এই আশঙ্কা করেছিলাম, কিন্তু এভাবে বলবে ভাবিনি। সত্যিকারের ক্ষতবিক্ষত করা বুঝি একেই বলে। আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল নিজেকে সামলে নিতে। তারপর ধীরে ধীরে নিজের রুমে চলে গেলাম। লম্বা শাওয়ার নেবার পর আমার নিজেরও ঘুম পেল। একেবারে শরীর ভেঙে আসা ক্লান্তি আর হতাশার ঘুম। আমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তে না পড়তেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল বিকেলে।


আজ কক্সবাজারে আমাদের শেষ রজনী। তাই বেশিরভাগই কেনাকাটায় ব্যস্ত। আমিও বাড়ির সবার জন্য কিছু কিছু কিনলাম। সবচেয়ে বেশি নিলাম তিন্নির জন্য আচার।

কেনাকাটা শেষে একটা খুব সুন্দর দেখে মুক্তোর সেট ভারি পছন্দ হয়ে গেল। দাম বেশি, কিন্তু কেনার প্রচন্ড ইচ্ছে হলো বলে কিনে নিলাম। সামনে ক’দিন চলতে কষ্ট হবে, তা হোক! প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম আফ্রিতাকে। পেলাম না। সবাই আছে, সে নেই। আফ্রিতার সাথে যে মেয়ে দুটো রুম শেয়ার করছে, তাদের জিজ্ঞেস করতে বলল ওর নাকি শরীর খারাপ, সকালের পর আর বের হয়নি। অগত্যা হোটেলে রওনা হলাম।

আফ্রিতার রুমে নক করতে দরজা খুলে দিল। আলুথালু চুল, গায়ে ওড়নাটা চাদরের মতো জড়ানো, চোখদুটো ফোলা। কেঁদেছে নাকি ঘুমিয়েছে বোঝা গেল না। আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে বলল, “কী দরকার?”

“তোমার জন্য এনেছি।” বলে প্যাকেটটা ওর হাতে দিলাম।”

“কী এটা?”

“দেখে নাও।” বলে উল্টো ঘুরে চলে এলাম। ও নিশ্চয়ই দরজা ধরে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই কাঙ্ক্ষিত ফোনটা এলো।

“তুই আমাকে এটা কেন দিলি? নিয়ে যা এক্ষুনি। আমার লাগবে না।”

আমি শান্ত স্বরে জবাব দিলাম, “তুমি আমাকে কয়েক ঘন্টার বয়ফ্রেন্ড বানিয়েছিলে, সেজন্য আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। মনে করো সেই সময়টুকুর প্রেমিক ভালোবেসে তোমাকে দিল। এটা আর ফেরত নেব না। ভালো থেকো। আর আমার সাথে যোগাযোগ করো না, খুব খুশি হব তাহলে।”

আফ্রিতা ফোন রেখে দিল। আমিও মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এক টুকরো তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটা ভীষণ অর্থহীন মনে হতে থাকল। কী প্রয়োজন ছিল কাউকে ভালোবেসে অকারণে কষ্ট ডেকে আনার? আমি তখনও জানতাম না কষ্টের কেবল শুরু। আমার জটিল প্রেমের ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল কেবল। আসল জার্নি এখনো বাকি।

(চলবে)