একটি সাঁঝরঙা গল্প পর্ব-০৫

0
68

#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_০৫

দুপুর আড়াইটা, নিশো মাত্রই মসজিদ থেকে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। মাথার ওপরের ফ্যানটা অল্প গতিতে ঘুরছে। সে চোখের ওপর হাত রেখে কিছু চিন্তা করছিল। কিছু বলতে ফালাকের কথাটাই ভাবছিল। মেয়েটা খুব একটা ভুল কথা বলেনি। পড়াশোনাটাই শুধু তার দ্বারা হয়ে এসেছে। বিসিএস পরিক্ষার আর খুব বেশি দেরি নেই। পুরো বাংলাদেশের কম মানুষ বুকে আশা নিয়ে বিসিএস দেবে না। বেশিরভাগ স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই একাডেমিক পড়ার পাশাপাশি বিসিএস এর জন্য পড়ে। নিশোর কিছুই করা হয়নি। তার মুখস্থ করার ক্ষমতা অনেক। সহজেই কোন কঠিন বিষয়ও বুঝে যায়। এখন এই কয়েক মাসে প্রস্তুতি নিতে হলে খুব খাঁটতে হবে তাকে তার ওপর অনেক সময় প্রয়োজন। সময় সে পড়াশোনায় দিতে পারবে সেটার সমস্যা নেই। বেকার ছেলের আবার ব্যস্ততা আছে নাকি! তবে কিছু প্রয়োজনীয় বই, নতুন-পুরোনো খবরের কাগজ এসব কিনতে বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন হবে। বাবার থেকে টাকা সে চাইতে পারবে না। টাকা চাওয়া তো দূরের কথা এই মুখ নিয়ে বাবার সামনেই উপস্থিত হতে পারবে না সে।

নিশো বাবার দোষ দিতে পারে না। সব বাবারাই চায় তার ছেলে কিছু করুক। তার সমবয়সী সবাই কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু করছে শুধু সে-ই একমাত্র ব্যক্তি যে ভবঘুরে হয়ে বেড়াচ্ছে। কিছু একটা মাথায় আসতেই বোনের ফোনে কল লাগাল সে। রিং হচ্ছে আর তার বুক কাঁপছে। ফোনে ব্যালেন্সের পরিমাণ কম। কথা তো বলা সম্ভব হবেই না, তোয়া যদি কল রিসিভ করে তাহলে পরবর্তীতে মিসকল দেওয়ার পয়সাও থাকবে না। বড় ভাই হয়ে বোনকে মিসকল দিতে বিবেকে বাঁধলো তার কিন্তু উপায় নেই।

কল রিসিভ হলো না। তোয়া হয়তো কল কেটে দিল। মুখে হাসি ফুঁটলো নিশোর। মুহূর্তের মধ্যে ওপাশ থেকে কলব্যাক এলো। নিশো কল রিসিভ করতেই তোয়া ওপাশ থেকে স্নিগ্ধকণ্ঠে বলে উঠল,

“কেমন আছিস,ভাইয়া? তোর শরীরটা ভালো?”

মৃদু হাসিটা এবার প্রশস্ত হলো। এই মেয়েটা তার মায়ের পরের অবস্থানে আছে যার সাথে কথা বললে অটোম্যাটিক হেসে ফেলে সে। কী প্রশান্তি!

“হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস? আর মা?”
“সবাই ভালো আছি। কী করছিস?”
“শুয়ে আছি। তুই?”
“আমি খেয়ে রুমে আসলাম মাত্র। খেয়েছিস কিছু?”
“না, তবে এখনই খেতে যাব। একটা কথা ছিল।”
“হ্যাঁ বল।”
“আমার কিছু টাকা প্রয়োজন, বুঝলি! কিছু বই কিনতে হবে।”
“কীসের বই?”
“ভাবছি বিসিএস দেব।”
“সত্যি!”
“হ্যাঁ। এত খুশি হচ্ছিস যেন বিসিএস এ পাশ করে গেছি।”
“তো খুশি হব না? আমি জানি আমার ভাইয়া পরিক্ষা দিলেই পাশ করে যাবে। এত সুন্দর বুদ্ধি তোর মাথায় ঢোকালো কে?”

বলতে গিয়েও থেমে গেল নিশো। সে বলতে পারল না, “একটা অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটা তার মাথায় এই বিসিএস এর ভূতটা প্রেরণ করেছে। মেয়েটাকে শাড়ি আর দুইপাশে বেণী করলে অসম্ভব সুন্দর দেখায়। চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তবে এক পলকে চেয়ে দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আর তার কথা! কানে পৌঁছলে চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় সবকিছু থামিয়ে দিয়ে শুধু তার কথা শুনতে। আর হাসি! মাঝে মাঝে তো তার হাসি হৃৎস্পন্দটার গতি বাড়িতে দেয়। মেয়েটা সংসারের সাথে তাকেও সামলে নিচ্ছে।”

নিশোকে চুপ থাকতে দেখে তোয়া আবার বলে উঠল,“কী রে? কিছু বলছিস না কেন, ভাইয়া?”

গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে সংযত করে নিল নিশো। বলল,“আমিই ভাবলাম। আচ্ছা শোন, আমার নন-একাডেমিক যে বইগুলো আছে না? ওগুলো বিক্রি করলে বিশ-পঁচিশ হাজার আরামসে উঁঠে আসবে। তুই সেখান থেকে বেছে বেছে মোটা মোটা উপন্যাসের যে বইগুলো আছে সেগুলো থেকে সাত-আটটা বইয়ের ছবি তুলে আমাকে পাঠিয়ে দে। এই কয়েকটা সেল দিলেই হয়তো আমার প্রয়োজন আপাতত মিটবে। পরে নাহয় কিছু করতে পারলে আবার ওই বইগুলো কিনে ফেলব।”

নিশোর বই পড়ার অভ্যেস অনেকদিনের। স্কুল লাইফ থেকেই টাকা বাঁচিয়ে এখন অবধি তিন-চারশোর মতো বই সংগ্রহ করেছে সে। অনেক টাকার বই কিনেছে সে। রুমের একপাশ ভরতি শুধু বই আর বই। রুমে ঢুকলেই কেমন শান্তি শান্তি লাগতো তার। এখানে এই রুমে কোন বই নেই। বই ছাড়া সময়ও কাটতে চায় না তার।

হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। নিশো দরজার দিকে তাকিয়ে ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে বলল,“ছবিগুলো আমাকে পাঠিয়ে দে। কে যেন এসেছে। আমি ফোন রাখছি। মা’র খেয়াল রাখিস। বাবাকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলিস।”

ফোনটা বিছানায় রেখে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল নিশো। বাহিরে সাদা রঙের জরজেটের থ্রিপিস মাথায় শিফনের ওরনা দিয়ে প্রায় অষ্টাদশী সেই রমনী দাঁড়িয়ে আছে। তার পোশাক এবং অবয়ব বলে দিচ্ছে সে মাত্রই গোসল শেষ করে বেরিয়েছে। চুল থেকে পানি এখনো ঝরছে। সমস্ত কায়ায় যেন একটা স্নিগ্ধরূপ বিরাজ করছে।

“কিছু বলবে?” বেশ স্বাভাবিক গলায় শুধালো নিশো।

“জি। খেতে আসুন। বাবা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
“আবির ফিরেছে?”
“না, ভাইয়া বাহিরে লান্স করে নেবে। আপনি আসুন।”
“ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।”
“তাড়াতাড়ি আসুন। একটা কথা।”
“হুম?”
“একা একা খারাপ লাগছে বেশি?”
“না, খারাপ লাগছে না।”
“আচ্ছা আসুন।”

আর দেরি করল না ফালাক। সোজা হেটে গিয়ে বাসায় ঢুকল। নিশো দরজাটা লক করে নিজেও ছুটলো দুপুরের ভোজ সম্পন্ন করতে।
_______

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে জাভেদ সাহেব ঘুমিয়েছেন। নিজের হাত দিয়ে আপাতত তিনি কিছুও করতে পারছেন না। রাবেয়া বেগম নিজেই খাইয়ে দিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় সব কাজ করে দিচ্ছেন। জাভেদ সাহেব ঘুমোলে রাবেয়া বেগম মেয়ের রুমে আসলেন। ফালাক বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল। মাকে রুমে আসতে দেখে বই বন্ধ করল সে। রাবেয়া বেগম বিছানার এক পাশে বসলেন।

“পড়া হচ্ছিল?”
“জি, আম্মাজান।”
“কী পড়ছিলেন?”
“ আমাকে যে সাবজেক্ট গলাটিপে মে*রে ফেলতে চায় সেটা।”
“আইসিটি?”
“ইয়েস। আপনি আপনার মেয়ের শ*ত্রুকে চিনে গিয়েছেন! আপনার জন্য কেয়া কসমেটিকসের পক্ষ থেকে থাকছে একটা ফ্লায়িং কিস, উম্মাহ।”

রাবেয়া বেগম মুচকি হাসলেন। পা উঠিয়ে বসতেই ফালাক চেয়ার ঘুরিয়ে মায়ের দিকে ফিরে বলল,

“মা..”
“জি, বলুন।”
“সিরিয়াস ম্যুডে চলে এসো।”
“আসলাম। বল।”
“আমার কিছু টাকা লাগবে।”
“কেন?”
“লাগবে। কারণ বলতে পারব না। ভরসা রাখতে পারো তোমার মেয়ে বাজে খরচ করবে না।”
“আমার মেয়েকে আমি চিনি তবুও একটু আগ্রহ হলো এই আর কি! কত টাকা লাগবে?”
“অল্প, বেশি না।”
“কত অল্প?”
“এই ধরো, সাত-আট হাজার।”
“সাত হাজার নাকি আট হাজার?”
“উমমম আট হাজার দিলে ভালো হয় তবে সাত হাজারেও চলবে। বই কিনব।”
“এখন কীসের বই?”
“উপন্যাস। আমার উপন্যাস পড়তে ইচ্ছে করছে।”
“সামনে তোমার পরিক্ষা। এখন কোন উপন্যাস না।”
“আমার এখনই সংগ্রহ করতে হবে নইলে আমার ভালো লাগবে না। আমার বই লাগবেই। পড়াশোনাও ঠিকমতো করব কথা দিলাম। তুমি নিশো ভাইয়ার থেকে খোঁজ রেখো, আমি কেমন পড়ছি না পড়ছি।”

রাবেয়া বেগম ভ্রু কুঁচকালেন।
“এত টাকার বই কিনতে হবে?”
“হ্যাঁ। ”
“কখন টাকা লাগবে?”
“সন্ধ্যায়। আমাকে টাকা দিও, আমি নিশো ভাইকে বলব অনলাইনের পেইজে সেন্ড মানি করে দিতে। বই তিন-চারদিনে চলে আসবে।”
“ঠিক আছে।”

মুচকি হাসলো ফালাক। মাকে ইশারায় চুমু দিয়ে বলল,“মাথায় তেল দিয়ে দেবে?”
“চলো। বাসার সামনে বসি গিয়ে। চেয়ার বাহিরেই আছে।”
“ঠিক আছে। তুমি যাও আমি তেল নিয়ে আসছি।”

মা বেরিয়ে যেতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলল ফালাক। মৃদু হেসে নিশোকে ভেবে মনে মনে বলল,“সম্ভব হলে আমার সবকিছু আমি আপনাকে দিয়ে দিতাম। আপনি চাইলে আমাকেও। আপনার সেইদিনটা আমার দেখার শখ ভীষণ, যেদিনটায় আপনার মুখে প্রাপ্তির, সাফল্যের হাসি ফুঁটবে। আমি নিজের মনকে জানাতে পারব, আমি হেরে যাওয়া মানুষকে হৃদয়ে জায়গা দেইনি।”

#চলবে…….