একদিন নববর্ষা পর্ব-০৪

0
117

“একদিন নববর্ষা” -৪
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

বর্ষার কথায় আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। ততক্ষণে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে এসেছে তার। অন্যমনস্ক হয়ে সে যে একান্ত ব্যক্তিগত কথা বলতে আরম্ভ করেছিল সেটুকু বুঝতে পেরে সহসা উদগ্রীব হয়ে উঠল।
–” উনুনে তরকারি। পুড়ি যাবে। ” বলে পালিয়ে গেল মুহুর্তে।

বর্ষার দুঃখটা এতক্ষণে গোচরে এল আমার। বর্ষার পরিবারের আর কেউ কুঠিবাড়িতে কাজ করে না। সে ছাড়া। নিজের মেয়ে হলে বসির শেখ নিশ্চয়ই কুঠিবাড়িতে কাজের জন্য তাকে একা ছাড়তেন না। অবশ্য একটা কথা স্বীকার করতেই হবে। ওরা নিতান্ত হতদরিদ্র। অভাব যাদের নিত্য সঙ্গী, অল্পবয়সী মেয়ে বাড়ির বাইরে একা কাজের জন্য যাবে কিনা সে প্রশ্ন নিয়ে তাদের ভাবা চলে না। অভাব একটু হলেও ঘোচানোর জন্যই হয়তো মেয়েকে কাজে দিয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার যাই হোক। আমি এটুকু বুঝলাম বর্ষা তার জীবনে খুব একা।

***

এ গ্রামে যে গুটিকয়েক বাংলো বাড়ি আছে সেকথা আগেই জানিয়েছি। তার একটিতে উঠেছে রাহিল সোবহান নামে একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তিনি একা এসেছেন ছুটি কাটাতে। রাহিলের সাথে আমার পুরনো পরিচয়। সে শহরের নামকরা প্রকাশনীর মালিক। মাঝে বছর পাঁচেক ধরে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন বলা চলে। এর আগেও যে খুব ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল এমন নয়। রশু তার আসার খবর জানালো। সেই সাথে এও জানালো রাহিল আজ বিকেলে তার ওখানে চায়ের দাওয়াত করেছে। এর কিছুক্ষণ পরই রাহিলের বাংলো থেকে লোক এল। তখন মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর। লোকটা বলল রাহিল তাকে পাঠিয়েছে আমাদের নিয়ে যেতে। সে নিজেই আসত। এতদূর জার্নির পর শরীর ক্লান্ত থাকায় নিজে আসতে পারেনি।

পাঞ্জাবি আমার বরাবরের পছন্দের পোশাক। হালকা ঘিঁয়া রঙা পাঞ্জাবি গায়ে চাপাতে চাপাতে রশুকে বললাম,
-” নির্জনে সাহিত্যসাধনা করতে এসেছিলাম। তার দেখছি বারোটা বেজে গেল। এই বোধহয় শুরু। এরপর আরও কত বিশিষ্ট ভদ্রলোক একে একে এসে হাজির হয়, আর আমাকে সৌজন্যতা দেখাতে যেতে হয় আল্লাহ ভালো জানেন।”

রশু হাসল।
-” বাকিদের কথা পড়েও ভাবা যাবে। আগে চলুন এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎটা সেরে আসি।”

কুঠিবাড়ি থেকে পাক্কা দশ মিনিট দক্ষিণে হাটার পর নজরে এল সাদা বাংলো বাড়ি। রাহিল যেখানে উঠেছে।
হ্যাজাক বাতির আলোয় আলোয় ছেয়ে আছে পুরো বাড়ি। আমরা সিড়ি ভেঙে ওপরের গাড়ি বারান্দায় গিয়ে বসলাম। মিনিট খানেক পরই রাহিল এল। চল্লিশোর্ধ্ব বয়স। পোশাক ঝকঝকে। সাদা দাঁতে মৃদু হাসির ঝিলিক। শুনেছি কয়েকমাস আগেই তার স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে।
রাহিলের সাথে আমার কখনো গভীর বন্ধুত্ব ছিল না। লেখালেখির সূত্রে পরিচয়। তারপর একসাথে ওঠাবসা। কিন্তু তার আচরণ দেখে মনে হলো এককালে আমাদের মাঝে ভীষণ সখ্যতা ছিল। মাঝের বছর খানেকের বিচ্ছিন্নতার কথা যেন সে বেমালুম ভুলে গেছে।

–” আজ রাতে কিন্তু তোমরা আমার এখানে ডিনার করছ। আমি গনীকে বলে দিয়েছি। স্পেশাল চুই ঝালের মাংস রানা হচ্ছে। খুলনা তথা সুন্দরবনের বিখ্যাত খাবার। সুন্দরবনে এসে এখানকার বিখ্যাত খাবার খাব না তা কি হয়!” বলে রাহিল হাসল।

অগত্যা সে রাতে খাবারটা ওখানেই সেরে আসতে হলো। এবং সৌজন্যতা খাতিরে রাহিলকেও ফিরতি ডিনারের দাওয়াত দিতে হলো।

পরদিন সকালে রশু বর্ষাকে অতিথি আসার ব্যাপার টা জানালো। বর্ষাকে দেখলাম একটা লম্বা বাজারের লিস্ট ধরিয়ে রশুকে বাজারে পাঠিয়েছে।

সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। বসার ঘরটাতে দিকে দিকে জ্বেলে দেয়া হয়েছে অনেকগুলো সাদা মোমবাতি। সাদা দেয়ালের সেই বড় ঘরটাতে গুটিকয়েক মাত্র আসবাব। মাঝে তিনদিক ঘিরে সোফা। তার সামনে খয়েরী গালিচা বিছানো। মোমবাতির হলুদাভ আলোয় নব্বই দশকের, রাতের শুটিং স্পটের মতো লাগছে ঘরটাকে। রাহিলের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই সদর দরজায় বাইরে তার গলার স্বর শোনা গেল। রশু তাকে নিয়ে এল ভেতরে। রাহিলের হাতে খুলনার বিখ্যাত ইন্দ্রমোহন সুইটস। আমি মনে মনে হাসলাম। রাহিলের হঠাৎ এত অধীরতার একটা মানে পাওয়া যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

খাবার পর বারান্দায় গোল করে পাতা চেয়ারে বসে রাহিল বলল,
–” আ….তোমার এখানে পান পাওয়া যাবে নাব্য? আজকাল খাবার পর সিগারেটের মতো পান খাওয়াটাও একটা নেশায় পরিনত হয়েছে। ”

রশু এই কথা শুনে ভেতরে চলে গেল পানের সন্ধানে। খানিক পরে এসে বলল,
–” এবাড়িতে পান নেই। তবে আমাদের রান্নার লোক আনতে গেছে ওর বাড়ি থেকে। নিয়ে এসে যাবে এক্ষুনি। ”

চেয়ারের সামনে পাতা ছোট টেবিলে একটা হ্যাজাক বাতি জ্বলছিল টিমটিম করে। হ্যাজাকের আলোর প্রখরতায় ঝকঝকে পরিষ্কার ক্ষুদ্র বারান্দার চারদিক। রশু কোন কাজ না পেয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
রাহিল হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু একটা বলছিল। হঠাৎ বর্ষা এল হাতে পানের থালা নিয়ে। তার আগমন ভেপসা গরমে একপশলা বাতাস বওয়ার মতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল। বর্ষা আজ সব বন্দোবস্ত করে দিয়ে শুরু থেকেই আড়ালে ছিল।
তার পড়নে হালকা গোলাপি, মিহি সুতির সোনালি পাড় দেয়া শাড়ি। মাথায় আঁচল জড়ানো। বর্ষা দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। তার হাত মৃদু কাঁপছে। আমি তাকিয়ে আছি। একমুহূর্তের জন্য ভুলেই গেছিলাম যে ঘরে আমি আর বর্ষা ছাড়াও আরও কেউ আছে। মনে হতেই রাহিলের দিকে চোরা দৃষ্টিতে তাকালাম। দেখলাম রাহিল একদৃষ্টে চেয়ে আছে বর্ষার দিকে। কোনো রাখঢাক নেই। তার চাহনি অস্বাভাবিক। মুহুর্তে দুদর্মনীয় ক্রোধ জেগে উঠল ভেতরে। মনে হলো নিজের ভেতরের এই হঠাৎ জেগে ওঠা ক্রোধ টাও অস্বাভাবিক!
আর কিছু না ভেবে কেবল ঠান্ডা স্বরে বর্ষাকে বললাম,
–“ওটা টেবিলে রেখে তুমি যেতে পারো।”
কথা শেষ হওয়া মাত্রই বর্ষা পানের থালা টেবিলে রেখে চলে গেল।
সে চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে যেন রাহিল আবার স্বাভাবিক জগতে ফিরে এল। দরজায় বর্ষার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বলল,
–” হু ইজ শী?”
আমি থেমে শীতল স্বরে বললাম,
–” কাজের লোক। ” বলে তির্যক দৃষ্টিতে চাইলাম রাহিলের দিকে।
রাহিলের চোখে ঘোর লাগা দৃষ্টি। সেদিকে চেয়েই সে বলল,
–” শী ইজ বিউটিফুল! লাইক অ্যা ব্লসমড ফ্লাওয়ার।”

ক্রোদে দুচোখে অন্ধকার ঠেকল আমার কাছে চারদিক। নিজের অর্ধেকেরও কম বয়সী একটা মেয়ের দিকে এমন সাহিত্যিক উপমা ছুড়ে রাহিল তখনও অম্লান বদনে বসে আছে আমার সামনে। তার বলার ধরন আর বাঁকা চাহনি দেখে গা রিরি করতে লাগল আমার। পাঞ্জাবির ওপরের দুটো বোতাম খুলে আমি কলার ঝাঁকি দিলাম। মুখে সৌজন্যতার হাসি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে আমার জন্য। তখন রাহিল হঠাৎ আমার দিকে মনোযোগী হলো। ভুরু কুঁচকে বলল,
–“ঠিক আছো তো?”
আমি কেবল মাথা নাড়লাম। মুখের হাসি আগেই গায়েব হয়ে গেছে।
রাহিল গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসলো। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
–” আ…. নাব্য। তোমার লেখালিখি কেমন চলছে? শুনলাম আজকাল নিয়মিত তোমার নাম বেস্টসেলার তালিকায় উঠছে। লেখার জন্য সময় দিতে পারছো না নিজের ফ্যামিলিকেও। তা একটা, দুটো লেখা তো আমাদেরকেও দিতে পারো। তোমার পরবর্তী উপন্যাসটাই দাও না আমার প্রকাশনীকে। একসময় তো নিয়মিতই তোমার বই বের হতো ‘কল্লোল’ থেকে। ”

আমি ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসলাম। এই তাহলে রাহিলের মৈত্রীজোট নবায়নের জন্য উঠে পরে লাগার প্রকৃত কারণ। কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলাম রাহিলের দিকে। সে উত্তরের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে অতঃপর শীতল স্বরে বললাম,
–“আপাতত ‘অর্ধবিন্দু ‘ ছাড়া আর কোথাও লিখছি না আমি। সরি।”
বলে উঠে দাঁড়ালাম। বুঝিয়ে দিলাম যে এখানে আর এক মুহুর্তও বসতে চাইছি না আমি।

রাহিলকেও উঠতে হলো। এতক্ষণে তার মুখের হাসিতে ভাটা পড়েছে। স্বর নামিয়ে সে বলল,
–“তোমার সাথে একটা দূরত্ব গড়ে উঠেছিল। ভেবেছিলাম একসাথে কাজের মাধ্যমে আবার আমরা বন্ধুত্ব টাকে জিইয়ে তুলব। সে তুমি হতে দিলে না। কি আর করা। যাইহোক আজ আসছি।”

গম্ভীর মুখে তার কথায় সায় জানিয়ে আমি জায়গা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম।

***

মধ্যদুপুরের রোদ তির্যক হয়ে জানালা গলে এসেছে ঘরে। রোদের সাথে সাথে জঙ্গল থেকে নানা বিচিত্র, তীক্ষ্ণ সব শব্দও এসে মিশে যাচ্ছে। ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় এত প্রকার শব্দ তরঙ্গ তোলা ওই একটি মাত্র জানালাকে মনে হচ্ছে যেন একটা বড় আকারের সাদাকালো টিভি। ঝিরঝিরে তার সব দৃশ্যপট, কিন্তু শব্দের তরঙ্গ বেজায় প্রবল।

জানালার সামনের টেবিলে আমার সদ্য লেখা উপন্যাসের বিশটি পৃষ্ঠা এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। তার পাশে তিনটা চায়ের কাপ। সবগুলোর তলায় সামান্য কিছু চা তখনো অবশিষ্ট। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে আরও অসংখ্য পৃষ্ঠা। সেসব পৃষ্ঠার কোনো কোনোটাতে কেবল এক আধটা শব্দ লেখা। তারপর ছিড়ে ফেলে দিয়েছি। সকাল থেকেই এই প্রক্রিয়া চলছে।

এবার আমি লেখা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে শার্ট টা তুলে গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। বর্ষনের হাত ধরে চললাম সেই নদীর ধারে, হাটতে।

ঘন্টাদেড়েক পর শাওয়ার নিয়ে ঘরে ফিরে আমার চক্ষু চড়কগাছ। টেবিলে একটা পৃষ্ঠাও নেই। মেঝেতেও পড়ে নেই কোনো পৃষ্ঠা। ওগুলো একেকটা আমার জন্য অমূল্য। একবারের সাহিত্য পরের বার রচনা করলে কখনোই সেটা প্রথমবারের মতো মৌলিক হতে পারে না। আমি মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে চেষ্টা করলাম যাবার আগে পৃষ্ঠাগুলো কোথাও রেখে গেছি কিনা। কিন্তু যতদূর মনে পড়ল। এখানেই ছিল ওগুলো। আমি চিৎকার করে রশুকে ডাকলাম। রশু প্রায় সাথে সাথে চলে এল। আমার মুখ দেখে সে বোধহয় আন্দাজ করতে পারল কিছু হয়েছে। আমি থমথমে গলার বললাম,
–” সকালে লিখা পৃষ্ঠাগুলো এখানেই রেখে গেছিলাম। এখন খুঁজে পাচ্ছি না। একটু খুঁজে দেখো প্লিজ।”
রশু ব্যাপার টার গুরুত্ব বুঝে কোথাও খোঁজার বাকি রাখল না। কিন্তু পাওয়া গেল না একটা পৃষ্ঠাও। রশু এবার ভেবে বলল,
–” বর্ষাকে ডেকে আনি। ও কিছু জানলেও জানতে পারে। ” বলে সে চলে গেল।
আমি অনবরত মাথার চুলে আঙুল চালাতে লাগলাম। রাগ নিয়ন্ত্রণের এরচেয়ে সহজ উপায় আমার জানা নেই।

লেখালেখির ক্ষেত্রে আমি ভীষণ সিরিয়াস। সেটা রশু জানে। এর পূর্বেও বাড়িতে কয়েকবার গায়েব হয়েছে আমার লেখার কাগজ। তখন আমার রুদ্রমূর্তি রশু দেখেছে। সেসব কাগজ কাজের লোক ভুল করে ফেলে দিলেও তার বেশিরভাগ অবশ্যি পুনোরুদ্ধার করা গেছিল।

বর্ষা এল। তার পেছনে রশু। রশু তাকে জিজ্ঞেস করল,
–” এই টেবিলের ওপর যে কাগজ ছিল। তুমি দেখছো সেগুলো কোথায়? ” রশুর মুখ দেখে মনে হলো সে খুব করে চাইছে বর্ষার উত্তর টা যেন না বোধক হয়।
বর্ষা একবার আমার দিকে চাইল। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে। আমি উত্তরের অপেক্ষায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সে হাত কচলে আমতাআমতা করে বলল,
–“ও…ওইগুলা বাজে কাগজ ভাইবে আমি শুকনা পাতার সাথে পুড়ি ফেলছি।”
–“পুড়ে ফেলেছ?”
আমার আগে রশু চেঁচিয়ে উঠলো। তার চোখে হতাশার দৃষ্টি। আজ বর্ষাকে আমার ক্রোধানলের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
চলবে…..

অদ্রিজা আশয়ারী