একদিন নববর্ষা পর্ব-১০

0
113

একদিন নববর্ষা -১০
অদ্রিজা আশয়ারী
__________

ফের গরানবনে আগমনের উদেশ্য লেখালেখি হলেও ওতে এবার একদম মন দিতে পারছি না। বর্ষাতে শুরু হয়ে বর্ষাতেই শেষ হয়ে যায় দিন।
বর্ষা তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করে সময় কাটায় আমায় সঙ্গে। এছাড়াও রোজ সকালে রয়েছে আমাদের একসাথে প্রাতভ্রমণ। এখনো কেউ আমাদের একসঙ্গে দেখেনি কিংবা দেখে থাকলেও সে নিয়ে প্রশ্ন তোলে নি। এটা আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে। তবুও বর্ষা সর্বদা খুব ভীত আর সাবধানি থাকে।

আজ বিকেলে কাছেই একটা নদীতে মাছ ধরার উৎসব আছে। বর্ষার আজ আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার কথা। শার্টের হাতা গুটিয়ে আমি ফের একবার ঘড়ি দেখলাম। তিনটা বেজে সাতান্ন মিনিট। এখানে সন্ধ্যা নামে খুব দ্রুত। ঘড়ির কাঁটা পাঁচের ঘর পেরতে না পেরতেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বর্ষা এখনো কেন আসছে না!

শেষ বার আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে এবার দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে এলাম। উঠোনে হাটতে লাগলাম উদ্দেশ্য হীন। এরও প্রায় মিনিট দশেক পর বর্ষা এল। দৌড়ে কাছে এসে কানে হাত রেখে বারবার সরি বলে বাচ্চা মেয়ের মতো লাফালাফি জুড়ে দিল। বর্ষার হাসি-হাসি চঞ্চল মুখের ওপর দুটি সরু হয়ে আসা চোখে গাঢ় করে আঁকা অঞ্জন। দুহাত ভর্তি চুড়ির ঝুমুরঝুমুর শব্দে ভারি আমার চারপাশের বাতাস। আমি গম্ভীর মুখে বললাম, –
-” আজ না এলেই পারতে। এমনিতেও সন্ধ্যে নামতে আর বেশি দেরি নেই।”

বর্ষা মুখটা করুন করে বলল,
-” বললাম তো সরি।”

আমি হাটতে শুরু করলাম।
-“বারবার সরি বলছ যে। সরির মানে জানো তো?”

বর্ষা আমার সাথে পা মিলিয়ে হাটতে গিয়ে প্রথমে একটু হিমশিম খেয়ে গেল। তারপর এক ছুটে দুপা সামনে এগিয়ে পেছন ফিরে চোখ বড় বড় করে বলল,
-” ওমা! আপনি ভাবিছেন এই সামান্য কথার মানে আমি জানি নে বুঝি?”

-“কিচ্ছু ভাবিনি। তবুও একবার তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হল।”

কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বর্ষা হঠাৎ আমাকে ভেঙচি কেঁটে জোড়ালো পদক্ষেপে সামনে এগোতে শুরু করল।

আমি ফিচেল হাসলাম।
-“আচ্ছা থাক থাক। বলতে হবে না। এসো।”

সাথে সাথে মুখ গোমড়া করে দু পা পিছিয়ে ফের আমার পাশাপাশি হাটতে শুরু করল সে।

__________________

মাছ ধরার উৎসব দেখে ফিরতি পথ ধরার আগেই সন্ধ্যা নেমে এল। নদীর তীরে প্রচুর মানুষ এসেছিল। উৎসব টাও জমেছিল খুব। সন্ধ্যে নামতেই অনেকের সাথে আমরাও ফিরতি পথ ধরলাম। একে একে একসময় পথ ভিন্ন হয়ে এল সবার সাথে। আমি আর বর্ষা কেবল আমাদের গন্তব্যের একক পথিক হয়ে রইলাম।

পথঘাট বেজায় বন্ধুর। বনঘেঁষে সরু সরু রাস্তা। আষাঢ় মাস। সর্বদা পড়ছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। সরু রাস্তায় প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদা। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে যতটা সম্ভব কাঁদা বাচিয়ে হাটছি। ধূসর সন্ধ্যার আলোয় দেখলাম তবুও আমার বাদামি রঙা ডেনিম প্যান্টের অনেকাংশ কাঁদায় মাখামাখি। অথচ বর্ষার জলপাই রঙা শাড়িতে কোনো কাঁদা নেই। কাঁদা লাগেনি তার পায়েও। সে দিব্যি উৎফুল্ল হয়ে হেটে বেড়াচ্ছে।
-” এই পথ দিয়েই কি এসেছিলাম আমরা? ” কাছের বন থেকে ভেসে আসা একটা ডাহুকের সঙ্গী হারানো করুণ আর্তনাদের মাঝেই আমি বর্ষাকে প্রশ্ন করলাম।

সাঁঝের কালচে আলো পরদ ফেলে দিয়েছে তখন সবখানে। অরণ্যে, অন্তরীক্ষে, ভূতলে…। ফড়িং এর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, কাঁদা থেকে পা বাঁচিয়ে বর্ষা বলল,
-” উহু।”

-“তবে? ”

-“ওই পথে মানুষের চলাচল বেশি। ঘাট থেইকে সবাই ফিরতে শুরু করিছে। সবাই ওইপথেই ফিরবে। কেউ চিনে ফেলবার পারে। সময় বেশি লাগলেও এই পথ নিরাপদ। তাই এই পথ নিলাম।”

-“ওহ। তা আজ জলদি জলদি বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাস্ত হচ্ছো না যে? আজকের জন্য তোমার আম্মা তোমাকে ছুটি দিয়েছেন বুঝি?”

বর্ষা হাসলো,
-” আম্মা বাড়ি নাই। আমাদের দুই বাড়ি পরে সুমিদের বাড়ি। সুমি আজ নাইওর আসছে তো সেইখানে গেছে। ”

ভ্রু কুচকে বললাম,
-“নাইওর কি জিনিস? ”

উত্তরে বর্ষা তার সুধাময়ী স্বরে ছন্দ করে বলল,

“থাকো থাকো থাকোরে বইন পন্থের দিকে চাইয়া
বাপ- ভায়ে কমু খবর নাইওর নিত আইয়া।”

-“এইবার বুঝছেন?”

আমি বোকার মতো ডানে বামে মাথা ঝাঁকালাম।
-“কিচ্ছু বুঝিনি।”

-“নাইওর মানে হইলো বিয়ার পর মেয়ে লোকের প্রথম বাপের বাড়ি ফেরা।”

-” ওহ, এই ব্যাপার! তুমি গেলে না সেখানে? নাইওর দেখতে? ”

বর্ষা নিশ্বাস ফেলে বলল
-” আপনার জন্যিই যেতি পারলাম কই? আমি গেলে এইখানে কে আসত?”

-“সেকথাও ঠিক। তোমার আম্মা কিছু বলেনি, যাওনি যে?”

বর্ষা ঝাপসা হয়ে আসা আলোয় একবার আমার পানে চেয়ে রহস্য করে হাসলো
-” না। কইছি মাথা ব্যাথা।”

-“তারমানে মিথ্যে বলে এসেছো? ”

বর্ষা হ্যাঁ বলবে নাকি না। বুঝতে না পেরে দ্বিধান্বিত স্বরে আমতা আমতা করছে। আমার রাগ হলো। সহসা ভীষণ গম্ভীর স্বরে বললাম,
-“শোনো বর্ষা। মিথ্যে বলা আমার ভয়ানক অপছন্দ। হোক সেটা যেকোনো পরিস্থিতিতে। আর কখনো মিথ্যে বলবে না। মনে থাকবে তো?”

প্রতুত্তরে গাল ফুলিয়ে বর্ষা আমাকে রেখেই এগিয়ে চলল। সামনেই দেখলাম একটা সাঁকো। বর্ষা সোজা সেদিকে হেটে চলেছে। ভেবেছিলাম সাঁকোর কাছাকাছি গিয়ে হয়তো ডানে কিংবা বায়ে কোনো একদিনে মোড় নেবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম সে তড়তড়িয়ে বাঁশের চিকন সাঁকোটা পাড় হয়ে ওপারে চলে গেল। বর্ষা…. বর্ষা…ডাকতে ডাকতে ওকে অনুসরণ করে সাঁকোয় এক পা এক পা করে কিছুদূর এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লাম। সাঁকোটা ভয়ানক রকম দুলছে। কোনোমতে দুহাতে আঁকড়ে ধরলাম খাঁড়া বাঁশের ফালি। তারস্বরে চেঁচিয়ে বর্ষাকে ডাকতে শুরু করলাম।
-” বর্ষা, বর্ষা এদিকে এসো। আমি পড়ে যাবো। আমাকে বাঁচাও । প্লিজ হেল্প মি। কুইক। ”

সেই নিষ্ঠুর মানবী তখন খালের ওপারে দাঁড়িয়ে দমফাটা হাসিতে ফেটে পড়ছে। তার মাঝে আমাকে উদ্ধার করতে আসার কোনো লক্ষনই নেই।
-“এসো বর্ষা প্লিজ। নাহয় তোমার আর কোনদিন নাইওর আসা হবে না। তার আগেই বিধবার পোশাক গায়ে জড়াতে হবে। ”
শেষ কথাটা শুনে বর্ষার হাসি থেমে গেল। আগের মতো তড়তড়িয়ে কয়েক মুহূর্তের মাঝে সে চলে এল আমার কাছে। গলায় অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ঝড়িয়ে বলল,
-” এইসব কথা আরেকবার বললে আমি নিজেই ধাক্কা দিয়া আপনেরে এই সাঁকো থাইকা ফেইলা দিমু। ” বলে সে হাত বাড়িয়ে দিল।

তার সাহায্য নিয়ে খুব ধীর পদক্ষেপে চলতে শুরু করলাম। বর্ষার স্বরে আদ্রতা নেমে এসেছে,
-“আর কখনো কইবেন নে এমন কথা। আমার নাইওর আসতে হবে নে। তাও সই।”

এত সামান্য একটা কথা বর্ষার মন খারাপ করিয়ে দেবে ভাবিনি। পরিবেশ হালকা করার জন্য বললাম,
-“কি মেয়েরে বাবা! বিয়ে হবার আগেই স্বামীর বাড়ি থেকে না ফেরার ফন্দি এঁটে নিচ্ছো। শশুর বাড়ির জন্য এত অধীর হলে এখনি চল ঢাকায় চলে যাই।
তারপর তোমার বাবাকে ফোন করে বলল,
বসির সাহেব, আপনার মেয়েকে অপহরণ করে এনেছি। কোনো মুক্তিপণের বিনিময়ে একে আর আপনারা ফেরত পাবেন না। হা হা হা…..।”
বর্ষা তখনো আমার হাত ছাড়েনি। কথা শেষ হওয়া মাত্রই সে আমার বাহুতে কিল দিতে শুরু করল। সেই সাথে প্রবল হাসি।

সেই আঁধার রাত্রির প্রথম প্রহরে, এই বিরান ভূমিতে, সদ্য আঁধার নেমেছে যেখানে ধরিত্রীর বুকে। দুজন মানব-মানবী প্রাণ খুলে হাসছে। নিজেদের ভালোবাসায় এত বেশি মত্ত ছিল তারা। যে নিজেদের ভালোবাসায় প্রথম এবং চূড়ান্ত বাঁধার উপস্থিতি এড়িয়ে গেছিল তাদের নজর।

সামনে তাকিয়ে হঠাৎ বসির শেখের উপস্থিতি লক্ষ্য করে বর্ষা পাথরের মতো জমে গেল মুহুর্তে। আমার বাহু ছাড়তেও ভুলে গেল সে। আমার মুখের হাসি ম্লান হয়ে গেছে। নিজের জন্য নয়। বর্ষার পরিণতির কথা ভেবে। তবে ভেতরে একটা অদম্য জেদ দানা বাধছে। আমি অনায়াসে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারি। খেলার দান আমার দিকে ঘুরে যাবে। যদি বর্ষা একবার রাজি থাকে চিরজীবনের জন্য আমার হাত ধরতে!

কিন্তু সম্বিত ফিরে পেতেই বর্ষা চাপা স্বরে একবার ‘বাজান’ বলে হাত ছেড়ে আমার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। মনে হল মুহুর্তে আমার ভেতরের জেদ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির তৈরি কাঁচের দেয়াল টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল।

বসির শেখ মেয়ের তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় কেবল বলল,
-“বাড়িত যা।”

বর্ষা ভীত হরিণীর মতো ত্রস্ত পায়ে দৌড়ে চলে গেল। মুহুর্তে বসির শেখের পুরো মুখাবয়ব পালটে গেল। পুর্বের দিনের মতো সে আমাকে সালাম ঠুকে বলল,
-” এদিকে কই গেছিলেন সাহেব?”

ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলাম,
-” মাছ ধরার উৎসব দেখতে। ”

-“আমিও সেদিকেই যাচ্ছিলেম। শুনিছি বেশ ভালো মাছই উঠেছে। ভাইবছি কিছু কিনব। আপনি কিনবেন সাহেব?”

-“না। আমি ফিরব এখন।”

-” তাহলি পরে ভালো মাছ দেখে আমিই কিছু আপনের ওখানে পাঠিয়ে দেব নে। আপনার আসার লাগবে না।”
বসির শেখের গলার আন্তরিকতায় কোনো খাদ নেই।

আমি বেশিকিছু না বলে ফিরতি পথ ধরলাম। বুকের ভেতরের দ্রিমদ্রিম শব্দটা বাড়তে লাগল। বহু যত্নে গড়া একটা সুক্ষ কাঁচের দেয়াল হঠাৎ ভেঙে চূড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা দায়ক তীব্র অনুভূতিতে ভারি হয়ে এল ভেতর টা।

বসির শেখ মানুষ টা যে সহজ না বরং শেয়ালের মতো ধুরন্ধর তা বুঝতে পেরেছি। এত সহজে এই ব্যাপার টা সে ভুলে যাবে বলে আমার বিশ্বাস হলো না। বসির শেখ কিছু করতে চাইলে তার রোষানলে সর্বপ্রথম পড়বে বর্ষা। এই চিন্তা আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিল। সারারাত কাটিয়ে দিলাম একটা অজানা আশংকায়। আমার বর্ষা ভালো থাকবে তো!
চলবে…..….