#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখাঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ০৭
১০!!
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে পাত্রপক্ষ আসলো। তারা মোট পাঁচজন আসলো। পাত্র, পাত্রের বাবা, বড় চাচা-চাচি, আর বোন। পাত্রের নাম রাইয়্যান রাযীন। রাযীনকে দেখলে সুপুরুষ বলা চলে। তাছাড়া মার্কেটিং এ মাস্টার্স শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করছে। পারফেক্ট ব্যাচেলর যাকে বলে। তারা আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের আযান দিলো। ফলে সবাই নামাজ পড়ে তারপর কথা বার্তা বলবে ভেবে ঠিক করল। ততক্ষণে রাযীনের বোন রোমিসা, লিপির সাথে গিয়ে ঘরের ভিতরে বসল। লিপি রোমিসাকে সোজা শশীর ঘরে নিয়ে গেল। শশী তখন রুমে বসে ফোন টিপছিলো।
সজলকে এ পর্যন্ত একশ উনিশবার কল করেছে শশী কিন্তু প্রতিবারই সজলের ফোন বন্ধ পেয়েছে। অথচ সজল ঠিকই অনলাইনে আছে। সে ফেইসবুকে ফান পোস্ট করছে, কমেন্ট রিপলাই করছে। শশী মেসেজ করলে শুধু সিন করে রেখে দিচ্ছে। শশী ওর পোস্টে শুধু একটা কমেন্ট করেছিল, “চেক দ্যা ইনবক্স।” সজল ইনবক্স চেক ঠিকই করেছে কিন্তু কোনো উত্তর দেয়নি মেসেজের। শশী লিখেছিল, “তুমি যদি আমাকে কল না দাও বা মেসেজ রিপলাই না করো তবে আমি বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিব।”
সজলটা মেসেজটা দেখে কোনোরকম প্রতিক্রিয়াই করেনি। না শশীকে কল করেছে আর না ওর মেসেজের উত্তর দিয়েছে। শশী আপন মনে বলল,
‘আমি বুঝে গেছি সজল তোমার মনে কী আছে! তবুও সরাসরি তোমার সাথে কথা বলে কিছু বলার আছে আমার।’
রাযীনের বোন রোমিসাকে দেখে শশী ছোট খাটো একটা ধাক্কা খেলো। শ্যামলা বর্ণের মেয়েটার চেহারা দেখতে ধারণার বাইরে সুন্দর। চুলগুলো লম্বা একটা বেণী করা। বেণীটা সামনে থেকে হাঁটু বরাবর পড়ছে। শশী রোমিসাকে দেখে বলল,
‘আপনার চুল কী সুন্দর!’
রোমিসা হাসিমুখে বলল,
‘ধন্যবাদ উড বি ভাবি।’
ভাবি ডাক শুনে শশী আবারও ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেয়ে বলল,
‘কে আপনি? আর আমাকে ভাবি কেন বলছেন?’
মৃদু হেসে রোমিসা বলল,
‘আপনাকে আমার কিন্তু ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আপনি দেখতে ঠিক আপনার নামের মতোই সুন্দর। এখন ভাইয়ার পছন্দ হলেই আপনি পারমানেন্টলী আমার ভাবি হয়ে যাবেন।’
শশী বুঝতে পারল যারা ওকে দেখতে রোমিসা তাদের একজন আর হতে পারে পাত্রের বোন। তাও লিপি বলল,
‘শশী ও পাত্রের বোন।’
রোমিসা শশীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘হ্যালো আপু, আমি রোমিসা। আর হ্যাঁ প্রথবার ভাবি ডেকে অাপনাকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য সরি।’
শশী মৃদু হেসে বলল,
‘ইট’স ওকে।’
রোমিসা আবার বলল,
‘কেমন আছেন আপু?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ভালো তবে প্লিজ আমাকে আপনি ডাকবেন না। আমি কেবল ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ি।’
শশী বলল,
‘সে আমি তোমার পটপট কথার ধরনেই বুঝে গেছি এ ইন্টারের নিব্বি।’
রোমিসা শব্দ করে হেসে বলল,
‘আমি কথা একটু বেশি বলি। বিশেষ করে যাকে পছন্দ হয় তার সাথে সহজে মিশে যাই।’
রোমিসা লিপির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনাকে কী ডাকব?’
‘তোমার যা ইচ্ছা। ভাবি অথবা আপু।’
‘ওকে আপু। আপু আপনার ঠোঁটের ডানপাশের উপরের তিলটার কারণে আপনাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে।’
লিপি লজ্জাময় ভঙ্গিতে বলল,
‘ধন্যবাদ। তুমিও দেখতে খুব কিউট।’
শশীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘শশী আপু, আপনাদের বাসায় দেখলাম সব মহিলারা-ই অনেক সুন্দর। এক বাসায় এত সুন্দরী মহিলাদের দিয়ে ভরে থাকলে বাকিরা সৌন্দর্য কোথায় পাবে?’
লিপি হেসে বলল,
‘কিউট হওয়ার সাথে সাথে তুমি বেশ পাকনা কথাও বলো।’
‘হুঁ মা-ও বলেন আমি খুব পাকা।’
লিপি মনে মনে খুব খুশি হলো। মনে মনে বলল,
‘ইদানিং তো আমার সৌন্দর্য কারও চোখে-ই পড়ে না। বিশেষ করে রেনু এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে কেউ আমার রূপের, গুণের প্রশংসা করে না। সবার প্রশংসা করা না করায় আমার অবশ্য কিছু আসে যায় না। তবে আমি সবসময় চাই আমার স্বামী সাজ্জাত আমার প্রশংসা করুক, ভালোবাসুক, যত্ন নিক। কিন্তু রেনু বউ হয়ে আসার পর সাজ্জাত রেনুর রূপে, গুণে এতটা মোহিত হয়েছে যে, উঠতে বসতে আমার সামনে রেনুর প্রশংসা করে। যেটা আমার একদম সহ্য হয় না। মূলত এটাই রেনুকে অপছন্দ করার আমার প্রধান কারণ। কোনো স্ত্রী-ই নিজের স্বামীর মুখে পরস্ত্রীর প্রশংসা শুনতে পছন্দ করবে না! আর রেনুর কারণে যেমন আমার স্বামী আমাকে মানসিক কষ্ট দেয়, তেমন কষ্ট আমিও রেনুকে দিতে চাই। ইদানিং আমার আর সাজ্জাতের সম্পর্ক মোটেও ভালো যাচ্ছে না। আমার কেন জানি তার জন্য রেনুকে দায়ী মনে হয়। আমার জীবন এমন ভালোবাসাহীন করে দেয়ার জন্য কোথাও না কোথাও রেনু-ই দায়ী।’
শশী, লিপিকে হালকা নাড়া দিয়ে বলল,
‘কী ভাবছো ভাবি?’
‘কিছু না। তুমি রোমিসার সাথে কথা বলো। আমি ওদিকটায় গিয়ে দেখছি।’
লিপি চলে যেতেই শশী বলল,
‘রামিসা।’
‘এক মিনিট আপু আমার নাম রোমিসা নট রামিসা।’
‘ওকে। তা তোমার ভাইয়ার নাম কী?’
‘রাযীন।’
‘তোমাদের সবার নামগুলো এমন অদ্ভুত কেন?’
‘অদ্ভুত মানে? এগুলো সব ইসলামিক নাম।’
‘না মানে আগে এমন নাম শুনিনি।’
‘তোমার নামের অর্থ কী?’
‘সৌন্দর্য।’
‘বাহ্! তা তোমার ভাইয়া বয়স কত?’
‘কিউরিসিটি হচ্ছে ভাবি?’
‘যার সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে তার সম্পর্কে কিউরিসিটি হবে না?’
‘হুম তা ঠিক। ভাইয়ার বয়স তো বেশি না। মাত্র পঁচিশ বছর।’
শশী রোমিসার সাথে এতটু মজা নিতে বলল,
‘কী বলো? তোমার ভাইয়া তো তবে আমার চেয়ে অনেক ছোট।’
‘কী বলছেন? আপনার বয়স কত?’
‘ত্রিশ বছর।’
রোমিসা বেশ অবাক হয়ে বলল,
‘কী বলেন? আপনি তো কেবল অনার্স শেষ বর্ষে পরীক্ষা দিচ্ছেন তাতে আপনার বয়স বড়জোর বাইশ-তেইশ হতে পারে।’
‘আরে পড়া-লেখার সাথে বয়সের কী সম্পর্ক? আমি এসএসসি পরীক্ষায় তিনবার ফেল করে চতুর্থবার পাশ করছি। এইচএসসিতে দুই বার ফেল করে তৃতীয়বার পাশ করছি। তারপর কোনো ভার্সিটিতে চান্স পাচ্ছিলাম না বলে এক বছর গ্যাপ দিয়ে তারপর এ ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি। তাও হিসাববিজ্ঞানে সহজে চান্স পাইনি। বাবা মোটা অংকের টাকা শিক্ষদের ঘুষ দিয়ে তবে ভর্তি করিয়েছে।’
রোমিসার চোখে মুখে বিস্ময় খেলা করছে। শশী রোমিসার চোখ দেখেই বুঝল রোমিসা ওর কথা বিশ্বাস করেছে। মনে মনে দুষ্টু হেসে বলল,
‘বিয়ে ভাঙার অর্ধেক কাজ সারা। বাকি অর্ধেক ছেলের সাথে দেখা হলে সারতে হবে।’
রোমিসা শশীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমি বরং সবার সাথে গিয়ে বসি।’
রোমিসা রুম থেকে যেতেই শশী মুখে শাড়ির আঁচল চেপে হাসতে লাগল। আর বলল,
‘মিঃ রাযীন কাম ফাস্ট। আপনার জন্য বড় বড় আন্ডা ভেজে রাখছি খাওয়াবো বলে। বিয়ের শখ একদম মিটে যাবে।’
বড়রা সবাই মিলে কথা বলছে। হাসি বেগম, লিপি, রেনুর মা তানজিলা সবাই তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। রেনুও হাতে হাতে টুকটাক করছে। যদিও শিহাব রেনুকে কড়া করে বলেছিল, যাতে কাজ না করে, বরং বিশ্রাম করে। কিন্তু রেনুর কেমন যেনো লাগছিল। ঘরের সব মহিলারা কাজ করছে, তো ও পটের বিবি হয়ে ঘরে বসে থাকবে সেটা শোভনীয় দেখায় না। যদিও হাসি বেগম রেনুকে প্রথম রান্নাঘরে দেখেই একবার বলেছিলেন,
‘তুমি এদিকটায় না আসলেও চলবে। ঘরে লোক কম নেই। তুমি একা কাজ করে দুনিয়া উল্টাইয়া ফেলবা না। তুমি নিজের শরীরের দিকে খেয়াল দাও।’
রেনু তার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেও নিজে নিজে টুকটাক করছে। যেমন: ফল কেটে দিচ্ছে, পিঠা, মিষ্টি, ফল প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছে।
বড়রা কথা বলার কিছুক্ষণ পর শশীর ডাক পড়ল। লিপি শশীকে নিয়ে সবার সামনে গেল। শশীর হাতে চা’য়ের ট্রে। শশী সবাইকে চা দিতে গিয়ে চোখ তুলে রাযীনের দিকে তাকাল কয়েকবার। সবাই শশীকে টুকটাক প্রশ্ন করছে, শশী ভদ্র মেয়ের মতো উত্তর দিচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে কী করে রাযীনকে জব্দ করা যায়! শশী মনে মনে বলল,
‘ছেলেটা দেখতে সত্যি হ্যান্ডসাম। আমি সজলকে ভালো না বাসলে একে হ্যাঁ বলে দিতাম।’
কিছুক্ষণ পর সবাই রাযীন আর শশীকে আলাদা কথা বলার জন্য বলল। লিপি, শশী আর রাযীনকে রুমের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেল। লিপি যেতেই শশী তিক্ষ্ণ চোখে রাযীনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দুষ্টু হেসে বলল,
‘তু তো গ্যায়্যা বাচ্চু!’
রাযীন হেঁটে হেঁটে শশীর রুমটা দেখছিল, শশী নিজের পা’টা বাড়িয়ে রাযীনকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে নিলে, রাযীন কিভাবে যেনো শশীর হাত ধরে টান দেয়। শশীকে সহ রাযীন, শশীর বিছানায় পড়ে যায়। না চাইতেও একে অপরের শরীরের সাথে শরীর লেগে যায়। শশী অপ্রস্তুত হয়ে যায় খুব। তাও নিজেকে সামলে উঠতে নিলে রাযীন ওর হাত ধরে বলল,
‘মিস শশী, আপনি যেমন বুনো ওল আমি তেমন বাঘা তেঁতুল। আমাকে বোকা বানিয়ে বিয়ে ভাঙা এত সহজ না।’
শশীর মুখও হা হলো, সাথে চোখ দুটোও মার্বেলের মতো বড় বড় হয়ে গেল। কোনো ছেলে ওকে এত বড় ঝটকা দিবে তা চিন্তাও করতে পারেনি। বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার আগেই রাযীন বলল,
‘রোমিসা বলল, আপনার বয়স নাকি ত্রিশের বেশি। ট্রাস্ট মি কথাটা শুনে এত খুশি হয়েছিলাম যে, যা আপনি ভাবতেও পারবে না। ছোটবেলা থেকে সিনিয়র আপুরা আমার ক্রাশ ছিলো। আর তেমন সিনিয়ার কেউ আমার বউ হবে। আমি তো ভাবতেই পারছি না। আমি তো বিয়েতে ১০০% রাজি। বাকি আপনার হ্যাঁ বা না বলাতে আমার কিছু আসে যায় না! বিয়ে তো আমি আপনাকেই করব।’
শশী এত হতভম্ব হলো যে, ও রাযীনকে জব্দ করার যা পরিকল্পনা করেছিলো সব ভুলে গেল। মনে মনে বলল,
‘এটা কি পোলা নাকি আগুনের গোলা?’
চলবে____