#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখাঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ০৬
‘রেনু আমি অনেক কিছুই মনে করেছি।’
রেনুর মুখটা ভয়ে বেশ চুপসে গেল। মনে মনে ভাবল,
‘তবে কি শিহাব আমাকে ভুল বুঝল?’
মৃদু হেসে শিহাব বলল,
‘যখন তুমি তার প্রশংসা করছিলে, সত্যি বলতে তখন, আমার খারাপ লেগেছিল। আসলে এ ব্যাপারটা স্বাভাবিক। নিজের স্ত্রীর মুখে অন্য পুরুষের প্রশংসা শুনলে যে কোনো পুরুষের-ই খারাপ লাগবে। তবে খারাপ লাগার সাথে সাথে তোমার সরল মনের সরল স্বীকারোক্তি শুনে বেশ ভালো লেগেছে। আমার প্রতি তোমার অব্যক্ত ভালোবাসার প্রকাশ করেছে শুনেও আমার খুব ভালো লেগেছে। বিশেষ করে যখন তুমি বললে তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো, সেটা শোনার পর আমার মনটা কতটা উৎফুল্ল হয়েছে তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। রেনু তোমার মনটা সত্যি খুব সরল। এভাবেই থেকো সারাজীবন। থাকবে তো?’
মৃদু হেসে রেনু বলল,
‘চেষ্টা করব।’
‘এখন ঘুমাও। মধ্য রাত এসব আলোচনার জন্য নয়।’
‘তাহলে কিসের জন্য।
শিহাব দুষ্টু হাসল। তারপর বলল,
‘এখন তো তুমি অসুস্থ। আগে সুস্থ হও তারপর বলব।’
শিহাবের চোখের ভাষায় রেনু ভীষণ লজ্জা পেলো। লজ্জাময় ভঙ্গিতেই বলল,
‘আমার ঘুম আসছে না।’
‘তাহলে চলো গল্প করি। কাল তো শুক্রবার আমার অফিস ছুুটি।’
‘ওহ হ্যাঁ কাল তো শশীকে দেখতেও পাত্রপক্ষ আসবে। বাসার সবাই কি তার প্রিপারেশন নিয়েছে?’
‘হ্যাঁ, ওসব নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। মা আর লিপি ভাবি সব সামলে নিবে।’
‘আচ্ছা। বিয়ের কথায় মনে পড়ল, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?’
‘করো?’
‘আপনার বয়স কত?’
‘হঠাৎ আমার বয়স নিয়ে পড়লে কেন?’
‘আগে বলেন তারপর বলছি।’
‘ছত্রিশ বছর। কদিন পর সাঁইত্রিষে পা দিব।’
‘আপনি এত দেরিতে বিয়ে করলেন কেন?’
রেনুর এমন প্রশ্নের জন্য শিহাব প্রস্তুত ছিলো না। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না! অপ্রস্ততুত ভঙ্গিতে আমতা আমতা করে বলল,
‘ইয়ে মানে…! আসলে…!’
‘সিক্রেট কিছু হলে বলার দরকার নেই। আই আন্ডারস্ট্যান্ড।’
‘না না তেমন কিছু না। তবে তোমাকে পরে একদিন বলব।’
‘পরে কেন? আজ সমস্যা কী?’
শিহাব কথা পাল্টা বলল,
‘মনে করো তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, তাই এতদিন বিয়ে করিনি।’
‘হতেই পারে না।’
‘কেন হতে পারে না?’
‘আমার যতদূর মনে পড়ে, আপনি প্রায় নয় বছর আগে প্রথম আমাদের বাসায় যান। তখন আমি পনেরো বছরের হলেও, আপনি সাতাশ কি আটাশ বছরের ছিলেন। তখন অলরেডি আপনার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছিল। ধরলাম আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাহলে তো, গত নয় বছর যাবত অপেক্ষা করছিলেন। এর আগে কেন বিয়ে করেননি? আর আমার জন্য অপেক্ষা করলে আমার সঠিক বয়স হবার পর আমার বাসায় কেন প্রস্তাব পাঠাননি? আর বিয়ে করলেন তা-ও আমার বিধবা হবার তিন বছর পর। গত তিন বছরে কিন্তু আমার জন্য অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু কোনো না কোনো কারণে তা ভেঙে গিয়েছিল। আমি যে বিয়েতে রাজি ছিলাম না তেমন কিন্তু না। আমার প্রাক্তন স্বামীর মৃত্যুর এক বছর পর থেকেই কিন্তু আমি বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিলাম। আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করলে এত বছর কেন চুপ ছিলেন? আর আমার সাথে পরিচয় হবার পূর্বে, মানে যখন আপনার গোল্ডেন এইজ ছিলো, যে বয়সে ছেলেরা প্রেম করে, বিয়ে করে তখন কেন বিয়ে করেননি? তখন কী আপনার কোনো পছন্দ ছিলো না? কাউকে ভালোবাসতেন না? যখন বিয়ে করার উত্তম বয়স ছিলো তখন কেন বিয়ে করেননি? শুনেছিলাম আপনি অনার্স শেষ করার পর পরই চাকরি পান, চাকরি করা অবস্থা এমবিএ করেছেন। আপনি পারফেক্ট ব্যাচেলর ছিলেন তবে কেন বিয়ে করেননি? বিয়ে তো দূরে থাক, কাউকে ভালোওবাসেননি কেন?’
রেনুর এতগুলো প্রশ্ন শুনে শিহাবের দম বন্ধ হওয়া অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ভিতর থেকে কেউ শ্বাসনালীটা চেপে ধরছে! অতীতের ভয়ানক সব স্মৃতি ওর চোখের সামনে ঘুরছে। রেনুকে বেশ শক্ত করেই ধমক দিয়ে বলল,
‘এত প্রশ্ন করো কেন? এত কথা জেনে কী করবা? যাও ঘুমাও। মধ্য রাতে প্রশ্নব্যাংক খুলে বসছে।’
শিহাবের কথায় রেনুর এত খারাপ লাগল যে সাথে সাথে ছোট ছোট জলরাশির বিন্দুতে ওর চোখ ভরে এলো।জলরাশিগুলো টুপ করে নিচে পড়ার আগেই রেনু মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল।’
রেনুর সাথে এমন ব্যবহার করে শিহাবেরও বেশ খারাপ লাগছে। মনে মনে বলল,
‘রেনু আমার অতীতের ওসব স্মৃতি আমি মনে করতে চাই না! চাই না তোমাকে কিছু জানাতে! সব কথা সবসময় সবাইকে বলা যায় না! ঐ স্মৃতিগুলো খুব কষ্টের ভয়াবহ। আমি তাদের মনে করে আমার বর্তমানকে ব্যথিত করতে চাই না।’
শিহাব বুঝতে পারল রেনু কান্না করছে। রেনুর পাশে শুয়ে, পিছন থেকে রেনুকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরল শিহাব। তারপর বলল,
‘সরি রেনু। আসলে সবসময় সব কথা তো বলা যায় না! কিছু কথা নিজ মনে একা একা সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়। আমি অতীতের সে কথাগুলো এখনও সাজাতে পারিনি। তোমাকে বলার মতো করে কথাগুলো সাজিয়ে, নিজের প্রস্তুত করতে পারিনি। আমাকে একটু গুছিয়ে নিতে দাও আমি তোমাকে সব বলব সব। তোমার কাছ থেকে কিছু লুকাব না। তুমি শুধু আমার উপর ভরসা রেখো। এই বিশ্বাসটা রেখো আমি এখন কেবল তোমাকেই ভালোবাসি। তোমাকে কখনো ঠকাব না আমি! আমার দ্বারা কোনো ভাবে তুমি প্রতারিত হবে না! প্লিজ আর কেঁদো না। সরি।’
রেনু শিহাবের দিকে ঘুরে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।’
‘আর আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটানোর পর শিহাব গভীর আবেশে রেনুর ঠোঁটে উষ্ণ পরশ দিয়ে আবার বুকে টেনে নিলো। রেনু লজ্জায় শিহাবের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
‘আপনি বড্ড পচা।’
‘হতে পারে।’
‘আচ্ছা কাল যে শশীকে দেখতে আসবে আপনারা কি শশীর মতামত নিয়েছেন? মানে ও বিয়েতে রাজি তো?’
‘জানি না। হয়তো মা জানেন। মায়ের সাথে তো শশীর সম্পর্ক খুব ভালো।’
‘তবুও বড় ভাই হিসাবে আপনারও ওর সাথে কথা বলা উচিত। ওর কোনো পছন্দ আছে কিনা?’
‘তা অবশ্য ঠিক বলেছ তুমি। তবে আমাদের মাঝে এইজ গ্যাপ এত বেশি যে দু’জন বন্ধু মতো কথা বলতে পারি না। কেন জানি আনইজি লাগে! তুমি তো ওর ভাবি। তাছাড়া তোমাদের বয়সের পার্থক্যও কম, তুমি কিন্তু চাইলে ওর সাথে কথা বলতে পারো।’
‘আপনার মনে হয় ও আমাকে সবটা খুলে বলবে?’
‘তাও ঠিক। ও তো তোমাকে একদম পছন্দ করে না।’
‘হুঁ সেটাই। আমার মনে হয় আপনি একবার ওর সাথে সরাসরি সহজ ভাবে কথা বলে দেখুন। ওকে এটা ভরসা দিন যে ওর সকল সিদ্ধান্তে আপনি ওর সাথে আছেন।’
‘আচ্ছা।’
৯!!
সকাল থেকেই শিহাবদের ঘরে তোরজোর চলছে। বিকালে শশীকে দেখতে আসবে। এবারের পাত্রকে বাড়ির সবার খুব পছন্দের। পাত্র ব্যবসায়ী। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। একটা ছোট বোন আছে তবে সে বিবাহিত। বাবার ব্যবসা এখন ছেলে দেখছে। দেখতে শুনতেও মাশাআল্লাহ। সব মিলিয়ে শশীর বাড়ির লোক পারলে আজই কাবিন সেরে ফেলে। কিন্তু ছেলে পক্ষ প্রথমে মেয়েকে সরাসরি দেখতে চেয়েছে। হাসি বেগম আর নূর ইসলাম আজ ভীষণ খুশি। এত ভালো পরিবারে মেয়ের বিয়ে হলে কে না খুশি হয়!
শশী সকাল থেকে একবারও রুম থেকে বের হয়নি। আর না সকালের নাস্তা করেছে। সকাল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে শুধু সজলকে কল দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু সজলের ফোন রাত থেকেই বন্ধ। শশী যতবার কল করেছে ততবারই অপর পাশ থেকে নারী কন্ঠে বলেছে, আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে সংযোগ দেয়া সম্ভব না। শশী যে ঘরের লোককে সজলের বিষয়ে বলবে তারও সাহস পাচ্ছে না। নিজেকে নিজে বলল শশী,
‘কোন ভরসায় আমি নিজের ভালোবাসার মানুষটার কথা ঘরে বলব? সে মানুষটাই তো এখন ভরসার যোগ্য নয়! সজল যদি তখন আমার কথা শুনে কাজ করার চেষ্টা করত তবে, আজ ওর একটা ইনকাম সোর্স থাকত। আমি তো মেয়ে হয়েও কয়েকটা টিউশনি করিয়ে নিজ খরচ চালাই। বাবা, ভাইয়ারা যা হাত খরচ দেয় সবটাই জমা করেছিলাম এই ভরসায় সজল যখন কোনো কাজ শুরু করবে ওকে হেল্প করব। কিন্তু ওর না আছে নিজের ফিউচার নিয়ে কোনো সিরিয়াসনেস? আর না আমাদের সম্পর্ক নিয়ে।
ওর সিরিয়াসনেস আছে শুধু বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, ঘোরা-ফেরায়। তাও নিজের টাকায় নয় বাপের টাকায়। বাবার অনেক টাকা আছে তাই জমিদার পুত্রের মতো বাপের জমিদারিতে খাচ্ছে মজা করছে। নিজের জীবনে যে, কিছু করতে হবে তার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কিছু বললেই বলবে আমার বাবার কি কম আছে নাকি যে এত ছোট বয়স থেকে কাজ করা শুরু করব? অথচ ওর বাবার টাকা পয়সা দিয়ে আমাদের সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শশী বলল, সকালে শিহাব ভাই জিজ্ঞেস করেছিল, আমার নিজের কোনো পছন্দ আছে কিনা? ভাইকে আমি কিছু বলতে পারিনি। কী বলব? যদি জিজ্ঞেস করে যাকে ভালোবাসি সে কী করে? তখন কী বলব? যে সে বাপের টাকায় পোদ্দারি করে। যার নিজের ইনকামে আমাকে একটা হেয়ার ক্লিপ কিনে দেওয়ারও যোগ্যতা নেই।
একটা পরিবার কারো কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়ার আগে তার বাবার কতটা আছে তা দেখে না, প্রথমে দেখে ছেলের কী আছে! আর আমাদের বেলায় সজলের বাবার আছে অঢেল, আর ওর আছে বা*ল। আজ মুখে কেন জানি খুব বাজে কথা আসছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে মুক্ত একটা জীবন কাটাই। যে জীবন ঝামেলামুক্ত, টেনশন মুক্ত। যেখানে শুধু ভালোবাসা নেই বরং শান্তিও আছে।ইদানিং আমার শান্তি চাই। ভালোবাসার চেয়েও বেশি, শান্তিময় একটা জীবন চাই। সজলের সাথে সম্পর্কে যাবার পর প্রথম দেড়-দুই বছর শান্তিতে কাটলেও গত দুই বছর যাবত অশান্তি আর অশান্তি। এত মানসিক চাপ আর নিতে পারছি না। আগামী বুধবার তো পরীক্ষা শেষ। তো বুধবার পরীক্ষা শেষে সজলের সাথে শেষ বোঝাপাড়া করব। তার আগে দেখি আদ্রভাই কী বলে?’
চলবে….