#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিল
লেখাঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ০৩
৪!!
শশী ভার্সিটির ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে সজলের জন্য অপেক্ষা করছে। বহু বছরের সম্পর্ক ওদের। আজ সজলকে বলবে বাসায় ওর বিয়ের কথা চলছে। সজল যেনো শীঘ্রই ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। চার বছরের সম্পর্ক ওদের। একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে। সেই ভার্সিটির প্রথম বর্ষে পরিচয় হয়েছিল। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব আর বন্ধুত্ব থেকেই প্রণয়। সজলকে প্রচন্ড ভালোবাসে শশী। সজলও তাই।
সজলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে শশী ভাবছিল ওদের প্রথম প্রেমে পড়ার কথা। দশটা সাধারণ প্রেমের মতোই। একই ক্লাসে একই বিষয়ে পড়ালেখা করে দুজন-ই। দুজন-ই হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স করছে। হিসাব বিজ্ঞানের হিসাব কষতে কষতে কবে যেন দুজন দুজনার মন দেওয়া নেওয়ার হিসাবটাও কষে ফেলে। অবশেষে বন্ধুদের সম্মুখে সজল একদিন শশীকে প্রেম প্রস্তাব দেয়। শশীও তো সজলকে পছন্দ করত, ও-ও অকপটে মেনে নেয়। শুরু হয় দুজনার প্রেমময় পথচলা। খুঁনসুটি, ভালোবাসায় কেটে যায় চারটি বছর।
শশীর আজও মনে পড়ে সে দিনটি যেদিন, সবার সামনে হাঁটু গেড়ে শশীর দিকে একগুচ্ছ লাল আর সাদা গোলাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলো,
‘তুমি কি আমার হবে শশী? আমি তোমায় ভালোবাসি।’
সে দিনটা ছিলো শশীর জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। আনন্দ অশ্রু নিয়ে শশী প্রিয় বন্ধুটির প্রেম নিবেদনে সাড়া দিয়েছিল। বন্ধুরা সব হইহই করে ক্যাম্পাসের মাঠের একটা কোণকে মুখরিত করে ফেলেছিল সেদিন। তারপর হাসি কান্না মিলিয়ে চারটি বছর বেশ কেটে যায় ওদের।
ক’দিন পরই চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, তারপর আর চাইলেও যখন তখন ক্যাম্পসে আসা হবে না শশীর। ঘরে হাজারটা বাহানা দিতে হবে। শশী চায় যত দ্রুত সম্ভব সজলের সাথে ওর বিয়েটা হয়ে যাক। কিন্তু শশী এটাও খেয়াল করেছে বিয়ের বিষয়ে সজল বেশ উদাসীন। এই যে শশীর জন্য এত বিয়ের প্রস্তাব আসে সবগুলো প্রস্তাব শশীই কোনোরকম কষ্ট করে ফিরিয়ে দেয়। সজল শশীকে বিয়ে করার কিংবা ওর জন্য আসা বিয়ের প্রস্তাবগুলো ভাঙার একদমই চেষ্টা করে না। শশী চায় ওর আর সজলের সম্পর্কের কথা ওদের দুই পরিবার জানুক এবং ওদের বিয়েটা জলদি হোক কিন্তু সজলের দিক থেকে তেমন কোনো পজেটিভ উত্তর পায়নি।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সজল এসে শশীর পাশে বসে বলল,
‘কী খবর? কখন আসলে?’
‘এই তো আধাঘন্টার মতো হবে।’
‘তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?’
‘ভালো। তোমার?’
‘হুঁ ভালো। তা বলো এত জরুরি তলব কেন?’
‘সজল তুমি বুঝতে পারছো না?’
‘না তো কী হয়েছে?’
‘বাসায় আমার বিয়ে নিয়ে সবাই খুব সিরিয়াস।’
সজল দুষ্টুমির সুরে বলল,
‘তো করে ফেলো বিয়ে। সমস্যা কোথায়?’
শশী বেশ রাগ করে বলল,
‘সমস্যাটা তুমি। তুমি কেন বাসায় আমাদের সম্পর্কের কথা বলছো না?আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছো না?’
‘তোমার মাথা ঠিক আছে শশী?’
‘এখানে মাথা খারাপের মতো কী বললাম?’
‘আমি একজন স্টুডেন্ট শশী?’
‘তো?’
‘আমার কোনো জব নেই, নিজের কোনো শক্ত অবস্থান নেই তো তোমাকে বিয়ে করে খাওয়াব কী? রাখব কোথায়?’
‘তাহলে সেটা তোমার প্রেম করার আগে ভাবা উচিত ছিলো।’
‘আর তাছাড়া আমার বয়স-ই বা কত? এখন কি বিয়ে করার মতো বয়স আমার?’
শশী বেশ রাগ করে বলল,
‘তোমার বিয়ে করার মতো বয়স হয়নি, কিন্তু আমার তো এখন বিয়ের উপযুক্ত বয়স।’
সজল মিনমিনে গলায় বলল,
‘কিন্তু আমার পরিবার তো আমাকে এত দ্রুত বিয়ে করার পারমিশন দিবে না।’
শশী বেশ শক্ত গলায় বলল,
‘জব, বয়স, পরিবার এসব তোমার বাহনা মাত্র। তোমাকে আমার এক কাজিন আদ্রর কথা বলেছিলাম না? যে তার ক্লাসমেট অথৈকে বিয়ে করে এখন সুখে সংসার করছে। তারা তো পড়ালেখা, প্রেম, বিয়ে, সব একসাথে সামলেছে। মূল কথা ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তোমার তো মনে হয় ইচ্ছাটাই নেই।’
‘তুমিই বলেছিলে, তারা তাদের পরিবার থেকে ফুল সাপোর্ট পেয়েছিলো কিন্তু আমরা যে তা পাব না তা তুমি ভালো করেই জানো।’
‘এখন কী করবে?’
‘আমি জানি না।’
‘এটলিস্ট তোমার পরিবারের সাথে কথা বলে এনগেজমেন্ট তো করে রাখতে পারো? তাহলে অন্তত আমার বিয়ে হবার ভয়টা থাকবে না।’
সজল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘দেখি আমার পরিবারে কথা বলার চেষ্টা করছি। দেখি তারা কী বলেন?’
উৎকন্ঠিত কন্ঠে শশী বলল,
‘প্লিজ সজল যা করার জলদি করো। আমার পরিবার থেকে বিয়ের জন্য ভীষণ চাপ দিচ্ছে। আগামী শুক্রবারও এক ছেলে আর তার পরিবার আমাকে দেখতে আসবে।’
সজল খানিকটা মন খারাপ করে বলল,
‘দেখছি কী করা যায়।’
৫!!
রেনুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রেনু যখন পড়ে যায় তখন হাসি বেগম অনেকটা ভয় পেয়ে ওর কাছে গিয়ে ওর নাম ধরে কয়েকবার ডাক দেয় কিন্তু রেনু কোনো সাড়া না দেয়ায়, তিনি পানির ছিটা দেয় ওর মুখে। রেনুর একটু জ্ঞান ফিরতেই তলপেট চেপে ধরে বলেছিল,
‘মা আমার পেটে প্রচন্ড ব্যথা করছে।’
রেনুর কথা শুনে তিনি নিচে তাকাতেই দেখলেন ফ্লোরে অনেক রক্ত। রক্ত দেখে রেনুও আতঙ্কিত হয়ে গেছিল। হাসি দ্রুত শিহাবকে কল করে বাড়ি আসতে বলে। শিহাব আসতে আসতে তিনি রেনুকে ধরে নিয়ে বাথরুমে যায়। রেনুর কাপড় পাল্টাতে সহায়তা করে। কাপড় পাল্টাতে গিয়ে তিনি আতকে ওঠে রেনুর কাপড়ের সাথে একটা রক্তের দলা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছোট্ট একটা ভ্রুন পৃথিবীতে আসার আগেই বিদায় নিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে।
তিনি রেনুকে প্রশ্ন করলেন,
‘তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলেন?’
রেনু নিজের বিস্ময় লুকাতে পারল না।বিস্ময়ের সাথেই বলল,
‘আমি জানতাম না।’
হাসি বেগম রক্তের চাকাটাকে টিস্যু দিয়ে হাতে নিয়ে বলল,
‘এই যে তোমার বাচ্চা। যে পৃথিবীতে আসার আগেই বিদায় নিয়েছে।’
এবার রেনু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। আবার মাথা ঘুরে ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছিল, হাসি বেগম কোনোমতে রেনুকে ধরে ফেললেন। তারপর কোনোরকম বিছানায় শুইয়ে দিলো। ততক্ষণে রক্তে আবার রেনুর কাপড় ভিজে গেলো। হাসি সেগুলো পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে কিন্তু রেনু বেশ লম্বা। রেনু লম্বায় পাঁচ ফুট ছয়, স্বাস্থ্যও মোটামুটি ভালো হওয়া, ছোট খাটো হাসি বেগম রেনুকে সামলাতে পারছেন না।
কিছুক্ষণের মধ্যে শিহাব চলে আসল। শিহাব রুমেই ঢুকেই আতঙ্কে জমে গেল। ওদের বিছানা রক্তে ভেজা, রেনু বিছনায় অবচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। ওর মা রেনুকে নাড়ানোর চেষ্টা করছে। শিহাব ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মা রেনুর কী হয়েছে?’
হাসি উৎকন্ঠিত হয়ে বলল,
‘ওর মনে হয় মিসক্যারেজ হয়েছে।’
হাসি বেগমের কথা শুনে শিহাব চূড়ান্ত অবাক কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করার আগেই হাসি বেগম বললেন,
‘অনেক ব্লাড যাচ্ছে। আমি এ্যামবুলেন্স খবর দিয়েছি। এসে যাবে হয়ত এখনই। তুই ততক্ষণে ওর কাপড়টা পাল্টে দে। আমি ওকে ঠিকভাবে নাড়াতে পারছি না। আর ওর জ্ঞানও ফিরছে না। এদিকে রক্তে ওর কাপড় সব ভিজে গেছে। শিহাবের চোখে রেনুকে হারানোর স্পষ্ট ভয়। রেনুর কাছে এসে বলল, মা তুমি গিয়ে গোছগাছ করো, আমি ওকে দেখছি।’
হাসি বেগম রুম থেকে বের হতেই শিহাব দরজা বন্ধ করে রেনুর কাছে আসল। রেনুর মাথায় হাত বুলিয়ে রেনুকে ডাকল,
‘রেনু! রেনু!’
কিন্তু রেনু সারা দিচ্ছে না।
শিহাব রেনুর কাপড় পাল্টে ওর শরীরটা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিল। রেনুকে প্যাড পরিয়ে, একটা কামিজ আর সেলোয়ার পরিয়ে দিল। ততক্ষণে হাসি বেগম সবাইকে ফোন করে খবরটা বলে দিলেন।
এর মধ্যে এম্বুলেন্স চলে আসলো।
হাসি বেগম আর শিহাব মিলে রেনুকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতালে জরুরি বিভাগে রেনুকে ভর্তি করানো হলো।
ডাক্তার শিরিন, রেনুকে দেখে কয়েকটা টেস্ট দিলো। ততক্ষণে রেনুর হুশ ফিরিছে। তবে রেনু বলার মতো কোনো কথা পাচ্ছে না। মনে মনে ভাবছে,
‘আমি প্রেগন্যান্ট হয়েছিলাম, সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি! আর আমার বাচ্চাটা আমাকে না জানিয়েই বিদায় নিলো।’
শিহাবও রেনুর সাথে কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ ওর পাশে বসে ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছে। ডাক্তার শিরিন টেস্ট রিপোর্টগুলো দেখে বলল,
‘উনি ছয় সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট ছিলেন। কিন্তু কোনো কারণে বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে। প্রচুর ব্লাডলস হয়েছে ওনার। এ কারণে ওনাকে ব্লাড দিয়েছি। আর ওনার ডিএনসি করাতে হবে।’
হাসি বেগম বললেন,
‘বাচ্চাটা নষ্ট হলো কেন?’
ডাক্তার রেনুর কাছে এসে বলল,
‘আপনি কি কোনোভাবে পড়ে গিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ তবে পড়ে যাবার আগে থেকেই আমার শরীর প্রচন্ড খারাপ লাগছিলো, পেটে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছিল।’
‘তখন কি ব্লিডিং হচ্ছিল?’
‘হালকা। আমি ভেবেছিলাম পিরিয়ড হয়েছে।’
‘আপনি জানতেন না আপনি প্রেগনেন্ট?’
‘জি না।’
‘ওহ। তা বিগত কয়েকদিনে কোনো ভাবে পেটে আঘাত পেয়েছিলেন?’
‘জি না।’
‘কোনো মেডিসিন নিয়েছিলেন? এ্যান্টিবায়োটিক কিছু?’
‘জি। দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা হওয়ায় দাঁতে ব্যথার ওষুধ খেয়েছিলাম।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডাক্তার বলল,
‘প্রেগনেন্ট অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতিত কোনো রকম এ্যান্টিবায়োটিক নেয়া নিষেধ। প্রেগনেন্ট অবস্থায় দাঁতের চিকিৎসা করাও প্রায় সবার ক্ষেত্রে নিষেধ থাকে। হয়তো এ কারণেই আপনার মিসক্যারেজ হয়েছে। যেহেতু আপনি জানতেনই না আপনি প্রেগনেন্ট সেহেতু আর কী বলা। এখন থেকে নিজের খেয়াল রাখবেন।’
রেনুর চোখ থেকে অনর্গল জল ঝরছে। শিহাব কিছুই বলছে না শুধু রেনুর মাথায় হাত বোলাচ্ছে। হাসি বেশ রাগ করেই বলল,
‘কেমন মেয়ে তুমি ! প্রেগন্যান্ট হয়েছো অথচ তা বুঝতেই পারোনি? তোমাকে দেখে তো এতটা বোকা মনে হয় না? নিজের প্রথম সন্তানকে নিজেই হত্যা করলে।’
শিহাব ওর মাকে চুপ করিয়ে বলল,
‘মা এসব কথা এখন রাখো প্লিজ। পরেও বলা যাবে।’
হাসি আর কিছু না বলে কেবিন থেকে বাইরে চলে গেল। বাকি সবাইও বাইরে। হাসি বের হতেই নূর ইসলাম বললেন,
‘কী অবস্থা রেনুর?’
‘মোটামুটি।’
‘সমস্যাটা কী?’
‘বংশে নতুন সদ্য আসার আগেই তাকে বিদায় করল। আমি তো এমনি এমনি ওকে অপয়া, অলক্ষী বলিনি। কোনো শুভ কাজ ওর দ্বারা সম্ভব না। প্রথমে স্বামী খেয়েছে, তারপর আমার ছেলের গলায় ঝুলেছে এখন আবার আমার ছেলের সন্তানকে পৃথিবীতে আসতেই দিল না। ওর ছাঁয়াটাও অশুভ। আহারে আমার নাতিটাকে পৃথিবীতে আসতেই দিল না। খুন করল আমাদের বংশধরকে। না জানি আর কত অঘটন ঘটায় অপয়াটা।’
হাসি বেগমের কথার প্রতি উত্তরে শশী বলল,
‘মা তুমি ভুল বললে?’
হাসি বেগম বেশ অবাক হয়ে শশীর দিকে তাকাল। শশী বলল,
‘মা ভাবি অপয়া, অলক্ষী তা মানতে পারলেও সে তার নিজের সন্তানকে খুন করবে এ কথা মানতে পারলাম না।’
চলবে______