এক‌দিন বিকা‌লে সকাল হ‌য়ে‌ছি‌লো পর্ব-০৪

0
523

#এক‌দিন_বিকা‌লে_সকাল_হ‌য়ে‌ছি‌লো
‌লেখাঃ শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ০৪

‘মা, ভা‌বি, অপয়া, অলক্ষী তা মান‌তে পার‌লেও সে তার নি‌জের সন্তান‌কে খুন কর‌বে এ কথা মান‌তে পারলাম না।’
‘‌কেন মান‌তে পার‌বি না?’
‘মা, কো‌নো মা কী তার সন্তান‌কে পৃ‌থিবীতে আসার আগেই হত্যা কর‌তে পা‌রে?’
‘‌কেন পা‌রে না। কত মে‌য়েই তো বি‌য়ের আগে অবৈধ বাচ্চা‌কে এবরশন ক‌রে। অনে‌ক মে‌য়ে বি‌য়ের পরও বি‌ভিন্ন কা‌র‌ণে এবরশন ক‌রে বাচ্চা মে‌রে ফে‌লে। তারা কী মা নয়?’
‘না তারা মা নয়। যারা অবৈধ সন্তা‌নের মা হয় তারা মা তো দূ‌রে থাক তা‌দের তো মে‌য়ে ব‌লেও গণ্য করা ঠিক না। আর বি‌য়ের পর বৈধ বাচ্চা‌কে সা‌মর্থ্যের অযুহা‌তে কিংবা বে‌শি বাচ্চার অযুহাতে মে‌রে ফেলে তারাও মা নয়। হ্যাঁ অনে‌কে একরকম, বাধ্য হ‌য়ে এবরশন ক‌রে। যেমন বাচ্চার কার‌ণে মা মারা যে‌তে পা‌রে তখন সেটা প‌রি‌স্থি‌তির স্বীকার। কেন মা তোমার ম‌নে নেই আমা‌দের প্র‌তি‌বে‌শী তা‌নিয়া আপুর কথা। আপুর বে‌বি জরায়ুর বাই‌রে প্র‌তিস্থা‌পিত হ‌য়ে‌ছি‌লো। ঐ যে যেটা‌কে এক‌টো‌পিক প্রেগ‌নে‌ন্সি ব‌লে! সে কার‌ণে তা‌নিয়া আপু‌কে না চাই‌তেও বাচ্চাটা নষ্ট কর‌তে হ‌য়ে‌ছি‌লো। তখন বাচ্চাটা‌কে রাখ‌লে আপুর বড় ধর‌নের ক্ষ‌তি হ‌তো। তি‌নি মারা যে‌তেও পার‌তেন। সেসব না হয় বাদ দিলাম। ভা‌বির বাচ্চা‌তো অবৈধ নয়, কিংবা তার প‌রিবা‌রে বে‌শি বাচ্চা অথবা বাচ্চার খরচ সংক্রান্ত কো‌নো সমস্যা নেই। তাহ‌লে ভা‌বি কেন নিজের সন্তান‌কে হত্যা কর‌বে? তাছাড়া ভা‌বি যে স‌ত্যি জানত না, যে সে প্রেগ‌নেন্ট, সে বিষয়ে আর কেউ বিশ্বাস না কর‌লেও আমি ‌বিশ্বাস ক‌রি।’

হা‌সি বেগম বেশ গম্ভীর গলায় বল‌লেন,
‘‌কেন তু‌ই এমন কী বিশ্বা‌সের কারণ পে‌য়ে‌ছিস?’
শশী ওর বাবা আর বড় ভাই সাজ্জাদকে উ‌দ্দেশ্য ক‌রে বলল,
‘বাবা, দাদা ভাই তোমরা গি‌য়ে চা খে‌য়ে এসো মা‌য়ের সাথে আমার পার‌সোনাল কথা আছে।’
তারা বুঝ‌তে পার‌লেন কো‌নো শশী রেনুর বিষ‌য়ে এমন কিছু জা‌নে, যা তা‌দের সাম‌নে বল‌তে ওর অস্ব‌স্তি হ‌চ্ছে। সে কার‌ণে শশী চা‌চ্ছে তারা ওদের কথা না শুনুক। তারা চ‌লে যেতেই শশী বলল,
‘ম‌া যতদূর ম‌নে প‌ড়ে মে‌বি দেড় মাস আগে ভা‌বি এক‌দিন রা‌ত বা‌রোটায় আমার কা‌ছে এসে বল‌লেন, শশী তোমার কা‌ছে এক্সট্রা প্যাড আছে? আমার হুট ক‌রেই পি‌রিয়ড হ‌য়ে‌ছে। আর প্যাড যে শেষ হ‌য়ে গে‌ছে তা খেয়াল ছি‌লো না। এত রা‌তে তোমার ভাইয়া‌কে ফা‌র্মে‌সি‌তে পাঠা‌তেও ইচ্ছা কর‌ছে না। বেচারা সারাদিন প‌রিশ্রম ক‌রে ফিরে এখন বিশ্রাম নি‌চ্ছে। আমা‌কে ক‌য়েকটা প্যাড দাও? কাল তোমার ভাইয়া আমার জন্য আন‌লে আমি তোমা‌কে ফেরত দি‌য়ে দিব। তো মা যেখা‌নে মাত্র দেড় মাস আগে ভা‌বির লাস্ট পি‌রিয়ড হ‌য়ে‌ছি‌লো তাহ‌লে সে যে প্রেগ‌ন্যান্ট এটা তার না জানাটা অস্বাভা‌বিক কিছু না। ভা‌বি হয়ত ভে‌বে‌ছে তার পি‌রিয়ড শীঘ্রই হ‌বে। বা ভে‌বে‌ছে আর ক‌দিন গে‌লে প্রেগ‌নে‌ন্সি টেস্ট করা‌বে। ভা‌বি‌র জানার ম‌তো সময়টা তো পে‌তে হ‌বে? সে সময়টাই তো ভা‌বি পায়‌নি বোধ হয়। মে‌বি পি‌রিয়‌ডের পর পরই ভা‌বি কন‌সিভ ক‌রে‌ছি‌ল। তি‌নি বোঝার আগেই দুর্ঘটনা ঘ‌টে গে‌ল।’

শশীর কথা শু‌নে হা‌সি বেগম খা‌নিক দমে গে‌ল। শশী আবার বলল,
‘মা তু‌মি আর ভা‌বি‌কে কো‌নো কথা ব‌লে তা‌কে কষ্ট দিও না। তু‌মি না‌তি হারা‌নোর খবর শু‌নে যতটা কষ্ট পা‌চ্ছো, ভা‌বি তার সন্তান হারা‌নোর খব‌রে তোমার চে‌য়ে হাজারগুন বে‌শি কষ্ট পা‌চ্ছে। এখন তোমার উচিত ভাই-ভা‌বি‌কে মান‌সিকভা‌বে সা‌পোর্ট করা বা‌কি ঝগড়া করার জন্য, কথা শোনা‌নোর জন্য সারাজীবন প‌ড়ে আছে। আর সত্যি কথা বল‌তে মা আমার ম‌নে হ‌চ্ছে ভা‌বির সা‌থে এখন আমা‌দের ঝগড়া করা বা তা‌কে কথা শোনা‌নো সম্পূর্ণ অযৌ‌ক্তিত। যা হবার তা তো হ‌য়েই গে‌ছে। ভাইয়া, ভা‌বি‌কে বি‌য়ে ক‌রে‌ছে, এখন আমরা শত চাই‌লেও, ভা‌বি‌কে বা‌জে কথা শু‌নি‌য়েও তা পাল্টা‌তে পারব না। তা‌দের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী-ই থাক‌বে। উল্টা ভা‌বি‌কে আঘাত মূলক কথা ব‌লে আমরা ভাইয়া‌কে কষ্ট দি‌চ্ছি। তার চো‌খে দিন‌কে দিন ছোট হ‌চ্ছি। আমা‌দের বিষয়টা নি‌য়ে গভীরভা‌বে ভাবা উচিত।
শশীর কথা শু‌নে হা‌সি বেগম চূড়ান্ত অবাক।

‌রেনু শিহা‌বের হাত ধ‌রে বলল,
‘আমা‌কে ক্ষমা ক‌রে দিন।’
‘‌কেন?’
‘আমার ভু‌লে আমা‌দের সন্তান পৃ‌থিবীর আলো দেখল না। পি‌রিয়ড ডেট মিস হ‌য়ে‌ছে এগা‌রো দিন হ‌লো। আমি ভে‌বে‌ছিলাম আরও ক‌য়েক‌দিন দে‌খে তারপর আপনা‌কে ব‌লে টেস্ট করাব। কিন্তু তার আগেই…।’
রেনুর চোখের কোণ বেয়ে জল গ‌ড়ি‌য়ে পড়‌ছে। শিহাব চো‌খের পা‌নি মু‌ছে দি‌য়ে বলল,
‘আ‌মি তে‌ামা‌কে খুব ভা‌লোবা‌সি রেনু। তু‌মি সুস্থ থাক‌লে আমার আর কিছ‌ু চাই না। আর দোষ তোমার নয় বরং আমার। দাঁ‌তে ব্যথার ওষুধ তো আমি-ই তোমা‌কে এনে দি‌য়ে‌ছিলাম। আমি ডাক্তা‌রের পরামর্শ না নি‌য়ে, নি‌জে পাকনা‌মি ক‌রে নি‌জের সন্তান‌কে হত্যা করলাম। তোমা‌কে এত কষ্ট দিলাম।’
‌রেনুর শিহা‌বের হাত ধ‌রে বলল,
‘‌প্লিজ ওভা‌বে বল‌বেন না। আপনার কো‌নো দোষ নেই। সবটা আমার কপা‌লের দোষ। আমার কপালটাই খারাপ।’
‘না তোমার কপা‌লের কো‌নো দোষ নেই সবটা মহান র‌বের ইচ্ছা। তি‌নি যা কর‌বেন সেটাই স‌ঠিক।’
‘‌শিহাব! আমি আপনা‌কে খুব ভা‌লো‌বে‌সে ফে‌লে‌ছি।’
‌শিহাব রেনুর কপা‌লে চু‌মো খে‌য়ে বলল,
‘এখন কান্না থা‌মি‌য়ে চুপ ক‌রে ঘুমাও। কিছুক্ষণ পর তো তোমা‌কে ডিএন‌সি কর‌তে নি‌য়ে যা‌বে। যা ব্লাড লস হ‌য়ে‌ছে তোমার আজ‌কে। তে‌ামার প্রচুর বিশ্রাম প্র‌য়োজন।

৬!!

রেনু‌কে আজ হাসপাতাল থে‌কে বা‌ড়ি‌তে নি‌য়ে আসা হ‌য়েছে। অতি‌রিক্ত রক্তক্ষ‌রণের ফ‌লে শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল। দুর্বলতার কার‌ণে সারাক্ষণ মাথাটা ভনভন ক‌রে ঘো‌রে ওর। রেনুর বাবা-মা ওর অসুস্থতার কথা শু‌নে সে‌দিনই এসে‌ছি‌লো। রেনুর বাবা চ‌লে গে‌লেও, ওর মা তান‌জিলা রেনুর কা‌ছেই থে‌কে যায়। রেনুর কা‌ছে আসার পর থে‌কে তান‌জিলা একটা বিষয় খেয়াল ক‌রে‌ছে রেনুর শাশু‌ড়ি ওর সা‌থে কো‌নো কথা ব‌লে না। তাছাড়া রেনুর শাশু‌ড়ি তার সা‌থেও তেমন কো‌নো কথা ব‌লে‌নি। দেখা হবার পর কুশল বি‌নিময় পর্যন্তই তার কথা শেষ হয়। তারপর থে‌কে তান‌জিলা-ই সে‌ধে সে‌ধে কথা বলে। তাও তান‌জিলা পাঁচটা কথা বল‌লে তি‌নি একটা ব‌লেন অথবা কো‌নো প্রশ্ন কর‌লে তার উত্তর দেন। তার কথার ধরন দে‌খেই বোঝা যায় প্রচন্ড বিরক্ত হ‌য়ে কথা বল‌ছেন। কিন্তু তবুও তান‌জিলা নিজ থে‌কেই কথা ব‌লে। তি‌নি মে‌য়ের মা, তার বে‌শি অহং‌বোধ থাকা মে‌য়ের সংসসা‌রের জন্য ক্ষ‌তিকর।

রেনু ঘুমা‌চ্ছে। তান‌জিলা রেনুর দি‌কে তা‌কি‌য়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে বলল,
‘আল্লাহ কেন যে আমার মে‌য়েটার এত পরীক্ষা নি‌চ্ছেন তিনি-ই জা‌নেন। রেনুর দি‌কে তা‌কিয়ে বলল, পরীর মতো দেখ‌তে আমার মে‌য়েটা। সচারাচার এমন সুন্দরী মে‌য়ে সবার চো‌খে প‌রে না। কিন্তু আমার এত সুন্দর মে‌য়েটার কপাল এমন কেন হ‌লো? মে‌য়েটার বি‌য়ের পরই স্বামীটা মারা গে‌লো। তারপর মানু‌ষের কত কুকথা শুনল। তিন বছর পর যাও সুখের মুখ দেখল, সে সু‌খেও কার নজর লাগল? প্রথম সন্তানের মুখটা পর্যন্ত দেখ‌তে পারল না। হে দয়াময় আমার মে‌য়েটার উপর রহমত ক‌রো। ওর জীব‌নে আর কো‌নো কষ্ট দিও না।’

মাত্র অফিস থে‌কে ফিরল শিহাব। গত চার দিন যাবত বেশ ধকল যা‌চ্ছে ওর উপর। অফিস করা, হস‌পিটা‌লে গি‌য়ে রেনুর দেখা‌শোনা সব মি‌লি‌য়ে বেশ হা‌ঁপি‌য়ে ওঠে। ছু‌টি পর্যন্ত নি‌তে পা‌রে‌নি। বি‌য়ের সময় দশ দিন ছু‌টি নি‌য়ে‌ছি‌লো। সে কার‌ণে এখন চে‌য়েও ছু‌টি পায়‌নি। কী কর‌বে বেচারা! নি‌জের কাজও তো দেখ‌তে হ‌বে। কাজ ঠিক না থাক‌লে প‌রিবার কী ক‌রে ‌ঠিক রাখ‌বে? তাছাড়া কোম্পা‌নির চাক‌রি‌। মোটা অং‌কের বেতন পে‌লেও তারা কাজও ক‌রি‌য়ে নেয় তেমন। নি‌জের প‌রিবারের এমন কষ্ট তো কর‌তেই হ‌বে। একজন পুরুষ য‌দি শুধু নি‌জের জন্য ভাবত ত‌বে সে এক‌দি‌নের ইনকা‌মে ক‌দিন ব‌সে ব‌সে খে‌য়ে আবার এক‌দিন কাজ কর‌লেই হ‌তো। কিন্তু প‌রিবা‌রের কথা ভে‌বে তারা নি‌জে‌দের আরাম বিসর্জন দি‌য়ে হাড়ভাঙা খাটু‌নি ক‌রে‌। শুধু প‌রিবা‌রকে একটু সুখী করার জন্য দিনরাত প‌রিশ্রম চ‌লে এদের।

‌শিহাব রুমে ঢু‌কে দেখল রেনু ঘুমা‌চ্ছে আর তান‌জিলা ওর মাথ‌ায় হাত বু‌লি‌য়ে দি‌চ্ছে। শিহাব‌কে দে‌খে তান‌জিলা বলল,
‘বাবা তু‌মি ফ্রেশ হ‌য়ে নাও আমি অন্য রু‌মে যা‌চ্ছি।’
‌তান‌জিলাকে দেখ‌লে শিহা‌বের প্রচন্ড লজ্জা ক‌রে। বি‌শেষ ক‌রে তান‌জিলা যখন তা‌কে বাবা বলে সম্ব‌োধন ক‌রে, তখন লজ্জায় তাকা‌তে পা‌রে না ও। কারণ অনেক বছর যাবত রেনুর ছোট মামা জিয়াউ‌লের বন্ধু হবার সুবা‌দে তান‌জিলা‌কে, শিহাব বড় আপা ব‌লে ডাকত। তান‌জিলাও, শিহাব‌কে ছোট ভাই‌য়ের ম‌তোই স্নেহ করত। দুষ্টু‌মি করত। তান‌জিলার সা‌থে ওর বয়‌সের পার্থক্যও তেমন না। সাত আট বছ‌রের বড় হ‌বে হয়ত তান‌জিলা। ভাই বো‌নের ম‌তো অনেক দুষ্টু‌মিই করত শিহাব। তান‌জিলারও শিহাব‌কে বাবা ব‌লে সম্বধন কর‌তে লজ্জা ক‌রে খুব। যা‌কে এত বছর ছোট ভাই‌য়ের ম‌তো স্নেহ ক‌রে‌ছে, সে হুট ক‌রে মে‌য়ের জামাই হ‌য়ে‌ছে। হুট ক‌রে সব সম্পর্কের নাম কেমন পা‌ল্টে গে‌লো। বি‌য়ের পর তো প্রথম প্রথম তান‌জিলা, শিহা‌বের সাম‌নেই পড়ত না।

বিষয়টা শিহাব বুঝ‌তে পে‌রে এক‌দিন জিয়াউল আর তান‌জিলা‌কে নি‌য়ে আলাদা ক‌রে ব‌সে ব‌লে‌ছি‌লো,
‘বড় আপা মা‌নে মা আমা‌দের আগের সম্পর্কটার নাম হয়ত পা‌ল্টে গে‌ছে কিন্তু আগের অনুভূ‌তি কিন্তু একরকম। বড় বোন সে তো মা‌য়েরই সমতূল্য। আর ছোট ভাই সন্তান সমতূল্য। এখন যেহেতু আপ‌নি আমার শাশু‌ড়ি হ‌য়ে‌ছে তো পারমা‌নে‌ন্টলি আপনা‌কে আমি মা-ই ডাকব। কারণ আপনা‌কে বড় বোন মান‌লেও আমি মায়ের ম‌তো সম্মান করতাম। তাছাড়া আমা‌দের ম‌ধ্যে তো র‌ক্তের কো‌নো সম্পর্ক নেই। আর এখন তো সৃ‌ষ্টিকর্তাই আমা‌দের সম্পর্ক মা সন্তা‌নের ম‌তো ক‌রে দি‌ছেন। তো এখন থে‌কে প্লিজ আমা‌কে দে‌খে দ্বিধাবোধ কর‌বেন না।
কথাগু‌লো শিহাব সে‌দিন তান‌জিলা‌কে বোঝানোর জন্য বল‌লেও ও নি‌জেই ওদের সম্প‌র্কের জ‌ড়তা কা‌টি‌য়ে উঠ‌তে পা‌রে‌নি।

তান‌জিলা বে‌ড়ি‌য়ে যেতেই শিহাব দরজাটা বন্ধ ক‌রে রেনুর কা‌ছে গে‌লো। রেনু তখনও ঘু‌মে। শিহাব ঘ‌ড়ির দি‌কে তা‌কি‌য়ে দেখল সন্ধ্যা সাতটা বা‌জে। রেনুর শরীর খুব খারাপ না থাক‌লে এসময় ও কখ‌নো ঘুমা‌তো না। রোজ এসময় যখন শিহাব ফিরত রেনুর শিহা‌বের পছ‌ন্দের সব নাস্তা বা‌নি‌য়ে তৈরী রাখত। শিহাব ফেরার সা‌থে সা‌থে হা‌তে এক গ্লাস ফ‌লের জুস কিংবা লেবুর শরবত দি‌য়ে বলত,
‘খে‌য়ে তারপর ফ্রেশ হ‌তে যান। আমি ততক্ষ‌ণে নাস্তা রেডি কর‌ছি।’
‌শিহাব ফ্রেস হ‌য়ে বের হ‌তেই ওকে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রত। তারপর বলত,
‘কেমন গে‌ছে আজ‌কে আপনার দিনটা?’
সা‌থে সা‌থেই যে‌নো শিহা‌বের সকল ক্লা‌ন্তি দূর হ‌য়ে যেত। নি‌জে‌কে একদম ঝরঝ‌রে লাগত। তা‌রপর বাসার সবার সা‌থে মি‌লে রেনুর হা‌তের মজাদার নাস্তা খেত। নিজেরা গল্প করত। রা‌তের খাবা‌রের পর অনেকটা সময় নি‌য়ে রেনুর সাথে গল্প করত, রেনু‌কে দেখ‌তে একদম শান্ত স্বভা‌বের ম‌নে হ‌লেও রেনু কথা বলায় বেশ চটপ‌টে। কথা বল‌তে বেশ ভা‌লোবা‌সে রেনু। বি‌শেষ ক‌রে শিহা‌বের সা‌থে ও প্রচুর কথা বলত। শিহাবও মুগ্ধ হ‌য়ে শুন‌তো। কথা বলার ছ‌লে রেনু‌কে বার বার ছু‌ঁয়ে দিত। ভা‌লোবাসার দেয়া নেয়া হ‌তো। রেনু খ‌ুব সহ‌জেই যে‌নো শিহা‌বের সা‌থে মি‌শে গি‌য়েছি‌লো। আর গত ক‌দিন যাবত রেনু কেমন নিশ্চুপ, র্নিজীব হ‌য়ে গে‌ছে। রেনুর এমন অবস্থা শিহা‌বের একদম ভা‌লো লাগ‌ছে না। সন্তান হা‌রা‌নোর ব্যথাটা রেনু যে‌নো ঠিক নি‌তে পার‌ছে না। নি‌তে তো শিহাবও পার‌ছে না, তবুও নি‌জের মন‌কে মা‌নি‌য়ে নি‌য়ে‌ছে শিহাব। কিন্তু রেনু তো মে‌য়ে, ওর মন খুব নরম ও নি‌জের মন‌কে মানা‌তে পার‌ছে না।

‌রেনুর দি‌কে তা‌কি‌য়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছে‌ড়ে শিহাব রেনুর কপা‌লে ঠোঁট ছোঁয়াল। রেনু‌কে ডাকল,
‘‌রেনু! রেনু!’
‌রেনুর ঘুম ভাঙ‌লেও রেনু চোখ বন্ধ ক‌রেই বলল,
‘শিহাব আমা‌কে একটু শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধর‌বেন?’
‌শিহাব রেনু‌কে ধ‌রে বসা‌লো। রেনুর চোখ তখনও বন্ধ। রেনু‌কে বু‌কের সা‌থে জ‌ড়ি‌য়ে ধরল। বেশ কিছুক্ষণ এমনভা‌বেই চ‌লে গে‌লো। রেনু শিহা‌বের বুকে মাথা রে‌খে বলল,
‘আপ‌নি কি আমা‌কে ভুল বু‌ঝে‌ছেন?’
‘‌কেন?’
‘আমার ম‌নে হ‌চ্ছে।’
‘কী ম‌নে হ‌চ্ছে?’
‘‌কেন জা‌নি ম‌নে হ‌চ্ছে সবার ম‌তো আপ‌নিও ভাব‌ছেন আমা‌দের সন্তা‌নের মৃত্যুটা আমার কার‌ণেই হ‌য়ে‌ছে?’
‌রেনু‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রেই শিহাব বলল,
‘এমন ম‌নে হবার কারণ?’
‘জা‌নি না।’
‘তোমার ভুল ম‌নে হ‌চ্ছে। তেমন কিছু না। আমি তোমা‌কে বিশ্বাস ক‌রি রেনু।’
‘আপ‌নি আমা‌কে কখ‌নো ছে‌ড়ে যা‌বেন না তো শিহাব?’
‘না।’

‌শিহা‌বের বুকে মাথা রে‌খেই রেনু বলল,
‘‌শিহাব জা‌নেন প্রথম আমার যার সা‌থে বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছি‌লো সেও খুব ভা‌লোমানুষ ছি‌লো কিন্তু তা‌কে আমি ভা‌লোবাস‌তে পা‌রি‌নি। আস‌লে তা‌কে ভা‌লোবাসার ম‌তো সময়-ই পাইনি। তার আগেই সে চ‌লে গে‌ছিল। সে চ‌লে যাওয়ায় কষ্ট হ‌য়ে‌ছি‌লো, সেটা হয়ত মায়ার টা‌নে। ত‌বে খুব বেশি কষ্ট আমি অনুভব ক‌রি‌নি। তার মৃত্যুর চে‌য়ে বাই‌রের লো‌কের কথা আমা‌কে বে‌শি যন্ত্রনা দি‌য়ে‌ছে। তারপর তার কথা আমার মা‌ঝে মা‌ঝে ম‌নে হ‌তো। মিথ্যা বলব না। মিস করতাম তাকে। ত‌বে ঐ যে ভা‌লোবাসা আছে না, যেটা‌কে ব‌লে ভে‌ঙেচু‌ড়ে ভালোবাসা, সে ভা‌লোবাসাটা তার প্র‌তি আমার ছি‌লো না। কিন্তু শিহাব আমি আপনা‌কে ঠিক সেই রকম ভা‌লো‌বে‌সে ফে‌লে‌ছি যে ভা‌লোবাসার মানুষ ব্য‌তিত মানু‌ষের নিঃশ্বাস বন্ধ হ‌য়ে যেতে চায়। আমার সবটা দি‌য়ে ভে‌ঙেচু‌রে আমি কেবল আপনা‌কেই ভা‌লো‌বে‌সে‌ছি। আপনা‌কে ছাড়া এখন কেন জা‌নি নি‌জের অস্তিত্ব কল্পনাই কর‌তে পা‌রি না। আমার এ ভু‌লের কার‌ণে আপ‌নি আমা‌কে ছে‌ড়ে দি‌বেন না তো?’

‌শিহাব আরও শক্ত ক‌রে রেনু‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘‌তোমার কো‌নো ভুল হয়‌নি রেনু। আর তোমাকে কেন ছাড়ব? তু‌মি যেমন আমা‌কে নি‌জের সবটা দি‌য়ে, ভে‌ঙেচু‌রে ভা‌লোবে‌সে‌ছো। আমিও তেমন শুরু থে‌কে নি‌জের সবটা দি‌য়ে কেবল তোমা‌কেই ভা‌লো‌বে‌সে‌ছি। প্লিজ রেনু এমন বা‌জে কথা আর ব‌লো না। আমি জা‌নি তু‌মি কিছুটা ইন‌সি‌কিউর ফিল কর‌ছো। তু‌মি জীব‌নে যেসব পরি‌স্থি‌তির সম্মুখীন হ‌য়ে‌ছো, তা‌তে এটা স্বাভা‌বিক। ত‌বে তু‌মি আমার উপর বিশ্বাস রাখ‌তে পা‌রো। আমি কখ‌নো তোমার বিশ্বাস ভাঙব না।’
শিহাব রেনু‌কে একটু খু‌শি কর‌তে বলল,
‘‌শো‌নো রেনু এবার তো প্ল্যা‌নিং ছাড়াই বাচ্চাটা কন‌সিভ হ‌য়ে গে‌ছি‌লো। তু‌মি আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হও তারপর আমরা কক্সবাজার যাব হা‌নিমু‌নে। বি‌য়ের পর ‌তো আমা‌দের হা‌নিমুন হ‌লো না। সেখা‌নে গি‌য়ে নাহয় নতুন বে‌বি প্ল্যান করব। প‌রের বে‌বিটাকে ফুলপ্রুফ প্ল্যান ক‌রে পৃ‌থিবীতে আনব। আর হ্যাঁ ক‌দিন পর থে‌কে শীত পড়‌তে শুরু কর‌বে, তখন যে‌নো তোমার বাহানা না শু‌নি, যে শীত কর‌ছে, তো রা‌তে গোসল করব কিভা‌বে?’
‌রেনু খুব লজ্জা পে‌লো। লজ্জায় শিহা‌বের বু‌কে একটা কামড় বসা‌লো।

৭!!

গত তিনদি‌নে সজল একবারও শশী‌কে কল ক‌রে‌নি। শশীও কল ক‌রে সজল‌কে পায়‌নি। সজ‌লের ম‌তিগ‌তি শশীর ঠিক ম‌নে হ‌চ্ছে না। শশী ম‌নে ম‌নে বলল,
‘হ‌রিা‌মিটা আমা‌কে চিট করার প্ল্যান কর‌ছে না‌তো? তাহ‌লে ওর ঠ্যাং ধ‌রে আমি পট ক‌রে ভে‌ঙে ফেলব। ঠিক যেমন চিং‌ড়ি মা‌ছের ঠ্যাং ভা‌ঙে। নাহ হারা‌মিটা‌কে অন্যভা‌বে শা‌য়েস্তা কর‌তে হ‌বে। শশী ফোনটা নি‌য়ে আদ্র‌কে কল করল। কল রি‌সিভ কর‌তেই শশী বলল,
‘হ্যা‌লো। আদ্র ভাই—।’

চল‌বে_____