এক আকাশ অভিমান পর্ব-০৪

0
158

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#পর্ব : ৪

গোধূলি বিকেল!! সূর্য ডুবে যাবে একটু পরেই। চারিদিকে লাল আভা ছড়িয়ে আছে। গ্রামের সবুজ মাঠ আর সূর্যের লাল আভা তার উপর আকাশের বুক চিরে অসংখ্য পাখি নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা রোমাঞ্চকর মুহুর্ত তৈরি হয়েছে। গোধূলি বিকেলটা এরকমই হয়। এইজন্যই হয়তো কবি থেকে শুরু করে প্রেমিক প্রেমিকা এই সময়টার প্রেমে পড়েন।

ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে গোধূলি বিকেলটা উপভোগ করছে তরী। হাঁটু সমান এলোমেলো চুল ছড়িয়ে আছে পিঠ জুড়ে। অনিক থাকাকালীন সময়ে মাঝে মাঝেই দুজন এই বিকেল টা উপভোগ করতো।

নদীর সাথে কথা বলতে ছাদে এসেছে শ্রাবণ। সিঁড়ি পার হতেই চোখ গেলো ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা এক এলোকেশী রমণীর দিকে। হৃদপিণ্ড থমকে গেল কিছু সময়ের জন্য। এই সেই এলোকেশী রমনী যার কাজল রাঙা চোখের গভীরে একটা সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলতো। যার দীঘল কালো চুল গুলোতে রক্তজবা গুঁজে দিতে মন চাইতো। এই সেই মায়াবিনী কন্যা যার দর্শনের আশায় সাঁতরে নদী পার করে উত্তরের মাঠে ছুটে যেত!! একটু এগিয়ে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সেই মায়াবিনী এলোকেশী রমনীকে। কত স্নিগ্ধ তার মুখখানা, ঘন কালো চোখের পাপড়ি, নিষ্পাপ তার চোখের চাহনি,, চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে মুখে গুটি কয়েক ব্রণ সাক্ষী দিচ্ছে রাতে ঘুমায় না মেয়েটা।এই মেয়ের মুখ কতই নিষ্পাপ অথচ মনটা তার থেকেও বেশি কু*ৎ*সি*ত। মুখ দেখে মনেই হয় না মেয়েটা কোনো পাপ করতে পারে।বেঈমানদের চেহারা কি এই রকমই মায়াবী নিষ্পাপ হয়? ঠিক যেনো মায়াজাল।

” এখানে কি করছো তুমি?তোমার মেয়েতো দেখলাম চাচীর কোলে কান্না করছে আর তুমি এখানে দাড়িয়ে ভাবনার সাগরে ডুবে আছো? ওহ হতেও পারে নতুন কারো জীবন নষ্ট করার ফন্দি আটছো। অবশ্য তোমার ভালো কিছু আশা করা বোকামি।যাও যাও মেয়েকে নিয়ে ভাবো। ”

কারো কণ্ঠস্বর শুনে পিছনে তাকালো তরী। শ্রাবণ দাড়িয়ে আছে বুকে হাত গুজে।
” মেয়েটা যেহেতু আমার তাই ওর সব ভাবনা ও আমার। আমি কাকে নিয়ে ভাববো না ভাববো সেটা আপনাকে বলে দিতে হবে না। আমার মেয়ের জন্য আমি আছি।”

” তুমি হয়তো ভুলে গেছো ‘তরিত্রী তরী ‘ তোমাদের মা মেয়ের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে”!!

“দায়িত্ব” শব্দ টা যতটা ছোট তার ওজন হাজার গুন ভারী।মুখে বললেই দায়িত্ব নেওয়া যায় না! সবাই পারে না সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করতে। প্রতিটা মানুষের জীবনে কিছু দায়িত্ব থাকে কেউ নিষ্ঠার সাথে পালন করে আর কেউ হেলায় কাটিয়ে দেয়। একটা মেয়ে যেমন মেয়ের দায়িত্ত্ব, বউয়ের দায়িত্ব, মায়ের দায়িত্ত্ব পালন করে ঠিক তেমনি ছেলেরা ও বাবা মার প্রতি ছেলের দায়িত্ব , বউয়ের প্রতি স্বামীর দায়িত্ত্ব, সন্তানের প্রতি বাবার দায়িত্ব পালন করে। আপনার এই লোক দেখানো দায়িত্ব আমাদের প্রয়োজন নেই। আমার মেয়ের দায়িত্ব ওর মা নিতে জানে।”

আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না তরী। দ্রুত নিচে নেমে এলো মেয়ের কাছে। ।


” বিশ্বাস করো নদী ওই মুহূর্তে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। এই বিয়েটা না করলে বাবা আমাকে তেজ্য করতেন। সাথে মা কে ও বাড়িছাড়া করতেন। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বিয়েটা করতে হয়েছে।”

” তাহলে তুমি ওই তরীকে ডিভোর্স দাও। আর আমাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নাও। বলো কবে দিচ্ছো ডিভোর্স?”

” ডিভোর্স দিবো তুমি একটু সময় দাও আমাকে। পরিস্তিতি টা একটু শান্ত হলেই আমি সব সামলে নিবো। এখন আমার হাতে কিছুই নেই।””

” তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো তো শ্রাবণ ? নাকি এখনো তুমি তরী কে ভুলতে পারো নি? ”

” মিথ্যে বলবো না , তরী ছিল আমার প্রথম অনুভূতি, আমার প্রথম ভালোবাসা। যাকে দেখে আমি মুগ্ধ হতাম বারং বার।আমার অস্তিত্ব জুড়ে ছিল তারই বিচরণ। ভালোবাসা কি জিনিস সেটা তাকে দেখেই শিখেছি।তবে সে আমাকে ঠকিয়েছে। আমার অনুভূতির সাথে খেলেছে। দিন শেষে অন্য কারো হাত ধরে আমাকে শেষ করে দিয়েছে। তুমি আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছো নদী। দ্বিতীয়বার যে ভালোবাসা যায় সেটা তুমি বুঝিয়েছো।তরীর জায়গা টা তুমি নিতে না পারলেও তুমি নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছো।”

রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো নদী। ফোন কেটে দিয়ে বললো ” তোমার মনে তরীর জন্য এক ফোটা জায়গা রাখতে চাই না শ্রাবণ। তোমার সবটা জুড়ে আমি রাজ করতে চাই। শুধু আমি।তরীর থেকে তোমাকে দূরে রাখতে হবে । আগুন আর ঘি একসাথে রাখা মানেই আমার বিপদ। তরীর অস্তিত্ব আমি মুছে দিবো চিরতরে।”


রাতের খাবার শেষ করে সবাই নিজ নিজ কক্ষে নিদ্রায় মগ্ন। জেগে আছে শুধু তরী।চাঁদ ঘুমিয়েছে সবে মাত্র। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ” তুই একদম তোর বাবার মতো হয়েছিস, চোখ, কান , নাক এমনকি ঠোঁট টাও তোর বাবার পেয়েছিস। কেনো রে ? মায়ের মতো একটু হলে কি হতো? তুই হয়তো বুঝে গেছিলি যে তোর বাবা তুই আসার খবর শুনেই চিরতরে হারিয়ে যাবে। তাই তো বাবার কার্বন কপি হয়েছিস।যেনো আমি তোর মাঝেই তোর বাবা কে খুজে পাই ।”

তরীর মনে পড়লো সেই দিনের কথা। চাঁদ পৃথিবীতে আসার দিন অনিক গিয়েছিল শহরে একটা কাজে।সেই দিনই তরীর ডেলিভারি পেইন শুরু হয়। সিরাজুল সাহেব আর রাবেয়া বেগম হাসপাতালে নেওয়ার পর অনিক কে জানানো হয়। অতিরিক্ত উত্তেজনা আর তাড়াহুড়া করে ড্রাইভ করতে গিয়ে ট্রাকের সাথে ধাক্কা খায় অনিকের গাড়ি।সেখানকার মানুষ জন হাসপাতালে নিয়ে যায়। বাড়িতে খবর জানানো হয় শুধু তরী ব্যাথিত।বাবার হাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে অনিক।ঠিক তখনই জন্ম নেয় চাঁদ। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে তরী। পুনরায় তাকালো মেয়ের দিকে।
“চাঁদ” আমার জীবনে তুই চাঁদের আলো হয়ে থাক মা।’ আমার জীবনে তোর বাবার আগমন ছিল উত্তপ্ত মুরুর বুকে এক ফোঁটা জলের মতো’। নিজের ব্যাক্তিত্বের কারণে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিল সে। সব কিছু হারিয়ে যখন নিঃস্ব আমি ঠিক তখনই ভরসা যুগিয়েছে সে। আমাকে ভালবাসতে বাধ্য করেছে। অথচ দেখ ভালোবাসা নামক যন্ত্রণার আগুন আমার বুকে জ্বেলে দিয়ে সে হারিয়ে গেছে তারাদের ভিড়ে।জানি না কি ভুল ছিল আমার। তবে একটা জিনিস বুঝে গেছি সবার কপালে সুখ সয় না।
জীবন তিন অক্ষরের ছোট শব্দ হলেও এর গভীরতা প্রশান্ত মহাসাগরের চাইতেও গভীর ।অনেকগুলো রঙের সংমিশ্রণের নামই জীবন। হাসি, আনন্দ যেমন জীবনের অংশ তেমনি দুঃখ, কষ্টও জীবনেরই অংশ। সেইসব রঙ ও অনুভূতিদের নিয়েই জীবন। জীবন একটা উপন্যাস এর মতই। ভূমিকা হোক বা উপসংহার আমার গল্পের শেষ পাতা জুড়ে তুমিই রবে। আমার স্মৃতির ভান্ডারে শুধু তুমিই থাকবে। তোমার মাঝেই আমার ভাবনার শুরু থেকে সমাপ্তি।

দরজার কড়াঘাতের শব্দে ধ্যান ভাঙলো তরীর। রাবেয়া বেগম হতে পারেন ভেবে দরজা খুলে দিল। শ্রাবণ দাড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে। নিভু নিভু চোখ, শরীল অস্বাভাবিক ভাবে দুলছে। তরীর বুঝতে বাকি রইলো না শ্রাবণ নেশা করে এসেছে।
তরীকে ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো শ্রাবণ। ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।তরী অনেকবার ডেকেছে তবে শ্রাবণ কোনো সাড়া শব্দ করে নি।
বিরক্ত হলো তরী। মেয়েকে বিছানা থেকে তুলে দুলনায় শুইয়ে দিল। নিজেও সোফায় শুয়ে পড়লো।
কত টা কান্ডহীন হলে বাচ্চা মেয়ে ঘরে আছে জেনেও নেশা করে আসে মানুষ।। ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিলো তরী।
ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বলছে শ্রাবণ। যেটা স্পষ্ট নয়।কিছুক্ষন ধরেই গোঙানির আওয়াজ শুনছে তরী।উঠে শ্রাবণের কথা বুঝার চেষ্টা করলো।
” তুমি আমাকে ঠকিয়েছ তরী। তুমি কথা রাখো নি। সার্থপর তুমি….আমার অনুভূতির মূল্য দাও নি…..

#চলবে ইনশা আল্লাহ