এক টুকরো মেঘ পর্ব-০৫

0
508

#এক_টুকরো_মেঘ ☁️
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০৫

ফোনটা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে পড়ে ।। সাথে খাবার আর খাবারের প্লেটের টুকরো পড়ে আছে ফ্লোরে।। আমি মাথা নত করে চোখের অশ্রু ফেলছি ।। পাশে অরিশ ভাইয়া চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এতো রাগ করার কি আছে বুঝতে পারছি না।।

— খুব সাহস বেড়েছে না তোর ।। তোর ডানা জাটার ব্যবস্থা আমি করছি।। একদিন আগেও ছেলেদের বলতে আমাদের চিনতি ।। আর আজ তনিমকেও চিনে ফেললি।। আজকের পর তোর ফোন ইউজ করা তো দূরে থাক ।। ফোনের কথা চিন্তা করলেও ।। আজ ফোনের যেই অবস্থা করেছি ,, সেদিন তোর অবস্থা ঠিক তেমন করবো ।। কথাটা যেন মাথায় থাকে।। ( আমার গাল চেপে কথাগুলো বলে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল অরিশ ভাইয়া।)

বুকের ভেতরের শ্বাস যেন‌ ভারি হয়ে উঠেছে।। পারছি না আর একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে।। খুব কষ্ট হচ্ছে।। চোখের অশ্রু যেনো কিছুতেই থামছে না।। আমি হেঁটে বেলকেনিতে গিয়ে আকাশে থাকা এক ফালি চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি ।। আজ নিজেকে বড্ড একা একা লাগছে।। চাঁদের কেউ না থেকেও চাঁদ আমাদের আপন করে নিয়ে ,, নিজের শক্তির অবক্ষয় করছে ।। আর আমার থেকেও সবকিছু ছেড়ে চাঁদের কাছে ছুটে চলে এসেছি।। মাথাটা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলাম।।

— আচ্ছা ,, তুমি আমাকে এতো কষ্ট দিয়ে কি পাই অরিশ ভাইয়া।। তুমি তো কথা দিয়েছিলে ।। আমাকে আর ব্যাথা দিবে,, আঘাত করবে না।। তাহলে কেন এমন করছো তুমি।। আমার যে কতোটা আঘাত লাগে তুমি কি সত্যিই বুজতে পারো না,, নাকি বুঝতে চাও না।।

একটু আগে যখন আমি পড়ায় ব্যস্ত ছিলাম ।। তখন হঠাৎ ই ফোনটা বেজে উঠে।। চেক করে দেখলাম,, অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন।। তাই ফোনটা রেখে আবার পড়ায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম।। প্রায় ৫ বার ফোন বাজার পরও যখন আবার ফোন বেজে উঠলো ।। তখন বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে নিলাম।।।

— হ্যালো!! আসসালামুয়ালাইকুম!! কে বলছেন???( আমি)

— আলাইকুম সালাম!! তুমি কি ঋনি বলছো??

— জি!! আমি ঋনি,, কিন্তু আপনি কে ??

— আমি তনিম!! তোমার ভাই অরিশের ফ্রেন্ড। চিনতে পারছো??

— ও আচ্ছা।। তা ভাইয়া আমার ফোন নম্বর কোথায় পেলেন ।। আর আমাকে ফোনই বা কেন করেছেন??( কৌতূহল নিয়ে আমি)

— একসাথে এতো প্রশ্ন করতে নেই !! তবুও উওর দিচ্ছি!! ১. আমার মনই তোমার ফোন নম্বর বলে দিয়েছে।। ২. তোমাকে আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছি ,, তাই ফোন করেছি।।

আর কিছু শোনার আগেই কেউ আমার হাত থেকে ফোনটা টেনে নিয়ে গেল।। এতোক্ষণ আমার পেছনে যে অরিশ ভাইয়া দাঁড়িয়ে ছিলো ,, সেটা একদমই আমি খেয়াল করিনি।। ভাইয়া এক হাতে খাবারের প্লেট দেখে আমার আর বুঝতে বাকি রইল না,, ভাইয়া আমাকে খাইয়ে দিতে এসেছে।। এবার ভাইয়া কেমন রিয়েকশন দিবে ভাবতে পারছি না।।আর কিছু ভাবার আগেই একটা বিকট আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখি,, আমার ফোন আর খাবারের প্লেট টা নিচে পড়ে আছে।। ভয়ে আমার গলা প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে।। ভাইয়ার দিকে তাকানোর সাহস অবধি পাচ্ছি না।। পরক্ষনেই ভাইয়া আমার চুলগুলো জোরে চেপে ধরলো।। ব্যাথা পেলেও কোনো রিয়েকশন করলাম না।। দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে নিলাম।।

— তনিম তোর ফোন নম্বর কোথায় পেলো।। ( দাঁতে দাঁত চেপে অরিশ)

ভাইয়ার কথায় আমি উওর দিলাম না ।। চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।।

— আই সেইড তোর ফোন নম্বর কোথায় পেলো তনিম!!( চেঁচিয়ে বললো অরিশ)

— আআমি জজানি না ভাইয়া!!( কাঁপা কাঁপা গলায় আমি)

আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দেয়ালের জোরে আঘাত করে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে ভাইয়া।। আমি আর সহ্য করতে পারলাম নিঃশব্দে কেঁদে দিলাম।

বর্তমানে নিজের রুমে ফিরে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে অরিশ ।। যখন তার চেষ্টা বারবার বৃথা হয় তখন সে ২ ঘন্টা শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে বেলকেনিতে গিয়ে ,, ঋনির রুমের দিকে উঁকি দিলো।। কিন্তু দেখা মিললো না ঋনির ।। নিরুপায় হয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জামালো অরিশ।।।

🍁 🍁 🍁

সকালে মাম্মাম নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দিয়ে রুম গুছিয়ে দিয়েছে।। ব্রেক ফাস্ট করেই আমি আরশিকে রেডি হয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসতে বলে নিজে রেডি হয়ে নিলাম। ঠিক করেছি আজকে আমরা রিক্সায় করে যাবো আবার ফিরবো।। স্কুটি চালিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়।। এখনো তো হাতের ব্যান্ডজগুলো খুলিনি।। কালকে সকালে খুলে তবেই কলেজের ফেয়ারওয়েল এ যাবো।। আরশিও তাতে রাজি হয়েছি।। ভেবেছি অরিশ ভাইয়াকে একদম নেবো না।। কিন্তু তা আর হলো না।। রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুম পর্যন্ত আসতেই দেখলাম ,, আরশি আর অরিশ ভাইয়া বসে আছে।। কিন্তু আমি তাকে নেবো না মানে একদমই নেবো না।। কিন্তু তা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না।। মাম্মাম আমাদের একা ছাড়বে না।। তার সাথে আবার অরিশ ভাইয়া বলছে ,, কালকে সে কথা দিয়েছিলো আমাদের সাথে যাবে তো আজকে যাবেই ।। তাই কোনো উপায় না পেয়ে নিতেই হলো।।

বাড়ি থেকে শপিং মল পর্যন্ত আমি ভাইয়ার সাথে একদমই কথা বলিনি আর ভাইয়া পছন্দ করে দেওয়া শাড়িও নেই নি।।কোনো শাড়ি হাত দিয়ে টাস অবধি করতে পারছি না ,,হাতে ব্যান্ডেজের কারনে।। হঠাৎ ই অরিশ ভাইয়া একটা নীল রঙের শাড়ি এনে ,, সেটা আমার গায়ে জরিয়ে দিয়ে,, তিনিও পেছন থেকে আমাকে জরিয়ে ধরলো।। এতো গুলো মানুষের মাঝখানে এই কাজ করাতে একদিকে লজ্জা অন্যদিকে অস্বস্তি বোধ করছি।। এদিকে আরশি কাবারের হাড্ডি মনে করে নিজে পালিয়েছে।।

— দেখেছো কতোটা মিষ্টি লাগছে তোমাকে এই নীল রঙের শাড়িতে ।। মনে হচ্ছে,, মেইড ফর ইচ আদার।। বুজেছো।। ( পেছনে ঘুড়িয়ে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে অরিশ)

— এই শাড়িটা আমাকে সুন্দর লাগছে কিনা তা সত্যি জানি না ।। এইটুকু জানি ।। আমার পাশে তোমাকে দায় করালে একদম রাতযোটক লাগবে।। যাকে বলে মেইড ফর ইচ আদার।।(মনে মনে কথাগুলো বলে একটা মুচকি হাসি দিলাম)

আমি আয়নাতে এক ধ্যানে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।। ভাইয়াও আমার দিকে তাকিয়ে আছি,, ইচ্ছে করছে ,, সারাজীবন এইভাবে তাকিয়ে থাকি ।।
হঠাৎ কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে আমার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।।শাড়িটা আমার গা থেকে ছিটকে নিচে পড়ে গেল।সাথে আমি ২ কদম পিছিয়ে গেলাম।। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারলাম না।। আমি কৌতূহল নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি ।। মেয়েটা আমার দিকে অগ্নি রুপ ধারণ করে তাকিয়ে আছে।। আমি অরিশ ভাইয়ার হাতের আঙ্গুলের ভাজে নিয়ে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলাম।। একবার ভাইয়া দিকে তাকিয়ে দেখলাম ,,, তিনি হয়তো মেয়েটাকে চেনে। কোথাও হয়তো দেখেছে।।

— তৃনা,, তুমি এখানে কি করছো ??( আমার হাত ছেড়ে দিয়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে অরিশ)

এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম তার নাম তৃনা।। হাঁটুর উপর পর্যন্ত জামা পড়েছে।। তার আবার হাতা নেই।। আর নিজেরই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।। মেয়েটার কি হচ্ছে না ।।

— কি আর করবো ।। তোমাদের রাশ লিলা দেখতে এসেছি।। ভাগ্যিস,, তৃষা আমাকে ফোন করে সবটা জানিয়ে ছিলো।। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নি।। তাই নিজের চোখে দেখতে এখানে চলে এলাম।। (আমার দিকে তাকিয়ে তৃনা)

— তুমি যা ভাবছো !! তেমন কিছু না ।। ও আমার কাজিন আর ওর সাথে ওদের সাথে শপিং করতে এসেছি !!বিলিভ মি!!!( তৃনার হাত ধরে অরিশ)

— তুমি সত্যি বলছো তো।।

— একদম!!!

— আমি জানতাম তুমি কখনো এমন হতেই পারো না।। তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো আর কাউকে না।। আই রিয়েলি লাভ ইউ বেবী!!( বলেই ভাইয়াকে জরিয়ে ধরলো)

ভাইয়াও একহাতে মেয়েটাকে জরিয়ে ধরে অন্যহাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লাভ ইউ টু বললো।।
ভাইয়া মেয়েটাকে জরিয়ে ধরা ,,হাত ধরা,, ভালোবাসি বলাটা দেখে বুকের মাঝে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করছি ।। ভাইয়ার বিহেবে বার বার মনে হয় ,, আমার প্রতি ভালোবাসা।। আমি ভুল কারন তিনি যেটা করেছে ,,সেটা তার দায়িত্ব।। আমি আজ ভুল প্রমানিত হলাম।। চোখের অশ্রু যেনো টলটল করছে ,, কিন্তু আমি তা কাউকে দেখাতে চাইছি না।। অন্যদিকে ফিরে চোখের অশ্রু মুছে বললাম….

— ভাইয়া বলছিলাম কি তোমরা থাকো !! আমি বরং তার চেয়ে গাড়িতে গিয়ে বসি ।। শরীরটা কেন জানি একদম ভালো লাগছে না মাথাটা ঘুড়ছে।।

আমার কথা শুনে তৃনা ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে আমার হাত ধরে বললো…

— সরি আসলে আমি বুঝতে পারিনি ,, তোমরা ভাই-বোন ।। অরিশকে কোনো মেয়ের সাথে দেখলে আমি একদমই সহ্য করতে পারি না!!!

— ইটস ওকে আপি!! আমি কিছু মনে করিনি।।আসলে ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যের কাছে দেখলে কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক।। আপনারা কথা বলুন আমি আসি কেমন ।।(মেয়েটাকে আর বলতে না দিয়ে আমি)

বলেই নিচে পড়ে থাকা শাড়িটা দিকে তাকিয়ে ,, সেটাকে কোনোরকমে হাত দিয়ে তুলে আগের স্থানে রেখে সেখান থেকে চলে এলাম।। আর একবার ও পেছনে তাকানোর মত সাহস বা শক্তি কোনোটাই আমার নেই।।

গাড়িতে এসে প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে বসে আছি।। এই দেড় ঘণ্টায় নিজেকে অনেক কষ্ট করে সামলেছি।। এক ফোঁটা চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেই নি চোখ থেকে ।। চোখ ভরে আসার সাথে সাথেই হাতের উল্টো পিঠ দেখিয়ে মুছে নিয়েছি।। আমি ভেঙে পড়েছি কিন্তু তা সবার চোখের আড়ালে।। আঘাত পেয়েছি ,, তা ডেকে নিয়েছি ,, নিজের মিষ্টি হাসির আড়ালে।।। আমার ভাবনার ছেদ ঘটালো আরশির কথায়……!!!

চলবে…💞💞

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন,,, ধন্যবাদ)