মধু পিঁপড়া পর্ব-০১

0
117

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ ০১
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

-‘সামিরে!মোখলেস চাচাকে নিয়ে বাবার এই আদিখ্যেতা আমার না ঠিক হজম হচ্ছে না!বিয়ে বাড়িতে এতো মেহমান রেখে কোথাকার কোন ড্রাইভার,তার পরিবার নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোনো মানে হয়!তুই বল?’

নামিরার হেঁড়ে গলার আওয়াজ সামিরা কানে আদোও ঢুকেছে কি না সন্দেহ!সে এখন জাম রাঙা বেনারসির সাথে গায়ে একগাদা গয়না জড়িয়ে সংয়ের মতো বসে আছে।একটু পর পর ফোন হাতে নিয়ে পাওয়ার বাটন ওফ অন করছে।এ নিয়ে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা মেসেজটি চৌত্রিশ বার পড়েছে।তার সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে!মাহিদের নম্বর তার মোবাইলে সেভ না থাকলেও,মস্তিষ্কে একদম স্যাট করা।ম্যাসেজের সারমর্ম হলো এই যে,মাহিদকে অতি জরুরি ভিত্তিতে ইন্ডিয়া যেতে হচ্ছে;এই মূহুর্তে সে কোনোভাবেই বিয়ে করতে পারবে না।ম্যাসেজের বিষয়টি ইতিমধ্যে সামিরা তার বাবা তাইজুল ইসলামকে জানিয়েছে!তার বাবার জন্য তো সবচেয়ে বড় খুশির সংবাদ।

-‘এই সামি,এই!ধুর বা* ভালো লাগে না!কখন থেকে ডাকছি কানে শুনিস না?”

বোনের ধাক্কায় সামিরা হুঁশে আসলো,প্রশ্নবোধকে চোখে তাকিয়ে রইল।নামিরা বিতৃষ্ণা গলায় বলল,

-‘বাবার হাবভাব একদম ভালো লাগছে না।অপ্রকৃতস্থদের মতো আচরণ করছে।শুনেছি ড্রাইভারের ছেলে নাকি কাস্টমস অফিসে কাজ করে !বাবা যদি ভোল পাল্টে এই ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দেয়,তখন কি হবে?জানিস না তো তুই!কাস্টমসে কাজ করা সব কয়টা ঘুষ/খোর।’

নামিরাকে এখনোও মাহিদের খবরটি দেওয়া হয় নি।দরকার বা কি,অযথাই হৈঁচৈ বাঁধাবে!সামিরা নির্জীব গলায় জবাব দিলো,

-‘বারবার ড্রাইভারের ছেলে বলে কি প্রমাণ করতে চাইছিস…আপা?তাদের অবস্থান আমাদের চেয়ে নিচু!আর আমরা তাদের চেয়ে খুব উঁচু?তুই কিন্তু ভুলে যাচ্ছিস একসময় আমাদের ড্রাইভারের কাজ করলেও,ইতিমধ্যে এক যুগ হয়ে গেছে তিনি তার কাজ থেকে অব্যহতি দিয়েছেন।আর তুই নিজের চোখে সবাইকে ঘুষ নিতে দেখেছিস!দেখেস নি তো,তাহলে?’

নামিরা কোনো জবাব দিলো না।তার বোনকেও তার কাছে স্বাভাবিক লাগছে না।বাড়ির সব কয়টা পাগল হয়ে যাচ্ছে। সামিরা না থেমেই বলতে শুরু করলো,

-‘আমার হবু স্বামী যদি ঘুষ*খোর হয়,তাহলে তোর স্বামী হলো জো*চ্চর।ভুলে গেছিস!সেই জোচ্চর কি করে নানীর গহনা নিয়ে পালিয়েছিলো? সাথে আমার দুুই বক্স কাঁচা মরিচের রসগোল্লাকেও রেহাই দেয় নি সে।তুই এই মূহুর্তে আমার সামনে থেকে যাবি,না হয় আমি যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাবো!”

নামিরা শুকনো ঢোক গিললো।সামিরা কিছু বুঝে যায় নি তো!বিস্ফো*রিত চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো।তার শিমুল তুলোর মতো তুলতুলে বোনের এমন ক*ঠিন রূপ দেখে সে বিস্মিত।যাওয়া কথা উঠলেও দুইজন একজনও কোথাও গেল না। সাঈফ ধপধপ শব্দ তুলে ঘরে ঢুকলো।সামিরার গলা জড়িয়ে কাঁ*দো কাঁদো গলায় বলল,

-‘আপা তোর হবু ননদ আমাকে গা*ধা বলছে।’
-‘কিভাবে বলেছে?’
-‘আমার দিকে একটা টিস্যু দিয়ে বললো,এখানের লেখাটি পড়ে শোনালে আপনাকে পুরষ্কার দেওয়া হবে।আমি সরল মনে লেখাটি পড়ে শোনালাম।’আমি গাধা’।সেই থেকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।’

ভাইয়ের কথার ভঙ্গিমা দেখে সামিরা খিলখিল করে হেঁসে উঠলো।তার এখন বেশ হাল্কা লাগছে।পরিবার মানেই শান্তি। সাঈফ আর সামিরা দেড় বছরের ছোট বড় হলেও,পড়াশোনা তাদের একসাথে।বর্তমানে তারা দুজনই নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োলজিক্যাল টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করছে।সাঈফ হাতে পায়ে লম্বা হলেও আচার আচরণ পুরো বাচ্চাদের মতো!বোনদের কাছে পেলে এ বাচ্চামি আরো বেড়ে যায়।

নামিরা এতো সময় দুজনের কার্যকলাপ দেখছিলো।সে যতোটুক জানে মাহিদরা দু’ভাই,তাদের কোনো বোন নেই।কিছু একটা আঁচ করতে পেরে মাথা দু’হাতে চেঁপে ধরলো।সামিরার পাশের সোফায় ধপ করে বসে পড়লো।ফিসফিস করে বললো,

–“ফর গড সেইক,সামি!ডোন্ট ডু দিস।তুই বিনা দোষে কেন এতো বড় শাস্তি মাথা পেতে নিবি?’

সামিরা শুনেও যেনো শুনলো না।সে সাঈফের মাথার লম্বা লম্বা চুলে হাত বুলাতে লাগলো।বেশ কিছুদিন আগে সাঈফ ও তার কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘গানের ছোঁয়া’ নামক একটা ব্যান্ড চালু করেছে।সাইফ মূলত সেখানকার একজন নব কন্ঠশিল্পী।যেদিন থেকে তারা এই ব্যান্ড চালু করেছে,তাদের চালচলনেও যেন বিস্তর পরিবর্তন এসে গেছে।এ নিয়ে অবশ্য তাদের বাবা তাইজুল ইসলামের কোনো মাথাব্যথা নেই।ছেলে মেয়েকে তিনি জীবনের শুরুতেই পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছেন। তার নিজের জীবনই তো ভুলে ভরা!তাইজুল ইসলাম মেয়ের কামরায় প্রবেশ করার পূর্বে ভালোমত ফ্রেশ হয়ে নিলেন। চোখে যতোই পানি দিচ্ছেন,চোখ ততোই বেশি ভিজে উঠছে।

শিল্পপতি তাইজুল ইসলাম নাকি মেয়ের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছে!সামিরা নিজে রুম থেকে বের হয়ে এলো,বাবাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকালো।চোখের পলকে জড়িয়ে ধরলো।বিড়বিড় করে বললো,

-‘বাবা আজ থেকে তোমার দায়*বদ্ধ*তা আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম।তুমি ভালো থেকো।মাকে ভালো রেখো।’

তাইজুল ইসলাম কিছু বলতে চাইলেন,পারলেন না।তার জ্বীভ শুকিয়ে গেছে।শরীর ঝিমঝিম করছে।গলায় অদ্ভুত কম্পন হচ্ছে।সামিরার বিদায় পর্যন্ত টিকতেও পারবেন কি না সন্দেহ। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বহু কষ্টে বললেন,

-“মারে,তোর এই অ*ধম পিতাকে ক্ষমা করে দিস।”

———

-‘জামাইকে দেখলাম কবুল বলার আগে কাঁদছে।শেরওয়ানির স্টোনের কাজ করা হাতায় চোখ মুছতে যেয়ে গালে কিছু অংশ নাকি ছিলেও ফেলেছে !ইসস,কি একটা বাজে অবস্থা হলো,বল তো!’

আফসোসের কন্ঠে বলে উঠলেন নাদিরা বেগম।তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাথাটা তিনিই পেয়েছেন!মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সামিরার চোখ ছলছল করে উঠলো।সে দু’হাতে তার মায়ের হাত চেপে ধরলো।নাদিরা বেগম ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ।হৈঁচৈ,চিল্লা-ফাল্লা,আহাজারি,ভাংচুর এসব জিনিস তার ধাতে নেই বললেই চলে।তিনি মেয়ের কপালে দীর্ঘ এক চুমু খেলেন।সামিরা মনে হলো তার মাথায় টপটপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পরছে।সে এই বৃষ্টির আলাদা নাম দিতে চাইলো।চোখের বৃষ্টি রাখবে নাকি দুঃখের বৃষ্টি!সামিরা বেশ কনফিউজড।

বিদায়ের সময় সকলকে অবাক করে দিয়ে,সামিরার নানী আমেনা বেগম বিলাপ করে কেঁদে উঠলেন।সামিরা এই জিনিসটা ইহো জীবনেও এক্সপেক্ট করে নি।তার মনে হলো নানী আজ ছোট পর্দার অভিনেত্রী হলে অনায়াসে দু’তিনটা এওয়ার্ড পেয়েই যেতো।সবাই সামিরাকে এক প্রকার ঘিরে রেখেছে!এদিকে নামিরা একটু পর পর ন্যাক ন্যাক করে কাঁদছে।মেকাপ নষ্ট হয়ে যাওয়া ভয়ে চোখ টিস্যু দিয়ে চেপে ধরে আছে।আমেনা বেগম এবার সামিরাকে ছেড়ে নামিরাকে স্বান্তনা দিতে লাগলেন।

এতো সবার মাঝে তাইজুল ইসলামকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না।সাঈফকে পাঠানো হলো তাকে ডেকে আনার জন্য!তাইজুল ইসলাম গুনে গুনে পাঁচ মিনিট পর এসে হাজির হলেন।হয়ত মেয়ের ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি!তার চোখমুখের অবস্থা বেজায় খারাপ!ফুলে টুলে একাকার!শরীরের পাঞ্জাবি ঘামে জবজব করছে।তাকে বেশ অস্থির লাগছে।সামিরা বাবাকে বেশ শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো।তাইজুল ইসলাম চোখ মুছতে মুছতে আবিরের হাতে সামিরার হাত তুলে দিলেন।

সামিরা মনে হচ্ছে সামনে থাকা লোকটি তার হাত ভেঙেই ফেলবে,এতো শ*ক্ত করে কেউ ধরে।আশ্চর্য!সে কি হারিয়ে যাচ্ছে?নাকি তাকে কেউ নিয়ে যাবে?সামিরা চট করে তার স্বামী নামক মানুষটির দিকে তাকালো।এই প্রথমই তার দর্শন পেলো।মানুষটির চোখগুলো ভেজা।নাকটা লাল হয়ে আছে।গালের পাশে আঁচড়ের দাগ। কাঁদছে নাকি?বেটা মানুষ হয়ে কাঁদছে!কই সামিরার তো কান্না আসছে না।তার সামিরাকে পছন্দ হয় নি নাকি!আচমকা সামিরা নিজের দেহে অদ্ভুত অনু*রণ*ন অনুভব করলো।রূপনগরের রাজকন্যার কথা তো সকলেই শুনেছে।এ যেন সুদর্শন এক রাজপুত্র।উহু,উহু বেশি সময় তাকানো যাবে না!চোখ জ্ব*লে যাচ্ছে।চোখের সামনে সবকিছু কেমন অ*স্পষ্ট হয়ে আসছে!সামিরা পড়ে যেতে নিচ্ছিলো।মানুষটি পেছন থেকে তার কোমড় জড়িয়ে ধরতেই নিশ্বাস আঁটকে এলো।ইশশ,কি ঠান্ডা স্পর্শ!দেহে শিহরণ জাগানো অনুভূতি।

মানুষটি সামিরাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।মাঝপথে এসে সামিরা এক অদ্ভুত কান্ড করলো।গলার ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে হড়হড় করে বমি করে দিলো।পাশে থাকা সুপুরুষকে বমিতে মাখিয়ে বেশ তৃপ্তি পেল।মুখটা কাঁদো কাঁদো করে হড়বড়িয়ে বলল,

-“আমি অত্যন্ত দুঃখিত।আমার গাড়িতে চড়ার অভ্যাস নেই।ট্রাভেল সিকনেসের কারণে গাড়ি চড়লেই বমি হয়।”

হাহ,শিল্পপতির মেয়ের নাকি গাড়িতে চড়লে বমি হয়!হাস্যকর!সামিরা মনে মনে বলল,

-‘আমাকে বিয়ে করে কেঁদেছিস না?এবার দেখ কেমন মজা।কেন রে আমি দেখতে কি ডাইনির মতো!তোকে কি খেয়ে ফেলবো নাকি !’

আবির শান্ত চোখ সামিরার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল।সামিরার ইচ্ছে কৃতভাবে বমি করার বিষয়টি সে ধরতে পারলো কি না,বোঝা গেল না!গাড়ি এক সাইডে থামিয়ে সামিরাকে নিজ হাতে পরিষ্কার করে দিলো।রুমাল দিয়ে যত্নসহকারে মুখ মুছে,পানি খাইয়ে দিলো।গাড়িতে আরো মানুষ থাকলেও শুধুমাত্র আবিরের বোন আদিবার চোখে সামিরার সম্পূর্ণ বিষয়টি ধরা পরলো।সে হাই তোলার ভঙ্গিতে এড়িয়ে গেল।

চলবে