এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১২

0
348

#এক ফোঁটা প্রেমের বিষ
#Tahmina Akther

১২.

সেই রাতে কাজি ডেকে এনে মিলি এবং শোয়েবের আবারও বিয়ে হয়। শোয়েবের ছয় বোন থেকে চার বোন চলে যায় রাত দশটার পরে। থেকে যায় শুধু নূরী আর ইরাবতী। রাসেল কিছুক্ষণ আগে কমলাপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশ্য বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। মিলি ড্রইংরুমে বসে আছে সেই বোরকা আর হিজাব বেঁধে। চেঞ্জ করার সময় বা সুযোগ হয়ে ওঠেনি। শোয়েব কোথায় যেন চলে গিয়েছে? মিলি মাথায় হাত দিয়ে সাইফের দেয়া প্রতিশ্রুতি, ধোঁকা সবটা পুনরায় ভাবছে। কি এমন পাপ করেছিল সে। যার জন্য এমন একটা ভালোবেসে যাওয়া মানুষটাকে অগ্রাহ করে সে মরীচিকার পেছনে এতদিনে ছুটেছে। কিন্তু, দিন শেষে কি পেলো সে?

— মিলি???

কারো ডাকে সম্বিৎ ফিরে আসে মিলির। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখে শোয়েবের মা দাঁড়িয়ে আছে। মিলি লজ্জায় আর উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না মাথা নিচু করে ফেলে। শোয়েবের মা মিলির পাশে এসে বসে পরলেন। তারপর, হাত বাড়িয়ে মিলির হিজাবের পিনগুলো একটা একটা খুলে রাখলেন টি-টেবিলের ওপর। হিজাব খোলা শেষ হলে মিলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

— বোরকা খুলে বস। এমন অবস্থায় কমফোর্ট ড্রেসে থাকা উত্তম।

মিলি ওর শ্বাশুড়ির কথায় উঠে দাঁড়িয়ে বোরকা খুলে ফেললো। এবার শোয়েবের মা মিলির হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলেন। তারপর, এই বাড়ির গৃহকর্মী দিদারের মাকে ডাক দিয়ে বললেন রাতের খাবার,এক গ্লাস দুধ পাঠিয়ে দিতে।

মিলি ওর শ্বাশুড়ির কান্ড দেখে কান্না করে দেয়। শোয়েবের মা হতভম্ব হয়ে গেলেন । কারণ, তিনি তেমন কিছুই বলেননি মিলিকে। তবে, কেন মিলি কাঁদছে?

— কি হয়েছে? কান্না করিস কেন?

— এমনি। আপনারা কেন আমার সাথে এত ভালো বিহেব করছেন? আপনাদের উচিত আমাকে অপমান করে এই বাড়ি থেকে বের করে দেয়া।

— তোর কোনো কাজে আমাদের তেমন কষ্ট হয়নি। কষ্ট পেয়েছে আমার শোয়েব। কিন্তু,ও যদি তোকে নিয়ে ভালো থাকতে পারে তবে আমরা কেন নয়? আর ভুল মানুষের দ্বারা হয়। এখন, সেসব কথা বাদ দে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তারাতারি ঘরে গিয়ে শুয়ে পর। সকালে তোকে নিয়ে হসপিটালে যাব।

শোয়েবের মা মিলিকে খাইয়ে দিলেন। মিলি খুব বেশি খাবার খেতে পারল না। শোয়েবের মা নিজের ঘরে যাওয়ার আগে মিলিকে বলে গিয়েছেন যেন মিলি তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে শুয়ে পরে।

খাবার খাওয়ার পর থেকে মিলির কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। বমি বমি ভাব। মিলি কোনোমতে একদৌঁড়ে ছুটে যায় বেসিনের দিকে। তারপর হরহর করে বমি করে দেয়। মিলির মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। পুরো শরীর অসার হয়ে আসছে।

এমনসময় নিজের পিঠে কারো শরীরের স্পর্শ পায় মিলি। পেছনে থাকা ব্যক্তিটা মিলির মাথা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে। মিলির পুরো শরীরের ভার নিয়ে নিজের শরীরের মাঝে নিয়ে নেয়।

কিছু সময় পর মিলি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো, শোয়েব ওকে ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে। তারমানে এতক্ষণ শোয়েব মিলিকে আগলে রেখেছিল?

মিলির চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, পারবে না সে। প্রথম থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সবই মিলির দোষে।

বারান্দায় বসে আছে শোয়েব। পরনের শার্ট কুঁচকে এলোমেলো হয়ে আছে। চুলগুলো উসকোখুসকো। চোখ দুটো স্থীর, নিষ্প্রাণ। যেন এই চোখদুটোতে নেই কোনো স্বপ্ন। আছে শুধু ব্যর্থতার কিছু মূহুর্ত।

— ভালোবাসায় যদি এত কষ্ট, বেদনা, পেয়েও হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা থাকবে তবে কেন এরই নাম ভালোবাসা হলো? ভালোবাসা না হয়ে মরণের বিষ হলো বা কেন এর নাম? ভালোবাসি কিন্তু তাকে কাছে টানতে পারি না। এ কেমন অসহ্য অনুভূতি!

পকেট থেকে সিগারেট নিয়ে লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করে শোয়েব। সিগারেটের ধোঁয়া গুলো একটু ওপরে উঠলে হাওয়ায় মিশিয়ে যাচ্ছে। শোয়েব মেকি হাসি দিয়ে আনমনে বললো,

— মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত স্মৃতি গুলো যদি এভাবে হাওয়ায় মিশিয়ে যেত। তবপ প্রত্যেকটি মানুষ হয়তো শরীরের নামক যেই বেঁচে থাকা বলে। সেই ভাবে বেঁচে থাকতে পারত।

বারান্দায় পাতানো দোলনায় দুলতে দুলতে শোয়েব হারিয়ে যায় সেই স্মৃতির পাতায়। যেখানে শুধু ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়ার খবর শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল শোয়েব।

***** অতীত *****

মেডিকেলের চেম্বারে বসে রোগী দেখছিল শোয়েব। কুমিল্লা থেকে ফিরে যাওয়ার পর থেকে শোয়েবের মাথা পুরো হ্যাং হয়ে আছে। মিলির সাথে কথা হয় না আজ দুদিন হলো। কল দিতে ইচ্ছে করে না শোয়েবের। কিন্তু, মনে মনে হাজারো অভিযোগ, অজস্র ভালোবাসা সবই বিলিয়ে দিচ্ছে মিলি নামের ভালোবাসার মানবী’র কাছে।

এমন সময় শোয়েবের মোবাইল ভাইব্রেট হয়। শোয়েব একহাতে মোবাইল চেক করে দেখলো। ওর বাবা কল দিয়েছে। রোগী চলে যাওয়ার পর শোয়েব ওর বাবার কাছে কল ব্যাক। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলে শোয়েব সালাম দিয়ে বাড়ির সবার ভালো-মন্দ অবস্থা জিজ্ঞেস করে। শোয়েবের বাবা শাফায়াত আহমেদ সবার অবস্থা জানায়। সবাই বেশ ভালো আছে।

— শোয়েব, তোকে একটা কথা বলব। জানি না তুই খবটা শুনে কেমন রিয়েক্ট করবি? আমি ভাবছি কথাটি তোকে সামনাসামনি বললে হয়তো ভালো হতো।

শোয়েব ভয় পেয়ে যায় ওর বাবার কথায়। আত্মীয়দের কেউ অসুস্থ হলো কি না এই ভেবে।

—মোবাইলে বলো কি হয়েছে?

— মিলির বাবা কল করে বলেছেন আমাদের সবাইকে কুমিল্লায় যেতে। তোর আর মিলির বিয়ের দিন তারিখ পাকা করার জন্য।

শোয়েব যেন নিজের শোনা কথাগুলোকে বিশ্বাস করতে পারছে না। হয়তো, সে স্বপ্ন দেখছে বা তার কানে সমস্যা হয়েছে। মিলির সাথে শোয়েবের বিয়ে দ্যাট’স আনপসিবল!

— কিরে কথা বলছিস না কেন? সারপ্রাইজড হয়ে গেলি নাকি? এই জন্য বলেছিলাম তোর সামনাসামনি বসে এই ব্যাপারে কথা বলব। কিন্তু, তোর জোড়াজুড়িতে..।

— কুমিল্লায় কবে যেতে হবে, বাবা?

ছেলের প্রশ্নে মুচকি হেসে শাফায়াত আহমেদ উত্তর দিলেন।

—আগামীকাল সকালে রওনা দিব। তুই হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে আসিস।

শোয়েব কল কেটে দেয়। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে পরে থাকে। হটাৎ, করে সব কিছু কেমন রঙীন লাগছে শোয়েবের কাছে।

হসপিটালের ডিউটি শেষ করে শোয়েব দুদিনের ছুটি নিয়ে রওনা হয় নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্য। বাড়িতে পৌঁছানোর পর সর্বপ্রথম ওর মায়ের কাছে চলে যায়।

মাকে জড়িয়ে ধরে শোয়েব বললো,

— মা, সব তোমার জন্য হয়েছে। তুমি যদি সেদিন মিলির বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব না দিতে তবে মিলির বাবা হয়তো মিলিকে রাজি করাতে পারত না।

—এবার নিজের রাগকে কন্ট্রোল করা শিখ। এভাবে হুটহাট মারামারি, ধমকাধমকি করা ছেলেদের মেয়েরা পছন্দ করে না।

শোয়েব ওর মায়ের কাছ থেকে সরে এসে মাথা চুলকানির ভঙ্গি করে নিজের ঘরে চলে যায়। তারপর, পাঁচ বোনকে কল দিয়ে সুসংবাদ দেয় যে মিলি এবং ওর পরিবার রাজি হয়ে গিয়েছে। ভাইয়ের কাছ থেকে এমন সংবাদ পেয়ে ওরা পাঁচ বোন অনেক খুশি।

সেই রাতে শোয়েবের মনে হচ্ছিল একটিবার মিলিকে কল দিক। কিন্তু, শোয়েব কি মনে করে আর মিলিকে কল দেয়নি। একেবারে কুমিল্লায় গিয়ে না-হয় মিলির সাথে মন ভরে দেখাও হলো, কথাও হলো।

বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে শোয়েবের রাত কেটে যায়।

সকালে যথারীতি সময়ে শোয়েব বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়।তারপর, শাওয়ার নিয়ে তৈরি হয়ে নেয়। ওফ ওয়াইট রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট।হাতে রোল্যাক্সের ঘড়ি। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে ছড়িয়ে আছে। এবার পুরো শরীরে ভুস ভুস করে পারফিউম ছড়িয়ে মোবাইল,মানিব্যাগ পকেটে পুরে ঘর থেকে বের হয় ড্রইংরুমে চলে যায়।

সেখানে যেতেই দেখলো শোয়েবের বাবা-মা, ইরাবতী তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে। শোয়েব এলে সবাই একসাথে ফ্ল্যাট থেকে বের হয় যায়।

নিজেদের গাড়িতে করে রওনা হয় কুমিল্লার উদ্দেশ্য। প্রায় চার ঘন্টার জার্নির পর কাঙ্ক্ষিত স্থানে গিয়ে পৌঁছে যায় শোয়েব এবং ওর পরিবার।

একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে মিলিদের বাড়িতে প্রবেশ করছে। কিন্তু, শোয়েব সেই একইভাবে বসে আছে ড্রাইভিং সিটে। সবাই নেমে যাওয়ার পর শোয়েব ওর মোবাইল বের করে মিলির মোবাইল নাম্বারে কল করে।

মিলি তখন আতংকিত হয়ে বসে আছে ওর ঘরে। পাশে বসে আছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড নিঝুম। মিলিকে যে আজ দেখতে আসবে কিংবা বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হবে তা নিয়েও মিলির মনে এত ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে না। যতটা ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে তা হলো শোয়েবের সামনে উপস্থিত হওয়া।

এমন সময় মিলির মোবাইলে কল আসে। নিঝুম ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে মোবাইল নিয়ে মিলির দিকে বাড়িয়ে দেয়। মিলি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো শোয়েব কল করেছে। অসহায় মুখ করে একবার নিঝুমের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার মোবাইলের দিকে। না পেরে মিলি নিঝুমকে অনুরোধের সুরে বললো,

— দোস্ত, তুই কল রিসিভ করে বল আমি ওয়াশরুমে আছি।

— আ.মি পারব না। তোর উডবিকে সেদিন আমি দেখেছি। বাপ রে যদি একবার ধরতে পারে আমি তোর হয়ে মিথ্যা কথা বলছি তবে আমাকে বিদুৎ ছাড়া ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে রেখে দিবে চিরকালের জন্য। তুইই কথা বল।

মিলি কেনোভাবে না পেরে শোয়েবের রিসিভ করে।

—হ্যা……লো???

—…..।

শোয়েব কথাটি বলে কল কেটে দেয়। শোয়েবের কাছ থেকে এহেন আদেশ পেয়ে মিলি চোখ ছানাবড়া ।

—-বিয়ে হতে না হতেই এই লোক তার ওপর হুকুমাত শুরু করেছে। তবুও, যেহেতু বলে দিয়েছে অবশ্যই তা পালন করতে হবে নয়তো মিলি তুই আজ কেল্লাফতে।

মনে মনে কথাগুলো বলে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির বাইরের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে মিলি।

অদূরে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে শোয়েব। পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে হেঁটে আসা নীল পরির দিকে। হয়তো, আর কিছুদিন তারপর এই পরিটা একমাত্র তারই হবে।

#চলবে