এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১১

0
368

#এক ফোঁটা প্রেমের বিষ
#Tahmina Akther

১১.

সাইফের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত থাকা সন্দেহে মিলিকে পুলিশ গ্রেফতার করার কারণে সাতদিন হাজতে থাকতে হয়। অষ্টম তম দিনে শোয়েব মিলির জামিন নিয়ে জেল থেকে বের করে নিয়ে যায় ঢাকায় শোয়েবের ফ্ল্যাটে। আজ শোয়েবের চেষ্টা এবং ভাগ্যের জোরে মিলি সেই কেইস থেকে বেকসুর খালাস পায়।

সেই খুশিতে শোয়েব আল্লাহর কাছে বারবার শুকরিয়া আদায় করে। যদিও মিলির কোর্টে আসতে হয়নি। কারণ, ওর অসুস্থতা। লয়ার মিলির অসুস্থতার কারণ দেখালে মিলিকে আর কোর্টে উপস্থিত হতে হয়নি।

কেইস জিতে যাওয়ার পর শোয়েব, ওর বাবা এবং মিলির বড়ো ভাই রাসেল একসঙ্গে বের হয়ে আসে আদালত থেকে। শোয়েব ওর পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাউকে কল দেয়। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলে শোয়েব বলে,

— বাড়ি যেন ঠিক সেদিনের মতো সাজানো থাকে। যেদিন আমার মন সেই বাড়িতে বধু বেশে এসেছিল।

কথাটি শেষ করে শোয়েব ওর বাবা এবং রাসেলকে বললো,

— আপনারা নারায়ণগঞ্জ চলে যান। আমি আমার ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। মিলিকে নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরব। সবাই যেন বাড়িতে থাকে আমার কিছু কথা আছে।

শোয়েব ওর গাড়ি নিয়ে রওনা হয় বাসার উদ্দেশ্য। রাসেল এবং শোয়েবের বাবা রওনা হয় শোয়েবদের নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে।

শোয়েব ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় মিলি। ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে শোয়েবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মিলি। কোর্টে কি হয়েছে তা জানার জন্য।

শোয়েব মিলির পাশ কাটিয়ে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে পরে। মিলি দরজা লক করে শোয়েবের পেছনে যেতে গিয়েও থেমে যায়। কারণ, শোয়েবের সামনে দাঁড়িয়ে কোনোকিছুর কৈফিয়ত চাওয়া এখন অনেক লজ্জার মনে হয় মিলির কাছে।

— দাঁড়িয়ে না থেকে খাবার খেয়ে জলদি তৈরি হয়ে নাও।

পরনের শার্ট খুলে সোফার কাছে ছুড়ে মেরে কথাটি মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলে নিজের রুমে চলে যায় শোয়েব।

মিলি শোয়েবের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটা যেন হুট করে বদলে গেছে।
এই যে আগের মতো মিলির চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। মনে হয় যেন মিলির চোখের দিকে তাকালে শোয়েবের পাপ হবে। আসলেই পাপ হবার কথা। মিলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর রুমে চলে যায় তৈরি হওয়ার জন্য।

মিনিট দশেক পার হতে না হতেই শোয়েবের ডাক শুনে মিলি ওর ঘর থেকে বের হয়ে আসে। এসে দেখলো শোয়েব কালো সাদা চেক শার্ট এবং কালো জিন্স পরে তৈরি হয়ে বের হচ্ছে হাতে ঘড়ি পরতে পরতে।

—মি..

মিলিকে ডাকতে গিয়েও থেমে যায় শোয়েব। কারণ, মিলি সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কালো বোরকা আর কালো হিজাব বেঁধে। একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে শোয়েব। মিলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— দুপুরের খাবার খেয়েছো?

— হুম।

—গুড। কিন্তু, কখন খেলে?

—আপনি আসার আগে খেয়েছি।

— তাহলে, চলো।

কথাটি বলে মিলিকে ইশারায় বললো ফ্ল্যাট থেকে বের হতে। মিলি বের হলে শোয়েব বের হয় ফ্ল্যাটের দরজা লক করে দেয়। তারপর, দুজন বিল্ডিং থেকে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে। গাড়িতে যখন চলতে শুরু করে তখন মিলি শোয়েবকে মিনমিনে গলায় জিজ্ঞেস করে,

— কোথায় যাচ্ছি, আমরা?

— গেলেই দেখতে পারবে।

ব্যস, তাদের দুজনের এতটুকু আলাপ ছিল গাড়িতে। সারা রাস্তায় তাদের আর কোনো কথা কিছুই হয়নি। অথচ, মনে মনে তাদের হাজার কথা আদান-প্রদান হচ্ছিল।

যখন গাড়ি থেমে যায় তখন প্রায় সন্ধ্যা। মিলি গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থমকে যায়। কারণ, ওরা এখন শোয়েবদের নারায়ণগঞ্জ বিল্ডিংয়ের নীচে পার্কিং এরিয়ায় আছে।

মিলিকে যেন হাজারো অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে। কিন্তু, শোয়েবকে যে জিজ্ঞেস করব তাও পারছে না। কারণ, শোয়েব ওট কথার কোনো উত্তর দিবে না। শোয়েব গাড়ি থেকে নেমে এসে মিলির সাইডে এসে দরজা খুলে ওকে বের হতে বললো। মিলি প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু, শোয়েব নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিলি ধীরপায়ে গাড়ি থেকে নেমে এক পাশে দাঁড়ায়।

শোয়েব মিলির হাত ধরে এগিয়ে যায় লিফটের দিকে। লিফটে ঢুকে চারতলার বাটন প্রেস করে দাঁড়িয়ে থাকে মিলির হাত ধরে। লিফট চারতলায় এসে থেমে যায়।

চারতলায় থাকা শোয়েবের পরিবার এবং মিলির পরিবার অধীর অপেক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিলি এবং শোয়েবের জন্য। লিফট খুলতেই সকলের মুখে হাসির বলিরেখা দেখা যায়। কারণ, শোয়েবের হাতে হাতে রাখে বের হয়ে আসে মিলি।

সঙ্গে সঙ্গে ওদের দুজনের ওপর ফুলের বর্ষণ হতে থাকে। শোয়েবের ছয়বোন আজ অনেক অনেক খুশি। কারণ,তার ভাই আজ তিনমাস পর এই বাড়িতে কদম রেখেছে।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে শোয়েব সবার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে একপাশে ইরাবতীকে কাছে ডেকে বললো,

—মিলিকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসাও। আমরা সবাই আজ একসাথে বসে অনেক গল্পগুজব করব। আর হ্যা, তার আগে মিলিকে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে খাইয়ে দিও। আমি আসছি।

ইরাবতী মিলিকে নিয়ে ফ্ল্যাটের ভেতরে চলে যায়। তারপর, লেবুর শরবত বানিয়ে খাওয়ায়। এরইমাঝে সবাই এসে ড্রইংরুমে উপস্থিত হয়। সবাইকে ড্রইংরুমে দেখে মিলি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সবশেষে আসে শোয়েব। মিলির থেকো চার ইঞ্চি দূরত্বে বসে পরে। তারপর, সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— প্রথমে আমি এবং পুলিশ সবাই ভেবেছিলাম হয়তো মিলি সাইফের মার্ডার করেছে। কিন্তু, তদন্ত করার সময় পুলিশের হাতে ক্লাবের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে। বিয়ের বর কনের অল্প সময়ের বিশ্রামের জন্য সেই রুমগুলো বরাদ্দ থাকে। সাইফের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে পুলিশ দেখতে পায়। একটি পানি ভর্তি গ্লাসে কি যেন মিশিয়ে দেয়। তার কিছু মিনিট পর মিলি বধু বেশে আসে। এবং সাইফের সাথে তার কিছু কথা হচ্ছিল। এমন সময় সাইফের প্রচন্ড কাশি শুরু হয়। যার দরুন সে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছিল না। মিলি দিশেহারা হয়ে যায় সাইফের এমন অবস্থা দেখে। তখনি দেখতে পায় টেবিলের উপর রাখা একটি পানির গ্লাস। ব্যস, মিলি সেই পানির গ্লাসটুকু এনে সাইফের মুখের সামনে দিতেই সাইফ না বুঝে তা পান করে। যার ফল স্বরূপ তার মৃত্যু হয়।

— তার মানে সাইফ সেই গ্লাসে বিষ মিশিয়ে ছিল! কিন্তু, কেন? নূরী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

— হ্যা। কারণ, সাইফ মিলিকে মারতে চেয়েছিল।

শোয়েবের মুখ থেকে এই কথা শুনে মিলি হতবাক হয়ে যায়। সাইফ ওকে মারতে চেয়েছে! কিন্তু, কেন?তাদের এত বছরের ভালোবাসা, অপেক্ষা তবে কি সব ছলনা ছিল?

— সাইফের মোবাইলে চেক করে পুলিশ। সাইফের নোট অপশন চেক করলে সাইফের লেখা কিছু অংশ পড়ে জানা যায়। যে সে জীবনের সকল অসাফল্যের কারণকে আজ জীবনের চরম শাস্তি দিবে। বেচারা, সাইফ। মিলিকে মারতে চেয়েছিল কিন্তু নিজেই মরে গেলো।
সেই সব প্রমান কালেক্ট করতে পুলিশের এতদিন লেগে গেছে। আর আজ সকল প্রমানের ভিত্তিতে মিলি ছাড়া পেয়েছে। যদি প্রথমে সবাই ভেবেছিল মিলি আমার কাছে ফিরে আসার জন্য ওর প্রেমিককে মেরে ফেলেছে।

শোয়েবের কাছ থেকে সবটা শোনার পর সবাই আফসোস করে। এরই মাঝে শোয়েবের মা বলে উঠেন,

— সবই বুঝলাম,যে মিলির কোনো দোষ নেই। মিলি কিন্তু সাইফের জন্য তোকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গিয়েছিল।

উনার কথা শুনে সবাই চুপ মেরে যায়। বিশেষ করে শোয়েব, মিলি এবং রাসেল। মিলির দুচোখ পানিতে ভরে ওঠে। যার জন্য সে এতবছর অপেক্ষা করল সে মাঝপথে এসে তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা সাজায়। অথচ, তার জন্য শোয়েবের মতো ছেলেকে পেছনে ফেলে মিলি চলে গিয়েছিল। কি পেলো সে শুধুমাত্র সামজের লাঞ্চনা ব্যতিত?

—যদি বলি মিলি এখনও আমার স্ত্রী? এই কথা বিশ্বাস করবে তো তোমরা?

শোয়েবের কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। মিলি মাথা নিচু করে বসে আছে। রাসেল যেহেতু কোর্টে থাকার কারণে সব জানে তাই সে চুপ করে বসে আছে।

— কিন্তু, কি ভাবে সম্ভব?

ইরাবতীর কথায় সকলে সায় দেয়। কারণ, সবার সামনে মিলি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

— কারণ, মিলি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার সন্তানের মা হবে মিলি। আর একজন গর্ভবতী নারীর কখনো তালাকপ্রাপ্ত হয় না।

শোয়েবের কথায় যেন সকলের মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। এ কি করে সম্ভব! মিলি মাথা নীচু করে অঝোরে কাঁদছে। সবই মিলির ভুল।

হাজতে থাকাকালীন তৃতীয়দিন মিলি অসুস্থ হয়ে যায়। তখন, শোয়েবের রিকুয়েস্টে মিলির চেকআপা এবং কিছু টেস্ট করা হয়। যার রির্পোট ষষ্ঠ দিন আসে। শোয়েব সেদিন মিলিকে সেই সুসংবাদ জানালে মিলি কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। এবং শোয়েবকে জানায় যে সে শোয়েবের সব কথা, আবদার মানতে রাজি আছে। কারণ, সে যে মা হতে যাচ্ছে।

— আমার সন্তানের মা হচ্ছে মিলি। মিলির গায়ে কষ্ট লাগা মানে আমার সন্তানের গায়ে সেই কষ্টের আঁচড় লাগা। আমি যদি আমার সন্তানের কথা ভেবে মিলির করা সব কর্ম ভুলে যেতে পারি। তবে তোমরা কেন পারবে না?

শোয়েবের মুখ থেকে এমন কথা শুনে মিলির কান্নার বেগ যেন আরও শতগুণ বেড়ে যায়। আসলেই লোকটা শুধুমাত্র তার সন্তান আসবে জেনে তাকে সেই অন্ধকার জগত থেকে বের করে এনেছে। নয়তো, মিলি যে এই লোকের পায়ের নখের যোগ্যতাও নেই।

#চলবে