এক বরষায় পর্ব-০১

0
943

#এক_বরষায়[১]
জেরিন আক্তার নিপা


ধারা তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। তার মা তাদের দুই বোনকে ফেলে তারই আপন চাচার সাথে পালিয়ে যায়। ছোট চাচা তার দাদার দ্বিতীয় ঘরের সন্তান এটা তখনও জানতো না ধারা। এমনকি এটাও জানতো না মা ছোট চাচার সাথেই গেছে। বড় হওয়ার পর অবশ্য জেনেছে। ধারা সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বাড়ির থমথমে পরিবেশ দেখে প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরে জানতে পারল, মা কারো সাথে পালিয়ে গেছে। কিন্তু কার সাথে গেছে এটা তাকে কেউ বলেনি। মা কেন কারো সাথে পালিয়ে গেছে এটার অর্থ সেসময় বোধগম্য হয়নি তার। জেসমিন তার ছোট বোন। ওর বয়স তখন কত হবে? তিন বা চার? সঠিক বলতে পারে না সে। অনেকটা সময় মা’কে না দেখে জেসমিন যখন কাঁদছিল ধারার তখনও মনে হয়েছিল মা চলে আসবে। পালায়নি মা। কোথাও ঘুরতে গিয়েছে হয়তো। সেদিন বাড়িতে চুলা জ্বললো না। দাদাজান বারান্দায় কাঠের চেয়ারে এমন ভাবে বসেছিলেন ধারার মনে হচ্ছিল এটা কোন পাথরের মূর্তি। যা নড়াচড়া করতে পারে না। গভীর রাত পর্যন্ত দাদাজান ওভাবেই বসেছিলেন। দাদী অনেক চেষ্টাচরিত্র করে জেসমিনকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। সেদিন বাবার দেখা পেল না সে। বাবা কি মা’কে খুঁজতে গেছে? মাঝ রাতে ধারার ঘুম ভেঙে গেলে সে দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এখনও দাদাজান ওই চেয়ারটাতে বসে আছে। দাদাজান কি বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ধারা কাছে এলে দাদাজান তাকে ডাকল। তার মাথায় হাত রেখে সেদিন দাদাজান বলেছিল,

‘দিদিভাই, বাড়িতে আজ কী ঘটছে তুমি জানো?’

ধারা মাথা নেড়েছিল। জানে সে। তার মনে যে প্রশ্নটা সকাল থেকে ঘুরপাক খাচ্ছিল, কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছিল না। তা এখন নির্জনে দাদাভাইকে জিজ্ঞেস করে ফেলল।। ঘুম জড়ানো গলায় সে বলেছিল,

‘আমার মা কি সত্যিই পালিয়ে গেছে দাদাজান?’

‘ওই বদ মহিলা তোমার মা না। আজকের পর থেইকা ওরে মা ডাকবা না, বুঝছো?’

‘কেন? মা পালিয়ে কোথায় গেছে?’

‘আবারও মা ডাকে! না করলাম না ওই দুশ্চরিত্রা মহিলারে মা ডাকতে। আচ্ছা আমারে একটা কথা কও, ওয় যদি তোমাদের মা হইত তাইলে কি তোমাগো দুই বইনেরে ফালায়া থইয়া যাইতে পারত? মা-রা কোনোদিন সন্তানরে কষ্ট দিতে পারে? কিন্তু এই মহিলা তো দিতাছে। দেখো নাই সারাদিন তোমার ছোট বোন কেমনে কানলো।’

‘হুম।’

‘শোন দিদিভাই, আজকের পর থেইকা কেউ তোমার মায়ের কথা জিগ্যাসা করলে তুমি কইবা তোমার মা বাইচা নাই। কি কইবা কও তো?’

ধারার ছোট্ট মস্তিষ্কে দাদাজান যে কথা ঢোকাতে চাচ্ছিল তা ধারা তখন বুঝেনি।

‘চুপ কইরা আছো কেন? কী কইবা তুমি? কইবা তোমার মা মারা গেছে। তোমার কোন মা নাই। কইতে পারবা না দিদিভাই?’

‘পারব।’

‘তুমি যখন বড় হইবা তোমার বিয়াশাদী হইব যদি কোনোদিন ওই মহিলা ফিরে আসে তুমি তখন কী করবা?’

ধারা এই প্রশ্নেরও কোন উত্তর দিতে পারেনি।

‘তুমি ওই মহিলারে সামনাসামনি দাঁড় কইরা বলবা। আমি আপনারে ঘৃণা করি। আপনি এই পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট প্রাণী। আপনি সেই দিনই আমার কাছে মারা গেছেন যেদিন আপনি আমার মাটির মতো সহজসরল বাপটারে ধোঁকা দিছিলেন। কইতে পারবা না?’

‘হুম।’

‘সেই দিনটা দেখার জন্য আমি যদি না-ও থাকি তুমি আমার হইয়া এই কথাগুলো কইতে পারবা না? মনে থাকব না তোমার?’

দাদাজান মা’কে মেয়ের মতো স্নেহ করতেন। কতটা কষ্ট পাওয়ার পর তিনি তার ছোট্ট নাতনির মনে নিজের মা’র জন্য ঘৃণার জন্ম দিচ্ছিল তা ধারা বড় হওয়ার পর বুঝেছে।
***
পরের দিন সকালে পাড়াপ্রতিবেশি অনেকেই এই ঘটনা জেনে গিয়েছিল। দল বেধে সবাই চিত্রাদের বাড়িতে আসা শুরু করেছিল। মহল্লায় লোকে ছি ছি করছিল। আপন দেবরের সাথে ভাবি পালিয়ে গেছে। পাড়ার কাকিমারা ধারা ও তার বোনকে দেখে নানা কথায় দুঃখ প্রকাশ করছিল।

‘আহারে এই ফুটফুটে দুইটা ফুলের মত মেয়ে রাইখা দেবরের সাথে পালাইয়া গেল! কি জামানা হইলো? বাঁইচা থাইকা আরও কতকিছু যে দেখতে হইব!’

দুইদিন বাবার কোন খোঁজ ছিল না। তৃতীয় দিনে বাবা বাড়ি ফিরে। বাবার চোখ দু’টো এত লাল ছিল ধারার দাদির বলা রাক্ষসের গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। ভয়ে হাতপা গুটিয়ে দাদির গা ঘেঁষে এসে বসেছিল। বাবা যখন তার সামনে এসে কথা বলছিল বাবার মুখ থেকে কেমন পঁচা গন্ধ আসছিল। বাবা সেদিন নেশার ঘোরে এক কাণ্ড করেছিল। ধারার নামটা পাল্টে দিয়েছিল। হাত উঠিয়ে ধারাকে কাছে ডেকে বলেছিল,

‘আমার এই মেয়ের নাম আজ থেকে ধারা। ওকে কেউ ওর আগের নামে ডাকলে তার গলার ভেতর থেকে জবান টেনে বের করে দিব। এই বাড়িতে ওই বেশ্যার নামগন্ধও যেন না থাকে।’
****

তারপর থেকেই ধারার জীবনে নানান পরিবর্তন ঘটতে লাগল। প্রথম পরিবর্তন তার নিজের নতুন নাম দিয়েই শুধু হলো। দ্বিতীয় পরিবর্তন বাবা, দাদাজান ওদের বাড়িঘর সব বিক্রি করে দিয়ে নতুন জায়গায় গিয়ে উঠল। তার স্কুল পাল্টালো। মা’কে ছাড়াই বাঁচতে শিখে গেল। বড় হবার সাথে সাথে মায়ের প্রতি ঘৃণা আরও তীব্র হতে লাগল ওর। দাদার বলা কথাগুলোও ধারার মনে গেঁথে রইল। কোনোদিন ওই মহিলা তার সামনে এলে সে কথাগুলো ওকে বলবে। ছোট চাচা বাড়ি আসে না। তাদের সাথে থাকে না। এই থেকে ধারা বুঝে নিল মা হয়তো ছোট চাচার সাথেই পালিয়েছে। ধারা মাধ্যমিক পাস করার পর দাদাজান তাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বাবা থেকেও না থাকার মতই। টুকটাক ব্যবসাপাতি করে। তা দিয়েই চার জনের সংসার চলে যায়। মদ খাওয়া এখন বাবার অভ্যাস হয়ে গেছে। রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে। কিন্তু বাবাকে কোনোদিন মাতলামি করতে দেখেনি ধারা। নিজেকে ঠিক ভাবে সামলে নেওয়ার আগেই জেসমিনের দায়িত্বও কিছুটা ওর কাঁধে এসে পড়েছিল। দাদী বুড়ো মানুষ একা একা সবদিক সামলে উঠতে পারে না। বাবা কোনোদিন দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবেনি। দাদাজানও দুই নাতনির ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই প্রসঙ্গ তুলেননি। ধারা কলেজ শেষ করে এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। জেসমিন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। মেয়েটা যে কী পরিমাণে পড়া চোর! সব কিছুতে অলসতা ওর। ছোট থেকে বিনা শাসনে দাদীর আদর পেয়ে পেয়ে আস্ত একটা বাঁদর হয়েছে।
ওদের জীবনে সব ঠিকঠাকই যাচ্ছে। এত বছরেও ধারার একবারও মায়ের কথা মনে পরেনি। কিন্তু মানুষটার দেওয়া নামটা তার এখনও মনে পড়ে। ওই মহিলার গোলাপ ফুল ভীষণ প্রিয় ছিল। মেয়ের নাম তো আর গোলাপ রাখতে পারবে না। তাই গোলাপের ইংরেজি রোজ রেখেছিল। বাবা সেই নাম কোনকালে পাল্টে দিয়েছে। তবুও নামটার কথা তার মাঝে মাঝেই মনে পড়ে।
****

‘এই আপু! আপু, কোন দিকে ধ্যান ধরেছিস?’

ধ্যান ভাঙল ধারার। ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে ছোট বোনের ডাকে সাড়া দিল।

‘কী হয়েছে তোর?’

‘এখনও কিছু হয়নি। তবে এবার মনে হয় হয়েই যাবে। ৭০% সম্ভাবনা আছে।’

‘কী যা-তা বলছিস বল তো!’

‘কেন তুই জানিস না বাবা বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা ভাবছে।’

ধারার কপাল কুঁচকে গেল। বাবা বাড়ি ভাড়া দেবে মানে কী?

‘বাড়ি ভাড়া দিবে! বাড়িতে ঘর কই যে ভাড়া দিবে?’

‘আরে সকাল থেকে দাদাজানের ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করছে দেখতে পারছিস না?’

ধারার মনটা তেতো হয়ে গেল। বাবার কি মাথা খারাপ হয়েছে? দাদাজানের ঘর কাকে ভাড়া দিবে? দাদাজান উপর থেকে এটা জানতে পারলেও তো কষ্ট পাবে।

‘দাদাজানের ঘর ভাড়া দিচ্ছে বাবা! কাকে দিবে? দাদী কিছু বলছে না কেন বাবাকে।’

‘আরে বলদের মতো কথা বলিস না তো। বাবা এতটাও মাতাল না যে দাদাজানের ঘর ভাড়া দেওয়ার কথা ভাববে। আমি আর দাদী দাদাজানের ঘরে শিফট হচ্ছি। আমাদের ঘর ভাড়া দেওয়া হবে।’

‘ওহ। কিন্তু ভাড়া দেওয়ার দরকার কি? বাড়িতে বাইরের মানুষ তোলা কেমন যেন লাগে না ব্যাপারটা!’

‘সেটা বাবাকে কে বোঝাবে! ‘

‘তাছাড়া আমরা বাড়িতে তিনজন মেয়ে মানুষ থাকি। বাবা তো সবসময় আর বাড়িতে থাকে না। বাবা যেন কোন ছেলেকে ঘর ভাড়া না দেয়। স্বামী স্ত্রী এলেও ঠিক আছে।’

‘দূর! জামাই বউয়ের ক্যাটকেটে ঝগড়া শুনতে পারব না। ভাড়াটে এলে সুদর্শন সুপুরুষ একটা ছেলে আসুক। তাতে আমারও এই বাড়িতে মন লাগবে।’

ধারা জেসমিনের কথা শুনেও শুনলো না৷ এই মেয়ে বয়স হবার আগে পেকে যাচ্ছে। সর্বক্ষণ মাথায় উলটাপালটা চিন্তা ঘুরপাক খায়। একে কিছু বলাও যায় না। মুখ কালো করে কথা বলার আগে কেঁদেকেটে দম আটকে মরে যেতে নেয়।

‘দাদীকে বলতে হবে বাবার সাথে যেন কথা বলে। বাবার মাথায় যে কখন কোন ভূত চাপে!’

ধারার মন খারাপ হয়ে গেল। দাদাজান বেঁচে থাকতে সব ঠিক ছিল। বাবা দাদাজানকে ভয় না পেলেও সম্মান করত। সেই সম্মান থেকেই কখনও দাদাজানের সামনে চোখ তুলে তাকায়নি। দাদাজান চলে যাবার পর থেকে ধারা ভীষণ একা হয়ে পড়েছে। দাদীর সাথে জেসমিনের সম্পর্ক দুই সইয়ের মতো। জেসমিনের গোপন থেকে গোপনতম কথাও দাদী জানে। আবার ওসব কথা দাদী সিক্রেটও রাখে। মাধ্যমিক দেওয়ার আগ পর্যন্ত সে দাদী জেসমিন এক ঘরে থাকত। তাদের দুই বোনের জন্মদাত্রী নিজের নতুন জীবন শুরু করতে যেদিন বাড়ি ছেড়েছে সেদিন থেকেই দাদী তাদের সাথে থাকা শুরু করেছে। দাদী জেসমিন দুইজন গভীর রাত পর্যন্ত পুটুরপুটুর করে আলাপ করে। পরীক্ষার সময় তার পড়ার ডিস্টার্ব হয়। রাতে ঘুমের সমস্যা হয়। এসব শুনে দাদাজান তাকে আলাদা ঘর দিল।

‘আপু।’

‘হুম।’

‘কী ভাবো তুমি?’

‘কিছু না। তুই এখনও এখানে কী করছিস? পড়াশোনা নেই তোর? দুই মাস পর পরীক্ষা এই কথা তোকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হয় কেন? গতবার নাইনে ফেল করে বসলি। এবার কি মেট্রিকে ফেল করে পাড়ার লোক জানাবি।’

জেসমিন দুনিয়ার সব বিরক্তি চোখে নিয়ে বোনের দিকে তাকালো। চোখ দিয়েই বোনকে কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিল। কারণ এই কথাগুলো আপুকে মুখে বলার সাহস নেই তার। আর বললেও চড় খেতে হবে।

‘তুই একটা পাষাণ বোন।’

‘ধন্যবাদ।’

জেসমিন তার এই বড় বোনটাকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু এই কথাটা সে কখনও বলতে পারে না। আপুর সাথে তার সম্পর্কটা ঠিক ততটাও কাছাকাছি না যে নিরদ্বিধায় মনের কথা বলে ফেলতে পারবে। আবার ততটা দূরেরও না যে আপুকে তার সমস্যার কথাগুলো জানানো যাবে না। আপু সবসময় এক টুকরো আকাশ হয়ে তার মাথার উপর থাকে। কিন্তু আপুটা যেন কেমন! জোরে হাসে না। বেশি কথা বলে না। সবসময় কেমন টিচার টিচার ভাব নিয়ে ঘুরে। যেন এক্ষুনি ধমকে দিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলবে। আপুটা বয়স হবার আগেই বুড়ো হয়ে গেছে।

চলবে_