এক বরষায় পর্ব-৪৪+৪৫

0
284

#এক_বরষায় [৪৪]
জেরিন আক্তার নিপা

_________
ধারা একটা রেস্টুরেন্টে সাদাফের সামনের চেয়ারে বসে আছে। সাদাফ ধারাকে নিয়ে এসেছে বিয়ের কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ধারার মনে অন্য কিছুই চলছে। অনেকটা সময় ধরে ধারা চুপচাপ বসে আছে। আসলে মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। কীভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সাদাফও ধারা কিছু বলবে আশা করে বসে আছে। কাল তাদের গায়ে হলুদ। ধারা তার হতে মাঝে শুধু একটা দিনের ব্যবধান। ধারা টেবিলের নিচ দিয়ে হাত কচলাচ্ছে। গলা শুকিয়ে এসেছে তার। ঢোঁক গিলে গলা ভিজিয়ে নিতে চাচ্ছে। কথা শুরু করার আগে ইতস্তত করছে। শেষে চোখ বন্ধ করে বড় বড় করে দু’বার দম নিয়ে বলেই ফেলল। আজ না বললে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাকে আজ সাহস দেখাতেই হবে।

-দেখুন সাদাফ সাহেব, আজকে আপনার সাথে দেখা করার মূল উদ্দেশ্য আমার আপনাকে কিছু বলার আছে। আর সেজন্যই আমি এসেছি।”

সাদাফ পিঠ সোজা করে বসে ধারার কথা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে তাকাল।

-হ্যাঁ বলুন।”

কথাগুলো বলতে গিয়ে ধারা নিজেকে বড় দুর্বল, অসহায়, অপরাধী মনে করছে। আরও আগে তার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল। তারপরও এখনও সময় চলে যায়নি।

-সাদাফ সাহেব, আজ আপনাকে আমি আমার জীবনের এমন একটা ঘটনা বলব যা আমি কখনও কারো সাথেই বলিনি। আমি নিজেও ওই কথাটা ভুলে থাকতে চাই৷ তবুও ভুলতে পারি না। কথাটা শোনার পর আপনি হয়তো বিয়েটা করতে চাইবেন না। তারপরও আমি বলব। আমি যখন খুব ছোট। বয়স কত হবে? নয় বছর। তখন আমার মা আমাদের দুই বোনকে ফেলে আমারই আপ চাচার সাথে পালিয়ে যায়। ওই লোক আমার বাবার সৎভাই হলেও সম্পর্কে আমাদের চাচাই তো! একই রক্ত। ওই ঘটনার পর সমাজের মানুষের চোখে আমাদের অবস্থান কোথায় হবে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। চেনা অচেনা, আত্মীয়স্বজন কেউই আমাদের কথা শোনাতে বাকি রাখল না। লজ্জায় অপমানে আমাদের দাদা রাতারাতি আমাদেরকে নিয়ে এখানে চলে আসে। তখন আমরা দুই বোন অনেক ছোট ছিলাম। জেসমিনের হয়তো কিছুই মনে নেই। কিন্তু আমার মনে আছে। ওই ঘটনার পর থেকে ভালোবাসা শব্দটার উপর আমার বিশ্বাস তো রইল না। বরং এই শব্দটার উপর ঘৃণা বসে গেল। আমার বাবা মদ খায় এটা জানেন নিশ্চয়? পাড়ার কেউই জানায়নি এটা জানলে আমি আশ্চর্য হবো। ওই মহিলা আমাদের জীবন থেকে গেল ঠিকই কিন্তু সাথে করে সুখ নামের শব্দটাও আমাদের জীবন থেকে নিয়ে গেল।”

ধারা থরথর করে কাঁপছে। ঠোঁটের কাঁপুনি থামাতে ঠোঁট কামড়ে ধরল। সাদাফ স্তব্ধ নির্বাক হয়ে বসে আছে। ধারার চোখ জলে টলমল করছে। এই মুহূর্তে সাদাফের কী বলা উচিত ভেবে পাচ্ছে না।

-আপনাকে এই কথাগুলো জানানোর কারণ কী তা আমি নিজেও জানি না। তবুও ইচ্ছে হলো আপনাকে আমি সব জানাই।”

-ধারা, আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন এজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু একটা কথা, আমি এসব না জেনেই আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছি। এখন এসব জেনেও আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হবে না। যা কিছুই হয়ে যাক আমি বিয়েটা ভাঙব না। অতীতে যা কিছু হয়ে গেছে তাতে আপনার তো কোন হাত নেই ধারা।”

ধারা টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে নিল। হাত দেখিয়ে সাদাফকে থামিয়ে দিল। নিজে বলতে লাগল,

-সাদাফ সাহেব, মানুষ হিসেবে আপনি একজন চমৎকার মানুষ। আপনার মনটাও ভীষণ ভালো। কিন্তু সাদাফ সাহেব আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না। আমি জানি আমি আপনার সাথে অন্যায় করেছি। আরও আগেই আমার জানানো দরকার ছিল। আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না বিয়েটা আমি করতে চাই কিনা। বলা যায় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি আমার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি। আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন সাদাফ সাহেব। এই বিয়েটা হলে আমি আপনি কেউই ভালো থাকবো না। আপনাকে আমি সেই ভালোবাসাটা দিতে পারব না যা আপনি আমার থেকে আশা করেন। আমি এমন একটা সম্পর্ক চাই না যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই।”

ধারার কথাগুলো সাদাফের বুকে চাবুকের বাড়ির মতো পড়ছে। তারপরও ধারাকে দুষতে পারছে না সে। সাদাফ নিজের আবেগ অনুভূতি বহু কষ্টে লুকিয়ে হাসবার চেষ্টা করে বলল,

-ধারা আপনি আমাকে বিশ্বাস করে অনেক কথাই বলেছেন। আরেকটা কথা বলবেন প্লিজ?”

-হুম।”

-আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন?”

ধারা ঝট করে একবার সাদাফের দিকে দেখল। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। এই মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার কোন অধিকার নেই ওর। ধারা মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে উত্তর দিল,

-হয়তো।”

-হয়তো?”

-ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করতাম না। এখনও হয়তো করি না। কিন্তু মায়া নামের একটা শব্দ আছে সাদাফ সাহেব। আর কারো প্রতি মায়া জিনিসটা এসে গেলে সেটা ভালোবাসার থেকেও বেশি ভোগায়।”

সাদাফ হাসল। জিজ্ঞেস করল,

-আর এই মায়াটা আপনার কার উপর পড়েছে?”

ধারাও সহজ হতে চেয়ে বলল,

-আছে একজন। এমন একজন মানুষ, যে মানুষটা আমি যখন ভালোবাসা শব্দটার অর্থ উপলব্ধি করতে পারি না তখন থেকে আমাকে ভালোবেসে আসছে। সেই মানুষটার মায়ায় পড়ে গেছি আমি।”

সাদাফের হাসিটা ঠিক কান্নার মতোই মনে হচ্ছে। ধারার ভালোবাসা তার ভাগ্যে লেখা নেই। যার ভাগ্যে লেখা আছে সে নিশ্চয় ভাগ্যবান। ধারা চলে যাবার পরও সাদাফ অনেকক্ষণ বসে রইল। যাবার আগেও ধারা মন থেকে অনুতপ্ত হয়ে সাদাফের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। ধারার উপর সাদাফের কোন রাগ নেই। নেই কোন অভিযোগ। ধারা এই কথাটা বিয়ের আগে বলেছে এতেই সে খুশি। ধারা তাকে বিশ্বাস করেছে। নিজের জীবনের অতি গোপন একটা অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়েছে।
****

জেসমিন কলেজ থেকে ফিরে জানতে পারল ধারা আপু ওই লোকটার সাথে বাহিরে গেছে। কথাট শুনেই জেসমিনের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। তার এই গাধা বোনটা চাচ্ছেটা কী? কেন বিয়েটা ভাঙছে না। আবার আজ নাকি ওই লোকের সাথে বাইরে গেছে। মুনতাসীর ভাইকে ভালোবাসে না ঠিক আছে। কিন্তু নয়ন ভাইকেও তো একটা সুযোগ দেয়নি। জেসমিন বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভেতরে বাবা আর দাদী কোন কিছু নিয়ে কথা বলছে। জেসমিন চট করে ঘরে ঢুকে যেতে পারল না। বাইরে দাঁড়িয়েই বাবা দাদীর কথা শুনতে লাগল।
শরিফুল ইসলাম নিজেও বিবেকের দংশনে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন। নজরুল মারা যাবার আগেও তার মেয়েকে ছেলের বউ বানাতে চেয়েছিল। নজরুল কথা রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনিই সব ভুলে গেলেন। মুনতাসীরের সাথে ধারার বিয়ে না দিয়ে অন্য একটা ছেলের সাথে দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন। যে ভুল করতে যাচ্ছিলেন তা এবার শুধরে নিবেন। এই কথাই তিনি মায়ের সাথে বলছিলেন।

-হ্যাঁ মা, আমি ঠিক করেছি এখানে ধারার বিয়ে দিব না।”

-বিয়া দিবি না! এইডা কি কস বাপ? আজ বাদে কাল পরশু বিয়া আর তুই কইতাছোস বিয়া দিবি না? কেন দিবি না? কী হইছে?”

-কিছু হয়নি মা। আমি ধারার বিয়ে নজরুলের ছেলের সাথে দিব।”

-মুনতাসীরের লগে?”

-হুম। বাবার দেওয়া কথা আমি রাখব। নজরুলের শেষ ইচ্ছা আমি পূরণ করব।”

দাদীরও মুনতাসীরকে পছন্দ। মুনতাসীরের সাথে নাতনির বিয়ে দিতে উনার কোন আপত্তি নেই। মুনতাসীরের সাথে ধারার বিয়ে হলে ধারা চোখের সামনেই থাকবে। ছেলেটার নিজেরও তো একটা ভাই ছাড়া কেউ নেই।

-কিন্তু যে পোলার লগে বিয়া ঠিক করলি? কাইল হলুদ। পরের দিন বিয়া।”

-ওদের কাছে অনুরোধ করব মা। দরকার পড়লে হাত জোর করে মাফ চাইব মা। তারপরও না মানলে সত্য কথা বলে দিব। ধারার বিয়ে ছোট বেলা থেকেই মুনতাসীরের সাথে ঠিক ছিল।”

-কিন্তু বাপ, হঠাৎ কইরা তুই এই সিদ্ধান্ত নিলি…

-একটা চরিত্রহীনার জন্য আমার জীবনটা শেষ হয়েছে মা। আমি আমার মেয়েদের জীবন নষ্ট করতে চাই না। ধারাকে তো তুমি দেখেছ মা। কখনও মুখ ফোটে নিজের জন্য কিছু চাইবে না। দুই মেয়ের দিকে আমিও নজর দিইনি। কিন্তু এখন আমি সেটাই করব যা ওদের জন্য ভালো হবে।”

-তা-ই কর বাপ। তুই ওদের বাপ, মেয়ে দুইটা তোকে অনেক ভালোবাসে রে। তুই-ই ওদের দূর কইরা রাখছস। আল্লাহ ওদের এমন একটা মায়ের গর্ভে জন্ম দিছে যে মা সন্তানের মায়া মমতা ত্যাগ কইরা নিজের সুখ দেখছে। বাপ থাইকাও না থাকার মতো।”

জেসমিন শেষ কথাটা শুনে থমকে গেল। তার মা তো সে ছোট থাকতে মারা গেছে। দাদীর মুখে এই কথাই শুনে এসেছে সে। কিন্তু এখন দাদী এইটা কী বলল? তার মা তাদের মায়া ত্যাগ করে নিজের সুখ দেখেছে মানে কী? তার মা কি তাদের ফেলে রেখে চলে গেছে? তাহলে দাদী কেন বলতো তার মা মারা গেছে? কেন তার থেকে সত্যিটা লুকিয়েছে সবাই? ধারা আপুও তো কোনোদিনও বলেনি। এইজন্যই কি ধারা আপু কোনোদিনও মা’র কথা বলেনি? মা’র কথা উঠলেই ধারা আপু কেমন কঠিন হয়ে থাকতো। তার মা কি বেঁচে আছে? মা তাদের ফেলে কেন চলে গেল? কোথায় গেছে? আপুর জন্মের পর তো মা যায়নি। তাহলে তার জন্মের পর কেন গেছে? মা কি তার জন্যই চলে গেছে? মা কি তাকে ভালোবাসতো না?

চলবে_

#এক_বরষায় [৪৫]
জেরিন আক্তার নিপা

_______
জেসমিন নিঃশব্দে বাবার ঘরের সামনে থেকে চলে এলো। তার চোখ উপচে জল আসছে। ছোটবেলা থেকে সবাই তাকে এত বড় একটা মিথ্যা বলে এসেছে! সবাই তাকে অন্ধকারে রেখেছে। সত্যিটা কেউ তাকে জানায়নি। সে জন্মের পর তার মা মারা যায় নি। বরং তার মা তাদের ফেলে চলে গেছে। ধারা এখনও বাড়ি ফিরেনি। জেসমিন দাদী বা বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। ওরা হয়তো এখনও তার কাছে সত্যি বলবে না। আপুর থেকেই জানবে সে। জেসমিন নিশ্চল পায়ে আতিফের ঘরে চলে এলো। মানুষের জীবন এক মুহূর্তে কেমন পাল্টে যেতে পারে। এতগুলো বছর ধরে জেনে আসা সত্যিটাও মিথ্যায় পরিনত হতে পারে। হাসিখুশি ভরা জীবনে বিষাদের কালো ছায়া নামতে এক সেকেন্ডও সময় লাগে না। জেসমিনকে কাঁদতে দেখে আতিফ অস্থির হয়ে পড়ল। অধৈর্য হয়ে ওর কান্নার কারণ জানতে চাইল,

-জেসমিন আপু, কাঁদছ কেন তুমি? কী হয়েছে? কে কী বলেছে?”

জীবনের আঠারো বছর পেরোনোর পর জেসমিন জানতে পারল তার মা বেঁচে আছে। এই সত্যটা এতদিন বাবা দাদী আপু সবাই তার থেকে লুকিয়েছে। জেসমিনের মনে হচ্ছে তার জীবনে আপন কেউ নেই। সে জন্মের পর মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সবাই তাকে মিথ্যা বলেছে। আসলে সে-ই বোকা। সবাই তাকে ভালোবাসে এমন একটা ভুল ধারণা নিয়ে বেঁচে আছে।

-কী হয়েছে জেসমিন আপু? আমাকে বলো। কেন কাঁদছ তুমি?”

জেসমিন অসহায় চোখে আতিফের দিকে তাকাল। আচ্ছা আতিফ কি তাকে ভালোবাসে? আতিফ তো তার নিজের ভাই না। তবুও কি তাকে আপুর মতো ভালোবাসে?

-কেউ আমাকে ভালোবাসে না আতিফ। কেউ আমাকে চায় না। আমি সবার জীবনে দুঃখ নিয়ে এসেছি। আমি জন্ম না নিলে হয়তো আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে যেত না। এতগুলো বছর আমি ভুল জেনেছি। আমার মা মারা যায়নি। আমার জন্মের পর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। হয়তো আমার জন্যই গেছে। নইলে আপুর জন্মের পর কেন যায়নি? আপু তো মা’র ভালোবাসা পেয়েছে। আমি কেন পাইনি?”

আতিফ জানতো এই কথাগুলো একদিন না একদিন সামনে আসবে। তার মা’র মতো সবাই তাকেও ঘৃণা করবে। আতিফ নিজেও জেসমিনের সাথে কাঁদতে শুরু করল। তাদের জীবনটা এত কঠিন কেন? ভাইবোন হয়েও কেন তারা অপরিচিতের মতো থাকে? কেন বলতে পারে না, আমার মা-ই তোমার মা। আমাদের মা একই। মা তোমাকেও ভীষণ ভালোবাসে। মা ধারা আপুকেও ভালোবাসে। আমাদের মা যা করেছে তাতে আমাদের কোন হাত নেই। আমরা তিন ভাইবোন। আমার মা বাবার ভুলের জন্য তোমরা আমাকে দূরে ঠেলে দিতে পারো না৷ আমি তোমাদেরই ভাই। আমাকে তোমরা আপন করে নাও। আর মাকেও ক্ষমা করে দাও। জানি ধারাপু আমাকে ঘৃণা করে। আমার পরিচয় জানলে আমাকেও ঘৃণা করবে। কিন্তু আমি তো তোমাদের নিজের বোন ভাবি। তোমরা ছাড়া আমার কেউ নেই। সত্য জেনে আমাকে তোমরা এবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিও না।
কান্নার জোরে আতিফের হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। জেসমিন নিজের দুঃখ ভুলে গিয়ে কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে আতিফকে দেখছে। আতিফ কেন এভাবে কাঁদছে বুঝতে পারছে না সে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-তুই কাঁদছিস কেন গাধা? তোর কী হয়েছে? তোর মা কি তোকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে? আমাকে আমার মা ফেলে চলে গেছে। আমার থেকে বেশি কষ্ট কি তোর?”

আতিফ কান্না না থামিয়েই নাক টেনে অস্ফুটস্বরে বলল,

-তোমাকে কাঁদতে দেখে আমারও কান্না পাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে আমার।”

জেসমিন দুঃখের মাঝেও এই ছেলের ঢঙ দেখে রেগে গেল। ধমক দিয়ে বলল,

-কান্না থামা গাধা। একদম কাঁদবি না। এই তুই কি মেয়ে? মেয়ে মানুষের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিস! আমার কান্না দেখে তোর কান্না পাবে কেন?”

-জানি না। কিন্তু তুমি কাঁদলে আমিও তোমার সাথে কাঁদব।”

-এহ ঢঙ। নাটক তো কম পারিস না। আমার জীবন দুঃখ কষ্ট দিয়ে ভরা সে আমার সাথে নাটক করতে কাঁদবে। তোর জীবনে কী দুঃখ লেগেছে? তোর তো মা আছে। দুইদিন পরপর মা’র কাছে চলে যাস। আমি তো এটাও জানতাম না আমার মা বেঁচে আছে। এটাও তো জানি না আমার মা দেখতে কেমন? মা যে মরেনি এই সত্য আজই জানলাম। আমার কেমন রিয়েক্ট করা উচিত আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না। আমি কি চিৎকার করে কাঁদব? বাবা দাদী আপুকে দোষব? নাকি ওই স্বার্থপর মহিলাকে খুঁজে বের করে কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে আসব? তিনি বেঁচে থেকেও তো আমাদের থেকে দূরে আছেন। বড্ড স্বার্থপর মহিলা আমার মা। না, উনাকে আমি মা ডাকব না। ওই মহিলা এতদিন আমার কাছে মৃত ছিল। বাকি জীবন মৃতই থাকবে। আঠারোটা বছর আমি উনাকে ছাড়া থাকতে পারলে আগামী আশি বছরেও উনাকে আমার দরকার নেই। আরে যে মহিলা আমাদের কথা ভাবেনি আমি কেন তার জন্য চোখের পানি ফেলব। আমার চোখের পানি এত সস্তা না। যার তার জন্য জেসমিন কাঁদে না। আমি আমার খুব আপনজন গুলোর জন্যই কাঁদব।”

জেসমিনের কথাগুলো শুনে আতিফের কান্না আরও বেড়ে গেল। মা যতই খারাপ হোক, তার মাকে কেউ এত বেশি ঘৃণা করছে এটা ছেলে হয়ে আতিফ সহ্য করতে পারছে না। মা অপরাধ করেছে। কিন্তু সেই অপরাধের শাস্তিও তো পাচ্ছে। নিজের মেয়েদের থেকে দূরে থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে মরছে। জেসমিন আপু অর্ধেক সত্য জেনেই মাকে এতটা ঘৃণা করছে। পুরো সত্য জানলে কোনদিনও মা’র মুখ দেখতে চাইবে না। তার সাথে এই মিষ্টি সম্পর্কটাও রাখবে না আর।
জেসমিন ঠাস করে আতিফের পিঠে চড় বসিয়ে দিল।

-আমার জীবনের এতবড় একটা সত্য জেনে আমি কাঁদছি না, তুই এখনও কেন কাঁদছিস রে? বউ মরেছে তোর? আমার আঠারো বছরের জীবন উলটপালট হয়ে গেল। সত্য মিথ্যা হয়ে গেল। মিথ্যা সত্য হয়ে গেল তবুও তো আমি তোর মতো কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছি না। ছিঁচকাদুনের বাচ্চা চুপ কর।”
*****

সাদাফকে কথাগুলো বলতে পেরে ধারার হালকা লাগছে। বুকের উপর থেকে ভারী একটা পাথর নেমে গেছে যেন। এতদিন মুনতাসীর ভাইকে এগিয়ে গেছে সে। মুনতাসীর ভাইয়ের মনের কথা জেনেও না জানার ভান করে থেকেছে। মুনতাসীর ভাইয়ের ভালোবাসা গ্রহণ করে নেওয়ার সাহস শক্তি কোনোটাই ছিল না তার। কিন্তু প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে বলা লোকটার কথা শুনে ধারা আর কঠিন হয়ে থাকতে পারল না। মোমের মতো গলে গেল। এতদিন ধরে লোকটাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিয়েছে সে। তারপরও মুনতাসীর ভাই তাকে এক মুহূর্তের জন্য ভালোবাসতে ভুলেনি। ধারা জীবনে যদি কোনোদিন বিয়ে করে তাহলে তার বরটা হবে মুনতাসীর ভাই। রৌদ্রোজ্জ্বল ঝকঝকে আকাশ। ধারার মনের আকাশেও আজ সমস্ত মেঘ কেটে গিয়েছে। কোথায় একফোঁটা মেঘের আনাগোনা নেই। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ধারা ভাবল মুনতাসীর ভাইয়ের বাসার সামনে দিয়ে যাবে? যদি দেখা হয়ে যায়। দূর থেকে দেখলেও হবে। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কথা না বললেও হবে।
ধারা মুনতাসীরকে দেখার জন্যই ইচ্ছে করে পায়ে হেঁটে আসছে। রিকশা নিয়ে চলে গেলে দেখা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আজকে সবকিছুই তার চাওয়া মতো হচ্ছে। তাই মুনতাসীরের দেখা পাবে এই বিশ্বাসও বদ্ধমূল হলো।
সত্যি সত্যিই রাস্তাতেই মুনতাসীরের দেখা পেল সে। ধারাকে দেখে মুনতাসীরও দাঁড়িয়ে গেল। অজান্তেই কপালে ভাঁজ পড়ল। এভাবে ধারার দেখা পেয়ে যাবে কল্পনার বাইরে ছিল। এদিকে ধারার কী কাজ? কেন এসেছে? মুনতাসীর দ্রুত হেঁটে ধারার কাছাকাছি চলে গেল। ধারা হাসি চেপে মুখে গম্ভীরতা ধরে রাখতে চাইল। কতটা পারল কে জানে।

-ধারা, কোথায় গিয়েছিলি?”

-হবু বরের সাথে দেখা করতে।”

মুনতাসীর অবাক বিস্মিত হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। তার প্রশ্নের উত্তরে ধারার এত সহজ জবাব! ধারাকে কি আজ কিছুটা অন্যরকম লাগছে? হবু বরের সাথে দেখা করে এসেছে বলেই চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে? মুনতাসীরের মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে লাগল। ধারা সেটা লক্ষ করে মনে মনে হাসল।

-তোকে বলেছিলাম বিয়েটা হবে না। তারপরও তুই ওই ছেলেটার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি?”

ধারা হাঁটতে হাঁটতে সামনের রাস্তার দিকে চোখ রেখেই বলল,

-কেন?”

-কেন কি?”

-বিয়েটা হবে না কেন? কাল হলুদ, পরের দিন বিয়ে। বিয়ে না হবার তো কোন কারণ নেই।”

মুনতাসীর দাঁড়িয়ে পড়ল। মাঝ রাস্তায় ধারার হাত চেপে ধরে ওকেও দাঁড় করিয়ে দিল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ চাপার চেষ্টা করে বলল,

-কারণ তুই যদি কারো বউ হোসও সেটা আমার বউ হবি। অন্য কারো না।”

-কেন?”

-কারণ আমার মতো ভালো তোকে কেউ বাসতে পারবে না তাই।”

ধারা আর কিছু বলল না। ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। মুনতাসীরও ওর হাত ধরা অবস্থায় হাঁটছে।”

-সেদিন আমি তোকে কী কী বলেছিলাম রে?”

-কোনোদিন?”

-ওইযে জ্বরে পড়লাম। তুই আমাকে দেখতে গিয়েছিলি।”

-আমি আপনাকে দেখতে যাইনি। জেসমিন দর্জির দোকানে যাবে বলে নিয়ে এসেছিল।”

-যা-ই হোক। কী কী বলেছিলাম তোকে?”

-আমার মনে নেই।”

-তুই রাগ করিসনি তো ধারা?”

-যদি বলি করেছি।”

-আমি তোকে ভালোবাসি এটা আমার সমস্যা। তুই আমাকে ভালোবাসিস না এটাও আমারই সমস্যা। আমার সবকিছু মনে নেই কিন্তু এটুকু মনে আছে আমি হয়তো তোকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আর আমার সেই কাজের জন্য আমি অনুতপ্ত। তুই রাগ করিস না প্লিজ। তখন হুঁশে ছিলাম না।”

-এখন তো হুঁশে আছেন, এখনও তো আমার হাত ধরে রেখেছেন।”

মুনতাসীর ঝট করে একবার ওর হাতের দিকে তাকাল। সত্যিই সে ধারার হাত ধরে রেখেছে। তবুও হাতটা ছাড়ল না।

-এখন তো তুই রাগ করছিস না।”

-কে বলেছে রাগ করছি না?”

মুনতাসীর উদাস গলায় বলল,

-রাগ কর। তবুও এখন হাতটা ছাড়তে পারব না।তোর সাথে এভাবে হাঁটতে আমার ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে সারাজীবন এভাবেই তোর হাতটা ধরে রাখি।”

ধারা মনে মনে বলল,

-ধরে রাখুন মুনতাসীর ভাই। কোনোদিনও ছাড়বেন না। আমি ছাড়াতে চাইলেও ছাড়বেন না। শক্ত করে ধরে রাখবেন।”

চলবে_