এক বরষায় পর্ব-৪৬+৪৭

0
391

#এক_বরষায় [৪৬]
জেরিন আক্তার নিপা

___________
ধারা বাড়ি ফিরে এসেছে। এসেই বাবাকে খুঁজছে সে। কিন্তু বাবা বাড়িতে নেই। দাদী মনে মনে ভাবছেন, ধারা যখন জানবে তার বাপ বিয়ে ভেঙে দিছে তখন কী করবে? মুনতাসীরের সাথে ধারার বিয়ে দিতে চায় এই কথা জানলে তো মেয়েটা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে। ধারার মনটা আজ শরতের আকাশে উড়ে বেড়ানো এক টুকরো পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। সদ্য কিশোরীতে পা দেওয়া চপল চঞ্চল মেয়েটির মতো কারণে অকারণে হাসতে গাইতে নাচতে ইচ্ছে করছে। মুনতাসীরের কল্পনা মনে আসতে রঙিন প্রজাপতির মতো উড়তে ইচ্ছে করছে। ধারা গালে হাত দিয়ে বসে মুনতাসীরের কথা ভেবে মিটমিট করে হাসছিল। জেসমিন কোমরে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে বোনকে দেখছে। যে মেয়ে পেট ফাটা হাসির কৌতুক শুনেও হাসে না। সে মেয়ে একা বসে হাসছে? জ্বীনে টিনে ধরল নাকি? উঁহু ব্যাপারটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। জেসমিনের হাজার মন খারাপের মাঝেও গোয়েন্দাগিরি করার সুযোগ হাতছাড়া করলো না। গলায় সন্দেহ নিয়ে বলল,

-এই আপু, একা একা হাসছো কেন? কী হয়েছে?”

জেসমিনের গলা শুনে ধারা ধড়ফড়িয়ে উঠল। জেসমিন কখন এসেছে বুঝতেই পারেনি। ওর এমন আচরণে জেসমিনের সন্দেহ আরও গুরুতর হলো। কিছু তো নিশ্চয় হয়েছে। নইলে আপু তার ডাকে চুরি করে ধরা খাওয়ার মতো ভয় পেয়ে যেত না।

-কী হয়েছে বলো তো! একা একা হেসে মরছো।”

ধারা তার স্বভাব মত গলায় কাঠিন্য আনার চেষ্টা করে বলল,

-তোর অভ্যাস দিনদিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিড়ালের মতো যেখানে সেখানে চলে আসিস। আসার সময় শব্দও হয় না।”

-রাগছো কেন? মানুষ তখনই এমন রাগ করে যখন তার চুরি ধরা পড়ে। একা একা হাসছিলে কেন?”

-কখন হাসছিলাম? আর আমি হাসলেও তোর কাছে জবাব দিতে হবে?”

-না। কিন্তু খুশির কথা অন্যের সাথে শেয়ার করলে খুশি দ্বিগুণ হয়ে যায়।”

ধারা উঠে গিয়ে শুধু শুধু আলনার সামনে দাঁড়িয়ে ভাঁজ করা কাপড় আরও গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল,

-তোর কোন কাজ নেই? সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াস।”

আপুকে হাসিখুশি দেখলে জেসমিনের নিজেরও ভালো লাগে। আপু খুব কম হাসে। কিন্তু আপুর হাসি ভীষণ সুন্দর। জেসমিন যা জিজ্ঞেস করতে এসেছিল এই মুহূর্তে ওসব কথা তুললে আপুর হাসি হাসি মুখটা আর দেখতে পারবে না। মা’র কথা উঠলেই আপুর মন খারাপ হয়ে যায়। জেসমিন আপুর মন খারাপ করতে চায় না।

-কাজ আছে। আমি যাই।”

-এই দুপুরবেলা কোথায় যাবি?”

-নয়ন ভাইদের বাড়ি যাব। অনেকদিন ধরে নয়ন ভাইকে দেখি না।”

সত্যিই কয়েকদিন ধরে নয়ন ভাইয়ের দেখা নেই। ধারা নিজের মন নিয়ে এমন দোটানায় ছিল নয়ন ভাইয়ের কথা ভাবার সময় পায়নি। তার জীবনেই তো কতকিছু ঘটে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে এবার বুঝতে পেরেছে ওর মন কী চায়।
এখনও তার ভয় হচ্ছে, বাবাকে কীভাবে বলবে? সব শুনে বাবা মেনে নিবে তো? বাবা যদি বিয়েটা ভাঙতে না চায় তখন? আচ্ছা সাদাফকে তো সে সবকিছু বলেছে। সাদাফ নিশ্চয় সব জেনেও বিয়েটা করতে চাইবে না। সাদাফ ভালো মানুষ। তাকে বুঝবে।
*****

বাবা বাড়িতে এসেছে। সবাই খেয়ে যার যার ঘরে চলে গেলে ধারা বাবার ঘরে গেল। তাকে সাহস করে বাবাকে বলতেই হবে। বাবা রাগ করুক, তাকে বকুক। তবুও এই বিয়ে সে করতে পারবে না। শরিফুল ইসলাম মেয়েকে দেখে নিজেও মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন। তিনি নিজে ছেলের বাড়িতে গিয়ে ছেলের বাবা মা বোনকে বুঝিয়ে এসেছেন। বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার। এমন না যে পাঁচ দশ বছর একসাথে থেকে তারপর আলাদা হয়ে যাবে। তার থেকে বড় কথা, তিনি একজনকে কথা দিয়েছিলেন। কথাবার্তা এতদূর এগিয়ে এনে এখন পিছিয়ে যাওয়ার জন্য ক্ষমাও চাইলেন। ছেলের বাবা মা রাগারাগি করলেও সাদাফ বুঝেছে। ধারার বাবা হিসেবে তিনি যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ছেলেটা সত্যিই ভালো।
শরিফুল ইসলাম মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না। কাল বাদে পরদিন বিয়ে এখন তিনি মেয়েকে না জানিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে এসেছে। ধারা জানলে কি রাগ করবে?
ধারা ভেতরে এলে বাবা ধারাকে নিজের কাছে ডাকলেন।

-এদিকে আয় মা।”

ধারা বাবার কাছে গিয়ে বসল। মনে মনে নিজেকে সাহস দিল। তাকে যে বলতেই হবে। শরিফুল ইসলাম মেয়েকে দেখছেন। সেই চোখ সেই নাক। মেয়েটা পুরোপুরি তার মায়ের মতো হয়েছে।

-বোস মা। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

ধারার ভয় হতে লাগল। বাবা তাকে কী বলবে? বাবার কথা ফেলতে পারবে না ধারা। বাবা বললে তাকে এখানেই বিয়ে করতে হবে। মানুষটাকে সে আর কোন কষ্ট পেতে দিতে চায় না।

-তুই তো জানিস মা আমি যা করি তোদের ভালোর জন্যই করি। বাবা হয়ে আমি নিশ্চয় চাইব না আমার মেয়েরা খারাপ থাকুক। আমার কোন সিদ্ধান্তে তোরা আমাকে ভুল বুঝিস না রে মা। আমি শুধু তোদের জন্যই বেঁচে আছি। তোরা না থাকলে হয়তো জীবনের বোঝা এতদিন টানতাম না। অনেক আগেই..

ধারার চোখ জ্বালা করছে। গলা ধরে আসছে। বাবা এভাবে বললে সে যে কথাগুলো বলতে এসেছে তা কখনোই বলতে পারবে না। ধারা ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলালো। কাঁপা গলায় বলে উঠল,

-বাবা এই বিয়েটা আমি করতে চাই না। তুমি আমাকে ভুল বোঝো না। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমি জানি, আমি কোনোদিন তোমার ভালো মেয়ে হয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু বাবা বিয়েটা আমি করতে চাই না।”

তিনি যে কথাগুলো বলতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন সে কথাগুলোই তার মেয়ে বলে দিয়ে তার বুকের উপর থেকে ভারী একটা পাথর সরিয়ে দিল। এই কথাগুলোই তো তিনি বলতে চাচ্ছিলেন। বাবাকে চুপ থাকতে দেখে ধারা কাঁদতে কাঁদতে বাবার পায়ের কাছে বসে পড়ল।

-আমি কোনোদিনও তোমার কাছে কিছু চাইনি বাবা। আজ চাচ্ছি। তুমি আমাকে জোর করো না। বিয়েটা তুমি ভেঙে দাও। আমার উপর তুমি রাগও করো না। তোমার রাগ আমি সহ্য করতে পারব না।”

মেয়ের কান্না দেখে শরিফুল ইসলাম অবশ হয়ে বসে রইলেন। ধারাকে তিনি কোনোদিনও কাঁদতে দেখেননি। মেয়েটা কখনও কাঁদে না। আজ মেয়ের চোখের পানি দেখে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।

-ওঠ মা। কাঁদছিস কেন তুই? আমি তোর উপর রাগ করিনি। তোর বাবা কোনোদিনও তোদের উপর রাগ করতে পারে না। তুই বিয়ে না করতে চাইলে আমি বিয়ে ভেঙে দেব। তবুও তুই শান্ত হ। কাঁদিস না।”

-আমি তোমার ভালো মেয়ে না বাবা।”

-কে বলেছে তুই আমার ভালো মেয়ে না? তুই আমার মা। আমি তোর বাবা না। তুই তো সবসময় আমাকে নিজের ছেলের মতোই যত্ন করেছিস। আমিই তোদের যোগ্য বাবা না। তোদের সম্মানের যোগ্য না আমি। বাবার দায়িত্ব কোনোদিনও পালন করিনি। ক্ষমা তো তোর কাছে আমার চাওয়া উচিত।”

বাবা মেয়ে নিজেদের মনের কথা বলে ফেলতে পেরে দু’জনই কাঁদছে। এতগুলো বছর পর বাবা মেয়ের মাঝের দূরত্ব শেষ হয়েছে। এই কান্না ওদের সুখের কান্না।
******

ধারার বাবা সাদাফদের বাড়িতে এসেছিল। তিনি নিজে বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে গেলেন। অথচ সাদাফই জানিয়ে দিত এই বিয়ে সে করতে পারবে না। ধারাকে সে পছন্দ করে। হয়তো ভালোও বাসে। তারপরও ধারাকে পাওয়ার তার কোন তাগাদা নেই। ধারা যাকে ভালোবাসে তার সাথেই সুখে থাকুক। প্রিয় মানুষটার সুখ নিশ্চিত করা এটাও নিজের কাছে একপ্রকার প্রশান্তি। বাবা মা রাগারাগি করেছে। ধারার বাবাকে দু’কথা শুনিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সাদাফ বাবা মা’কে বুঝিয়েছে। ধারার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে তার। মানুষটা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।

-ভাই, ম্যাচ হবে?”

সাদাফ নির্জন রাস্তায় হাঁটছিল। একটা স্বস্তির সাথে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। একটু খোলা হওয়ার প্রয়োজন ছিল। হঠাৎ কে যেন এসে লাইটার চাইল। সাদাফ কিছু বলার সাথে পেছন থেকে প্রচন্ড জোরে মাথায় একটা আঘাত পেল। তারপর আর কিছু মনে নেই তার। সাদাফ নিচে পড়ে যাবার আগে পারভেজ ওকে ধরে ফেলল। রাসেল খেঁকিয়ে উঠে বলল,

-হালারপু এত জোরে মারলি ক্যা? মইরা গেলে জরিমানা তুই দিবি?”

পারভেজ সাদাফের নাকের কাছে হাত দিয়ে বলল,

-মরে নাই।”

-তুই মারলি ক্যা? না মাইরা অজ্ঞান করা যাইত না?”

-না মাইরা অজ্ঞান ক্যামনে করমু?”

-হালারপু তুই কথা কইছ না। মালডারে ধর এহন।”

দু’জন ধরাধরি করে সাদাফকে সিএনজিতে তুলে বসিয়ে দিল। সাদাফের জ্ঞান ফিরতে কত দেরি কে জানে। পারভেজ বলল,

-এমনে রাখলে জ্ঞান ফিরা যদি পলাইয়া যায়?”

-হাত পায়ে বান্ধন দে। বেশি জোর খাটাইস না। হালারে কষ্ট দেওয়ার আমাগো কোন উদ্দেশ্য নাই। নেহায়েত ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হইতে আইছে তাই এই ব্যবস্থা।”

-ভাই জানে?”

-জানব না কেন? ভাইয়ের অর্ডার ছাড়া কামে নামছি?”

পারভেজ সাদাফের হাত পা বেঁধে দিল। পরিষ্কার একটা কাপড় দিয়ে মুখটাও বেঁধে দিল। যেন জ্ঞান ফিরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে না পারে। সাদাফকে মাঝে বসিয়ে ওরা দু’জন দুইপাশে বসে আছে। সাদাফের যেহেতু জ্ঞান নেই তাই সে সোজা বসে থাকতে পারছে না। আবার মাথা পেছনের দিকে হেলান দিলেও ঘাড়ে ব্যথা পাবার সম্ভাবনা আছে। রাসেল সাদাফের মাথা নিজের কাঁধে ফেলে উদাস গলায় বলল,

-সরি ভাই। মাফ করে দিয়েন। আপনি হইলেন ডাক্তার মানুষ। আমরা মূর্খ। শিক্ষাদীক্ষা তেমন নাই। আপনার লগে আমগোর কোন তুলনা নাই। তারপরও ভাইয়ের খুশির জন্য আপনারে একটু কষ্ট দিতে হইছে। ভাবীর বিয়াটা ভাইয়ের লগে হইয়া যাক। আপনার পায়ে ধইরা মাফ চামু। দরকার পড়লে আপনার পায়ে নাকে খত দিমু।ভাইয়ের খুশির আগে কিছু না। ভাইয়ের খুশির আগে আমার জীবনও ছোট। ভাবীরে বিয়া করার আপনার স্বপ্ন কোনদিন সত্যি হইব না। সেইজন্য দুঃখিত।”
******

ধারা ঘরে চলে গেলে শরিফুল ইসলাম ভাবলেন এক্ষুনি তিনি মুনতাসীরের কাছে যাবেন। তার মেয়েকে বিয়ে করতে মুনতাসীরকে অনুরোধ করবে। যেভাবেই হোক বন্ধুকে দেওয়া কথা রাখবেন তিনি। নইলে যে সেই জীবনে বন্ধুর মুখোমুখি হতে পারবেন না। ঘড়িতে রাত এখন একটার ঘরে গেলেও শরিফুল ইসলাম বেরিয়ে পড়লেন। ঘুম থেকে ডেকে তুলে মুনতাসীরকে বললেন, বাবা তোমার আমানত আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিতে এসেছি। তোমার বাবা দাদাকে দেওয়া কথা রাখতে এসেছি। তুমি কি আমার মেয়েটাকে ভালো রাখতে পারবে না?
*****

আজ আপুর হলুদ। ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হচ্ছে। তাই কোন ঝাঁক জমকাল আয়োজন নেই। সবকিছুই সাদামাটা। জেসমিন আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। নয়ন ভাই, মুনতাসীর ভাই কেউই কিছু করতে পারেনি। শেষ ভরসা সে নিজেই। যেভাবেই হোক আজকের রাতে আপুকে ঘুমের ঔষধ খাওয়াতেই হবে। হলুদ মাখুক সমস্যা নেই। বিয়ের দিন যেন ঘুম না ভাঙে।
কাল রাতে ধারা বাবাকে সবকিছু বলার পরেও আজ হলুদের আয়োজন হচ্ছে দেখে ধারা অবাক না হয়ে পারল না। বাবা কি তবে তার কথা শুনবে না? আতিফ এসে খবর দিল। যার যার বাড়িতে হলুদ হবে। ছেলে মেয়ে কেউ কারো বাড়িতে হলুদ নিয়ে যাবে না। ধারা বাবাকে দেখছে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে বাবা কেমন খুশি হচ্ছে। দাদীও কেমন পাড়ার কাকীদের হলুদ বাটতে বসিয়ে দিয়েছে। পান খেতে খেতে কাকীরা গীত ধরছে। আতিফ ছুটাছুটি করে বাবার ফুটফরমাস পালন করছে। জেসমিন কোন কাজকর্মের মাঝে যাচ্ছে না। এই বিয়েতে তার মত নেই। তাই এই বিয়ের আগেপিছেও সে থাকবে না। গায়ে হওয়া লাগিয়ে ঘুরছে সে। সবাই সবার মতো আনন্দ করছে। শুধু ধারাই বুক ফেটে মরে যাচ্ছে। মুনতাসীর ভাই তো বলেছিল তার বিয়ে হতে দিবে না। তাহলে আজ কোথায় তিনি? ধারার চোখ উপচে জল আসছে। এই অসহনীয় কষ্টের কথা সে কাকে জানাবে?

চলবে_

#এক_বরষায় [৪৭]
জেরিন আক্তার নিপা

__________
উঠানেই ছোট্ট করে হলুদের স্টেজ বাঁধা হয়েছে। বাবা ধারার কথা রাখেনি। বিয়েটা ভাঙেনি। এক আকাশ সমান যন্ত্রণা বুকে চেপে ধারা হলুদের সাজে বসে আছে। তার পরনে কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি। হাতে, কানে, গলায়, কপালে তাজা গাঁদা ফুলের মালা। সাজসজ্জা বলতে এই ফুলের গহনাটুকুই। তার বাইরে মুখে প্রসাধনী সামান্য ছোঁয়াও নেই। ধারার চোখ জলে টলমল করছে। মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলাচ্ছে।
আপুর বিয়ে হোক আর না হোক জেসমিনের সাজতে তো বারণ নেই। সে হলুদের শাড়ি পরে নিজেই কনে সেজে বসে আছে। জেসমিন ধারার পাশে বসতে বসতে বলল,

-তোমাকে কি কেউ মেরেছে? মুখ অমন করে রেখেছ কেন? বিয়ে তো জীবনে একবারই হয়। হাসো।”

আজ জেসমিনের কথা শুনেও ধারার রাগ হচ্ছে না। জেসমিন ধারার সামনে রাখা মিষ্টির প্লেট থেকে একটা কালো মিষ্টি নিয়ে পুরোটাই মুখে পুড়ে দিল। মুখ ভরে চিবোতে চিবোতে বলল,

-আমি জানি কেন তোমার মন খারাপ। চিন্তা করো না আপু। বিয়েটা তোমাকে করতে হবে না। এই জেসমিন থাকতে তোমার কোন সমস্যাই সমস্যা না।”

জেসমিন কী বলল ধারা শুনতে পায়নি। শোনার চেষ্টাও করেনি। মাতিম এসেছে। মাতিমকে দেখে ধারা ভেবেছিল মুনতাসীরও হয়তো এসেছে। সে ব্যাকুল চোখে চারপাশে মুনতাসীরকে খুঁজতে লাগল। যখন বুঝতে পারল মুনতাসীর আসেনি, তখন আর ধারা চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। টুপ করে গাল বেয়ে একফোঁটা উষ্ণ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মাতিম খুশি খুশি মুখে স্টেজের কাছে ধারাকে দেখতে এলো। ধারাকে দেখেই একগাল হেসে বলল,

-ভা…ধারাপু তোমাকে কিন্তু ভীষণ সুন্দর লাগছে। লাল টুকটুকে বউ না। হলুদ বউ লাগছে।”

জেসমিন মুখ বাঁকাল। বিয়েটা হলে তো বউ লাগবে! ধারা চোখের পানি লুকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। জেসমিন দায়সারা ভাবে জিজ্ঞেস করল,

-মুনতাসীর ভাই এলো না যে। কই উনি?”

মাতিম আড়চোখে ধারাকে দেখল। হাসি লুকিয়ে বলল,

-ভাই তো ঘুম দিচ্ছে।”

এই কথাটা শোনার থেকে ধারাকে কেউ উঁচু বিল্ডিংয়ের উপর থেকে ফেলে দিলেও ভালো করত। এতদিন ভালোবাসি, তোকে বিয়ে করব বলে পেছন পেছন ঘুরলেও আজ তার হলুদের দিন মুনতাসীর ভাই ঘুমোচ্ছে! মানুষটা কি বুঝতে পারছে না কাল ওর বিয়ে হয়ে যাবে। ধারার আর কিছুই ভাবতে ভালো লাগছে না।
জেসমিন আবার বলল,

-মুনতাসীর ভাই আসবে না?”

-জানি না। মনে হয় আসবে না।”

মাতিম কথা শেষ করে ধারাকে দেখল। মনে মনে ভাবল, ধারাপু টেনশন হচ্ছে? দেবর হিসেবে তোমাকে এটুকু জ্বালানোর অধিকার তো আমার আছেই। কষ্ট পাচ্ছ? কষ্ট পেয়ো না। তুমি আমার ভাবী হবে। বিয়েটা তো তোমার আমার ভাইয়ের সাথেই হবে। তোমার জন্য কতবড় একটা সারপ্রাইজ যে অপেক্ষা করছে তুমি নিজেও ভাবতে পারছ না। সারপ্রাইজটা তুমি নিতে পারবে কি-না তাও সঠিক জানি না। হয়তো খুশিতে হার্টফেল করে বসবে।

-ধারা আপু তোমাকে একটু হলুদ লাগাই?”

ধারা হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারল না। তার জীবনটা এমন কেন? তার চাওয়া মতো কোনকিছুই হয় না। তার প্রিয় জিনিস গুলোই সবার আগে তার থেকে দূরে চলে যায়। মাতিম দুই আঙুলে একটু হলুদ নিয়ে ধারার গালে গালিয়ে দিল।
******

ধারা পুরোটা দিন অপেক্ষা করে ছিল মুনতাসীর ভাই আসবে। বলেছিল তো তার বিয়ে হতে দিবে না। মুনতাসীর ভাই এলো না। নয়ন ভাই এসেছে। রোজী আপাও এসেছে। রোজী দুই হাতে ধারার গলা ধরে বলল,

-তুই রাগ করবি ভেবে কোনোদিনও তোকে বলিনি ধারা। জানিস আমার কত ইচ্ছে ছিল তোকে সারাজীবনের জন্য আমাদের কাছে রেখে দিব। কিন্তু তুই তো এখন পর হয়ে যাচ্ছিস রে ধারা।”

এতটা সময় ধরে চেপে রাখা কান্না এবার বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। ধারা রোজী আপাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার মনের অবস্থা কাউকেই বোঝাতে পারছে না সে। রোজী আপাকেও বলতে পারছে না। বিয়েটা সে করতে চায় না। সে একজনকে ভালোবাসে।
******

ধারা যখন মুনতাসীরের আসার অপেক্ষা ছেড়ে দিয়ে যা কিছু হচ্ছে তা তার ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিল। ঠিক তখনই বুকের ভেতর নিভে যাওয়া আগুনটায় হাওয়া দিয়ে মুনতাসীরের আগমন ঘটল। সাদা পাঞ্জাবীতে মুনতাসীরকে কোন রাজপুত্রের চেয়ে কম মনে হচ্ছিল না। মুনতাসীরকে দেখে ধারার বুকটা আবার কেঁদে উঠল। এই মানুষটাকে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে সে। মানুষটা তার হবে না। ধারার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মুনতাসীরের যেন এতে কিছু যায় আসে না। সে হাসিখুশি ভাবে সবার সাথে কথা বলছে। ধারার দিকেও একবারও তাকাচ্ছে না। এদিকে ধারার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাবার দশা। জেসমিন মুনতাসীরের উপর চরম বিরক্ত। মুনতাসীর ভাই আসলে তার বোনকে ভালোই বাসে না। শুধু শুধু বড় বড় কথা বলেছে। আপুর বিয়ে হচ্ছে আর তিনি হিরো সেজে এন্ট্রি নিয়েছে। এখন ভাবখানা এমন যেন প্রেমিকার বিয়েতে তার থেকে খুশি আর কেউ না।

-মুনতাসীর ভাই, আপনি কি আপুর বিয়ের মিষ্টি খেতে এসেছেন?”

-মিষ্টি খাওয়াই যায়। আমার ডায়াবেটিস নেই।”

-কালও কি আসবেন?”

-অবশ্যই। আমি না এলে কীভাবে হবে?”

-মুনতাসীর ভাই আপনাকে এখন আর আমার ভালো লাগছে না। দেখতেও ইচ্ছে করছে না। আপনার উপর আমি হতাশ। মিষ্টি খেয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় হোন তো।”

মুনতাসীর জেসমিনের রাগ বুঝতে পেরেও ওকে এখন সত্য জানালো না। তার বোনের বিয়েটা অন্য কারো সাথে হচ্ছে না। বরং মুনতাসীরের সাথেই হচ্ছে। জেসমিনের দুলাভাই মুনতাসীরই হবে। এই বাচাল মেয়েকে জানালে ধারার জানতে বেশি সময় লাগবে না। ধারা এখনও মুখ ফোটে বলেনি সে ওকে ভালোবাসে। ধারা একটা বার বলে দিলেই মুনতাসীর জানিয়ে দিবে কাল আমিই তোকে বিয়ে করতে আসছি। ধারা যে তাকে ভালোবাসে এটা কেউ না জানলেও মুনতাসীর জানে। ধারার চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছে। কিন্তু মেয়েটা স্বীকার করতে চায় না। কাল রাতে শরিফুল কাকা যখন তার কাছে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময়ই মুনতাসীরও শরিফুল কাকার কাছে আসছিল। পথেই ওদের দেখা হয়ে যায়। সে কিছু বলার আগেই কাকা বলে। সবকিছু এত সহজে হয়ে যাবে মুনতাসীর কখনও কল্পনাও করেনি। কাকাকে সে ইচ্ছে করেই না করেছে ধারাকে যেন এখনই কিছু না জানায়। কাকাও তার কথা মেনে নিয়েছে। মুনতাসীর পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে ধারার দিকে এগিয়ে এলো। হলুদের দিন বউটাকে দেখার তারও ভীষণ ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ধারাকে শায়েস্তা করতে সে আজ দেখা দিবে না ভেবে নিয়েছিল। একটা দিন একটু তার কষ্টটা উপলব্ধি করুক। কিন্তু মাতিমের বর্ণনা শুনে ধারাকে দেখতে নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। মুনতাসীর ধারার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। মুগ্ধ চোখে ধারাকে দেখে নিচু গলায় বলল,

-ভেবেছিলাম আমার ভাইটা বাড়িয়ে চারিয়ে বলছে। কিন্তু না, নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতাম না। সত্যিই তোকে হলুদ পরী লাগছে।’

ধারা ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। মুনতাসীর ধারার আরও একটু কাছে এসে বলল,

-অন্যের বউকে মুগ্ধ নজরে দেখা কি অন্যায়? তাহলে এই অন্যায়টা করার জন্য আমার শাস্তি কী হতে পারে? চেষ্টা করেও তো আমার এই অবাধ্য চোখ দু’টোকে আটকে রাখতে পারছি না।”

-আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

মুনতাসীর হাসি লুকালো। ধারার গলার কম্পন তার কান এড়ায়নি। কী ভাবছিলি, বাংলা সিনেমার নায়কের মতো এসে তোর বাবার পায়ে পড়ে যাব? বলব, চৌধুরী সাহেব আপনার মেয়েকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তোর ভাবনা ঠিকই হতো। যদি না তোর বাবাই আমার কাছে যেত। সুযোগ যখন পেয়েছি তখন একটু তো ভাব নিতেই পারব। তবে বেশি কষ্ট পাস না। কাল তুই তোর জীবনের শ্রেষ্ঠ সারপ্রাইজটা পেতে যাচ্ছিস ধারা। মুনতাসীর গলা পরিষ্কার করে উঁচু গলায় বলল,

-তোকে দেখতে এসেছি। কাকা গিয়েছিল আমার কাছে।”

ধারা মানুষটাকে এতটা সহজ আচরণ করতে দেখে আর কিছুই বলতে পারল না। কী বলবে সে? বলবে, মুনতাসীর ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি। এই বিয়ে করব না আমি। না, এসব কথা কখনও বলা সম্ভব না।

-তোকে কি হলুদ মাখানো শেষ হয়ে গেছে? আমিও কি একটু হলুদ লাগাতে পারব?”

ধারা কোন উত্তর দিল না। কঠিন হয়ে বসে রইল। মুনতাসীর অনেকটা সময় থাকল। পুরোটা সময় ধারার আশেপাশেই থেকেছে। আড়চোখে ধারাকে দেখে ভেবেছে, কাল যখন এই মেয়ে দেখবে তার বর মুনতাসীর নিজেই। তখন ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? খুশিতে মরে টরে যাবে না তো? বিয়ের দিন বউ মরে গেলে বেচারার আর বিয়েই করা হবে না।
মাতিম জেসমিনের হাবভাব দেখে বলল,

-একমাত্র বোনের বিয়েতে তোমাকে খুশি মনে হচ্ছে না।’

জেসমিন মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-খুশিতে মরে যাব নাকি? যেটুকু খুশি হওয়া দরকার হয়েছি। এর থেকে বেশি খুশি কীভাবে হতে হয় আমার জানা নেই।”

মাতিম হাসল। ইচ্ছে হলো জেসমিনকে সত্যিটা বলে দেয়। কিন্তু বলল না। এই মেয়ের পেটে কথা থাকে না। ভাবী জেনে ফেললে ভাই তাকে মেরেই ফেলবে।

-খুশি হয়েছ বুঝলাম। কিন্তু মাথার মধ্যে উল্টাপাল্টা যে চিন্তা গুলো ঘুরছে তা বাস্তবায়ন করতে যেও না।”

জেসমিন কটমট করে রাগী চোখে মাতিমকে দেখল। এই বেডার থেকে সাহায্য নিয়ে তো ভালোই ঝামেলায় পড়েছে দেখা যাচ্ছে। ব্যাটা তো কাল সবার সামনে তাকে ফাঁসিয়ে দিবে। বাবা যদি জানতে পারে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে বোনের বিয়ে আটকাতে চাচ্ছে সে, তাহলে তাকে মেরেই ফেলবে। বাড়ি থেকে বের করে দিবে।

-দেখুন, উল্টাপাল্টা চিন্তা আমার মাথায় ঘুরছে না। উল্টাপাল্টা কথা তো আপনি বলছেন। আপনাকে কে দাওয়াত দিয়েছে হ্যাঁ?”

-তোমার বাবা। আর আমার দাওয়াত লাগবে কেন? নিজের ভা… কিছু না। ঘুমের ঔষধ গুলো ফেলে দাও।”

-ফেলব কেন? ওগুলো আপনাকে খাওয়াব। আপনি বেশি কথা বলেন। এই খেয়েদেয়ে আপনারা দুই ভাই বাড়ি যান তো। দুটাকেই অসহ্য লাগছে।”
*****

মুনতাসীর চলে গেলে ধারা অনেকক্ষণ কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলল। জেসমিন এসে অনেকক্ষণ বোনের পাশে বসে ছিল। যে বিয়ে হবে না সে বিয়ের কথা ভেবে এত কান্না করার কি আছে? জেসমিন নানাভাবে বোনকে সান্ত্বনা দিল। মুখ ফোটে শুধু বলতে পারল না, আপু তোমার বিয়ে হবে না। শুধু শুধু কেঁদো না তো।
জেসমিন এক গ্লাস পানিতে তিনটা ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছে। পাঁচটা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ভয়ে দিল না। আপু যদি আবার মরে যায়। না বাবা থাক। তিনটা খেয়েও কড়া ঘুম না হলে সকালে আরও দুইটা খাইয়ে দিবে। বর আসার আগে আপুর মরার মতো ঘুমাবে। জেসমিন ধারার সামনে দাঁড়িয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল।

-এই নাও পানি খাও। আর কেঁদো না। বিয়ে তো নিজের ইচ্ছেতেই করছো। তখন আমি কত বারণ করলাম। আমার কথার তো কোন দামই নেই।”

ধারা বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে গ্লাসটা নিল। সামান্য একটু পানি খেয়ে ফিরিয়ে দিল। জেসমিন উদাস গলায় বলল,

-পুরোটা খাও। সারাদিন তো তেমন কিছুই খাওনি। পানি খেয়ে পেট ভরো।”

ধারা খালি গ্লাস ফিরিয়ে দিলে জেসমিন ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশ্ব জয় করার মতো হাসি দিল। মনে মনে বলল,

-এবার শান্তিতে ঘুমাও। এক ঘুমে কালকের দিনটা পার করে দাও। হাহ্, বোনের জন্য কত কী করতে হয়!”

চলবে_