এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা ২ পর্ব-২+৩

0
1271

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা(সিজন ২)
২.
#WriterঃMousumi_Akter

সূর্যমামা মাত্রই ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়ে পৃথিবীর উল্টো পিঠে অবস্থান করে চাঁদ মামাকে পৃথিবীতে জায়গা করে দিয়েছে।সূর্যের ডুবে যাওয়া আর চাঁদের উদয় হওয়া এই দৃশ্য বড়ই সুন্দর দেখতে।শহরে সন্ধ্যা নেমেছে এইতো কিছুক্ষণ হবে।পাখিরা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে যে যার নীড়ে ফিরছে,গাছের পাতায়, সবুজ ঘাসে ক্রমশ জমছে শিশির বিন্দু।চারদিকে কৃত্রিম আলো জ্বল জ্বল করছে।প্রতিটি বিল্ডিং এ জ্বলে উঠেছে লাল,সাদা কৃত্রিম আলো।রাস্তায় রোড লাইটের আলো চারদিক ঝলমল করছে।

ঘর্ণায়মান এই সুন্দর সন্ধায় আমাদের কাজিনদের চাঁদের হাট বসেছে।ছাদে রং বেরঙের লাইটিং করা হয়েছে।বাসার ঢুকতে পাতাবাহার গাছ গুলোতে রঙিন লাইটিং করা হয়েছে।জুনি লাইট গুলো, লাল,নীল,গোলাগি বিভিন্ন রঙের জ্বলছে আর নিভছে।পিচ্চি গুলো ছোটাছুটি করছে, এমন অপরূপ সৌন্দর্য আর লাইটিং দেখে বাচ্চা গুলো আনন্দে ছোটাছুটি করছে।তিয়াস ভাই,আর বিভোর ভাই গান চালাচ্ছেন ছাদে।বাসায় বিভিন্ন ধরনের দূর সম্পর্কের আত্মীয় এসেছে তাদের মাঝে এসেছে অনেক মেয়ে,ছেলে আমাদের বয়সী প্রায়,একটু বড়, ছোট ও হবে।রিয়া,মেহু আপুর হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে আর আমি রুশা আপুর হাতে।কোন কুওক্ষণে যে সৃষ্টিকর্তা আমাকে এই মহৎ প্রতিভা দিয়েছিলেন হাতে মেহেদীর সুন্দর ডিজাইন তোলার প্রতিভা।ঈদ হোক আর কোনো অনুষ্টান হোক পাড়ার মানুষের ভীড় পরে তারা আমার হাত থেকেই মেহেদী নিবে।বিভা আপুর কয়েক জন বান্ধবী কে মেহেদী লাগিয়ে দিয়েছি, এখন রুশা আপুর হাতে মেহেদী দিচ্ছি আরো কত জোড়া হাত আমার অপেক্ষা করছে।এ বলছে এর পর আমি তো ও বলছে এর পর আমি।আমি আছি মহা সংকটে।ঘাড় লেগে যাচ্ছে আর একটুও বসতে পারছি না,আবার কোমরেও প্রচন্ড ব্যাথা করছে।বেশ কয়েকমাস আগে হঠাত সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেছিলাম কল পাড়ে সেখান থেকে কোমড়ের একটা হাড় চটে গিয়েছে।বেশীক্ষণ বসলেই কোমরে ভীষণ পেইন করে।ডাক্তার বলেছে ওষুধ খেতে খেতে এক সময় ঠিক হয়ে যাবে।হাতেও ব্যাথা করছে সাথে অবশ হয়ে যাচ্ছে।এই মুহুর্তে কেউ যদি আমাকে কোনো কাজে ডেকে নিয়ে উদ্ধার করতো বেঁচে যেতাম।এত গুলা আত্মীয়র মুখের উপর বলতেও পারছি না যে আমি আর দিতে পারবো না।জিনিস টা নিজের বিবেক এর কাছেই বাঁধা দিচ্ছে।

শান্ত পরিবেশ অস্হির করে তুললেন বিভোর ভাই হঠাত অদ্ভুত এক গান চালিয়ে।

“ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না,
দিন রাত শুধু মিস কল মারে কল করে না,
টুনি স্কুলে যাইবো, টুনি বারান্দায় আইবো টুনিরে লইয়া আমি নৌকা দৌড়াবো।”

সবাই হতবাক এই মারাত্মক গান টা শুনে।সবাই এক প্রকার হুল্লোড় ছেড়ে দিলো গান টা শুনে।এই মুহুর্তে এই গান টা ছিলো মারাত্মক বিনোদনের খোরাক সবার কাছে।

“রিয়া মেহেদী টা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিভোর ভাই এর ফোন টা বক্স থেকে নিয়ে গান টা স্টপ করে বললো, এটা কি বিয়ে বাড়ি নাকি বেহারা বাড়ি”

“বিভোর ভাই অবাক হওয়ার মতো একটা ভান করে বললেন,বেহারা বাড়ি টা আবার কি রিয়া।”

“বেহারা মানে যারা পালকি বয়ে বেড়ায়।আপনাদের ওই পাড়ায় এক ঘর আদি বেহারা এখনো বেঁচে আছে তারা এসব উদ্ভট গান চালায়।”

“বিভোর ভাই অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বললেন,এখানে ওই বেহারা বাড়ির এক হবু বউ উপস্হিত আছে এ কারণেই গান টা চালালাম আরকি?”

“হোয়াট বেহারা বাড়ির হবু বউ কে বিভোর ভাই?একদম উল্টাপালটা বলবেন না কিন্তু।ঠিক করে বলুন কে এখানে।”

“ওই যে লিয়াকত বেটের ছেলে আতিক বেটে ওর বউ আমার একমাত্র দাদার দুইমাত্র ছেলের একমাত্র মেয়ে মানে আমাদের ফুফুর একমাত্র মেয়ের ছোট কাকার বউ এর একমাত্র বড় মেয়ে।ওদের নামের সাথে বেটে পদবী টা না বললে কেউ চিনেই না।তাহলে ভাবো রিয়া বাচ্চা কাচ্চা কেমন হবে?..”

আবির ভাইয়া,তিয়াস ভাইয়া,বিভা আপু,মেহু আপু, তোহা আপু সহ সবাই প্রচন্ড বিনোদনের সাথে হেসে উঠলো।

“রিয়া খানিক টা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, কি বললেন এত পেচিয়ে না বলে সোজা সুজি বলেন।আমি বুঝি নি আপনার কথা।”

“তোহা আপু উঠে গিয়ে বললো,আরে রিয়া বুঝিস নি তোকেই তো সেই লিয়াকত বেটের ছেলের বউ বললো ইয়াক রিয়া তোকে বিভোর ভাই এইভাবে পঁচালো।এতগুলো মানুষের মাঝে ছিঃছি আমার তো মন চাইছে কচু গাছে গলায় দড়ি দিতে।আমি হলে এত সময় গলায় দড়ি ই দিয়ে বসতাম।”

“রিয়া অগ্নিচোখে বিভোর ভাই এর দিকে তাকিয়ে বললো শকুনের দোয়ায় কি আর গরু মরে তোহা আপু।ওই বিভোর ভাই এর কপালে লিয়াকত বেটের বউ এর মতো মহিলা ই জুটবে।”

তৎক্ষনিক ছাদে প্রবেশ করলেন বিহান ভাই,গায়ে ব্লু পাঞ্জাবী,পরণে ব্লু জিন্স, পাঞ্জাবীর হাতা গোটানো, হাতে কালো ফিতার ঘড়ি উনার প্রবেশের অপেক্ষায় ছিলো এতক্ষণ সব মেয়েরা।উনি ছাড়া যেনো আড্ডা টা সবার কাছে খাপছাড়া মনে হচ্ছিলো।না না আসলে কিছুই জমে ক্ষির হয় না।উনার প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ে গুলোর মুখের ভাব ভঙ্গি বদলে গেলো।আপুদের বান্ধবীরা এমন ভাবে দেখছে যেনো জীবনে ছেলেই দেখে নি অথচ তাদের হিরো বিষয় টা তে বিরক্ত হচ্ছে।মেয়েদের এমন ছ্যাচড়ামো দেখে রাগে শরীর রি রি করছে আমার।কি আছে উনার মাঝে যে গায়ে পড়তে হবে।আমার কোনো দোষ ত্রুটি পেলেই উনি বাজে কথা বলবেন,বলবেন তো আর থামবেন না তার থেকে বেটার মান ইজ্জত বাঁচাতে চুপ চাপ ই থাকি।সমস্যা মন কে বেঁধে রাখতে পারি না।মন উনার দিকে ছুটবেই।বার বার চোখ উনার দিকেই চলে যায়।তাছাড়া উনাকে আজ এমনিতেই অনেক সুন্দর লাগছে।দীর্ঘদিন পরে পাঞ্জাবীতে দেখলাম উনাকে।

উনি এসেই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে স্ট্রাং হয়ে দাঁড়ালেন,কপালে এক গোছা চুল ও পড়েছে উনার।

“রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,রিয়া তুমি একদম ই ঠিক বলেছো,ওর বিয়ে কোনো মহিলার সঙ্গেই হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু।লিয়াকত বেটে টাইপ কারো বউ এর সাথেই হবে আমি ড্যামন সিওর।”

“বিহান ভাই আপনিও বলছেন,ওহ ইয়েস বিহান ভাই আমাকে সাপোর্ট করেছে।”

“সাপোর্ট কেনো করবো না আমি সব সময় সত্যর সাথে আছি আর থাকবো।”

“বিভোর ভাই বললেন,বিহান এখানে অনেক মেয়েরা আছে আমাকে দেখে তারা ক্রাশ খাচ্ছে বলে আমার নামে বদনাম দিবি এটা জানতাম।এত জেলাস হয়ে লাভ নেই বিহান।তোর কপালে জিএফ নেই তাই বলে কি আমাদের প্রেমের মাঝে আগুন লাগাবি।সময় থাকতে ভাল হয়ে যা, ভালো হতে পয়সা লাগে না।”

“সে ক্রাশ খেতেই পারে।ছেলে তো আর তুই দেখতে খারাপ না তাইনা বিভোর।যেমন ও গায়ের রং তেমন ও চোখের কালার,তেমন ও সিল্কি চুল,তেমন ও হাইট যে কোনো মেয়ের প্রথম চয়েজ তুই হবি এতে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু তোর যে একটু রাশিগত সমস্যা।”

“তোহা আপুর এক বান্ধবীর সাথে বিভোর ভাই এর বিশাল ভাব হয়েছে সে এসে বললো ভাইয়া কিসের সমস্যা আছে উনার।”

“বিহান ভাই বললেন,সিরিয়াস কিছু না বিবাহিত মহিলাদের প্রতি আসক্তি আছে এইটুকু যা।মানে বিবাহিত মহিলা দেখলে ওর মাথা ঠিক থাকে না।এই নিয়ে একাধিক বিবাহিত মহিলার সাথে রিলেশন আছে ওর।তবে ছেলে কিন্তু ও খারাপ না।চরিত্র ফুলের মতোই পবিত্র।সমস্যা শুধু ওই টুকুই।”

–উপস্হিত সবাই এক গাল হেসে দিলো।আবার সত্যি ও ভাবছে তারা।ভাবছে বিহান যখন বলছে হতেই পারে অস্বাভাবিক কিছু না।তাছাড়া এখানেই মেয়ে গুলো অনেক বার বিহান ভাই এর সাথে কথা বলার ট্রাই করেছে কিন্তু উনার মুড দেখে কেউ চান্স ই পায় নি।সবাই যেখানে মেয়েদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো উনি বাড়ির মুরব্বি দের সাথে কিভাবে কি করলে ভাল হবে সেগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনায় বিজি ছিলেন।উনার এই এটিটিউড মেয়েদের আরো বেশী আকৃষ্ট করে।তাছাড়া এমনিতেও উনি মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলতে পছন্দ করেন না।কেউ নিজে থেকে এসে বললে যথা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

–তোহা আপুর এক বন্ধবী বললো,ভাইয়া কি তাহলে সিঙ্গেল।ভাবা ই যায় না ভাইয়ার মতো এমন সুন্দর একজন ছেলে সিঙ্গেল।

–তোহা আপুর আরেক জন বান্ধবী বললো,ভাইয়া আপনি কি কথা কম বলেন?

–বিভোর ভাই বললেন সিঙ্গেল ছাড়া কি?ওর কপালে মেয়ে নেই।

বিহান ভাই কারো কথার ই উত্তর দিলেন না।খুব একটা ভাব ও নিলেন না।তবে বিভোর এর কথার উত্তর দিয়ে এক ই সাথে সবার কথার দিলেন।

“প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে টাইম দেখে ফোন আবার প্যান্টের পকেটে রেখে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে বললেন,বিভোর আমার জিএফ নেই এটা ঠিক,আর আমার দ্বারা প্রেম হবে না এটাও ঠিক।তবে আমি যে সিঙ্গেল এই গ্যারান্টি কে দিলো।আমি কি বলেছি যে আমি সিঙ্গেল।আমার জিএফ না থাকলেও বিশেষ কেউ আছে আমার জীবনে।প্রেম হবে না কারণ প্রেম যা হওয়ার সেটা বহুকাল আগেই হয়ে গিয়েছে।এইযে এখন আমি তার সাথে আমার ভালবাসার কথা বলছি এটা শুনেও সে রেগে যাচ্ছে।সে তো এতটায় অবুঝ এই মুহুর্তে আমাকেই ভুল বুঝছে।আমি যদি অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলি সে ভীষণ রেগে যাবে।আর আমি তার অগ্নিচোখ সব থেকে বেশী ভয় পায়।আমার উইকনেস মানেই সে আর তার রাগ।আমি তো আর বিভোরের মতো ক্যারেক্টর লেস নই যে জিএফ থাকতে অন্য মেয়ের পিছে ঘুরবো।এটা বিভোর এর সাথে যায় আমার সাথে না।”

সবার মাথায় মনে হয় আকাশ ভেঙে পড়লো উনার মুখে এমন প্রেম ভালবাসার কথা শুনে।উনি তো এইভাবে ভালবাসার কথা প্রকাশ করেন না।আমি সিওর এই মেয়েগুলোকে এড়াতেই এমন ডাহা মিথ্যা বলছেন উনি।

–তোহা আপু বলে উঠলো,আজ রাগ করতে পারিনা বলে বিহান ভাই এর জিএফ হতে পারলাম নাহ।

–আবির ভাইয়া বললো,বিহান সারাজীবন শুনেই এলাম তোর এই বিশাল প্রেম কাহিনী। কিন্তু কোনদিন দেখলাম না। আসলেই কি আছে।

–আলবাত আছে, ছোট মানুষ আগে বড় হোক দেখাবো।

মনে মনে ভাবছি আল্লাহ আমার কাছে যেনো না আসে।আমি বিভা আপুকে আড়াল করে বসে মেহেদী লাগাচ্ছি।

“মেহু আপু বললো,বিহান ভাই মেহেদী পরবেন না,সবাই পরছে।”

“এগুলা মহিলাদের ব্যাপার।পুরুষ মানুষের হাতে মেহেদী দিলে হাতের ইজ্জত যাবে। তাছাড়া এখানে ডিজাইনার কে মেহেদীর।”

“দিয়া”

“উনি অবাক হয়ে বললেন দিয়া।কথার মাঝে আশ্চর্যজনক ভঙ্গি।তাইতো বলি মানুষের সুন্দর সুন্দর হাত এইভাবে কে নষ্ট করছে।এত বিশ্রি ডিজাইন মানুষ কিভাবে করতে পারে ছিঃছি।একদম ই ভাল হচ্ছে না ডিজাইন।সবার হাত কি যে বিশ্রি লাগছে।বুঝলাম না যা পারবো না তা করে ক্রেডিট নেওয়ার কি প্রয়োজন।দিয়া তোর দ্বারা এসব কিচ্ছু হবে না।তোর কাছে মাফ চাই তুই আর মানুষের হাতের বারোটা বাজাস না।”

“মানুষের মাঝে এমন ভাবে অপমান করবেন সেটা জানতাম।এত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না।”

“উনি আবার বললেন,সিরিয়াসলি বলছি গাইস আমার শ্বশুরের মেয়ে যে এত সুন্দর করে মেহেদী ডিজাইন করে,দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।”

“আমি মেহেদী দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে বললাম,আপনার শ্বশুরের মেয়ে না ওসুরের মেয়ে তার প্রশংসা আর কত বিহান ভাই।”

“ওসুর!ওহ মাই গড।একদম ই ঠিক বলেছিস।ওসুর না হলে মেয়েকে এইভাবে আটক রেখে কি আর তার জামাই কে কষ্ট দিতো।”

“আমি খানিক টা মেহেদীর পেষ্ট হাতে নিয়ে উনার পাঞ্জাবী তে লাগিয়ে দিয়ে রাগে ফুলতে ফুলতে বেরিয়ে এলাম।”

চলবে?….

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা(সিজন ২)
৩.
#WriterঃMousumi_Akter

–মেহেদী এর পেষ্ট উনার পাঞ্জাবী তে মুছে উনাকে ধাক্কা মেরে নিচে চলে এলাম।উনার পাঞ্জাবীতে মেহেদী লাগিয়ে দেওয়ার দুঃসাহসে ভড়কে গেলেন উনি।চোখে মুখে বিস্ময়কর চিহ্ন উনার। বিভা আপু বললো, বিহান এইভাবে দিয়াকে রাগিয়ে দিলি কেনো তুই?সারাক্ষণ তুই দিয়ার পিছু লেগেই থাকিস।মেয়েটা তোর ভয়ে আমাদের বাড়ি যেতেই চায় না।আর তুই ঘুরে ফিরে ওর পিছেই লেগে থাকিস।এখানে যে এত গুলা মেয়ে আছে তারা তোর সঙ্গ চাইছে আর তুই কিনা তাদের রেখে আমাদের দিয়ার পিছেই লাগতে গেলি।উনার এক হাত প্যান্টের পকেটে অন্য হাতে ফোন স্ক্রল করছেন আর কপাল কুচকএ বিভা আপুর কথা শুনছেন।বিভোর ভাই বললেন,বিহান আজকের দিনেও আমাদের দিয়াকে না রাগালে হচ্ছিলো না তোর।এখন তো দিয়া আর আসবেই না এখানে।

–উনি কারো কথার ই তেমন গুরুত্ব না দিয়ে বললেন,বাচ্চা মানুষ এসব অনুষ্টানে থেকে কি করবে।?ও বরং ঘুমিয়ে যাক নিজের রুমে গিয়ে সেটাই ভাল হবে।

–মেহু আপু বললো,বিহান ভাই এইটা কোনো কথা দিয়া ছাড়া কি অনুষ্টানে কোনো আনন্দ পাবো।আপনি যান দিয়া কে ডেকে দিন প্লিজ।

–উনি একটা বড় নিঃশ্বাস টেনে বললেন,আমি বললে কি আর দিয়া আসবে?আমার উপর ক্ষেপে গিয়ে দেখলে না আম্মুর দেওয়া নতুন পাঞ্জাবী টার কি হাল করেছে।আমি গেলে আরো কয়েক’শ গুন রেগে যাবে।এই মুহুর্তে সে ক্ষেপিদের রাণী হয়ে বসে আছে।আমি গেলে এই বিয়ে বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হবে নিশ্চিত।

–রিয়া বললো,বিহান ভাই একমাত্র আপনি পারবেন। অন্তত আপনার হুমকি ধামকি শুনে ভয়ে হলেও দিয়া আসবে।আপনি ছাড়া তো আর কাউকে দিয়া ভয় পায় না বিহান ভাই।আর আপনি শুধু আপনার জিএফ কে বড় করতে গিয়ে আমাদের দিয়াকে ছোট করেন কেনো?আমাদের দিয়া ও কম না কোনো কিছুতে।

–উনি ফোন টা পকেটে রেখে বললেন,আচ্ছা আমি নিচে গিয়ে দেখি তোমাদের দিয়া ম্যাডাম এখানে আসেন কিনা?একবার বলবো আসতে, রাজি না হলে নিচ থেকে উপরে ছুড়ে মারবো।

রাগে মনে চাচ্ছে সব কিছু ভেঙে ফেলি।মানুষ এতটা অসহ্য হবে কেনো?কেনো এতটা জঘন্য হবে। কি ক্ষতি করেছি উনার আমি।কোন কু ওক্ষনে উনার মতো মামাতো ভাই কপালে জুটেছিলো।যতবার ই ভাবি উনি যেনো আমার সামনে না আসেন ততবার ই আসবেন।আসবেন আর যত প্রকার অপমান জনক কথা আছে সব উনি বলবেন।রাগ সামলাতে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছি।মনে মনে ভাবছি কেউ যদি আমার জীবনে আসতো আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতো তাহলে তার সাথে পালিয়ে যেতাম, শুধু মাত্র উনার অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য।বাড়িতে প্রচুর মানুষ জন।এর ই মাঝে আম্মুর সাথে দেখা।আম্মু আমাকে বললো,দিয়া মেহেদী পরানো শেষ।একটু ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম না আম্মু খুব মাজা ব্যাথা করছে তাই উঠে এলাম।রুশা আপুর এক মামি বললেন,কি ব্যাপার দিয়া এই বয়সেই মাজা ব্যাথা।বিয়ে শাদী হলো না,বাচ্চা কাচ্চা হলো না এক্ষুণি মাজা ব্যাথা কেনো?আচ্ছা বাচ্চার সাথে মাজা ব্যাথার কি রিলেশন বুঝলাম না মনে মনে ক্ষীপ্ত হলাম।সাইড থেকে আরেক জন বলে উঠলো,আমার মতো এগারো টা বাচ্চা হলে কি করতে।এখনের যুগের মতো সিজার না সব নরমাল ডেলভারী হয়েছে।সকালে বাচ্চা হয়েছে বিকালে ভাতের হাড়ি নামিয়েছি।আরেক জন দাদী মজা করে বললো,কি ব্যাপার দিয়া আমার তো মনে হচ্ছে অন্য কোনো ব্যাপার।উনাদের এসব কথা বার্তা যেনো আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।উনারা সবাই গ্রামের, তাছাড়া সেকেলে উনারা।উনারা যে কথা গুলো অন্য ভাবে বা অন্য মাইন্ডে নিচ্ছে সেটা আমি না বুঝলেও আম্মুর বুঝতে বাকি নেই একটুও।আম্মু ও তার ভাতিজার মতোই প্রচন্ড রাগি।আম্মু রাগ সামলে বললো ওর কোনো কোমরে পেইন নেই।ওর ক্ষুদা লেগেছে তো তাই অজুহাত দিয়ে চলে এসেছে।

বিহান ভাই কখন এসে দাঁড়িয়েছিলেন জানিনা,উনি খুব বিরক্তি নিয়ে বললেন,মানুষের শরীর কোনো রোবট নয় যে ক্লান্তি আসবে না। আর অসুখের ক্ষেত্রে কোনো বয়স আছে নাকি।
বিহান ভাই মনে হয় উনাদের কথায় ভীষণ রেগে গিয়েছেন।এটুকু বলেই উনি পকেট থেকে ফোন বের করে কোথাও একটা কল দিলেন।আমি কোনো কথা না বলে রুমে চলে এলাম।মহিলা গুলো মনে হয় বিহান ভাই এর কথায় বুঝতে পেরেছেন যে বিহান ভাই একটু রেগে গিয়েছেন।তারা বলাবলি করছে এটা দিয়ার মামাতো ভাই ডাক্তারি পড়ে, ছেলেটা দেখতে যেমন গুন ও তেমন।

–আমি রুমে আসতেই আম্মু রণচন্ডী মুডে আমার দিকে তাকালো।বাইরে একটু উঁকি মেরে দেখে নিলো কেউ আসছে কিনা?কাউকে না দেখতে পেয়ে আম্মু বললো,তোর কি বুদ্ধি কোনদিন ই হবে না দিয়া।আর কতবার বোঝাবো যে এইসব কোমরে ব্যাথার কথা কারো সামনে উচ্চারণ করবি না তুই।একটা কথা একশবার বললেও কানে যায় না।এই মেয়ে বিয়ে দিবো কিভাবে?

“এমনিতেই মেজাজ খারাপ উনার ভাতিজার জন্য।তার উপর আম্মু আবার এসে যা মন চাইছে তাই বলছে।আম্মুকে বললাম প্লিজ আম্মু আর কত?আর কত মানুষের কথায় কান দিবা বলোতো।আমার বিয়ে না হয় না হোক।”

“এইসব মহিলারা এইসব কথার কত বাজে মানে খুজবে জানিস।পাড়ায়,পাড়ায় রটিয়ে বেড়াবে। ”

“যা ইচ্ছা ভাবুক আমি কেয়ার করি না আম্মু।”

মেজাজ ঠিক না হতে হতেই মেজাজ খারাপের মহারাজা বিহান ভাই হাজির।

ফুপ্পি তোমাকে রুশা আপুর আম্মু খুজছে।

বিহান রাতে খেয়েছিস বাবা।

না ফুপ্পি,অতিরিক্ত তেল যুক্ত খাবার, এটা খেলে আমার ঘুম হবে না।

বিভোর, বিভা,তুই খেয়ে নে।আমি আমার ভাইজি,ভাতিজাদের জন্য রান্না করেছি আলাদা।তুই তো সবার মতো গড়ান খাবার খেতে পারিস না তাই আমি আলাদা রান্না করে রেখেছি।

ফুপ্পি তুমি আবার এত কষ্ট করতে গেলে কেনো।

এটা কোনো কষ্ট না বাবা।দিয়া ওদের খেতে দে তুই।আমি গেলাম।

ড্রেসিন টেবিলের উপর রাখা একটা হলুদ চিরকুট।চিরকুট টা দেখে বেশ অবাক লাগলো আমার। আমি পেছনে ঘুরে চিরকুট টা খুলেই আরো অবাক।

!তোমায় বহু বার ছুঁতে গিয়ে ছোঁয়া হয়নি,
তোমায় বহু বার বলতে গিয়ে বলা হয়নি,
তোমায় বহু বার ডাকতে চেয়েছি ;
কেনো যেনো ডাকা হয়নি।
আমি তো প্রায় স্বপ্নে তোমার সাথে বহু দূর হারায়!
সেটা কখনো তোমায় বলা হয়নি।
আমি তোমাকে আমার প্রিয় ভাবি সেটাও তুমি কখনো জানোনি,
আচ্ছা তুমি তো আমার আশেপাশে থাকো,
তাহলে আমার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা এ অনুভূতি গুলো বুঝো না কেন?
তুমি বুঝো কেন আমার আমি শুধু তোমাকে চাই,
একান্ত করেই আমার আমি শুধু তোমাকে চাই।
দিন শেষ আমিও বলতে চাই সেও আমায় বুঝেছে-
তাই সে আমার হয়েছে।

ইতি–
তোমার অপ্রিয় কেউ।
আসাদ ~(কপি)”

এমন সুন্দর ভাবে কেউ চিরকুট লিখতে পারে।কিন্তু কে সেই মানুষ টা। এই সুন্দর চিরকুটের মালিক কে।এমন সময়ে পেছন থেকে বলে উঠলেন বিহান ভাই,

“জানিস দিয়া আমার শ্বশুরের মেয়ে শাড়ি পরলে আমার সর্বনাশ হয়ে যায়।মন আর চোখ দুটোই অন্য দিকে সরতেই চায় না।আচ্ছা বলতে পারিস সে এতটা সুন্দর কেনো?”

“মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে সারাক্ষণ নিজের বউ এর প্রশংসা করতে পারে সেটা আপনাকে না দেখলে বুঝতাম না মিষ্টার বিহান।”

“ড্রেসিন টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে রাগে ফুঁশছি আমি।সারাদুনিয়ার মানুষ যেখানে আমার হাতের মেহেদীর ডিজাইনে মুগ্ধ সেখানে উনি কিনা অত গুলো মানুষের সামনে আমাকে বিশ্রি ভাবে অপমান করলেন।”

“আমার কথা শুনে উনি অবাক হয়ে গেলেন,চোখ বড় বড় করে তাকালেন আমার দিকে।উনার পাঞ্জাবীতে মুছে দেওয়া মেহেদী টা মনে হয় রং ধরেছে এত সময়।একদম বুকের বাম সাইডে কালো মতো লেপ্টে আছে হেনা পেষ্ট।এক পা থেকে আরেক পায়ের দূরত্ব বেশ খানিক টা ফাঁকা উনার।ভ্রু কুচকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।হাত পেছনে বাঁধা উনার।এক’পা, দু’পা করে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে।আমার কাছাকাছি এসে ড্রেসিন টেবিলে এক হাত বাঁধিয়ে খানিক টা ঝুঁকে ডান ভ্রু কুচকে বললেন,আমার বউ এর প্রশংসা করলে তোর এত জ্বলে কেনো দিয়া?তুই কি জেলাস।বাট কেনো কি সমস্যা তোর?তোর জেলাস হওয়ার মতো তো কিছুই নেই।”

“আপনি নিজেকে কি ভাবেন কি রোমিও।ওইসব মেয়েরা আপনাকে ডেইরি মিল্ক ভাবতে পারে,মারাত্মক ক্রাশ খেতে পারে কিন্ত এই দিয়া না বুঝেছেন।আপনার বউ এর প্রশংসায় আমি একটুও জেলাস নই বরং অসহ্য লাগে আমার এত আদিক্ষেতা দেখলে।দুনিয়ায় কি মানুষের আর বউ নেই।তারা কি আপনার মতো সারাক্ষণ আমার বউ, আমার বউ করে।এমন ভাবে সারাক্ষণ নিজের বউ এর প্রশংসা করেন যেনো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নারী আপনি বিয়ে করেছেন।”

“উনি আরো খানিক টা ঝুকে একদম ই আমার নিঃশ্বাসের কাছাকাছি চলে এলেন।উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস নাকে মুখে এসে পড়ছে আমার।কিন্তু একটুও টাচ করেন নি আমায়।আবার বললেন,তাহলে সমস্যা টা কোথায়?”

“সমস্যা টমস্যা কিচ্ছুই না।আমার সামনে কখনো আদিক্ষেতা করবেন না।আমার একদম ই ভাল লাগে না। ”

“তাহলে কি ভাল লাগে মিসেস বিহান?”

“মিসেস বিহান?অবাক হয়েই বললাম”

“ওপস সো সরি দিয়া!দিহান হবে।আই মিন মিসেস দিহান।
কেনো যে তোর নাম টা দিহান রাখতে গেছিলাম।এই যে দেখ মিস্টেক হয়ে গেলো।আর তুই ভুল বুঝলি।”

“বিহান আর দিহানের মাঝে অনেক পার্থক্য বুঝেছেন।”

“ওহ নো!আমি মিসেস দিহান বলেছি সেটাকে জোর করে মিসেস বিহান প্রুভ করতে চাইছিস।মিসেস বিহান হওয়ার খুব শখ তাইনা?(ভ্রু কুচকে বললেন)”

“উনার বুকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বললাম, এমন ভয়ংকর শখ কোনো মানুষের হবে না জীবনেও।আমার তো কোনদিন ই হবে না।নিজেকে যে কি ভাবেন।”

“মিসেস বিহান,সরি দিহান কোমরে পেইন কি কম হয়েছে?”

“আমি হঠাত খেয়াল করলাম আমার কোমরে পেইন কমে গিয়েছে।এখন মনে চাইছে উনাকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দেই।কেননা উনি তখন হাবিজাবি না বললে রেগে মেগে আসতে পারতাম না।এখনো প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করতে হতো।”

“উনি কপাল কুচকে আবার ও বললেন, তো যা মেহেদী দিতে।মেহেদী দিতে না পেরে আমার তো গুষ্টি সহ উদ্ধার করা হচ্ছে।কথায় আছে না যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর।রাজাকারের বংশধর একটা।”

“আমার চোখে মুখে বিনয়ী একটা ভাব চলে এসছে।উনাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত বলে মনে হচ্ছে।”

“উনি আমার মুখের অদল দেখেই কিছু একটা অনুমান করতে পারলেন।আমি কিছু বলার আগেই বলে উঠলেন,থাক তোর ওই সস্তা ধন্যবাদ নিয়ে নিজেকে ধন্য করতে চাইছি না এই মুহুর্তে। আমি আবার সবার ধন্যবাদ নেই না।”

“আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার একবিন্দু ইচ্ছা আমার নেই।আমার ধন্যবাদ নেওয়ার যোগ্যতাও সবার নেই বুঝেছেন।”

“উনি আমার দিকে খানিক সময় তাকিয়ে বললেন দিন দিন অনেক বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস তুই।কিছুক্ষণ আগে আমার নাম ধরে জাস্ট মিস্টার বিহান বলেছিস।দিন দিন আদব কায়দা কি সিকেতে তুলছিস তুই।আমি না তোর বড়ো।তাও এক দুই দিন না কয়েক বছরের বলেই আবার আমার দিকেই এগোচ্ছেন উনি।”

“আপনি আবার এগিয়ে আসছেন কেনো?আপনি বেরোন আমার রুম থেকে।”

“আমার হাত থেকে চিঠি টা কেড়ে নিয়ে চিঠির দিকে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে আমার দিকে অগ্নিচোখে তাকালেন।”

চলবে~~