এক মুঠো প্রেম পর্ব-১২+১৩+১৪

0
517

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১২

আদ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পৃহার দিকে। তার চোখে মুখে ফুটে ওঠা আগ্রহ ও কৌতুকের দেখে স্পৃহা হালকা হাসলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-আপনি ড্রিংক করেন, এটা আমায় আগে জানালেই পারতেন!

আদ্র গাল ফুলিয়ে বললো,

-তুমি যেমন ভাবছো, তেমনটা নয়। আমি অ্যাডিক্টেড না। মাঝে মাঝে মাইল্ড লেভেল পর্যন্ত-ই খাই। কিন্তু সেদিন একটু একসেস হয়ে গেছে, তাই আউট অফ সেন্স হয়ে গিয়েছিলাম।

-এজন্যই আপনার মনের কথাগুলো জানতে পেরেছিলাম, আদ্র।

স্পৃহার মুখে শ্লেষের হাসি। আদ্র ভ্রু কুঁচকালো। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন-ই জাগছে ওর। কিন্তু স্পৃহা ঘুরিয়ে পেচিয়ে যা বলছে, তাতে কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না সে। তাই কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,

-তুমি সরাসরি বলবে সেদিন ঠিক কী হয়েছিল?

স্পৃহা একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

-সেদিন কিছুই হয়নি, আদ্র। আপনি সেন্সে ছিলেন না, তাই আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সাথে সাথেই আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো এর আগে এতো ড্রিংক করেননি! তাই …

এতক্ষণে আদ্র একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। তা দেখে স্পৃহা শুকনো হেসে আদ্রের সামনে থেকে সরে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই মনের মধ্যে নানা ভাবনা চিন্তা এসে জড়ো হলো। আহির দেশ ছেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ওর জীবন থেকে চিরতরে চলে গেল। হয়তো ভিন্ন পরিবেশে গিয়ে নিজের জীবনটাকে নতুনভাবে ও সুন্দররূপে গুছিয়ে নিতে চায় সে। ভাবতে ভাবতেই স্পৃহা বললো

-আহির আজ কানাডা চলে গেছে, আদ্র!

আদ্র অবাক হয়ে বললো,

-আচ্ছা?? হঠাৎ কেন চলে গেল?

-জানি না। জানতে চাই-ও না!

স্পৃহা চোখ ঘুরিয়ে আদ্রের দিকে তাকালো। ওর চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে আছে যেন পলক ফেলতেই গড়িয়ে পড়বে পানি। আদ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। স্পৃহা ধরা গলায় বললো,

-সেদিন আমার কাছে আপনি একটা বেবি চেয়েছিলেন, আদ্র!

আদ্র গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেললো। এইসময় এমন কথার মানে খুঁজে পাচ্ছে না ও৷ হাত দিয়ে কপাল ঘষে বললো,

-তুমি সময় চেয়েছিলে তখন। আমিও ভেবে দেখেছি, তোমার পড়াশোনা বাকি। এখনই ইচ্ছেটা তোমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না।

-পড়াশোনা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না, আদ্র।

আদ্র বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে গেছে এমন কথা শুনে। নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই বললো,

-আর ইউ ওকে? মাথা ঠিক আছে তোমার?

বলেই এগিয়ে এসে স্পৃহার কপালে, গালে চিন্তিত ভঙ্গিতে হাত দিতে লাগলো। স্পৃহা বিরক্ত হয়ে ওর হাত সরিয়ে দিলো। সাথে সাথেই চোখের পানিতে গাল ভিজে উঠলো তার। কাতর স্বরে বললো,

-আমার জীবনে একটু শান্তি চাই, আদ্র। শুধু একটু শান্তি-ই লাগবে আমার। ছোট বেলা থেকে সবার অবহেলা, অনাদরে বড় হয়েছি আমি। একটুও ভালোবাসেনি কেউ আমায়! বাবা, মায়ের দুই চোখের বিষ ছিলাম আমি। শুধু মাত্র ভাইয়ার কারণে আজ আমি বেচে আছি। আমি না খেয়ে থাকলে, ভাইয়া ছাড়া কেউ খোঁজও নিত না। অসুস্থ হলে কেউ একবার জানতেও চাইত না, সুস্থ হয়েছি কিনা। এজন্যই আমার জীবনে আমি শুধু একটু শান্তি চাই। একটু ভালোবাসা চাই, যেটাকে আঁকড়ে ধরে সারাজীবন বাঁচতে পারবো আমি।

আদ্রের বুকও ভার হয়ে গেছে স্পৃহার এমন কান্নামিশ্রিত আকুতি শুনে। স্পৃহার চোখের পানি গুলো নিজ হাতে মুছে দিলো ও। দুই হাতে জড়িয়ে বুকে আগলে নিলো স্পৃহাকে। মাথায় ওষ্ঠ স্পর্শ করে সুর টেনে টেনে বললো,

-আপনার সকল ইচ্ছে নিজ দরবারে মঞ্জুর করতে পেরে আনন্দিত হলাম, মহারাণী। কিন্তু এতো দেরি করে আমার রাজ্য পদধূলি দেওয়ার জন্য আপনাকে শ খানেক চুমু দন্ডে দন্ডিত করা হলো। আমি নিজ দায়িত্বে গুণে গুণে তা আদায় করে নেব।

স্পৃহা আদ্রের এমন টেনে টেনে বলা কথা শুনে কান্নার মাঝেই হেসে দিলো।
___________________________

প্রণব নিজের কাপড়চোপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্যাকিং করছে। প্রান্তি দরজার আড়ালে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রণব আপাতত নিজের কাজে ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রান্তির দিকে তাকাচ্ছে না ও। বোনকে ছেড়ে এমনিতেই যেতে ইচ্ছে করছে না। তারওপর প্রান্তি এখন বায়না ধরলে মনটাই খারাপ হয়ে যাবে ওর।

-ভাইয়া, তুই সত্যিই যাচ্ছিস?

প্রণব ঠোঁট গোল করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-এই নিয়ে সাতবার একই প্রশ্ন করলি তুই!

প্রান্তি ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,

-তাও তো তোর উত্তর সেই সেইম-ই রইলো। যা! কথাই বলবো না তোর সাথে!

প্রণব নিঃশব্দে হেসে বললো,

-আচ্ছা? বলিস না তাহলে।

প্রান্তি কাঁদো কাঁদো ফেস করে এগিয়ে এসে বললো,

-ভাইয়া, তুই যাস না, প্লিজ। তোকে ছাড়া আমি থাকবো কীভাবে বল? বাবা তো আমার খবরও রাখে না! তুই না থাকলে আমি একদম একা হয়ে যাবো!!

বলতে বলতেই ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে দিলো প্রান্তি। প্রণব হাত থেকে কাপড় ফেলে প্রান্তির দিকে ঘুরলো। ওর চোখ মুছে দিতে দিতে বললো,

-আরে এমনভাবে কাঁদছিস যেন আমি আজীবনের জন্য তোকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। মাত্র ছয়মাস-ই তো!দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আর তোর সাথে তো আমার রোজ কথা হবে, তাই না?

-কথা বললে কী হবে? আমি তো তোমাকে সরাসরি দেখতে পারবো না! ছুঁতেও পারবো না। তোমায় জড়িয়ে ধরতে পারবো না।

বলেই প্রণবকে জড়িয়ে ধরে কান্নার গতি বাড়িয়ে দিলো। প্রণবেরও খারাপ লাগছে। ছয় মাস কীভাবে প্রান্তিকে ছেড়ে থাকবে ও। কষ্ট হলেও যেতে হবে ওকে। তাই প্রান্তির মাথায় হাত রেখে বললো,

-প্রান্তি, একটা সত্যি কথা জানিস?

-কী কথা?

-কাঁদলে না তোকে একদম পেত্নীর মতো লাগে! আর এখন তো পুরোই শাঁকচুন্নির মতো লাগছে!

প্রান্তি ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলে প্রণবের দিকে তাকালো। কটমট করতে করতে বললো,

-তুই আমায় পেত্নী বললি? তোর সাথে কথাই বলবো না আমি!

প্রণব কিটকিটিয়ে হেসে বললো,

-হ্যাঁ, সেই! এটুকুই তো পারো তুমি! পরে আমাকে ছাড়াই তোমার উদ্ধার হয় না।

প্রান্তি গাল ফুলিয়ে পাশ ফিরে তাকালো। হাতে হাত ভাজ করে বললো,

-মায়ের সাথে কথা বলেছিস?

-হ্যাঁ, বলেছি। জানিয়েও দিয়েছি ছয় মাসের জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছি।

-তোকে অনেক মিস করবো, ভাইয়া।

-আমিও মিস করবো। নিজের খেয়াল রাখিস।

বলেই প্রান্তির কপালে একটা চুমু দিয়ে ব্যাগপত্র ও গিটার নিয়ে চলে গেল প্রণব। প্রান্তি শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
________________________

কেটে গেছে দুই মাসেরও বেশি সময়। গ্রীষ্মকালীন প্রকৃতির রুক্ষতা বর্ষণের হঠাৎ আগমনে অনেকটাই কমে গিয়েছে। অফিসে নিজের কেবিনে বসে জানালার আড়ালে থাকা আকাশটাকে মন ভরে দেখছে আদ্র। নীলাম্বরের অস্তিত্ব জুড়ে বিরাজ করা কালচে সত্তাগুলো ইতস্তত বিচরণ করছে। মাঝে মাঝে গর্জেও উঠছে। হঠাৎ করেই কোনো একসময় কান্নায় ভেঙে পড়বে সে। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সকল জঞ্জাল।

এমন বৃষ্টির মৌসুমে কাজে একটুও মন বসছে না আদ্রের। বিরক্তি নিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিতেই পিয়ন এসে ডোরে নক করলো।

-স্যার, মে আই কাম ইন।

আদ্রের বিরক্তি আরো এক ধাপ বৃদ্ধি পেল। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বললো,

-ইয়েস, কাম ইন।

পিয়ন তার পান খাওয়া লালচে দাঁত গুলো বের করে একটা হাসি দিলো। আদ্র গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো,

-কিছু বলার আছে।

পিয়ন মুখে হাসি বজায় রেখেই একটা খাম টেবিলের ওপর রাখলো। আদ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,

-এটা কী?

-জানি না তো, স্যার! এক ম্যাডাম এসেছিলেন। আমায় ডেকে বললেন, এই খামটা আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। আমার পকেটে কিছু বখশিশও দিলেন। সাথে সাথে চলেও গেলেন।

আদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। খামটা হাতে নিয়ে বললো,

-আচ্ছা, আপনি যান।

পিয়ন চলে গেল। আদ্র খাম খুলতেই কিছু কাগজ বেরিয়ে এলো। সেগুলো দেখেই সে একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। বারবার লেখা গুলোর ওপর চোখ বুলালো ও। এটা সত্যি তো? নাকি ও স্বপ্ন দেখছে! বিশ্বাসই হচ্ছে না যেন!! চিন্তাভাবনা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অনুভূতি গুলোও কেমন যেন অচেনা লাগছে আদ্রের। অদ্ভুত ভাবেই চোখের কোল ছাপিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো তার।

# চলবে…

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৩+১৪

“আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।

আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে
তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।

তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে
আমার ছাদে এসে,
ভোরের শিশির খুব ছুঁয়ে যায়
তোমায় ভালোবেসে।

আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে …”

এতক্ষণ গানের তালে তালে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলেও আকস্মিক ভাবে গানটা থেমে যাওয়ায় আদ্র ভ্রু কুঁচকালো। স্পৃহা জানালার রেলিঙে মাথা ঠেকিয়েই হেসে বললো,

-দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গান শুনছেন, আদ্র?

আদ্র হকচকিয়ে গেল। ধীর পায়ে ভেতরে এসে বেডে থম মেরে বসে পড়লো। ওর এমন থমথমে মুখ দেখে স্পৃহা বেশ অবাক হলো। এগিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

-মুখটাকে এমন বানিয়ে রেখেছেন কেন? কোনো প্রব্লেম হয়েছে কি?

আদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালা। স্পৃহার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,

-তুমি আমার অফিসে গিয়েছিলে, স্পৃহা?

স্পৃহা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হেসে বললো,

-হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো!

আদ্র নিজের হাতে থাকা কাগজগুলো স্পৃহাকে দেখিয়ে বললো,

-এনভেলাপে থাকা এই রিপোর্ট গুলো সত্যি?

স্পৃহা এবার শব্দ করেই হেসে দিলো। কোমড়ে দুই হাত দিয়ে বললো,

-আমার রিপোর্ট, আমি আপনার কাছে পাঠালাম, তাহলে মিথ্যে হবে কেন? আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? এমনটাই তো হওয়ার ছিল, আদ্র!

আদ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পৃহার দিকে। স্পৃহার নিজের ভেতর কেমন অনুভূতি হচ্ছে, সেটা ও জানে না! কিন্তু ওর নিজের কাছে তো এটা স্বর্গীয় আনন্দকেও হার মানাবে! স্বপ্নটা কি সত্যি সত্যিই ধরা দিয়েছে? এখনও সবটা বিশ্বাস হচ্ছে না। তাই কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

-রিপোর্টে তোমার প্রেগন্যান্সি পজিটিভ দেখাচ্ছে, স্পৃহা। তার মানে…

স্পৃহা এগিয়ে গিয়ে একদম আদ্রের কাছাকাছি দাঁড়ালো। আদ্রকে আশ্বস্ত করে বললো,

-সবটা সত্যি, আদ্র। স্বপ্ন দেখছেন না আপনি। এতো বিভ্রান্ত হওয়ার কী আছে?

আদ্র চোখে ছলছল করছে। আচমকা স্পৃহাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে দিতে বললো,

-থ্যাংক ইউ, স্পৃহা। থ্যাংকস আ লট!! তুমি জানো না তুমি আমায় আজ কী দিয়েছো! এতো খুশি লাগছে যে, সেটা কীভাবে প্রকাশ করবো বুঝতেই পারছি না। সামথিং লাইক, অতি আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি।

স্পৃহা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। আদ্রের বুকে মাথা রেখেই বললো,

-আপনার খুশিতেই আমি খুশি। আপনার হাত ধরেই আজীবন বাঁচতে চাই। অতীতের সবকিছু ভুলে নতুনভাবে বাঁচতে চাই আমি। আপনি সবসময় ভালোবাসবেন তো আমায়?

-ভালোবাসি, স্পৃহা। ভবিষ্যতেও বাসবো!

স্পৃহা জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বললো ,

-ব্যাস! আমায় কখনো দূরে ঠেলে দেবেন না, মাঝপথে আমার হাত ছেড়ে চলে যাবেন না আর আমায় ভুলে যাবেন না।

আদ্র স্পৃহাকে সোজা করে ওর গালে হাত রেখে অবাক কন্ঠে বললো,

-এসব কী বলছো তুমি? আমি তোমায় ভুলে যাবো কেন?

-ভয় হয় আমার। বাস্তবতাটা ভয়ংকর রকমের নিষ্ঠুর! কখন, কোথায়, কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে দাঁড় করায়, সেটা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায় না।

আদ্র স্পৃহার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

-সেরকম কোনো পরিস্থিতি আসবে না। আর এলেও… তখন আমি তোমায় দূরে ঠেলে দেবো না। ভরসা আছে আমার ওপর?

স্পৃহা মলিন হেসে বললো,

-আপনার ওপর ভরসা আছে বলেই তো এখনো বেঁচে আছি আমি। এই বিশ্বাসটা কখনো ভাঙবেন না। আমার অনুরোধ রইলো। আপনি বিশ্বাস ভাঙলে এবার আমার কী হবে জানি না। শুধু এটুকুই জানি যে… আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে, আদ্র।

শেষোক্ত কথাটা শুনে আদ্রের ভেতরটা যেন কেঁপে উঠলো। কম্পিত কণ্ঠে বললো,

-শাট আপ, স্পৃহা। আর একটাও আজেবাজে কথা যেন না শুনি আমি। বাই দ্য ওয়ে, তুমি এতো সুন্দর গান গাইতে জানো আগে বলোনি তো!

স্পৃহা হেসে বললো,

-অতোও ভালো গান গাই না আমি যে জনে জনে বলে বেড়াবো!

-বললেই হলো! তোমার গানের প্রশংসা করার ভাষা নেই আমার। ফার্স্টে তো পুরোই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি! এতো আবেগ মিশিয়ে কীভাবে গাও??

আদ্রের কথা শুনে স্পৃহা হাসতে লাগলো।
__________________________

মিসেস সামায়রার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে না, তিনি খুশি হয়েছেন নাকি হননি। স্পৃহা বেশ মনযোগ সহকারে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। নিজের একমাত্র ছেলে বাবা হতে চলেছে, এটা শুনে তো তার ধারণাতীত খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু মিসেস সামায়রার মুখে তেমন একটা খুশি খুশি ভাব দেখা যাচ্ছে না। তিনি যে জোর পূর্বক মুখে হাসির রেখা টেনে রেখেছেন, সেটা স্পৃহা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে।

-মা, আমি কিন্তু এখন থেকে বাড়িতেই থাকছি! অফিস-টফিস যাচ্ছি না আর!

মিসেস সামায়রা অবাক হয়ে বললেন,

-বাড়িতে থাকবি মানে? এর সাথে অফিস না যাওয়ার কী সম্পর্ক?

-তুমি বুঝবে না! আমি সবসময় স্পৃহা আর আমার বেবির কাছাকাছি থাকবো।

মিসেস সামায়রা বিরক্তি নিয়ে বললেন,

-এটা কোনো কথা হলো, আদ্র? তোর বউকে কি আমি দেখেশুনে রাখতে পারবো না? বউয়ের বাচ্চা হবে বলে তো এমন নয় যে, তোকে বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরঘুর করতে হবে!

-আরে, আমি সেটা কখন বললাম? আমি তো জাস্ট…

-এতো কথার কিছু নেই। আমি একাই সবটা খেয়াল রাখতে পারবো! তোর এসব নিয়ে আর ভাবতে হবে না।

আদ্র মুখটা গোমড়া করে ফেললো। স্পৃহা আদ্রের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো শুধু। ও আগেই বুঝতে পেরেছিল, এমনই হবে। এতো দিনে নিজের শাশুড়ীকে বেশ ভালো ভাবেই চিনতে পেরেছে সে।
_________________________

-ভাইয়া, কবে ফিরবি তুই? বল তো!

প্রান্তির এমন মুখ গোমড়া করে বলা কথা শুনে প্রণব হেসে বললো,

-এখনো বড় হসনি তুই? এভাবে বাচ্চার মতো কেউ কথা বলে? বয়স তো বিশ পেরিয়ে গেছে! এখনো বড় হলি না!

প্রান্তি গাল ফুলিয়ে বললো,

-দূররর…. আমার বড় হওয়া লাগবে না। তুই কবে আসবি? আজই চলে আয় না!

-পাগল হয়ে গেলি নাকি? সবে মাত্র দুই মাস হলো! গান কমপ্লিট হয়েছে মাত্র তিনটা। এখন কীভাবে আসবো? তবে সব ফুলফিল হলে পাঁ মাসের মাথায় চলে আসবো, আই মিন আরো তিন মাস পর।

প্রান্তি মুখ গোমড়া করেই বললো,

-আচ্ছা। তবে একটা গুড নিউজ আছে। পিহুর কথা বলেছিলাম না তোকে?

প্রণব হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-সারাক্ষণই তো বলতে থাকিস! তো কী হয়েছে তোর পিহুর?

প্রান্তি খুশি মনে বললো,

-পিহুর বেবি হবে, ভাইয়া! আমি আজ অনেক খুশি।

-আচ্ছা! ইট’স আ ভেরি গুড নিউজ। কনগ্রেটস জানিয়ে দিস আমার পক্ষ থেকে।
___________________________

প্রায় তিন মাসের মতো সময় পেরিয়ে গেছে। স্পৃহার প্রেগন্যান্সির এখন চার মাস চলছে। শারীরিক অবস্থার কারণে ভার্সিটি যাওয়া-আসা আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে স্পৃহা। আদ্র ইদানীং নিজের কাজ নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে। সারাদিন শেষে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে সে। এদিকে সারা দিন স্পৃহাকে সাংসারিক কাজকর্ম সবটাই সামলাতে হয়। মিসেস সামায়রা বেশ কৌশলে ওকে দিয়ে সব কাজ করায়। তবে তার আচরণে এখন কিছুটা কোমলতার ভাব লক্ষ করেছে স্পৃহা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই কাজকর্ম সব করে সে।

এদিকে নিজের বোনের সাংসারিক জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে কী ঘটছে, সবটাই স্পন্দনের কানে যায়। নিজের ওপরই রাগ হয় ওর। কিচ্ছু করতে পারছে না নিজের বোনের জন্য। তবে কিছু একটা তো করতেই হবে! সুযোগ বুঝেই কাজ করবে স্পন্দন।

রাতে ডায়নিং টেবিলে সবার খাবার গুছিয়ে রাখছে স্পৃহা। আদ্র এখনো ফেরেনি। হঠাৎ মিসেস সামায়রা এসে বললেন,

-তুমি খেয়ে নাও, বউমা। আদ্রের ফিরতে দেরী হবে আজ!

স্পৃহা অবাক হয়ে বললো,

-কিন্তু মা! আমাকে তো কিছু বলেননি উনি! আপনাকে বলেছে?

-হ্যাঁ, একটু আগে ফোন দিয়ে বললো। তুমি খেয়ে নাও।

স্পৃহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-আচ্ছা।

স্পৃহার খাওয়া শেষ হতেই মিসেস সামায়রা ওষুধের বক্স থেকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ রেডি করলেন। স্পৃহার দিকে সেগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-নাও, ওষুধ গুলো খেয়ে নাও। আর বেশি রাত জেগে থেকো না। বুঝলে?

স্পৃহা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। স্পৃহা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরেই আদ্র বাড়ি ফিরলো। আদ্রকে ঘরে ঢুকতে দেখে স্পৃহা উঠে বসলো। সাথে সাথেই পেটের ভিতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো সে।

আদ্র ওকে এভাবে উঠে বসতে দেখে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে বললো,

-আরে, আস্তে। উঠে বসতে বলেছে কেউ তোমায়?

স্পৃহা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বললো,

-এতো দেরী হলো কেন আপনার আজ?

আদ্র মুখ ছোট করে বললো,

-সরি! কাজের চাপ দিনদিন বাড়ছেই। তোমাকে একটুও সময় দিতে পারি না এখন। অথচ দেখো কতো প্ল্যান ছিল এই সময়টা নিয়ে আমার!

-আচ্ছা, এখন এসব নিয়ে মন খারাপ করতে হবে না। চলুন, আপনার খাবার রেডি করে দেই।

স্পৃহা বসা থেকে উঠতেই নিচ্ছিলো। এমনসময় আদ্র ওকে আটকে দিয়ে বললো,

-আরে, পাগল নাকি? তোমার এই শরীর নিয়ে আমায় খাবার দিতে হবে না। তুমি ঘুমোও। মা খাবার দিচ্ছে আমাকে।

অগত্যা স্পৃহাকে আবার শুয়ে পড়তেই হলো। কিন্তু পেটের দিকটায় ব্যথাটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। এমনটা হওয়া হয়তো স্বাভাবিক – ভেবেই স্পৃহা চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। বেশ
কিছুক্ষণ পর আদ্র ঘরে ফিরে এলো। স্পৃহাকে দেখেই বুঝলো, ও এখনো ঘুমোয়নি। তাই ওর মাথার কাছে বসে বললো,

-কী ব্যাপার বলো তো? আজ ঘুম আসছে না?

স্পৃহা চোখ মেলে তাকালো। জোরপূর্বক হেসে বললো,

-আসলে শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। তেমন সিরিয়াস কিছু না।

আদ্র চিন্তিত ভঙ্গিতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

-আচ্ছা, তুমি ঘুমোও। আমি তোমার পাশেই আছি।

বলেই স্পৃহার পাশে হেলান দিয়ে বসে ওর মাথায় নিজের হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আদ্র। ক্লান্ত থাকায় নিজেই কিছুক্ষণের মধ্যে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু স্পৃহার চোখে ঘুম নেই। ব্যথায় কুঁকড়ে চোখ মুখ খিচে আছে সে। তবে ব্যথাটা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েই চলেছে।

মাঝরাতে পেইন অসহ্য মাত্রায় পৌঁছে গেলে স্পৃহার মুখ থেকে না চাইতেও অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। এতে আদ্র ঘুমঘুম চোখে তাকাতেই চোখ বড়বড় করে ফেললো। চোখ থেকে ঘুমও উবে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো রক্তাক্ত বিছানায় কাতরাতে থাকা প্রিয় মানুষটির দিকে।
____________________________

হসপিটালের করিডোরে দুই হাতে মুখ চেপে বসে আছে আদ্র। তার পাশেই মিসেস সামায়রা থমথমে মুখ করে বসে আছে। স্পন্দন রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। চোখের কোণে জমে ওঠা পানি গুলো আঙুল দিয়ে মুছে ফেলছে বারবার। হঠাৎ আদ্র ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-বাচ্চাটা বাঁচবে না, মা। তাই না?

এমন কথা শুনে স্পন্দনের দমিয়ে রাখা রাগটা এবার বেরিয়েই এলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-বাচ্চা? এখনো বাচ্চার চিন্তা নিয়ে বসে আছো তুমি? লিসেন! আমার বোনের যদি কিছু হয়ে যায় না, তোমাদের মা-ছেলেকে আমি ছাড়বো না!তোমাদের জন্য আমার বোনের আজ এই অবস্থা।

-স্পন্দন! কী হচ্ছেটা কী? এটা হসপিটাল! চেচামেচি করার…

স্পন্দন নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

-হসপিটাল মাই ফুট! তোমরা কোনো কথা বলো না, প্লিজ। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে এসেছো কেন৷ তোমরা? হোয়াই? পিহু তোমাদের কেউ হয়? শুধু জন্ম-ই দিয়েছো ওকে! আজ ও মরে যাক, বা বেঁচে থাকুক, তাতে তোমাদের তো কিছুই যায়-আসে না! তাই না? বাবা-মায়ের কোন দায়িত্বটা পালন করেছো তোমরা? মেয়েটার এই অবস্থা আর তোমরা ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছো! কিন্তু আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কেন বলো তো? কারণ ওকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। দু হাতে বুকে আগলে বড় করেছি ওকে আমি।

স্পৃহার বাবা-মা দুজনেই মাথা নিচু করে ফেললো। কিছু বলার নেই তাদের। স্পন্দন নিজের চোখের পানি মুছে আদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,

-পিহুর আজকের এই অবস্থার জন্য তুমি দ্বায়ী, আদ্র। কীভাবে দ্বায়ী, সেটা বুঝিয়ে দেবো শীঘ্রই।

এমনসময়ই ওটি থেকে ডক্টর বেরিয়ে এলেন। সবাই ডক্টরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আদ্র কিছু বলার আগেই স্পন্দন এগিয়ে গিয়ে বললো,

-ডক্টর, আমার বোন ঠিক আছে তো?

ডক্টর সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। থমথমে গলায় বললেন,

– পেশেন্ট সুস্থ আছেন। বাট উই আর এক্সট্রিমলি সরি টু স্যায়, বেবিটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে!

কথাটা শোনার সাথে সাথেই আদ্র চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। সাথে সাথেই চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু এরপর-ই ডক্টর এমন একটা কথা বললেন, যেটা শোনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।

-আরও একটা ব্যাড নিউজ আছে।

আদ্র একটা ঢোক গিলে নিজেকে প্রকৃতস্থ করে নিলো। উৎসুক দৃষ্টিতে ডক্টরের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন,

-পেশেন্ট হয়তো আর কখনোই মা হতে পারবেন না!

# চলবে