এক মুঠো প্রেম পর্ব-৩৯

0
353

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৯

-আপনাকে আমি কিছু বলেছি, মিসেস নিস্তব্ধতা!

প্রণবের চাপা আওয়াজটা স্পৃহার কর্ণভেদ হলো না। সে নিবিষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে আছে সেই অপেক্ষিত মানবের দিকে। পলক ফেলাটাও দুঃসাধ্য মনে হচ্ছে তার। এতোদিন পর এভাবে হঠাৎ দেখা হওয়াটা কল্পনাতীত ছিল স্পৃহার। কিন্তু চোখের তৃষ্ণা মেটানোতে অদ্ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে মনে। ভয়ঙ্কর এক ব্যধি যে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। চাইলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না সে। অনুভূতি গুলো কি এভাবে অজান্তেই মনে জায়গা করে নেয়?

-মিসেস নিস্তব্ধতা!!!

দ্বিতীয় ডাকটা বেশ জোরেই দিয়েছে প্রণব। ভাবনার রাজ্যে ভাটা পড়লো স্পৃহার। চকিত দৃষ্টিতে তাকালো সে প্রণবের দিকে। যদিও এতোক্ষণ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু এখন সেই স্থির দৃষ্টিটা সচল হলো। প্রকৃতস্থ হয়ে বললো,

-কিছু বললেন?

-অনেক কথা-ই তো বলি! কিছু প্রকাশ্যে, কিছু নীরবতায়। আপনি তো আমার মুখে বলা কথাগুলোই শুনতে পান না! নীরবে প্রকাশিত অনুভূতি গুলো কীভাবে শুনবেন?

স্পৃহা আহত দৃষ্টিতে তাকালো প্রণবের মলিন চাহনির দিকে। প্রণবের চোখে মুখে ম্লানতা, অদ্ভুত বিষাদময় অভিব্যক্তি, যা হাসির আড়ালেও প্রকাশ পাচ্ছে। এই বিষাদের একমাত্র কারণ কি স্পৃহা নিজেই?

-আমি সত্যিই যোগ্য নই আপনার! আমার যোগ্যতা নেই আপ………

স্পৃহার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে দিয়েছে প্রণব। কথাটা আর শেষ করতে পারলো না সে। অবাক চোখে তাকালো প্রণবের দিকে। প্রণব ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-যোগ্যতা নিয়ে ফারদার যেন আমার মুখ থেকে একটা কথাও না শুনি আমি। আপনি আমার কাছে ঠিক কী, সেটা আপনি নিজেও জানেন না, মিসেস নিস্তব্ধতা! তবে জানবেন খুব শীঘ্রই। আপনি হয়তো আমার নীরবে বলা কথাগুলো শুনতে পারেন না। কিন্তু আপনার চোখের ভাষাটা আমি খুব ভালো করেই পড়তে পারি। নিখুঁতভাবে পড়তে পারি। সেটা কি আপনি জানেন, মিসেস নিস্তব্ধতা?

স্পৃহা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। সেটাও প্রণবের দৃষ্টি এড়ালো না। প্রণব বরাবরের মতোই বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বললো,

-ভয় পেলেন? ভয় পাওয়ার মতো আমি কিছু বলিনি। শুধু মনটাকে খোলাবই বানাতে শিখুন। সেটাকে বুঝতে শিখুন। অনুভূতি গুলো অব্যক্ত রাখতে নেই! তাড়াতাড়ি প্রকাশ করে দিয়েন।

স্পৃহা এখনো নিজের চোখে মুখে অবাকতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই ব্যক্তিটা কীভাবে বুঝে ফেলে তার না বলা কথাগুলো? প্রণব সেই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আশেপাশে একবার তাকালো। রাস্তাটা নীরব। তবুও বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা পছন্দ হচ্ছে না প্রণবের। তাই নিজেই স্বগোতক্তি করলো,

-আপনাদের বাসার ভেতরে নিয়ে যাবেন আমায়? নয়তো আমার বাড়িতে চলুন!

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। বললো,

-আপনি এই অসময়ে এখানে কেন এসেছেন? বিকেলেও না এলেন?

-আপনি বুঝেছেন তাহলে চিঠিটা আমিই লিখেছিলাম! ধন্য হলাম আমি। আর এখানে আসার কারণ আছে। কিন্তু সব কথা কি রাস্তায়-ই সারবেন?

স্পৃহা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,

-চলুন, ভেতরে যাই।

.

প্রণব স্পৃহার ঘরে বিছানার ওপর পা মুড়িয়ে বসে আছে। দৃষ্টি সারা ঘর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর। মেয়েটা বড্ড গোছালো! ঘরের ভেতর নজর কাড়ার মতো তেমন কিছু না থাকলেও গোছালো আছে বেশ। ভাবনার মাঝেই স্পৃহা ভেতরে প্রবেশ করে ওর দিকে কফি মগ বাড়িয়ে দিলো। বললো,

-ডিনার না করে এমনিতেও যেতে পারবেন না! আপাতত কফিটাই ভালো লাগবে, যদিও আমি অতো ভালো কফি বানাতে পারি না।

প্রণব প্রসন্নচিত্তে হাসলো। মগটা স্পৃহার হাত থেকে নিয়ে বললো,

-অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির আনন্দ আপনি বুঝবেন না, মিসেস নিস্তব্ধতা!

স্পৃহা কথাটা ঠিক বুঝতে পারলো। বললো,

-মানে?

-কিছু না। আপনি একটু কম কঠিন হলেও পারতেন, মিসেস নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে আপনাকে অনেক নিষ্ঠুর মনে হয়। আপনি সবটা বুঝেও বুঝেন না, হয়তো… হয়তো বুঝতেই চান না!

কথাটা বলে তপ্ত শ্বাস ফেললো প্রণব। স্পৃহা মলিন হাসলো ওর কথা শুনে। পড়ার টেবিলের সামনে থেকে চেয়ার টেনে এনে প্রণবের মুখোমুখি বসতেই বললো,

-আমাকে দেখে এমনটাই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু কথা শুনে বা ভাবভঙ্গি দেখে তো ভেতরটা যাচাই করা যায় না!

-আমি জানি, আপনার মনটা অনেক নরম ছিল। কিন্তু রিয়েলিটি ফ্যাক্টস্ ট্যু মাচ্! আর আঘাতের মাত্রাগুলো অনেক বেশি ছিল। অতি আঘাতে মনটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়!

বলেই কিছুটা থেমে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো প্রণব। বললো,

-কিন্তু পাথরের বুকেও ফুল ফোটে, মিসেস নিস্তব্ধতা!

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। মানুষটা আস্ত একটা রহস্য! একে ভেদ করা অসম্ভব। প্রতিটা কথা, কাজ ও পদক্ষেপের বাঁকে বাঁকে রহস্য তার। সবকিছুতেই সাসপেন্স ক্রিয়েট করাটা কীভাবে সম্ভব? ভেবেই আশ্চর্যান্বিত হয় স্পৃহা। তবে এই প্রসঙ্গটা আর দীর্ঘায়িত করে না সে।

-আপনি হঠাৎ এখানে এলেন কেন, সেটা বললেন না যে?

প্রশ্ন শুনে প্রণব খানিকটা নড়ে চড়ে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-ভোরে আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি। এক সপ্তাহের জন্য। হুট করেই রিসেন্ট একটা শো-তে লিডিং জাজ হিসেবে থাকতে হবে। অনেক আগেই ডিলটা হয়েছিল। আমি ক্যান্সেল করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন না গেলে ওনাদের অনেক লস হয়ে যাবে। ইট ডিপেন্ডস্!

প্রণবের মুখশ্রীতে পাংশুটে ভাব। বিমর্ষ ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে বসে আছে সে। স্পৃহারও মনটা কিছুটা খারাপ হলো।

-দুরত্ব জিনিসটা অনেক কষ্টকর, মিসেস নিস্তব্ধতা। যেখানে আপনার কাছাকাছি থেকেও দূরে থাকার মতো দুরত্বটা আমার সহ্য হয় না, সেখানে এতো মাইল দূরে থাকতে … … আই জাস্ট কান্ট এক্সপ্লেইন!!

স্পৃহা পূর্ণ দৃষ্টিতে প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনাকে এসব পাগলামি মানায় না! এক সপ্তাহের-ই তো ব্যাপার!

প্রণব অগত্যা কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। থমথমে গলায় বললো,

-আপনার কাছে একসপ্তাহ কোনো কিছু মিন করে না হয়তো! কিন্তু আমার কাছে প্রতিটা মুহূর্ত-ই ভয়াবহ লাগে। মা-রা-ত্ম-ক ভয়াবহ!

স্পৃহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো। মুখ বাকিয়ে বললো,

-ভয়াবহ!!! হুহ্! এজন্যই তো এক সপ্তাহ কোনো খোঁজ-খবর নেননি! মিথ্যেবাদী কোথাকার!

বলেই মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো স্পৃহা। প্রণবের দৃষ্টিতে অবাকতা। ঠোঁট মেলে দুই প্রান্তে ছড়িয়ে মুখ হা হয়ে গেছে বিস্ময়ে। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে। সবটা মস্তিষ্কে ধরা দিতেই প্রণবের ঠোঁট প্রসারিত হলো। মুখে ফুটে উঠলো প্রসন্নতার হাসি। কফিতে শেষ চুমুক বসিয়ে সেটা টেবিলে রেখে বললো,

-অনুভূতি লুকিয়ে রাখা বা দমিয়ে রাখা বড্ড কঠিন! আর এই কঠিন কাজটার চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ বরাবরই ব্যর্থ হয়। আপনিও তার ব্যতিক্রম নন।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-মানে?

প্রণব একটু এগিয়ে এসে স্পৃহার দিকে ঝুঁকতেই ও চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। প্রণব ধীর কন্ঠে বললো,

-প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছুই দিয়ে ফেলেছেন, মিসেস নিস্তব্ধতা! অনেক বেশি। এতোটাও আশা করিনি আমি আপনার কাছ থেকে। এন্ড ফর দ্যাট……

বলেই স্পৃহার কপালে নিজের অধর বসিয়ে দিলো অকস্মাৎ! স্পৃহার চোখ দুটো নিজের অজান্তেই বন্ধ হয়ে গেল। কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ অশ্রু কণা। প্রণব কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে রেখেই হাত দিয়ে স্পৃহার গাল স্পর্শ করলো। সযত্নে মুছে দিলো পানিগুলো। স্পৃহা অবাক হলো। চোখ মেললো সাথে সাথেই। প্রণব ওর কাছ থেকে দূরে সরে বসে বললো,

-এই চোখ দুটোতে পানি দেখতে চাই না আমি। দমবন্ধ হয়ে যায় কেন যেন! কিন্তু আফসোস! আপনি বুঝলেন না!

-আপনি কীভাবে না দেখে বুঝলেন যে, আমি কাঁদছিলাম?

প্রণব হাসলো। স্পৃহার কাছে গিয়ে পুনরায় ওর কপালে অধরস্পর্শ করে চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। বিমর্ষ ভঙ্গির সেই হাসি বজায় রেখেই বললো,

-হার্ট ক্যান হেয়ার দ্য ফিলিংস অফ স্পেশাল ওয়ান’স্! দ্য মোস্ট স্পেশাল পারসন আফার অল।৷ হাত ধরা আর খাইয়ে দেওয়া পর্যন্ত-ই সীমাবদ্ধ ছিলাম। আজ সেই লিমিটেশনটা একটু ব্রেক করলাম। তবে আপনিময় সম্পর্কটা সবসময় এমনই থাকুক না-হয়! আপনাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করলে একটা মোহনীয় অনুভূতি, জানেন? অদ্ভুত মোহনীয়তা আচ্ছন্ন করে আমায়। আমি সেই মোহ কাটাতে চাই না, মিসেস নিস্তব্ধতা! একদমই চাই না!
# চলবে……

ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]