এক মুঠো প্রেম পর্ব-৪০

0
341

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৪০

“নিজের খেয়াল রাখবেন, মিসেস নিস্তব্ধতা। আপনার ব্যথায় কিন্তু আরো একজন ব্যথিত হয়!”

ভোরবেলায় মেসেজ টোন বেজে উঠতেই ঘুমের মাঝে মুখ কুঁচকে ফেললো স্পৃহা। ঘুমঘুম চোখে ফোনের স্ক্রিনে লেখাটায় চোখ বুলাতেই ঘুম গুলো মুহুর্তেই উবে গেল যেন। আননৌন নাম্বার! কিন্তু বুঝতে সমস্যা হলো না মেসেজটা কে পাঠিয়েছে। সম্বোধন! মিসেস নিস্তব্ধতা! অজান্তেই হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোল ঘেঁষে। পলক ফেলতেই দ্বিতীয় লেখাটা ভেসে উঠলো,

-এই দুরত্বটা-ই যেন শেষ দুরত্ব হয়! ছয়টা বছরের দুরত্ব মিটিয়ে দেবো আমি। চিরতরে মিটিয়ে দেবো।

কপালে ভাজ পড়লো স্পৃহার। ছয় বছর! এতো বছর ধরে প্রণব ওকে চেনে? কীভাবে?
__________________

আজ বহুদিন পর চৌধুরী ভবনে পা রাখলো স্পৃহা। সব কিছু আগের মতোই আছে। থাকারই কথা! এক সপ্তাহে কী এমন পরিবর্তন ঘটবে? আবার ঘটতেও পারে। অসম্ভব কিছুই নয়।

স্পৃহাকে দেখেই আশফি ছুটে এলো। চেঁচিয়ে বললো,

-কিউট মাম্মা এসেছে! কিউট মাম্মা এসেছে!!

স্পৃহা হাঁটু মুড়ে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। গালে চুমু দিয়ে বললো,

-মিস করছিলাম আপনাকে! কিন্তু আপনি তো ভুলেই গেছেন!

আশফি ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

-কে বলেছে ভুলে গেছি? আমিও তো মিস করছিলাম তোমায়! এত্তোগুলো মিস করছিলাম, হুম!

স্পৃহা হেসে ওর নাক টেনে দিলো। ভেতরে ঢুকতেই মিস্টার চৌধুরী, মিসেস মেহরীন আর আনিলার সাথে দেখা হলো। সবার সাথে কথা বলা শেষে আনিলা স্পৃহার কানে ফিসফিস করে বললো,

-দুদিন আগে এলেই পারতে, স্পৃহা! তোমার বিরহে তো কেউ একজনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

এমন কথা শুনে স্পৃহা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। স্পৃহার এমন মুখশ্রী দেখে আনিলা হেসে বললো,

-আরে, এতো ইতস্তত করার কী আছে? আমিই তো!তবে প্রণব কিন্তু প্রণব-ই! বরাবরই জেদি। শুধু মাত্র তোমার প্রতি-ই ওকে আমি নরম হতে দেখেছি। ও হয়তো তোমায় কখনো ‘ভালোবাসি’ বলবে না! তবে ওর অনুভূতির গভীরতা কতটা, সেটা হয়তো তোমার অজানা নয়!

স্পৃহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সত্যিই প্রণব ওকে এখনো ‘ভালোবাসি’ বলেনি। বলবে কি না, জানা নেই! ওর প্রেমানুভূতি প্রকাশের ধরণটা ভিন্ন। একদমই অন্য রকম! ‘ভালোবাসি’ না বলেও ভালোবাসা প্রকাশের এই অদ্ভুত ধরণটাই হয়তো শ্রেষ্ঠ!

ঘরের ভেতর অন্ধকার। খাটের একপায়ায় হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে প্রান্তি। দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে তাকালো সে। বাইরের একফালি আলোয় অন্ধকার কিছুটা দূরীভূত হলো। স্পৃহা এসেছে। ওকে দেখে প্রান্তি তেমন ভাবাবেগ দেখালো না। স্পৃহা অবাক হলো। এগিয়ে এসে প্রান্তির পাশে বসে বললো,

-এভাবে বসে আছিস কেন? কী হয়েছে?

প্রান্তি মলিন চাহনিতে তাকালো। চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে ওর। পলক ফেলতেই গড়িয়ে পড়লো পানি। স্পৃহার ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে গেল। মেয়েটা কাঁদছে কেন? প্রণবের জন্য নয়তো! হতেও পারে। প্রণব দূরে কোথাও গেলেই প্রান্তি সবসময় মুখ কালো করে রাখতো। ভাইয়ের প্রতি মেয়েটা প্রচন্ড দূর্বল। সে নিজেও তো! ভেবেই কম্পিত হাতে প্রান্তির গাল মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-আরেহ্! এভাবে কাঁদছিস কেন? তোর ভাইয়ের জন্য মন খারাপ করলে ফোন ক……

কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রান্তি ফুপিয়ে উঠে বললো,

-আহানকে তুই একবার বুঝিয়ে বল না, পিহু! ও কেন আমায় বুঝে না? কেন?

স্পৃহা থমকালো। আহান! অবাক কন্ঠে বললো,

-মানে? কী বলছিস এসব তুই?

-আমার জন্য সম্বন্ধ এসেছে, ইয়ার। বাবার পছন্দ হয়েছে। ভাইয়াও দ্বিমত করবে না। কিন্তু আমি কীভাবে রাজি হবো? আহানকে আজ ফোন দিয়ে বলতেই ও আমায় কতো কথা শোনালো! সবজায়গা থেকে ব্লক করে দিয়েছে ও আমায়।

স্পৃহা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। বিস্ময় নিয়ে বললো,

-তুই আহানকে ভালোবাসিস? সিরিয়াসলি!!!

প্রান্তি মাথা নিচু করে নীরবে চোখের পানি ফেলছে। বিষয়টা স্পৃহার কাছে অসম্ভব-ই ঠেকছে! এটা আদৌও সম্ভব? সারাজীবন আহান আর প্রান্তিকে ঝগড়া করতেই দেখেছে। সাপেনেউলে সম্পর্ক যাকে বলে। দুজনেই দুই মেরুর দুই প্রান্ত। এখন সেখানেই প্রেমের জোয়ার!

-দ্যাখ, ছেড়ি! এহন তুই আমার কাছে ঐ ফাজিল মাইয়ার হইয়া কোনো কথা কইতে আসবি না কইয়া দিলাম। মনমেজাজ তুঙ্গে উইঠা গেসে ওর ঢঙের কথা শুইনা! সামনে পাইলে ঠাটিয়ে দুইটা চড় মাইরা দাঁত ফেলে দিতাম।

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আহানের কর্কশ কথাগুলো শুনে ফাঁকা গলায় ঢোক গিললো স্পৃহা। প্রান্তির দিকে একপলক তাঁকিয়ে আমতাআমতা করে বললো,

-দেখ, আহান। তুই তো আর কাউকে ভালো-টালো বাসিস না, তাই না? আর সারাজীবন নিশ্চয়ই অবিবাহিত থাকবি না। তাই বলছিলাম ……

-তাতে কী হইসে, হ্যা? তুই আর প্রান্তি, দু’জনরেই আমি বন্ধুর চোখে দেখি, বুঝলি? এখন এতো একসেস ভাবাটা আবেগ ছাড়া কিছুই না। আর সবচেয়ে বড় কথা হইলো, ও হইতাসে ধনী বাপের একমাত্র দুলালি, আর আমি নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবারের। আকাশপাতাল পার্থক্য আমাদের মধ্যে। তাই এসব ফাউল মার্কা চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে বল। তুই এতো আস্কারা দিস না। কয়েকদিন পর এসব আবেগ কেটে যাবে।

বলে খট করে ফোন কেটে দিলো আহান। ওর কথায় ভুল নেই। কিন্তু প্রান্তিকে দেখেও মনে হচ্ছে না, এটা শুধু আবেগ। আহানকে আরেকবার বুঝিয়ে বলতে হবে।
___________________

প্রণবের ঘরে সবার দৃষ্টি আড়াল করে প্রবেশ করেছে স্পৃহা। আজ এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য এটাই। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে এ বাড়িতে এসেছে সে! এই ঘরে তো কিছুনা কিছু আছেই!

প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে খোজাখুজির পরও তেমন কিছু পেল না স্পৃহা, যেটায় ওর প্রশ্ন গুলোর উত্তর পাবে সে। ক্লান্ত দৃষ্টিতে সারা ঘরে চোখ বুলাতেই কাবার্ডের ওপর চোখ পড়লো তার। দেখে মনে হচ্ছে এটাতে শুধু কাপড়চোপড়-ই রাখা। তবুও একবার খুঁজে দেখা উচিত। ভেবেই কাবার্ডটা খুলে খোঁজা শুরু করলো স্পৃহা। সবশেষে ওপরের তাকে হাত ছোঁয়াতেই শক্ত কিছু আছে বলে মনে হলো। নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে না। স্পৃহা দুই হাত উঁচিয়ে সেটা নামালো বহু কষ্টে। সুন্দর কারুকার্যে খচিত একটা কাঠের বক্স! স্পৃহার চোখ চকচক করে উঠলো মুহুর্তেই। তড়িঘড়ি করে বিছানায় বসে সেটা মেলে ধরতেই ভেতরে একটা ডায়েরি পেল। তার নিচে সাদা রঙের লালপেড়ে সুতি শাড়ি।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। এসবের মানে কী? চিন্তিত ভঙ্গিতে ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ছবি পেল স্পৃহা। চোখ দুটো বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গেল। এটা তো তার ছবি! বহু পুরাতন ছবি। ক্লাস এইট বা নাইনে পড়াকালীন তোলা। এটা প্রণব কীভাবে পেল?

ডায়েরির কভারটা হালকা উচুনিচু লাগছে। ভেতরে হাত ঢুকাতেই একটা পায়েল বেড়িয়ে এলো। এটাও স্পৃহার। স্পন্দন দিয়েছিল ওকে। কিন্তু ভার্সিটিতে হারিয়ে গিয়েছিল এটা। এটাই বা প্রণবের কাছে কীভাবে এলো?

ডায়েরি পুরোটা উল্টেপাল্টে দেখে বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে ফেললো স্পৃহা। পুরো ডায়েরিটাই খালি। পুরো ব্ল্যাঙ্ক। কিচ্ছু লেখা নেই কোনো পৃষ্ঠায়। আজব তো!

ডায়েরিটা সরিয়ে রেখে শাড়িটা হাতে নিল স্পৃহা। শাড়ির নিচে একটা লাল কাগজ। হাতে নিতেই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,

“আমি জানতাম! আপনি আসবেন, আপনি খুঁজবেন। কিন্তু আপনার মানুষটা একদমই ব্যতিক্রমধর্মী, মিসেস নিস্তব্ধতা! সে অনুভূতি গুলো মনের কোণে জমিয়ে রাখতেই পছন্দ করে, ডায়েরির ভাজে নয়। আর সেটার প্রকাশ ঘটবে শুধুই নিস্তব্ধতার প্রণয়ের আড়ালে।”
_____________________

গাড়িতে গা এলিয়ে দিয়েছে প্রণব। আজই দেশে ফিরেছে সে। বেশ ক্লান্ত লাগছে এখন। ফোনটা হাতে নিলো। স্পৃহাকে একটা টেক্সট করা দরকার। যদিও মেয়েটা রিপ্লে দিবে না ওকে। শুধু দেখাটাই যেন তার কাজ! ভেবেই প্রণবের হাসি পায়।

মেসেজ সেন্ড হতেই ফোনটা বেজে উঠলো। স্পন্দনের নাম্বার। ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো সে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে চেচামেচি ও কোলাহলের আওয়াজ ভেসে এলো কানে।

-হ্যালো!

অপর প্রান্ত থেকে স্পন্দন নিশ্চুপ। প্রণব চিন্তিত স্বরে বললো,

-ভাইয়া, কথা বলছেন না কেন? কিছু কি হয়েছে?

হঠাৎই স্পন্দনের ফুপিয়ে ওঠার আওয়াজ শুনতে পেল প্রণব। এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসলো সে। স্পন্দন কাঁদছে কেন? ভীতসন্ত্রস্ত ও উত্তেজিত ভঙ্গিতে ঢোক গিললো প্রণব।

# চলবে……