এক মুঠো প্রেম পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
845

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter

অন্তিম পর্ব.

-তোমার বাগান বাড়িতে আগুন লেগেছে, প্রণব। আগুনে পুড়ছে তোমার ডুপ্লেক্স বাংলোটা!

স্পন্দনের ধরা গলায় বলা কথাটা কানে পৌঁছুতেই চোখ দুটো সচকিত হয়ে উঠলো প্রণবের। বাংলোতে আগুন লেগেছে! এর আগেও তো দু’বার লাগার মতো অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু লাগার আগেই ব্যবস্থা নিতে পেরেছিল তারা। কিন্তু এবার ইলেক্ট্রিশিয়ান দিয়ে সব ঠিক করানোর পরও আগুন লেগেই গেল। ইলেকট্রিক্যাল স্ট্রাকচারেই মূল সমস্যা – এটা তারা বলেই গিয়েছিল। আগুন লাগাটা অসম্ভব কিছু না। তবে সে তো ওয়াটার সিংকিং সিস্টেমের ব্যবস্থাও করে রেখেছে, যেন আগুন লাগলেও কারো ক্ষতি না হয়! ভেবেই হতাশ কন্ঠে বললো,

-বাড়ির ভেতরেই তো শুধু সার্ভেন্ট আর কেয়ারটেকার ছিল! আর তারা তো নিচ তলায় থাকে। সবাই বের হতে পারার কথা।

স্পন্দনের কান্নার আওয়াজ যেন আরো ঘন হলো। কোলাহলের মাঝেও শব্দটা কর্ণকুহরে বারবার তরঙ্গিত হচ্ছে প্রণবের। দৃষ্টি মুহূর্তেই টানটান হয়ে গেল তার। স্পন্দন সেই প্রথম থেকেই কাঁদছে। কেন কাঁদছে? ওকে তো কখনো কাঁদতে দেখেনি প্রণব! স্পন্দন শুধু স্পৃহার ব্যাপারেই দূর্বল। স্পৃহার কি কিছু হয়েছে? ভাবতেই গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে ওর।

-আপনি কাঁদছেন কেন, ভাইয়া? কান্না করার মতো কিছু ……

কথাটুকু আর শেষ করতে পারলো না প্রণব। স্পন্দনের গুমরে ওঠা আর্তনাদ ওর বাকপথ অজান্তেই বন্ধ করে দিয়েছে,

-আমার বোনকে বাঁচাও, প্রণব! আমার বোনটা মরে যাবে। প্লিজ, বাঁচাও ওকে। তুমি তোহ্…… তুমি তো আমাকে ক্ কথা দিয়েছিলে, তাই না? সবসময় ওর পাশে থাকবে। কোনো বিপদ ওকে স্পর্শ করতে পারবে না, তুমি ওর পাশে থাকলে। এমনটাই তো বলেছিলে তুমি! আজ ও ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। এই আগুনে আমার পিহু পুড়ে শেষ হয়ে যাবে! কীভাবে সহ্য করবো আমি? বাড়ির ভেতরে আমার বোনটা হয়তো পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে! তুমি ……

বাকি কথা আর প্রণবের কানে পৌঁছতে পারলো না। ফোনটা হাত গলিয়ে কান থেকে পড়ে গেছে। কোথায় পড়লো, তা জানার ইচ্ছে নেই তার। স্থির হয়ে পাথরের মতো বসে আছে সে। থমকে গেছে প্রণব! মুহূর্তেই থমকে গেছে ওর দুনিয়া। স্পৃহা! ওর মিসেস নিস্তব্ধতা! স্পন্দন এসব কী বললো? কেন বললো? কথাগুলো কানে বাজছে বারবার। স্পন্দনের আহাজারি! সারা শরীর প্রচন্ড ভাবে কাঁপছে প্রণবের। ভারী একটা ঢোক গিলে কাঁপা হাতে কপালের ঘাম টুকু মুছলো!

বাংলোর সামনে হৈচৈ ও কোলাহলে মুখরিত পরিবেশ। ফায়ার সার্ভিস ও দমকল বাহিনীর তীব্র সাইরেন। নরম রোদের প্রকৃতিও এখন বিপন্ন ঠেকছে। সাদা মেঘে ঢাকা আকাশটা কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। পোড়া বিদঘুটে গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আগুন এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও, তার উত্তাপ কমেনি কোনো অংশে। সাদা প্রাসাদ তুল্য বাড়িটার ভেতর থেকে জ্বলতে থাকা রক্তিম ও হরিদ্রাভ অগ্নিশিখা চোখ ঝলসে দিচ্ছে। দেয়ালগুলো কালচে ঠেকছে। এই নির্জন এলাকায় শুধু আগুনের কারনে আজ কতশত মানুষের আগমন।

গাড়ি থেকে নেমে এমন পরিবেশ দেখে প্রণবের সব শক্তি যেন নিমেষেই হারিয়ে গেছে। সুঠাম দেহটাকে দাঁড় করিয়ে রাখতেও বেগ পেতে হচ্ছে ওকে। মনে মনে একটাই কথা ঘুরছে,

-এই বাড়ির ভেতরে স্পৃহা নেই। এখানে স্পৃহা থাকতে পারে না। স্পন্দন মিথ্যে বলেছে। নির্ঘাত মিথ্যে বলেছে।

হুট করে স্পন্দন কোত্থেকে এসে প্রণবের দুই হাত আঁকড়ে ধরলো। প্রণব চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। সবাই উপস্থিত এখানে। ওর বাবা, মা, প্রান্তি, আনিলা, স্পৃহার বাবা, মা, আহান, নীড়সহ বাকি সবাই। কিন্তু আশ্চর্য! ওরা কাঁদছে কেন? সবার চোখে পানি কেন? মুখে এমন ভয়ের ছাপ কেন? সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে প্রণব স্পন্দনের দিকে তাকালো। সেও কাঁদছে? তার মানে, সত্যিই স্পৃহা বাংলোর ভেতরে?

-স্পৃহা কোথায়, ভাইয়া? আপনারা কাঁদছেন কেন? ফোনে ওসব মিথ্যে বলেছেন আপনি আমায়, তাই না? প্লিজ, বলুন! ওসব মিথ্যে কথা ছিল। স্পৃহা, আমার মিসেস নিস্তব্ধতা! ও এই আগুনের ভেতর নেই। একবার বলুন।

চিৎকার করে কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দিয়েছে প্রণব। কেন কান্না পাচ্ছে? স্পৃহা তো এই বাংলোর ভেতরে নেই! ও থাকতে পারে না এখানে! তাহলে ওর কেন নিজেকে এমন পাগল পাগল লাগছে?

-স্পৃহা এখানেই এসেছিল। সকাল থেকে এখানে অপেক্ষা করছিল ও তোমার জন্য। সার্ভেন্টদের মধ্যে যারা বেরোতে পেরেছে, তারা বলেছে আগুন লাগার সময় স্পৃহা দোতলায় ছিল। আর ও বের হতে পারেনি। তার মানে……

মিস্টার চৌধুরীর বলা কথাগুলো শুনে প্রণব নিজের সামনে থেকে স্পন্দনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ঠিক-বেঠিক বিবেচনা বোধ হারিয়ে গেছে ওর। চেঁচিয়ে উঠে বললো,

-তার মানে ও এই আগুনের ভেতরে? তোমরা… তোমরা এতোক্ষণে আমার বলছো এ কথা? আরে আমার মিসেস নিস্তব্ধতা বের হতে পারছে না ভেতর থেকে। ওকে বের করে আনতে হবে আমায়। সরো তোমরা। আমি ওকে বের করে না আনলে ওর গায়ে আগুন লেগে যাবে তো!

বলেই প্রণব বাংলোর দিকে ছুট লাগালো। কেউ আটকাতেই পারলো না ওকে। মিসেস মেহরীন আর প্রান্তি কেঁদেই দিয়েছে প্রণবের পাগলামি দেখে। তারা এই ভয়টা-ই পাচ্ছিলো।

অকস্মাৎ একজোড়া বলিষ্ঠ হাত ঝাপটে ধরে আঁটকে দিলো প্রণবকে। প্রণব কাঁদছে আর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলছে,

-ছাড়ো আমায়! কেন আটকালে? আমার স্পৃহা যে কষ্ট পাচ্ছে! আমাকে ওর কাছে যেতে দাও। ওর গায়ে আগুনের তাপ লাগছে না? ও ব্যথায় কাঁদছে! সহ্য হচ্ছে না আমার। একটুও সহ্য হচ্ছে না। ওর কাছে যাবো আমি। ওকে বাঁচাতে হবে আমার!

-পাগলামি করিস না, প্রণব! এই আগুনে গেলে তুই নিজেই পুড়ে যাবি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসুক আগে।

প্রণব রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ওকে ধরে রাখা ব্যক্তিটির ওপর। আদ্র! আদ্র-ই ঝাপটে ধরে রেখেছে ওকে। প্রণব ওর থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য কতোগুলো কিল-ঘুষি-ধাক্কা দিলো হিসেব নেই।

-ছাড় আমাকে। তুই চাস না মিসেস নিস্তব্ধতা বেঁচে থাকুক। আমি জানি সেটা! এতো জঘন্য তুই? আমি থাকতে স্পৃহার কিচ্ছু হবে না। ওকে ছাড়া থাকবো কীভাবে আমি? দমবন্ধ হয়ে যাবে আমার। ছাড় তুই আমায়!

আদ্র চেষ্টা করেও ওকে আটকে রাখতে পারছে না। স্পন্দন, আহানেরাও ওকে গিয়ে ধরলো। কিন্তু প্রণব নাছোড়বান্দার মতো আগুনের ভেতর চলে যেতে চাইছে। এমন পাগলও হয়? এই আগুনে কোনো মানবদেহের আদৌ টিকে থাকা সম্ভব? কিন্তু সেটা প্রণবকে কে বোঝাবে?
__________________________

স্বচ্ছ দিবালোক! প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে নরম রোদের মিষ্টতা। লেকে টলমলে পরিষ্কার পানিতে ফুটে উঠছে পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রবীন বৃক্ষের প্রতিকৃতি। তার ডালে বসে কোকিলের কুহুতান যেন থামছেই না। গাছটায় হেলান দিয়ে বসে সেই পাগল প্রেমিক কোকিলের তোলা সুরগুলো শুনছে। চোখ দুটো বন্ধ তার। কিন্তু চোখের নিচের গভীর কালো দাগ দুটো ওর সহস্র নির্ঘুম রাতের প্রতীক। কোলে মেলে রাখা ডায়েরিটায় হাত দুটোর স্পর্শ চলছে অনবরত। যেন অতি ভালোবেসে ছুঁয়ে দিচ্ছে বস্তুটাকে। কিন্তু এটা কি তার কাছে শুধুই একটা বস্তু? সে নিজেই একমাত্র জানে হয়তো!

প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে। নিয়ম মেনেই এসেছে সে। বরাবরের মতোই নিয়ে এসেছে রঙের বহর। এরকম বসন্ত তার জীবনেও এসেছিল। রঙিন বসন্ত। আরো দশ বছর আগে। ভাবতেই ঠোঁট দুটো প্রসারিত হলো প্রণবের। বদ্ধ চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে সেই প্রথম দেখা ষোড়শী প্রণয়িনীর প্রতিচ্ছবি। আনিলার জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। সবেমাত্র এইচএসসির কোঠা পেরিয়েছে প্রণব। আবেগগুলো ধীরে ধীরে অনুভূতিতে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে তখন। আনিলার জন্মদিনেই প্রথম দেখেছিল সে স্পৃহাকে। আনিলার সাথে তখন আয়াফের সম্পর্কের সূচনা পর্ব। সেই সুবাদে আহির আর স্পন্দনও সেখানে গিয়েছিল। আর স্পন্দনের সাথে ছিল সেই ষোড়শী কিশোরী। প্রথম দেখায় ভালোবাসার মতো কিছু ঘটেনি প্রণবের সাথে। কিন্তু মেয়েটাকে সবার থেকে আলাদা মনে হয়েছিল। এই বয়সে এতো চুপচাপ! চোখে মুখে অদ্ভুত ভীতি ও আতঙ্ক নজর কেড়েছিল প্রণবের। তখনই নাম দিয়েছিল ‘নিস্তব্ধতা’। কথা বলতে গিয়েছিল সে। কিন্তু স্পৃহা ওর কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ভয়ে। পুরো সময়টাতে প্রণব খেয়াল করেছিল ওকে। অকারণেই! কয়েকটা ছবিও তুলেছিল আড়ালে। এসব-ই ওর রাতের ঘুম কেড়ে নেবে, সে কি জানতো? যখন নিজেকে বুঝতে পেরেছে, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আনিলার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রিয় ব্যক্তিটিকে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা কম করেনি সে।

কিন্তু এরই মধ্যে স্পৃহার জীবনে এতো গুলো মোড় চলে আসবে, সেটা প্রণবের কল্পজগতেও আসেনি। প্রান্তির মুখে সারাজীবন পিহু নামে শুনে আসা মানবীটি-ই যে তার প্রেয়সী, সেটাও জেনেছে অসময়ে। ভার্সিটির গেইটের সামনে থেকে স্পৃহার পায়েলটা পেয়েছিল। প্রথম দেখাতেই সেই পায়েল চোখে পড়েছিল প্রণবের। তবে স্মৃতিতে একটু ভাটা পড়ায় সন্দেহও ছিল, এটা কি আদৌও নিস্তব্ধতার? তবুও যত্নে রেখে দিয়েছিল সেটা। বিশ্বাস ছিল, নিস্তব্ধতা ফিরবে। ফিরেছে-ও! দৈবাৎ ভাবে। প্রেগন্যান্সি ও মিসক্যারেজ- এর জন্য পরিবর্তন এসেছিল স্পৃহার মধ্যে। এক দেখায় চিনে উঠতে পারেনি সে। পরিস্থিতিও এসব ভাবতে দেওয়ার অনুকূলে ছিল না। কিন্তু প্রান্তির মুখে প্রথম বারের মতো পিহুর প্রকৃত নাম স্পৃহা শুনে চিনে ফেলেছিল প্রণব। আর সে রাতেই স্পন্দনকে নিজের বাড়িতে দেখে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু তার নিস্তব্ধতার মনে তখন অন্য ব্যক্তির বাস! রাতের আড়ালে সে ‘আহির’ নাম জপতো। বিয়েও হয়ে গিয়েছিল স্পৃহার। ভয়ংকর কান্না কেঁদেছিল সে সেদিন। যখন আদ্রের ব্যাপারটাও জানতে পারলো, তখন-ই সবার অজান্তে নিজের সাথে নিজের নিস্তব্ধতাকে বেঁধে নিয়েছে সে। অতি সংগোপনে ও জটিল ভাবে। হারিয়ে আবার ফিরে পাওয়া ভালোবাসা! একান্তই নিজের করে ফিরে পাওয়ার আনন্দটা কেমন ছিল, বর্ণনা করা অসম্ভব। হয়তো সে তাকে ভালোবাসে না। কিন্তু দ্বিতীয় প্রেমের জোয়ার উঠবেই- এটা তার বিশ্বাস ছিল।

-সেই বিশ্বাস হারে নি, মিসেস নিস্তব্ধতা। আমার বিশ্বাস হারেনি। যদিও আমি নিজেই হেরে গিয়েছি।

বিরবির করে কয়েকবার কথাটা বললো প্রণব। চোখের কোণে জমে থাকা পানিগুলো গড়িয়ে পড়লো। চোখ মেলে তাকালো সে। ডায়েরির লেখায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। প্রণবের সেই প্রথম লাল কাগজে লেখা চিঠিটা। স্পৃহা যত্ন করে রেখে দিয়েছে ডায়েরির গায়ে। কোণায় লিখেছে,

“আমি কঠিন, আমি নিষ্ঠুর। এই পাথর হৃদয়ে কেন নিজের স্থান করে নিতে চাইছো তুমি? কেন ‘তুমি’ বলতে ইচ্ছে করছে তোমায়? এটা তো আবেগ নয়! কিন্তু মনের আঙিনায় ক্ষত হয়েছে। ভয়াবহ ব্যাধি। দুঃসহ রোগ। এটাই কি তবে দ্বিতীয় বসন্তের প্রত্যূষাগমন?”

লেখাটায় আঙুল ছোঁয়ালো প্রণব। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে এসেছে ওর। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই বিষাক্ত স্মৃতির পাতা……

🍁
আগুন একটু দম নিয়ে দ্বিতীয় মাত্রায় কয়েকগুন বেড়ে গেছে। প্রণবকে ধরে বেঁধে আটকে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে গেছে এখন। ও ভেতরে যাবেই! সবাই ভেঙে পড়লেও ওকে সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন সময় কয়েকজন প্রণবের দিকে ছুটে আসলো। তারা আগুন নেভানোর কাজেই ছিল। এদিকে কেন আসছে বুঝতে না পেরে সবাই প্রশ্নসূচক চাহনি নিক্ষেপ করলো।

-বাংলোর পেছনের দিকে এক মেয়ে পাওয়া গেছে। শাড়ি পরা ছিল। হাত আর গায়ের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। মেয়েটা হয়তো পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়েছে কোনো মতে। জ্ঞান আছে, কিন্তু বাঁচবে বলে মনে হয় না। শ্বাস নিতে পারছে না ঠিক মতো।

প্রণব এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বললো,

-ক্ কোথায় ও? কোথায়? আমি ওর কাছে যাবো। বলো কোথায় র…

অদূর থেকে স্ট্রেচারে করে সাদা কাপড়ে ঢেকে নিয়ে আসা হলো মেয়েটাকে। গলা থেকে পা পর্যন্ত আবৃত হলেও মুখটা খোলা-ই। সারা মুখে অনেক জায়গায়ই কালি লেগে আছে তার। কিন্তু কারো চিনতে অসুবিধা হলো না এটা কে! কান্নারা আবারো এসে ভীড় করলো। প্রণব আটকাতে চাইলো ওদের। মিস্টার চৌধুরী বললেন,

-ওর ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। এখন পাগলামি করে সময় নষ্ট করো না, প্রণব।

প্রণব দমে গেল। সত্যিই, তাড়াতাড়ি স্পৃহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু স্পৃহা আবছা চোখে সবাইকেই একটু-আধটু দেখছে। স্ট্রেচার বহনকারীর হাত আঁকড়ে ধরলো সে। তাদের পা থেমে গেল। স্পৃহা পোড়া হাত দিয়ে প্রণবকে ইশারা করলো। শুধু হাতটা দেখেই প্রণব দিগ্বিদিক ভুলে গেছে। এক ছুটে এসে স্পৃহার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে ও। কালিমাখা মুখটায় কতগুলো চুমো দিলো, হিসেব নেই। প্রণবের চোখের পানিতে স্পৃহার মুখ পুরো ভিজে যাচ্ছে। স্পৃহার চোখ দিয়ে প্রথম থেকেই পানি ঝরছে।

-আপনার কিছু হবে না, মিসেস নিস্তব্ধতা! কিছু হবে না। কেন এখানে এসেছেন আপনি? এই আগুনকে কেন সুযোগ দিলেন আপনাকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেওয়ার? কেন?

বলেই স্পৃহার পোড়া হাতটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো প্রণব। স্পৃহা হাসলো যেন! এসেছিল তো প্রণবকে নিজের মনে কথা গুলো বলতে আজ। সেই লালপেড়ে সাদা শাড়িটা জড়িয়েছিল গায়ে। এখান থেকেই নতুন পথচলার সূচনা চেয়েছিল সে। কিন্তু ভাগ্য তো শুরুর আগেই সবকিছুর ইতি টেনে দিলো। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,

-আপনার সাথে হাজার বছর বাচার স্বপ্ন ছিল আমার। জানি সেটা পূরণ হওয়ার নয়। তবে আমৃত্যু আপনাকে পাশে চেয়েছিলাম। সেই ইচ্ছে পুরন হয়েছে। কিন্তু আপনার সাথে আমার পথচলা হলো না, গায়ক সাহেব। আপনিময় সংসার হলো না। সময় শেষ আমার। এই বিদায়ের সময় আপনাকে বলতে চাই, আপনি পেরেছেন! আমার মনে নিজের স্থান তৈরি করতে। ভালোবাসি আপনাকে। আপনার বিশ্বাস জিতে গেছে। ভালোবেসে বিদায় নিচ্ছি আমি। কাঁদবেন না কখনো আমার কথা ভেবে। প্লিজ! কখনো কাঁদবেন না। আপনার কান্না আমারও সহ্য হবে না। আপনার কষ্ট দূরে বসে দেখবো কীভাবে আমি বলুন? এসে তো আপনার চোখের পানি মুছে দিতে পারবো না। দূর থেকে আমিও কাঁদবো তখন। আজ থেকে আমি একা হয়ে যাবো। আপনার বুকে মাথা রাখার অনেক ইচ্ছে ছিল, গায়ক সাহেব। সেটাও পূরণ হলো। আপনাকে জুড়ে জীবনটা পূর্ণতা পেল না আমার। তবে আপনি অপূর্ণ থাকবেন না। ভালো থাকবেন।

স্পৃহার ভাঙা ভাঙা কথাগুলো প্রণবের দেহ থেকে যেন আত্মাকে আলাদা করে দিচ্ছে। স্পৃহা চোখ মেলে রাখতে পারছে না। বারবার বুঁজে আসছে চোখ জোড়া। প্রণব ওর গাল দুটো দুই হাতে আগলে ধরে বললো,

-হেই, মিসেস নিস্তব্ধতা! চোখ বন্ধ করবেন না, আপনি। একদম চোখ বুজবেন না। আপনি ছাড়া আমার নিঃশ্বাস কীভাবে চলবে? আমি নিস্তব্ধতা বলে কাকে ডাকবো? কে আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেবে? আপনাকে ছাড়া দেহ চললেও প্রাণ চলবে না, মিসেস নিস্তব্ধতা। আপনি আমায় একা করে যেতে পারেন না। ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করেছি বলে এতো বড় শাস্তি দিতে পারেন না। চোখ খুলে রা……

স্পৃহা চোখ খুলে রাখতে পারলো না। প্রণব থমকে গেল। আদ্র পালস চেক করলো। অনেক ধীর গতিতে চলছে। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো। স্পৃহার বাবা-মাও আজ কাঁদছে। প্রচুর কাঁদছে। এই মেয়েকে তো তারা কতো অবহেলা করেছে। স্পৃহার জন্মের পর পরই ওর বাবার ব্যবসায়ে ধস নামে। পুরনো ধ্যানধারণা জেঁকে বসেছিল স্পৃহার মায়ের মধ্যে। তাতে ঘি ঢেলেছিল স্পৃহার ফুপি। অপয়া- শব্দটা জুড়ে গিয়েছিল নামের আগে। তখন থেকেই স্পৃহার অযত্নের শুরু। সংসার সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল স্পৃহার বাবাকে। মেয়েকে তেমন সময় দিতে পারতেন না তিনি। ইচ্ছেও ছিল না। তাই মায়াটাও সেভাবে জন্মেনি মেয়ের প্রতি। আজ আফসোস হচ্ছে তাদের। ভয়াবহ আফসোস! হাউমাউ করে কেদেও আজ সেই দিনগুলো ফিরে পাবেন না তারা। স্পৃহাকেও ফিরে পাবেন না হয়তো। পুরনো দিন গুলো আজ তাদের পুড়িয়ে মারছে। কি নিষ্ঠুর বাবা-মা তারা!! মা-বাবার কলঙ্ক তারা!!
🍁

হসপিটালে দ্বিতীয় দিন-ই ছিল সেই বিষাক্ত দিন। অতি সন্তর্পণে পরপারে পাড়ি জমিয়েছিল প্রণবের নিস্তব্ধতা। তার পয়তাল্লিশ ভাগ পুড়ে যাওয়া দেহটা দেখেছিল প্রণব। সেদিন থেকেই মনটাও ঝলসে গেছে ওর। চারটা বছর পেরিয়ে গেছে আজ। তবুও প্রতিটা মুহুর্ত কাঁদে সে। প্রতিটা মুহূর্তে মনে আসে স্পৃহা নামক মানবীটা। কাঁদিয়েই ছাড়ে ওকে। নাক টানলো প্রণব। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনি কি কাঁদছেন, মিসেস নিস্তব্ধতা? আমি কাঁদছি, সেটা দেখতে পাচ্ছেন আপনি? আপনার কষ্ট হচ্ছে? আমার কিন্তু অনেক কষ্ট হচ্ছে! আপনি সেটা দেখে কষ্ট পেয়েন না। আপনার শেষ কথাটা রাখতে পারিনি আমি। কী করবো বলুন? প্রচন্ড কষ্ট হয়! নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। কাঁদতে না চাইলেও মন মানে না। চোখ দুটোও শোনে না কোনো বারণ। পানি ঝরাতে পারে বলেই হয়তো শ্বাস চলছে। যেদিন চোখের পানি ফুরিয়ে যাবে, সেদিন শ্বাসও থেমে যাবে।

বলেই চোখ দুটো মুছলো সে। ডায়েরির দ্বিতীয় ও শেষ লেখাটায় তাকালো,

“আপনার বিশ্বাস জিতে গেছে, গায়ক সাহেব! ভালোবাসি আপনাকে। কখন, কীভাবে এমনটা হলো? মনের অজান্তেই! কালকে দেশে ফিরছেন আপনি। আর কাল-ই নতুনভাবে শুরু হবে আমাদের জীবন নতুন সেই বাংলোতে। আপনার মিসেস নিস্তব্ধতা পুরোপুরি আপনার হয়ে যাবে।”

আরেক দফা জলে ভাসলো প্রণবের কপল ও গলদেশ। কান্নারা দলা পাকিয়ে ভীড় জমালো গলায়,

-শুরু হওয়ার আগেই তো পুরোপুরি শেষ হয়ে গেল, মিসেস নিস্তব্ধতা। আমার হওয়ার আগেই আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন আপনি। আমি তো জিতেও হেরে গেলাম! ‘ভালেবাসি’ কথাটাই বলা হলো না আপনাকে। অথচ আপনি ঠিকই বলে গেলেন। এভাবে পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়ে যাবেন জানলে আপনাকে নিস্তব্ধতা বলে সম্বোধন করতাম না। কোনোদিনও করতাম না।

প্রান্তি অদূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। পাশে আহান, আনিলা, স্পন্দন, মেঘা, আদ্র সবাই-ই আছে। প্রণব এতোদিনে একই রকম আছে। গিটার ছেড়েছে সেদিনই, যেদিন নিস্তব্ধতা ওর থেকে হারিয়ে গেছে। চার-চারটে রংহীন বসন্ত পেরিয়ে গেছে। প্রণবের মুখের হাসিটাও এখন আর দেখা যায় না। বেঁচে থাকার মতোই বেঁচে আছে সে। শ্বাস নিয়ে, নিঃশ্বাস ছেড়ে। শ্রান্ত বিকেল গুলোতে আকাশের সাথে কথা বলে। রাতের আঁধারিয়া অম্বরে নোনা জলে বালিশ ভিজিয়ে। মন থেকে সরাতে পারেনি সেই প্রিয়দর্শিনীকে! তার মিসেস নিস্তব্ধতাকে। পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে সে। সেটা টানা অক্ষিদ্বয় এখন কারো দিকে তাকায় না। সেই সরু ভ্রদ্বয় এখন কারো কথায় কুঞ্চিত হয় না। সেই হলদেটে ত্বক এখন সূর্য কিরণে চকচক করে উঠে না। সেই মানবীটি এখন কষ্টের অশ্রু ঝরায় না। কষ্ট পেয়ে আবার কষ্ট নিয়েই চলে গেছে সে। কোনো বিনিময় আশা করেনি। পৃথিবীর মাটি থেকে সরে গেছে স্পৃহা নামটি। কিন্তু কেউ একজনের মন থেকে সে মুছে যেতে পারেনি। হয়তো পারবেও না। চিরদিন-ই রয়ে যাবে। হয়তো এতেই প্রাপ্তি, এতেই সুখ।

🍂সমাপ্ত🍂

৩১.০১.২০২২

[সমাপ্তিটা এরকম প্রত্যাশিত ছিল না, আমি জানি। কিন্তু আমি বাস্তবিকভাবে ইতি টানবো বলেছিলাম। তাই চাইলেও মিল দিতে পারতাম না। বাস্তবে তাদের মিল হয়নি। অনেকটা আজকের পর্বের মতোই সমাপ্তি ঘটেছে তাদের বৈধ প্রণয়ের। আশা করি সবাই বুঝবেন। আর লিখতে গিয়ে আমি নিজেও চোখ ভিজিয়েছি। আপনাদেরও ভিজবে, স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতাটা আরো বেশি নির্মম ছিল, যেটা লেখায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়।

পরিশেষে, অনেক গ্যাপ পড়েছে লেখায়। সেজন্য সরি🥺। ব্যস্ততায় ও চাপে আমি গল্পে সময় দিতে পারিনি তেমন। সেভাবে সাজিয়েও তুলতে পারিনি হয়তো। তবুও যারা ভালোবেসে পাশে ছিলেন, তাদের অনেক ভালোবাসা। শেষ পর্বেও সবার সাপোর্ট আশা করছি। পুরো গল্প সম্পর্কে দুই লাইন লিখে যাবেন কষ্ট করে। পরবর্তী গল্প এই জুটি নিয়ে আসবে। কবে আসবে, সেটা এখন বলতে পারছি না। ততোদিন সবাই ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ! ]