এক মুঠো প্রেম পর্ব-১৫+১৬

0
438

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৫

-মিসেস স্পৃহা হয়তো আর কখনোই মা হতে পারবেন না!

কথাটা বারবার কানে বাজছে আদ্রের। দুই হাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে বসে আছে সে। এই সত্যিটা কীভাবে মেনে নেবে ও? ভাবতেই নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে আজ। সে কখনো পিতৃত্বের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে না। অথচ কতো স্বপ্ন ছিল তার! ঘর আলো করে একটা এঞ্জেল আসবে, তাকে সে নিজের বুকে আগলে রাখবে সবসময়, নিজের আঙুল ধরিয়ে হাঁটা শেখাবে, কথা বলা শেখাবে- এসব শুধু স্বপ্ন-ই রয়ে যাবে আজীবন। কোনোদিনও বাস্তব রূপ নেবে না। এই ভয়ংকর সত্যটা আদ্র যেন মানতেই পারছে না। ফুপিয়ে কেঁদে উঠে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-এমনটা কেন হলো, মা? কেন হলো? কী পাপ করেছিলাম আমি যার জন্য আমায় এতো বড় শাস্তি পেতে হলো?

মিসেস সামায়রা গম্ভীর ভাবে বসে আছেন। তার মৌনতা দেখে আদ্র আবার বললো,

-চুপ করে আছো কেন? আমি কোনোদিন বাবা হতে পারবো না, এর থেকে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে?

-তুই বাবা হতে পারবি না, এটা কে বললো? সমস্যা তো স্পৃহার! তোর তো কোনো সমস্যা নেই!

আদ্র কান্না থামিয়ে অবাক চোখে তাকালো। বিস্মিত কন্ঠে বললো,

-এসব তুমি কী বলছো? স্পৃহা আমার স্ত্রী। ও মা হতে না পারলে আমি কীভাবে বাবা হবো? আর তাছাড়া …

-তোর বউকে তুই অনেক ভালোবাসিস সেটা আমি জানি। কিন্তু ভাগ্য এখন এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে, তোকে যেকোনো একটা দিক বেছে নিতে হবে। হয় স্পৃহাকে, নয়তো পিতৃত্বের সুখের জন্য ওকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করতে হবে।

আদ্র স্তব্ধ হয়ে গেল! ওকে এমন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিসেস সামায়রা ম্লান হেসে বললেন,

-স্পৃহা খুবই ভালো একটা মেয়ে। তুই ওকে অনেক ভালোও বাসিস। তাই আমার মনে হয় না এই একটা কারণের জন্য তোর ওকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে! তবে জীবনটা যেহেতু তোর, সিদ্ধান্তটাও তোর-ই হওয়া উচিত। তোর কাছে যেটা প্রাধান্য পাবে, তুই সেটাই করবি। এখন ভেবে দেখ কী করবি?

থম মেরে বসে আছে আদ্র। এ কেমন গোলকধাঁধায় পড়েছে সে? স্পৃহা নয়তো বাচ্চা, যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে তাকে। তবে তার তো দুটোই চাই! পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে তার জীবনটাকে! গতদিনও এই ধরনের কথা কল্পনায় আনতে পারতো না সে। আর আজ! এখন স্পৃহার বলা সেই কথাগুলো কান বাজছে আদ্রের …


[-আপনার খুশিতেই আমি খুশি। আপনার হাত ধরেই আজীবন বাঁচতে চাই। অতীতের সবকিছু ভুলে নতুনভাবে বাঁচতে চাই আমি। আপনি সবসময় ভালোবাসবেন তো আমায়?

-ভালোবাসি, স্পৃহা। ভবিষ্যতেও বাসবো!

স্পৃহা জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বললো ,

-ব্যাস! আমায় কখনো দূরে ঠেলে দেবেন না, মাঝপথে আমার হাত ছেড়ে চলে যাবেন না আর আমায় ভুলে যাবেন না।

আদ্র স্পৃহাকে সোজা করে ওর গালে হাত রেখে অবাক কন্ঠে বললো,

-এসব কী বলছো তুমি? আমি তোমায় ভুলে যাবো কেন?

-ভয় হয় আমার। বাস্তবতাটা ভয়ংকর রকমের নিষ্ঠুর! কখন, কোথায়, কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে দাঁড় করায়, সেটা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায় না।

আদ্র স্পৃহার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

-সেরকম কোনো পরিস্থিতি আসবে না। আর এলেও… তখন আমি তোমায় দূরে ঠেলে দেবো না। ভরসা আছে আমার ওপর?

স্পৃহা মলিন হেসে বললো,

-আপনার ওপর ভরসা আছে বলেই তো এখনো বেঁচে আছি আমি। এই বিশ্বাসটা কখনো ভাঙবেন না। আমার অনুরোধ রইলো। আপনি বিশ্বাস ভাঙলে এবার আমার কী হবে জানি না। শুধু এটুকুই জানি যে… আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে, আদ্র। ]

কথাগুলো ভাবতেই আদ্রের ভেতরটা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে যেন! ভাবনা-চিন্তারা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বারবার চোখ ভিজে উঠছে তার। স্পৃহার সামনে দাঁড়ানোর সাহসটাও ও পাচ্ছে না, আর না পারছে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে।
___________________________

কপল বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ নোনাজলের ধারা। বেডে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে ও নিষ্পলক চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে স্পৃহা। মুখে কোনো কথা নেই, কোনো কথা বলার ইচ্ছেও নেই।

-আমি চাই না তুই আর ঐ বাড়িতে গিয়ে সংসার কর!

স্পন্দনের বলা গাম্ভীর্য পূর্ণ কথাটা শুনে স্পৃহা নড়েচড়ে উঠলো। চোখ ঘুরিয়ে স্পন্দনের ক্রোধান্বিত মুখের ওপর দৃষ্টি স্থাপন করে কম্পিত স্বরে বললো,

-মানে?

-মানে এটাই যে, ঐ বাড়িতে আর তোকে পাঠাচ্ছি না আমি। যেখানে তোর কোনো যত্ন নেই, কোনো মূল্য নেই, কোনো স্নেহ নেই ; সেখানে আমি তোকে যেতে দেব না। পারলে আদ্রকে বল তোকে আলাদা রাখুক!

স্পৃহা হতভম্ব হয়ে বললো,

-ভাইয়া, এসব কী বলছো তুমি? আমাকে আলাদা কেন র্…

স্পন্দন রাগী গলায় বললো,

-দেখ, একদম ন্যাকামি টাইপ কথা বলবি না এখন! তোর শাশুড়ী তোকে একবেলা শান্তি দিয়েছে এতো দিনে? আর আদ্র! ওর মতো ব্যক্তিত্বহীন মানুষ আমি দুটো দেখিনি। নিজের মাকে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস কেন করবে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু না বলে মুখ বন্ধ কেন রাখবে?

স্পৃহা অবাক হয়ে বললো,

-তুমি এসব কীভাবে জানো?

-সবটাই জানি। এতো যত্নে তোকে বড় করেছি আমি! তোকে শশুর বাড়ি পাঠিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে নাকি? তোর প্রতি মুহূর্তের আপডেট আমি নিতাম। সো, এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি। ঐ বাড়িতে আর মরতে পাঠাবো না আমি।

-কিন্তু ভাইয়া, আমি আদ্রকে বলতে পারবো না, আমায় আলাদা রাখতে আর.… এটা অন্যায় হবে।

স্পন্দন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-হলে হোক অন্যায়! তোর জীবন বাঁচাতে এসব ছোট খাটো অন্যায় করতে আমার বাঁধবে না।

স্পৃহা চোখ বন্ধ করে নিল। স্পন্দনের কথাগুলো এখন ওর গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। চোখ বন্ধ রেখেই বললো,

-ভাইয়া, আমি জানি, তুই আমার ব্যাপারে অনেক সেনসিটিভ। কিন্তু এতো ডেস্পারেট কেন হচ্ছিস?

স্পন্দন হাতে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসলো। শক্ত চোখে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোকে ছোট থেকে বুকে আগলে বড় করেছি, পিহু। তোর কিছু হলে আমার কী অবস্থা হতো, তুই কল্পনা করতে পারবি? সেই তোকেই দুদিন আগে ওমন অবস্থায় দেখে আমি কীভাবে সহ্য করেছি একবার ভেবে দেখ! মৃত্যুর মুখ থেকে বেচে ফিরেছিস তুই।

বলেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্পন্দন। নিজেকে ধাতস্থ করে আবার বললো,

-কী দরকার ছিল আদ্রকে বিয়ে করার? আহির বিয়ে করেছে বলে তোকেও বিয়ে করতে হবে? আমি তো জানতাম আহির একাই তোকে ভালোবাসে! কিন্তু পরে বুঝলাম, তুইও ওকে ভালোবাসতি। একবার আমার সাথে শেয়ার করতে পারতি সবটা!

স্পৃহা ফট করে চোখ খুলে ফেললো। বিস্ময়ভরা চাহনিতে তাকিয়ে রইলো স্পন্দনের রাগী চেহারার দিকে। স্পন্দন আগে থেকেই সবটা জানতো? ভাবতেই অবাক লাগছে ওর। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্পন্দন থমথমে গলায় বললো,

-তোকে আর কোনো ভুল করতে দিচ্ছি না আমি। তুই স্বেচ্ছায় মানলে তো ভালোই, আর না মানলে জোর করে হলেও আমার কাজ করে ছাড়বো আমি। হয় আদ্র নিজে তোর দায়িত্ব নেবে, নয়তো সম্পর্কটার ইতি টানবি তুই!

স্পৃহা স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-অসম্ভব! আমি আদ্রকে ছাড়তে পারবো না।

স্পন্দন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

-তোর ছাড়তে হবে না। এমন যদি হয়, আদ্রই সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিলো!

কথাটা শুনে স্পৃহা চমকে উঠলো। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-এমনটা কখনো হবে না! আর হলে আমি তোমার কথাই মেনে নেব।

স্পন্দন কিছু বলার আগেই আদ্র কেবিনে এলো, আর তার পেছনে মিসেস সামায়রাও প্রবেশ করলেন। তাদের দুজনকে দেখে স্পন্দন দাঁত চেপে রাগ দমিয়ে বসে রইলো। আদ্র এগিয়ে গিয়ে স্পৃহার পাশে বসলো। স্পৃহার চোখে এখনও পানি জমে আছে। ওর মাথায় হাত রেখে বললো,

-ইউ উইল হ্যাভ টু বি স্ট্রং, স্পৃহা। এভাবে কেঁদো না!

স্পন্দন গম্ভীর কন্ঠে বললো,

-তোমায় আমার একটা কথা মানতে হবে, আদ্র।

আদ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-কী কথা?

স্পন্দন মিসেস সামায়রার দিকে একপলক তাঁকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

-ডিরক্ট-ই বলছি। তোমার মা যেভাবে অনাদরে, অবহেলায় আমার বোনকে রেখেছে, সেটা আমি আর টলারেট করতে পারবো না।

আদ্র ভ্রু কুঁচকে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-মা স্পৃহাকে অবহেলায় রেখেছে মানে?

মিসেস সামায়রা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন,

-ম্ মিথ্যে কথা। আমি তো ওকে দেখেশুনেই রাখতাম।

স্পন্দন হেসে বললো,

-আচ্ছা?? সেটা তো আপনার কথা বলার ধরণ-ই বলে দিচ্ছে কতো দেখেশুনে রাখতেন। সে যা-ই হোক! আমি সাফ কথায় বলে দিতে চাই, আমার বোনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে যদি নিতে পারো, ওকে যদি আলাদা রাখতে পারো, তবেই আমি পিহুকে তোমার কাছে পাঠাবো। নয়তো…

আদ্র হতভম্ব হয়ে বললো,

-নয়তো…

স্পন্দন কিছু না বলে ওর সাইড ব্যাগ থেকে তিন পেইজের একটা পেপার বের করে আদ্রের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

-এটায় সাইন করে আমার বোনকে মুক্তি দাও।

আদ্র কাগজটার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। স্পৃহা ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাস, আদ্র এটায় সাইন কখনোই করবে না। আদ্র তো তাকে কথা দিয়েছিল! কোনো পরিস্থিতিতেই তাকে ছেড়ে যাবে না।

আদ্র থম মেরে বসে আছে। প্রচন্ডভাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। স্পৃহাকে ও কীভাবে ছেড়ে দেবে? এটা ভাবলেই নিজেকে অস্তিত্বহীন বলে মনে হয়। জীবন-মরণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখন তাকে। অনেকক্ষণ ভাবনাচিন্তা করার পর, আদ্র ধরা গলায় বললো,

-আমার একটু সময় দরকার। এখনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না আমি।

স্পন্দন বার কয়েক মাথা দুলিয়ে বলল,

-ওকে। টেইক ইয়র টাইম।

#চলবে…

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৬
✨কাহিনীর আসল মোড়✨

ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে পাথরের মতো বসে আছে স্পৃহা। পেপারের তৃতীয় পৃষ্ঠার শেষাংশে মোটা কলমে ‘আদ্র ইশরাক’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। হাত থেকে আলগা হয়ে কাগজগুলো ফ্লোরে পড়ে গেল। আদ্র ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছে? কী করে পারলো ও এটা করতে? আদ্র-ও মিথ্যে ছিল তাহলে? ওর বলা সব প্রতিশ্রুতিগুলো মিথ্যে ছিল! অনুভূতিহীন যন্ত্রের মতো বসে আছে স্পৃহা।

স্পন্দন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-বলেছিলাম না ও একটা ব্যক্তিত্বহীন ছেলে! নিজের মাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। বাবার পছন্দের ওপর সবসময়ই আমার ডাউট থাকে। উনি মানুষ চিনতেই পারেননি।

বলেই স্পৃহার দিকে তাকালো স্পন্দন। স্পৃহাকে এমন থম মেরে বসে থাকতে দেখে বললো,

-ঐ আদ্রের জন্য একদম কষ্ট পাবি না তুই! ওর কাছে নিজের পরিবারটা-ই সবার আগে। সেটা না হয় মেনেই নিলাম। কিন্তু তোর অপূর্ণতা-টা ওর কাছে এতোটাই বড় হয়ে গেছে যে, তোকে ছেড়ে দিতেও ওর বাঁধে নি। একবার বললেই পারতো, ‘ভাইয়া, যা হওয়ার হয়েছে। আমি কথা দিচ্ছি স্পৃহার পাশে সবসময় থাকবো। ওকে আর কষ্ট পেতে দিবো না।’ আদ্র যদি আমায় এভাবে একবার বলতো আমি সত্যিই মেনে নিতাম। তোকে যেতে দিতাম ওর সাথে। আমার বোনের সংসার ভাঙুক, এটা আমি কখনোই চাইনি! কিন্তু ও তো এসব কিছুই বললো না। উল্টো কী বললো? তার নাকি সময় লাগবে! ও তোকে কোনোদিন-ই ভালোবাসেনি, পিহু। যদি বাসতোই, তাহলে এই দুঃসময়ে তোর হাত এভাবে ছেড়ে দিতো না। তোকে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে পারতো না! জাস্ট শেইম অন দিস কাইন্ড অফ পারসন!!

স্পন্দনের বলা এতো লম্বা বক্তব্য স্পৃহার কানে ঢুকেও ঢুকলো না যেন! এখনো নড়চড় হীন ভাবে বসে আছে ও। হলদেটে ফ্যাকাসে মুখটার উপরিভাগে থাকা বিস্তৃত অক্ষিদ্বয়ের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে কোনো অজ্ঞান লক্ষ্যের পানে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। আদ্র শুধু মাত্র ওর অপূর্ণতার কথা ভেবেই ওকে ছেড়ে দিলো? কারন এটাই যে, ও কখনো মা হতে পারবে না! মাতৃত্ব আজ আদ্রের কাছে এতো বড় হবে গেল যে, এর জন্য নিজের দেওয়া কথাগুলোও ভুলে গেল! বিশ্বাস ভাঙ্গার সাথে সাথে স্পৃহার পুরো পৃথিবীটাই উল্টেপাল্টে দিল। আহিরের মতো আদ্রও কি আবার নতুন করে নিজের জীবন সাজাবে? ভুলে যাবে স্পৃহা নামক মানবীর কথা? মানুষ কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি কাউকে ভুলে যেতে পারে? স্থবিরতা বজায় রেখেই শুকনো ওষ্ঠ দ্বয় নাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে স্পৃহা বললো,

-আবার ঠকে গেলাম আমি! আবার!! মানুষ কীভাবে এতো স্বার্থপর হতে পারে, ভাইয়া?

স্পন্দন চোখ তুলে স্পৃহার মুর্তিবৎ মুখশ্রীর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-মানুষের ধর্মটাই এমন! ঠকাতেই তারা বেশি ভালোবাসে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেটা ভেঙে দিতে মানুষের বাঁধে না। আর যাকে ঠকাবে, তার মুখোমুখি হতেও ভয় পায়। এই যে, আদ্রকে দেখ। তিনদিন সময় নিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে হসপিটালে পাঠিয়ে দিল! কিন্তু তোর সামনে এসে দাড়ানোর সাহস পেল না।

স্পৃহা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইলো। কাঁদতে অনেক ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু কান্নাও আজ তার সাথে শত্রুতা করছে যেন। এক ফোঁটা পানিও চোখে আসতে চাইছে না। কোথাও আঁটকে গেছে তারা! ঠিক সেভাবেই আঁটকে গেছে, যেভাবে থেমে গেছে স্পৃহার জীবনটাও। তবুও কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে! খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে! প্রচন্ড রকমের অসহনীয়, অসহ্যকর সে কষ্ট। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন! একটু কাঁদলে কি এই কষ্ট থেকে কিছুটা পরিত্রাতা পাবে স্পৃহা? হয়তো হ্যাঁ! হয়তো বা নয়! কিন্তু এই আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করার সামর্থ্য ও ইচ্ছে, কোনোটাই স্পৃহার নেই।
_________________________

টানা দশদিন হাসপাতালে কাটিয়ে আজ ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে স্পৃহাকে। স্পন্দন হাসপাতাল থেকে সরাসরি নিজের বাড়িতেই নিয়ে এসেছে বোনকে। স্পন্দনের মা-বাবার কিছু বলার মুখ নেই। কিন্তু স্পৃহার ফুপু অনুপমা কারো ধার ধারেন না। আর স্পৃহার ব্যাপারে তার বিরক্তিটা একটু বেশিই। তাই কোনো রকম ভণিতা না করেই সরাসরি বলে ফেললেন তিনি,

-আমি জানতাম, এই মেয়ের দ্বারা সংসার হবে না। সাধে কি আমি ওকে অপয়া বলি? দেখলি তো! বাচ্চাটাকে তো খেলোও! সাথে সংসারটাও গেলো! এখন না আবার কোনোদিন মা-ও হ……

-জাস্ট শাট আপ!

স্পন্দনের ধমকে সবাই কেঁপে উঠলো। অনুপমাও থেমে মুখ বাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্পৃহা কিছু না বলে ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে ওর! এ বাড়িতে থাকলে এই সমাজ ওকে বাঁচতে দেবে না। রোজ রোজ-ই লোকে আঙুল তুলে ওকে কথা শোনাবে। যখন ঘরের মানুষ-ই অপয়া, ডিভোর্সি, অলক্ষ্মী এসব বলতে পারে, তাহলে বাইরের মানুষ থেমে থাকবে কেন?

স্পৃহা চলে যেতেই স্পন্দন অনুপমাকে উদ্দেশ্য করে রাগী স্বরে বললো,

-কী সমস্যা তোমার, মনি? বলতে পারো? মেয়েটার মানসিক অবস্থা এমনিতেই ঠিক নেই! তার ওপর এসব কথা বলতে তোমার বিবেকে বাঁধলো না?

অনুপমা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

-যেটা সত্যি, সেটাই তো বলেছি! এখানে বিবেকে বাধার কী আছে?

স্পন্দন হাতে হাত ভাজ করে বললো,

-আচ্ছা? তাহলে আমিও কিছু সত্যি কথা বললে তোমার ভালো লাগবে তো?

অনুপমা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-কী বলতে চাইছিস তুই?

-জাস্ট তোমায় কিছু সত্যি মনে করিয়ে দিতে চাই। তোমার বিয়ের পর ফুপাও কিন্তু তোমায় পছন্দ করতেন না, মনি। এজন্যই বাবার কাছে তুমি বছরের বেশিরভাগ সময় কাটাতে। আর ফুপার মৃত্যুর পর তোমার একমাত্র ছেলেও তোমায় ত্যাগ করেছে এন্ড এখনো তুমি আমাদের বাড়িতেই পড়ে আছো। সুতরাং সত্যিটা এটাই যে, সংসার কিন্তু তোমার কপালেও জোটেনি। সো, পিহুকে কিছু বলার আগে নিজের দিকটা একবার ভেবে নিও!

অপ্রিয় সত্য গুলো অনুপমার গায়ে কাটার মতো বিধলো যেন! তিনি মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্পন্দন সেটা দেখে মৃদু হেসে ভেতরে চলে গেল।
____________________________

নিকষ কালো আকাশটা আজ অনেক ভার হয়ে আছে। তার বুকেই আবার থালার মতো মস্ত বড়ো এক চাঁদ দেখা যাচ্ছে। জমাট বেঁধে চলা কালো মেঘ গুলো বারবার ঢেকে দিচ্ছে তার সেই উজ্জ্বল সত্তাটিকে। আবৃতকরণে বারংবার ব্যর্থ হলেও অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। প্রকৃতিতে বয়ে চলে মৃদুমন্দ হাওয়া। মাঝে মাঝে দমকা হওয়ায় ও রূপ নিচ্ছে তারা।

খাটে হেলান দিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে এসবই পর্যবেক্ষণ করছে স্পৃহা। মাঝে মাঝে প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছে হয় তার। এই প্রকৃতির এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, যা আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির প্রতিটি সত্তা-ই বাস্তব, আর মানুষের জীবনের একেকটি দিককে ইঙ্গিত করে।

হঠাৎ বালিশের পাশে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট হতে থাকায় চিন্তাজগতে ভাটা পড়লো স্পৃহার। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা চোখে পড়লো ওর। ‘Adro’ নামটা জ্বলজ্বল করতে দেখে দাঁতে দাঁত খিঁচে বসে রইলো স্পৃহা। কলটা কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাআপনি-ই কেটে যেতেই স্পৃহা জোরে একটা শ্বাস নিলো। ফোনের ব্যাক পার্টটা খুলে সিমকার্ডটা বের করে ফেললো এবং দুই আঙুল দিয়ে ভেঙেও ফেললো। ঝামটা মেরে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো যোগাযোগের মাধ্যমটাকে। মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ভাবলো,

-মানবমন বড়ই বৈচিত্র্যময়! কখন সেখানে কোন ইচ্ছে জাগে, তা বোঝা দুষ্কর।

স্পন্দন ভেতরে ঢুকতেই স্পৃহাকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে কিছু বলতে চেয়েও বললো না। স্পৃহার হঠাৎ চুপ করে যাওয়াটা ভাবাচ্ছে ওকে। মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু সেটা একটুও প্রকাশ করছে না। একবারও কাঁদতে দেখলো না স্পৃহাকে। মেয়েটা কষ্টের কারণে কোনো ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসবে না তো!

ভাবতে ভাবতেই চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল স্পন্দন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, কাল ওর কোনো বোনকে নিয়ে আসবে স্পৃহার সাথে রাখার জন্য। আজকের রাতটা নজরে নজরে রাখবে স্পৃহাকে। ভাবতে ভাবতে কখন নিজেই ঘুমিয়ে গেল টেরই পেল না স্পন্দন। ঘুম একটু কাটতেই লাফিয়ে বসে পড়লো স্পন্দন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাত একটা বাজে। বেশিক্ষণ ঘুমায়নি সে। ভেবেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। কিন্তু স্বস্তিটা বেশিক্ষণ স্হায়ী হলো না। স্পৃহার ঘরে গিয়েই দেখলো, ঘরটা ফাঁকা। নিজেকে নিজেই গালি দিতে দিতে বললো,

-ওহ্ শিট! যেটার ভয় পাচ্ছিলাম, সেটাই হলো!

এদিকে,
এলোমেলো পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো স্পৃহা। ভেতরের ঘা গুলো এখন তাজা হয়েছে উঠেছে যেন! ঐ বদ্ধ ঘরে নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে ওর। বাইরের মুক্ত বাতাস অনুভূত হতেই হালকা লাগছে এখন। দমকা হাওয়ার তোড়ে ভেতরে জমে থাকা কষ্ট গুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। হাত দিয়ে সেগুলো মুছতেও ইচ্ছে করছে না। কেন জীবনটা এতো এলোমেলো হয়ে গেল তার? ভালোবেসে, বিশ্বাস করার শাস্তিটা কি এতোই বসে?

উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ কেউ স্পৃহার হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো। স্পৃহা টাল সামলাতে না পেরে তার বুকের ওপর পড়তেই তাদের পাশ ঘেঁষে শা শা করে কয়েকটা ট্রাক গেল। তীব্র গতিতে চলতে থাকা হৃদযন্ত্রের ধুপধাপ শব্দের পাশাপাশি স্পৃহা কানে ভেসে এলো ঝাঁঝালো পুরুষালি কণ্ঠস্বর,

-হেই ইউ!! স্টুপিড গার্ল!! পাগল নাকি আপনি, হ্যা? এভাবে এই নীরব রাস্তায় এত রাতে একা একা হাঁটে কেউ? আমি না আসলে এতোক্ষণে আপনার অস্তিত্বও পাওয়া যেত না। মরতে এসেছেন এই রাস্তায়?

স্পৃহা কথাগুলো শুনেই মুখ তুলে তাকালো। ল্যাম্পপোস্টর ঝাপসা আলোয় চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পরিচিত অবয়বটিকে অস্ফুটস্বরে বললো,

-প্ প্রণব মেহরাজ চৌধুরী ………

# চলবে…

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা সাপেক্ষ ]