এক মুঠো প্রেম পর্ব-১৯+২০

0
402

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৯

স্পৃহাকে ছাদের একদম কিনারার দিকে পা বাড়াতে দেখা যাচ্ছে। আর এক চুল এগোলেই সোজা ছাদ টু ফ্লোরে পড়ে যাবে ও। প্রণব ছুটে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওর হাত টেনে নিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করালো। হাতে আকস্মিক টান পড়ায় স্পৃহা চমকে সামনে তাকায়। প্রণব অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পৃহার দিকে। সেটা দেখে ও চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।

প্রণব ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললো,

-ইউ স্টুপিড গার্ল! অতি শোকে পাগল হয়ে গেছেন নাকি আপনি? মরার এতো শখ আপনার! সুইসাইড করতে এসেছেন এখানে? ইচ্ছে তো করছে আপনাকে নিজেই ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেই।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে ফেললো। প্রণবের কথার মানে বোঝার চেষ্টা করছে সে। প্রণব ঝাঁঝালো কণ্ঠে পুনরায় বললো,

-ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? লাইফে দুঃখ – আনন্দ দুটোই থাকে। কষ্ট পেলেই জীবন শেষ করে দেবেন- এটা কোনো লজিক হলো? আজকালের ছেলেমেয়েদের মনে এতো আবেগ কোত্থেকে আসে, কে জানে?

স্পৃহা প্রণবের কথাগুলো শুনে ওর গম্ভীর চাহনিতে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু এখন ওর বিরক্ত লাগছে। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে ও ছাদের আরেকদিকে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রণব বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে এতো কথা শোনালো, অথচ মেয়েটা কিছুই বললো না! মেয়েটা কি সত্যিই কথা বলতে জানে না না-কি?

প্রকৃতিতে শীতের আগমন ঘটে-ই গিয়েছে প্রায়! হিমশীতল উত্তরে হাওয়া বারেবারে ত্রিধারে ছড়িয়ে পড়ছে। স্পৃহা গায়ে জড়ানো শালটা দিয়ে গা আরো ভালো করে মুড়িয়ে নেয়। শো শো করে বয়ে চলা বাতাসগুলো ওর খোলা চুল বারবার হাওয়ায় এলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সেদিকে স্পৃহার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! লক্ষ্যহীন শূন্য দৃষ্টিতে সম্মুখ পানে তাকিয়ে আছে ও।

প্রণব স্পৃহার দিকে তাকিয়ে ওকে বোঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই অনেকটা খোলা বইয়ের মতো মনে হয় তার, যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। আদৌ কি মেয়েটার এই ক্ষুদ্র জীবনটায় কাহিনীর বিস্তৃতি অসীম দ্বার পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত? ভাবতে ভাবতেই নিজের হাত থেকে গিটারটা টেবিলের ওপর রেখে স্পৃহার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নীবরতার ইতি টেনে বললো,

-একা একা রাতের আকাশ দেখতে অনেক ভালো লাগে, তাই না?

এমন কথা শুনে স্পৃহা সামনে থেকে চোখ ঘুরিয়ে প্রণবের দিকে তাকালো। প্রণব-ও স্পৃহার দিকে দৃষ্টি না দিয়েও সেটা বুঝতে পারলো। স্পৃহা বেশ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রণব পুনরায় বললো,

-রাতে ছাদে একা এসেছেন, আপনার ভয় লাগেনি?

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-ভয় কেন লাগবে?

স্পৃহার মুখের এই তিনটি শব্দ প্রণবের কানে বেজে উঠতেই ও চোখ বড়বড় করে ফেললো। স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনি কথা বলতে জানেন? আই থট, আপনি কথা বলতে জানেন না! আমি আরো প্রান্তিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম যে, আপনার ব্যাপারে এতো কিছু বললো, অথচ আপনি বোবা- এটা কেন আমায় জানালো না!

স্পৃহার কুঁচকানো ভ্রু যুগল আরো সংকুচিত হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই মন পড়লো, আজ বহুদিন পর সে মুখ ফুটে কিছু বললো আর এটাই প্রণবের সাথে বলা তার প্রথম কথা। ভেবেই চোখ সরিয়ে একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো স্পৃহা। সাথে সাথেই কানে ভেসে এলো,

-তবে আই শ্যুড এডমিট দ্যাট, আপনার ভয়েসটা অনেক সুইট!

স্পৃহা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো প্রণবের দিকে। প্রণব বাঁকা হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পৃহা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই প্রণব বলে উঠলো,

-প্রান্তি জীবনেও এই রাতের বেলা একা ছাদে আসতে পারতো না। আপনি এসেছেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কী!!

-যার পুরো জীবনটা-ই অন্ধকার, তার এই সামান্য আঁধারে ভয় থাকে না, জনাব। মানুষ যেটাকেই ভয় পাক না কেন, তার পেছনে একটা কারণ থাকে। সেটা হলো মৃত্যু। মানুষ মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচতেই ভয়কে মনে পোষে। যার বেঁচে থাকার কোনো বাসনা থাকে না, তার কাছে এসব ভয় নিছক ও অবান্তর।

প্রণব অবাক চোখে স্পৃহার দিকে তাকালো। আবছা আলোয় স্পৃহার মলিন শুকনো মুখটার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। স্পৃহার যুক্তির প্রতিটা শব্দের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারছে ও। ভেবেই ভ্রু বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভাবে হেসে বললো,

-এ জন্যই আপনি একটু আগে সুইসাইড করতে চাইছিলেন?

স্পৃহা বিরক্তি নিয়ে বললো,

-আমি কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সুইসাইড করতে চাইছিলাম না। তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে কেউ সুইসাইড করে না।

বলেই গটগট করে চলে গেল। সবার মাঝে থাকতে বিরক্ত লাগছিল বলেই একটু ছাদে এসেছিল স্পৃহা একা কিছুক্ষণ থাকার জন্য। কিন্তু এখানেও এসে একটু নিরিবিলি প্রকৃতিবিলাস করা সম্ভব হলো না।

প্রণব এখনো বোকার মতো তাকিয়ে আছে। পরমুহূর্তেই সবটা মাথায় আসতেই নিজের মাথায় নিজেই চাটি মেরে আপনমনে হাসলো। গিটার হাতে নিয়ে সুর টুংটাং তুললো। গলা ছেড়ে গাওয়ার চেয়ে এখন সুর তুলতেই ভালো লাগছে তার।
__________________________

স্পৃহার দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছে এখন। প্রান্তি সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থাকে ওর সাথে। এক মুহুর্তের জন্যও মন খারাপ করে থাকতে ধেয় না। স্পন্দন প্রতিদিন-ই দেখা করতে আসে বোনের সাথে। স্পৃহাকে কথা স্বাভাবিক ভাবে বলতে দেখে, ওর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেশ দেখে স্পন্দন মনে মনে একটু স্বস্তি পায়।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বসতেই প্রান্তি স্পৃহার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে এক্সাইটেড হয়ে বললো,

-পিহুউউউউ!!! তোর জন্য আজ জম্পেশ একটা সারপ্রাইজ আছে।

স্পৃহা বিছানায় পড়ে যেতে নিলেই নিজেকে সামলে চোখ বড়বড় করে তাকালো। হতভম্ব হয়ে বললো,

-সারপ্রাইজ? কী সারপ্রাইজ?

-চল! চল!! বাইরে যাই। ওখানে গেলেই দেখতে পাবি।

বলেই প্রান্তি ওর হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। বাগানে যেতেই সামনে তাকিয়ে স্পৃহার চক্ষু চড়কগাছ!

-স্কুটি? তুই স্কুটি কিনেছিস?

স্পৃহা অবাক চোখে প্রান্তির দিকে তাকাতেই সে খুশিমনে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-এটা তোর জন্য, ইয়ার! তুই তো আগে এটা দিয়েই ভার্সিটি যাওয়া-আসা করতি! তাই আমি এটা তোর জন্য কিনেছি।আমরা দুজন এটা দিয়েই এখন থেকে ভার্সিটি যাবো, ইয়ার! আ’ম সো এক্সাইটেড!!

স্পৃহার চোখে পানি জমে উঠলো। সত্যিই স্কুটি ওর খুব পছন্দের। ভাবেনি কখনো যে, স্কুটি চালিয়ে আগের মতো চলাচল করার সুযোগ ওর কখনো হবে। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে স্কুটি টাতে হাত বুলিয়ে দিতেই উপর থেকে কারো কন্ঠস্বর ভেসে এলো,

-যাক! পছন্দ হয়েছে তাহলে। এটা নিয়েই টেনশনে ছিলাম।

স্পৃহা মাথা উঁচিয়ে উপরে তাকাতেই দেখলো, প্রণব ওর ঘরের বেলকনি দিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। উপর ছেড়ে চাবি ছুঁড়ে প্রান্তির হাতে দিয়ে প্রণব বললো,

-এখন এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে খেয়েদেয়ে ভার্সিটি যা আজ থেকে। পড়াশোনা তো ছেড়েই দিয়েছিস বোধ হয়!

বলেই হাই তুলতে তুলতে নিজের ঘরে চলে গেল প্রণব।

ব্রেকফাস্ট করে ভার্সিটির জন্য স্পৃহাকে জোর করে রেডি করিয়ে দিলো প্রান্তি। মিস্টার চৌধুরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো দুজন। স্পৃহা স্কুটির সামনে বসলে প্রান্তিও পেছনে বসে পড়লো। স্পৃহা চোখে মুখে আনন্দ ফুটিয়ে পাড়ি জমালো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রণব সেই দৃশ্য দেখে বাঁকা হাসলো।
____________________

হসপিটালে মিসেস মেহরীনের চেম্বারে বসে আছে স্পৃহা আর প্রান্তি। তিনি বেশ কয়েকটা মেডিক্যাল টেস্ট করিয়েছেন স্পৃহার। চোখের চশমাটা খুলে নিয়ে তিনি বললেন,

-রিপোর্ট না দেখে আমি কিছু বলতে পারছি না। ইন ফ্যাক্ট, বলতে চাইছি না। তবে তোমার ফিজিক্যাল কন্ডিশন আগের থেকে অনেকটা ইম্প্রুভড্ হয়েছে। অ্যানিমিয়া নিয়ে যেই ভয়টা ছিল, সেটা আর নেই।

প্রান্তি ব্যস্ত হয়ে বললো,

-মা, তাহলে এখন কী করা উচিত?

-যেমন চলছে, চলতে থাক! রিপোর্ট রেডি হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

স্পৃহা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সম্মতি জানালো। এসব নিয়ে আর কোনো আশা ওর মনে নেই। ঘুরেফিরে ভাগ্যে শুন্য ছাড়া কিছু মিলবে না!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। স্পৃহা আর প্রান্তি ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়িং রুমে তাকিয়ে চমকে গেল। সোফায় আনিলা বসে আছে আর তার পাশেই চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা। আনিলা এতো দিন পর হঠাৎ এখানে কেন এলো? তার মানে তো আহিরও এসেছে! কিন্তু আহিরকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না! ভেতরে গিয়েছে নাকি? হয় তো স্পৃহার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! ভেবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল স্পৃহা। আনিলা সেটা লক্ষ করে বললো,

-আহিরকে খুঁজছো?

এমন প্রশ্ন শুনে স্পৃহা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। পরমুহূর্তেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

-প্রতারকদের খোঁজার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। যারা কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না, তাদের মুখদর্শনও করতে চাই না আমি।

# চলবে……

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২০

-আহির আর বেঁচে নেই, স্পৃহা! এক সপ্তাহ আগেই মারা গেছে সে।

কথাটা কর্ণকুহরে যেন ঝংকার দিয়ে উঠলো। ধপাধপ এগিয়ে চলা পা দুটো মুহূর্তে-ই থেমে গেল। প্রতিটি শিরা-উপশিরায় বয়ে চলা রক্তপ্রবাহ থমকে গেল স্পৃহার। বিস্ফোরিত চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আনিলার মুখের ওপর। তার মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু একটি বাক্যই বিরাজ করছে, যা বারবার শ্রবণেন্দ্রিয়তে ধ্বনিত হচ্ছে- “আহির আর বেঁচে নেই!” এটা আদৌ সম্ভব? স্পৃহা কম্পিত কণ্ঠে বললো,

-ম্ মিথ্যে বলছেন আপনি? আপনি না আহিরের ওয়াইফ! ওনার ব্যাপারে এ ধরনের মিথ্যে কীভাবে বলছেন?

আনিলা চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস ফেললো। সেই বদ্ধ চোখের কোল ছাপিয়ে তার অজান্তেই দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হাঁটুর কাছে আনিলার জামা আঁকড়ে টেনে আশফি উত্তেজিত হয়ে স্পৃহাকে দেখিয়ে বললো,

-মাম্মা! মাম্মা!! এটা ঐ আন্টিটা না যার ছবি পাপার ঘরে বাঁধিয়ে রাখা আছে? পাপা সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতো ছবিটার দিকে! তাই না, মাম্মা?

আনিলা মাথা নিচু করে আশফির দিকে জলসিক্ত চাহনিতে তাকায়। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায় সে। উত্তরে আশফি উৎফুল্ল হয়ে একটা হাসি দিলো। এক ছুটে স্পৃহার সামনে গিয়ে ওর হাত ধরে আনন্দিত কন্ঠে বললো,

-তুমিই তাহলে আমার কিউট মাম্মা, তাই না?

স্পৃহা প্রশ্নসূচক চাহনি নিক্ষেপ করলো আনিলার দিকে। ওর মাথায় সব কিছু এখন জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। তাই আশফির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। ওর গালে হাত রেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-কিউট মাম্মা মানে?

আশফি খিলখিলিয়ে হেসে বললো,

-ওহ গড! তুমি জানো না? পাপা ঠিকই বলতো! তুমি আসলেই বোকা। আরে পাপা-ই তো আমাকে বলেছিল যে, তুমি আমার আরেক মাম্মা। আমার কিউট মাম্মা!

-‘বলেছিল’ মানে? তোমার পাপা এখন কোথায়?

আফশি গাল ফুলিয়ে বললো,

-জানি না তো! পাপা লাস্ট আমাকে বলেছিল, তিনি আমার থেকে দূরে চলে যাবে। শুধু আমার সাথে স্বপ্নে-ই দেখা করবে। কিন্তু জানো? পাপা না এখন আমার স্বপ্নেও আসে না! পাপা বলতো, “আই এ্যাম অলওয়েজ দেয়ার ফর মাই চ্যাম্প!” কিন্তু এখন আমার মনে হয়, “হি ইজ নো-হোয়্যার ফর মি!” আমি আর পাপার সাথে কথা-ই বলবো না! পাপা ফিরে এলে অনেক রাগ দেখাবো, হুম।

আশফির অভিমানী সুরে বলা কথাগুলো স্পৃহাকে সম্পূর্ণভাবে অসার করে তুললো। ও চোখ ঘুরিয়ে আনিলার দিকে অপলক তাকিয়ে বললো,

-ও এসব কী বলছে? আহির কোথায়?

আনিলা নিজের ভেজা গাল দুটো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো। নাক টেনে নিজেকে ধাতস্থ করে স্পৃহার দিকে এগিয়ে গেলো। নিজের ব্যাগ থেকে অতি যত্নে একটা খাম বের করে স্পৃহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-আজ বিকেলে দেশে ফিরেছি আমি। এই লেটারটা তোমায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডিরেক্ট এখানে এসেছি। এটাতেই তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।

স্পৃহা চিঠিটার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা নিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ সেটার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরলো। সাদা জমিনে ছোট ছোট কালো বর্ণের শব্দের সমাহার চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্পৃহার,

“প্রিয়,
সম্বোধন শুনে রাগ করেছো নিশ্চয়ই? কিন্তু তোমার প্রতি এই সম্বোধন-টাই ব্যবহার করে অভ্যস্ত আমি। তাই একটু তিক্ত অনুভূতি নিয়েই সহ্য করে নাও না-হয়! আর হ্যাঁ, সবসময় তুইতোকারি করে ডাকলেও আজ তুমি করে বলছি। কারণটা না-হয় একটু পরেই বলি।

আজ তোমাকে নিজের কৃতকর্মের খোলাখুলি স্বীকারোক্তি দিতে চলেছি আমি। কখনো ভাবিনি কথাগুলো নিজে থেকেই জানাতে হবে তোমায়! সত্যিই ভাবিনি। এধরণের কিছু ঘটার ভয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকতাম। কারণ আমি চাইতাম না তুমি জানো সবটা। সত্যটা আড়াল করার জন্যই তোমার থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে চলে এসেছি। আমি চেয়েছিলাম যে, তুমি আমায় আজীবন ঘৃণা করো। ঘৃণার আড়ালে চাপা পড়ে থাকুক তোমার জীবনে ‘আহির’ নামক অধ্যায়টা। কিন্তু সত্যকে কখনো ঢেকে রাখা যায় না। আমিও পারলাম না। পরিস্থিতি আজ এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করালো যে, সবটা নিজেকেই স্বীকার করে নিতে হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় সত্যিটা কী জানো? সত্যিটা হলো আমি তোমাকেই ভালোবাসি, স্পৃহা। পৃথিবীর আলো দেখার সাথে সাথেই আমি মা-হারা হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে বুকে আঁকড়ে নিয়েই বাবা বেঁচে ছিলেন। তার হাতেই আমি মানুষ হয়েছি। কিন্তু কৈশোরে পদার্পণ করতেই বাবাও আমায় একা করে দিয়ে চলে গেলেন। নামের আগে ‘অনাথ’ শব্দটা যুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু বাবা আমার পুরো ভবিষ্যৎটাই গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেজন্য আমায় কোনো সংকটে পড়তে হয়নি। কিন্তু তখন আমার একাকিত্বের সময় আমায় সাপোর্ট দেওয়ার মতো কেউ ছিল না! আমি একটা পনের বছর বয়সী ছেলে, যার আপন বলতে পুরো পৃথিবীতে কেউই ছিল না। ভাবতে পারো সেই সময়টা আমার জীবনের কতো দূর্বিষহ সময় ছিল? কিন্তু সেসময় আমাকে কেউ একজন নিজের বুকে আগলে নিয়েছিল। আমার পরিবারের অভাব পূরণ করেছিল। ওর জন্যই আমি পৃথিবীতে টিকে আছি। সেই ব্যক্তিটা আনিলার হাসবেন্ড আর আশফির জেনেটিক বাবা আয়াফ। অবাক করার বিষয় হলেও এটাই সত্যি।

আয়াফ আনিলাকে বিয়ে করেছিল ছয় বছর আগেই। তখন আমি, আয়াফ আর স্পন্দন তিনজনই ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম। দিনকাল বেশ ভালোই চলছিল তখন। কিন্তু বিয়ের ছয়-সাত মাস পর-ই সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল। আমি তখন হলে থাকতাম। আনিলা নিজের বাবার বাসায় গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। তখন ও অন্তঃসত্তা ছিল। একদিন রাতের বেলা আমার ফোনে আয়াফের কল আসে। আমি ফোন রিসিভ করতেই ওর কাতরানো কন্ঠ শুনতে পাই,

‘ আ… আমি চ্ চলে যাচ্ছি, আহির। হয়তো আর বাঁচবো না। তুই শুধু আনিলা আর আমার বাচ্চাটাকে দেখে রাখিস। ওদের খেয়াল রাখিস। তোকে যেমন আমার বাবা মা পরিবারের অভাব বুঝতে দেয়নি, তুইও আমার বাচ্চাটাকে বাবার অভাব বুঝতে দিস না। ভালো থাকিস। ‘

এটাই ছিল ওর সাথে আমার শেষ কথা। সেদিন আয়াফ ওর বাবা-মাকে নিয়ে গ্রামে যাচ্ছিলো। কিন্তু রাস্তায় কার-এক্সিডেন্টে তারা তিনজনই মারা যায়। আয়াফ শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার আগে আমায় ফোন দিয়েছিল। হয়তো ও বুঝতে পেরেছিল ও আর বাঁচবে না, যেমনটা আমি বুঝতে পারছি!

সে যাইহোক, আয়াফের মৃত্যুর পর আনিলা একদমই ভেঙে পড়েছিল। আমি আর স্পন্দন ওকে সাপোর্ট দিয়ে আসছিলাম। এরপর আশফি পৃথিবীতে এলো। আশফি ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলে আমিই ওকে পাপা ডাক শেখাই। আনিলা নিষেধ করেছিলো। কিন্তু আমি আশফিকে বাবার অভাব বুঝতে না দেওয়ার জন্য সব চেষ্টা করেছি। আসলে যার কারণে নতুন জীবন পেয়েছি, তাকে দেওয়া কথা রাখতে পারবো না- এতোটা স্বার্থপর হতে পারিনি আমি। সেই সময়ে আমি তোমাকে ভালোবাসতাম আর আমার বিশ্বাস ছিল, তুমি সবটা জানার পর কখনো বাঁধা দেবে না। স্পন্দনও সবটা শুনে আশ্বাস দিয়েছিল যে, কোনো সমস্যা হবে না।

এরপর তুমি ভার্সিটিতে এসে ভর্তি হলে। তখন আমি লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি মাত্র। আশফির তখন তিন বছর বয়স। স্পন্দনকে না জানিয়েই তোমায় ‘ভালোবাসি’ বলেছিলাম। কিন্তু তুমি আমায় টানা একবছর ঘুরিয়ে নিজের মনের কথা বলেছিলে। আমি তোমায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সবসময় তোমার পাশে থাকবো। কিন্তু আলটিমেটলি আমি কারো প্রতিশ্রুতি-ই রাখতে পারিনি। না তোমার, না আয়াফের। সেদিন রাতেই হুট করে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। নাক আর মুখ দিয়ে প্রচন্ড ব্লিডিং হচ্ছিল। এর আগেও এরকম হয়েছিল, কিন্তু তেমন একটা গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু সেদিন রক্ত পড়া বন্ধই হচ্ছিল না! আনিলা আমার বাসায় এসে হসপিটালে নিয়ে যায়। সেদিন-ই জানতে পারি যে, আমার বাবাকে যে রোগটা কেড়ে নিয়েছে, সেই একই রোগ আমাকেও পৃথিবী থেকে কেড়ে নিতে চলেছে। সেসব কথা না-হয় না-ই বলি। ডক্টর বলেছিল, আমার ইম্প্রুভমেন্টের সম্ভাবনা তেমন নেই। তখন প্রচন্ড আক্ষেপ হচ্ছিল। কেন তোমাকে নিজের এই মুমূর্ষু জীবনটার সাথে জড়িয়েছিলাম?

এরপর তোমাকে নিজের থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলাম, যেটার জন্য এখন আক্ষেপ হচ্ছে। তখন তোমাকে সবটা জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম। তুমি সহ্য করতে পারবে তো! নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেলবে না তো? অনেক ভালোবাসতে যে আমায়! সেই ভয়ে কাউকে কিছু জানাতে পারিনি। শুধু আনিলা জানতো। ওকে অনেক রিকোয়েস্ট করে বিয়েতে রাজি করিয়েছি আমি। স্পন্দনও অবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওকে আশফির ভবিষ্যতের কথা বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। ও জানতো না যে, তুমিও আমাকে ভালোবাসো। অবশেষে হাতে-কলমে সেই নামমাত্র বিয়েটা হয়েছিল। এরপর যা যা হয়েছে, সবকিছু তোমাকে দেখানোর জন্য। যেন তুমি আমাকে ভুলে, ঘৃণা করে, মুভ অন করো। করেও ফেলেছিলে তুমি। বিয়ে করেছিলে আদ্রকে। বুকের ভেতর হাজারো দহন নিয়েও সেদিন খুব খুশি হয়েছিলাম।

কিন্তু ভাবতেও পারিনি আদ্র তোমার হাত ছেড়ে দেবে। কানাডা চলে আসার পর রোজ স্পন্দনের কাছ থেকে তোমার খোঁজ নিতাম। তুমি মা হতে চলেছ শুনে মনে অনেক শান্তি পেয়েছিলাম এটা ভেবে যে, তুমি সুখে আছো। কিন্তু তোমার বেবি মিসক্যারেজ হয়ে গেছে শুনে আমার পৃথিবী-টাই অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল ছুটে যাই তোমার কাছে। কিন্তু সেটা তো এতো সহজে সম্ভব নয়! কারণ একমাস যাবৎ আমি চলৎশক্তিহীন। হুইলচেয়ার-ই আমার চলার একমাত্র অবলম্বন। হয়তো আমার সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়। তিনদিন পর আমার বাংলাদেশ যাওয়ার ফ্লাইট। জানি না ফিরে যেতে পারবো কিনা! তবে শেষ বারের মতো তোমায় একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। হয়তো সেটা আর পুরন হবে না।

আজ আমি বুঝতে পারছি, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমার কাছ থেকে সবটা লুকানো। তোমায় সবটা জানিয়ে দিলে হয়তো এমন একটা দিন দেখতে হতো না! না আদ্রের কাছে তোমায় ঠকতে হতো আর না এতো কষ্ট পেতে হতো। তাই আজ নিজেই সবটা তোমার কাছে বলে দিলাম। কারণ সবটা না জানলে তুমি চিরদিন এটা ভেবে কষ্ট পাবে যে, তুমি দু-দুটো পুরুষের দ্বারা প্রতারিত হয়েছো!

সত্যি তো এটাই যে, আমার ভালোবাসায় একটুও খাঁদ ছিল না। তুমিও আমায় অনেক ভালোবাসতে। কিন্তু ভাগ্য বলেও কিছু একটা আছে যেটা চায় না, তোমার সাথে আমার মিল হোক। হয়তো আমরা একে-অপরের জন্য পৃথিবীতে আসিনি! আমি এসেছিলাম একাকিত্বকে সঙ্গী করে, আবার চলে যাচ্ছি একা হয়েই। তবে আমার শেষ ইচ্ছে আর প্রার্থনা একটাই – তোমার জীবনের সব দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটিয়ে এক_মুঠো_প্রেমের আগমন ঘটুক, যেটার কাছে পৃথিবীর সকল ভালোবাসা ফিকে পড়ে যায়। আর আমার বিশ্বাস, আল্লাহ কাউকে নিরাশ করেন না।

ভালো থেকো। তুমি কাঁদলে কিন্তু আমি অনেক কষ্ট পাবো। কখনো আমার কথা ভেবে চোখের পানি ফেলো না। অনুরোধ রইলো। বিদায়।

-তোমার অপ্রিয়”

তিন পাতার চিঠিটা থেকে চোখ তুলে সামনে তাকালো স্পৃহা। চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে ওর। পলক ফেলতেই চোখে গড়িয়ে পড়লো টসটসে জলকণা। চিঠিটাও হাত গলিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেল। স্পৃহা নিজেও ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে। কান্নার তোড়ে শ্বাস রোধ হয়ে আসছে ওর। মুখে হাত চেপে ধরে শব্দ করেই কেঁদে দিলো সে। চিৎকার করে বললো,

-কেন করলে আমার সাথে এমনটা? কেন? কেন?

স্পৃহাকে এভাবে কাঁদতে দেখে প্রান্তি দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো। আনিলার চোখ দুটোও পানিতে ভরে উঠেছে। স্পৃহা আজ অঝোর ধারায় কাঁদছে। কান্না যেন থামতেই চাইছে না! কিন্তু বেশিক্ষণ কান্না স্থায়ী হলো না। হাঁটু মুড়ে বসা অবস্থায়-ই মাথা ঘুরিয়ে উঠলো ওর। ঢলে পড়লো মাটিতে। কিন্তু ফ্লোরে পড়ার আগেই কেউ বাহুডোরে আগলে নিয়ে নিজের বুকে আশ্রয় করে দিলো স্পৃহাকে।

# চলবে……

[রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]