এক মুঠো প্রেম পর্ব-২৫+২৬

0
402

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২৫

ঘুম একটু হালকা হয়ে আসতেই নিজেকে কোনো পুরুষ অবয়বের সংস্পর্শে অনুভব করলো স্পৃহা। নাকে ভেসে এলো অপরিচিত একটা স্মেল। ধীর গতিতে চোখ মেলে তাকাতেই কুয়াশায় ঘোলাটে একটা পরিবেশ চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। বিস্তৃত শস্য ক্ষেতের একপ্রান্তে ঘুমঘুম চোখে কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট প্রকৃতি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। প্রণবের কাঁধ থেকে মাথা তুলে সামনে একবার চোখ বুলিয়ে পাশে তাকাতেই চমকে গেল স্পৃহা। প্রণবের বাহুতে জড়িয়ে রাখা হাত দুটো সাথে সাথেই সরিয়ে ঝড়ের গতিতে তার থেকে সরে বসলো সে।

স্পৃহা সরে বসতেই প্রণবের ঘুমটাও হালকা হয়ে গেল। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই নিজের থেকে কিছুটা দূরে স্পৃহাকে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখলো সে।

প্রণবের দৃষ্টি নিজের ওপর পড়তে দেখে স্পৃহা আরো গুটিয়ে গেল। শালটা গায়ে মুড়িয়ে নিতে গিয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। শালের ওপর দিয়ে একটা জ্যাকেট গায়ে জড়ানো ওর। ভ্রু কুঁচকে প্রণবের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো, ওর গায়ে শুধু ফুল-স্লিভের একটা কালো টি-শার্ট। স্পৃহা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-আপনার জ্যাকেট আমার গায়ে কী করে এলো?

প্রণব উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

-রাতে অনেক শীত পড়েছিল। আপনি বারবার গুটিয়ে যাচ্ছিলেন।

-তাই বলে আপনার জ্যাকেট আমার গায়ে জড়িয়ে দিবেন? আপনার ঠান্ডা লাগেনি?

প্রণব নিজের ঠোঁট বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। স্পৃহার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,

-সবারই নিজের কিছু নিজস্ব ও একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ থাকে, মিসেস নিস্তব্ধতা। সেই সম্পদটার প্রায়োরিটি নিজের জীবনের থেকেও বেশি হয়। আর সেটাকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখার মধ্যেই থাকে প্রশান্তি ও স্বার্থকতা।

স্পৃহা এমন কথার কোনো অর্থ উপলব্ধি না করে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রণবের দিকে। কথার পৃষ্ঠে বলার মতো কিছু না পেয়ে স্পৃহা বললো,

-আপনি ভারী অদ্ভুত একটা ব্যক্তি। কথার মাঝে রহস্য লুকিয়ে রাখাটা আপনার বেশি পছন্দ।

প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বললো,

-মে বি ইউ আর রাইট। আমি নিজেও নিজের সম্পর্কে ভালো মতো জানি না একচুয়েলি!

স্পৃহা আর কথা বাড়ালো না। জ্যাকেটটা গা থেকে সরাতে নিলেই প্রণব বলে উঠলো,

-ওটা পরে থাকুন। খোলার দরকার নেই।

-কিন্তু আপনার তো…

প্রণব কন্ঠে কাঠিন্যতা মিশিয়ে বললো,

-আমায় নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। নিজের কথা ভাবুন। সকালের এই ঠান্ডা বাতাস এই মুহূর্তে আপনার জন্য একদমই ভালো নয়।

স্পৃহা বাধ্য হয়ে জ্যাকেটটা আর খুললো না। বরং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-আপনি রাতে আমার পাশে বসেছিলেন কেন? আপনি তো আমার অপজিটে ছিলেন!

প্রণব খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

-আপনার পাশে দুরত্ব বজায় রেখেই বসেছিলাম। সারারাত পাহারা দিয়েছি আমি। আপনি তো আরাম করে ঘুমচ্ছিলেন!

স্পৃহা অবাক হয়ে বললো,

-আপনি সারারাত ঘুমোননি?

-রাতে চন্দ্র বিলাস করছিলাম। থালার মতো গোলাকার চাঁদটা তার সমস্ত আলো ও উজ্জ্বলতা দিয়ে আমায় এমনভাবে মোহিত করে ফেলেছিল যে, আমার ঘুম-ই আসেনি। কিন্তু ভোরে চোখ লেগে গিয়েছিল আর কি!

-কিন্তু গতরাতে তো পূর্ণিমা ছিল না! আপনি চাঁদ কোথায় পেলেন বলুন তো?

প্রণব কথা ঘোরাতে বললো,

-সেটা আপনি বুঝবেন না। চলুন, গাড়ির কাছে যাই। রাতে বাড়ি ফিরিনি আমরা। কেউ আমাদের খোঁজে এলে ঐ গাড়ির পাশেই দাঁড়াবে।

বলেই গিটারটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা দিলো প্রণব। স্পৃহাও আর কথা না বাড়িয়ে ওর পিছু পিছু পা বাড়ালো।

গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছুতেই ওরা দেখতে পেল, ওদের গাড়ির পাশে আরেকটা গাড়ি পার্ক করা। প্রণব এগিয়ে গিয়ে দেখলো, এটা ওদেরই গাড়ি। কারণ ওর ড্রাইভার গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। প্রণব তার কাছাকাছি গিয়ে গলা ঝেড়ে শব্দ করতেই ড্রাইভার চমকে গিয়ে হাতের সিগারেটটা ফেলে দিলো। ড্রাইভার জোরপূর্বক হেসে প্রণবকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই প্রণব থমথমে গলায় বললো,

-এই ঠান্ডায়ও নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে পরিবেশ দূষণ করছেন!

ড্রাইভার আমতা আমতা করে বললো,

-স্যার, ঐ আর কি আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম। প্রান্তি ম্যাম বললো, আপনারা নাকি রাতে বাড়ি ফেরেন নি! তাই এই রাস্তায় খোঁজ নিয়ে দেখতে। এই গাড়ি দেখে বুঝলাম, আপনারা আশেপাশেই আছেন। তাই ……

-আর এক্সপ্লেইন করতে হবে না। চলুন। আর এই গাড়িটার চাকা চেঞ্জ করে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।

বলেই ড্রাইভারের পাশের সিটে গিয়ে বসলো প্রণব। স্পৃহাও ব্যাক সিটে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো।

প্রণব আর স্পৃহাকে একসাথে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে প্রান্তি ডায়নিং টেবিল ছেড়ে এগিয়ে এলো। প্রণব প্রান্তিকে উদ্দেশ্য করে স্পৃহাকে দেখিয়ে বললো,

-ওকে ব্রেকফাস্ট করানোর ব্যবস্থা কর। গতরাতে মেডিসিন নেওয়া হয়নি। আজ যেন কোনো অনিয়ম না হয়।

বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করেই সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল। স্পৃহা ঈষৎ থমকানো চোখে তাকালো প্রণবের যাওয়ার পানে। ডায়নিং টেবিলে বসে মিস্টার চৌধুরী আর আনিলা সবটাই স্পষ্ট দেখতে ও শুনতে পাচ্ছিলো। ছেলের কথা ও কর্মকাণ্ড দেখে তার চোখে মুখে প্রসন্নের হাসি খেলে গেল। কিন্তু ওপর দিয়ে সেটা তেমন ভাবে প্রকাশ করলো না।

প্রান্তি স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,

-তুই ঠিক আছিস?

স্পৃহা চোখ সরিয়ে প্রান্তির দিকে তাকিয়ে বললো,

-ফ্রেশ হয়ে আসছি।

বলেই স্পৃহা নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। প্রান্তি অবাক চোখে তাকালো ওর এমন স্বাভাবিক আচরণ দেখে। ওর ভাই কীভাবে স্পৃহাকে এমন স্বাভাবিক করে দিলো।

আনিলা এতোক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। প্রণবের আদেশ অনুযায়ী সে এখন এ বাড়িতেই থাকে। চলে যেতে চাইলেও প্রণবের কাঠিন্য ও রাগী দৃষ্টি দেখে আর সাহস পায়নি।

আনিলা প্রান্তির পাশে এসে দাঁড়িয়ে অবাক কন্ঠে বললো,

-স্পৃহা আর প্রণব রাতে বাড়ির বাইরে ছিল?

-হুম!

আনিলা চোখ বড়বড় করে তাকালো। বিষয়টা কোনোভাবেই হজম হচ্ছে না ওর। অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-একসাথে ছিল সারা রাত?

প্রান্তি চোখ ছোট ছোট করে বললো,

-তুমি যা ভাবছো, তেমন কিছুই না! ভাইয়ার গাড়িটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই ফিরতে পারেনি তারা।

আনিলা মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে বললো,

-প্রণবকে আমি বেশ ভালো করেই চিনি ও জানি। ও যেমনটা ভাবছে, তেমনটা কখনোই সম্ভব নয়।

প্রান্তিও ওর কথায় সায় দিয়ে আনমনে বললো,

-আমার ভয়টাও এখানেই!!
_________________________

অফিস থেকে সবে মাত্র বাড়ি ফিরে এসেছে আদ্র। মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে দিনদিন তার। অফিসের এমপ্লয়িদের সাথেও আজ অনেক চেচামেচি ও বকাঝকা করে এসেছে সে। বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসতেই মিসেস সামায়রাকে ঘরের ভেতর দেখতে পেল আদ্র। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-কিছু বলবে, মা?

মিসেস সামায়রা হাতে থাকা কাগজ গুলো থেকে চোখ সরিয়ে আদ্রের দিকে তাকালেন। মুখ কালো করে বললেন,

-কিছু তো বলার নেই! তোর দরকারেই এসেছিলাম।

-আমার দরকার মানে?

মিসেস সামায়রা হাতে থাকা কাগজ গুলো আদ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-এখানে বেশ কয়েকটা মেয়ের ছবি আর বায়োডাটা আছে। ঘটক দিয়ে গেল আজ। দেখ, তোর কাকে পছন্দ হয়।

আদ্র কাগজগুলো হাত বাড়িয়ে নিতেই মিসেস সামায়রা চলে গেলেন। আদ্র বিছানায় বসে সবগুলো ছবি দেখলো। কেন যেন এসবে বিরক্ত লাগছে তার! ছবি গুলো দেখতেও অসহ্যকর একটা অনুভূতি হচ্ছে। কাগজ গুলো ঘাটাঘাটি করে সবকিছু হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিলো। রাগ লাগছে এখন। ইদানীং অকারণেই মেজাজ বিগড়ে যায় আদ্রের।

কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদ্র। ফোনটা হাতে নিয়ে প্রণবের নাম্বারে ডায়াল করলো। প্রণব ফোন রিসিভ করে বললো,

-এতো রাতে ফোন দিলি যে? এনি প্রব্লেম?

-কাল দেখা করতে পারবি?

প্রণব খানিকটা অবাক হয়ে বললো,

-কাল? হঠাৎ দেখা করতে চাইছিস কেন?

আদ্র শান্ত গলায় বললো,

-কাল দেখা করার পর বলি?

-আচ্ছা। কাল বাসায় আয় তাহলে।

আদ্র আপত্তি দেখিয়ে বললো,

-বাসায় না। অন্য কোথাও।

-আচ্ছা, তাহলে আমি তোকে কাল জানাবো কোথায় দেখা করবি।

আদ্র সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখলো। অন্য দিকে, প্রণব ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, আদ্র হঠাৎ তাকে দেখা করতে কেন বললো?

# চলবে…….

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২৬

-কাল সারারাত পিহুকে নিজের সাথে কেন রাখলি, ভাইয়া?

প্রণব বিছানায় বসে হাই তুলে ছোট ছোট চোখে সামনে তাকাতেই দেখলো, প্রান্তি আর আনিলা ওর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবে মাত্র ঘুম ভেঙেছে প্রণবের। তাই বিরক্তি নিয়ে বললো,

-সকাল সকাল কী শুরু করলি তোরা? এমনিতেই একরাত ঘুমোতে পারিনি!

আনিলা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-তোরা সারারাত না ঘুমিয়ে থেকেছিস? কী করেছিস সারারাত?

প্রান্তি সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,

-অনাথসনাথ কিছু করিসনি তো তোরা? আমি তো রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি!

কথাটা বলেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে জিভ কাটলো প্রান্তি। এটা কী বলে ফেলেছে সে? বাঁ চোখটা সামান্য খুলে তাকাতেই দেখলো, প্রণব রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সেটা দেখে প্রান্তি জোরপূর্বক ঠোঁট টেনে হাসলো। কিন্তু হাসি বারবার মিলিয়ে যাচ্ছে ওর। প্রণব গাঢ় গলায় বললো,

-ভুলে যাস না আমি তোর বড় ভাই! আর সারারাত আমি একাই জেগে ছিলাম। স্পৃহা ঘুমোচ্ছিলো, তাই।

আনিলা আমতা আমতা করে বললো,

-তুই বসে বসে ওকে পাহারা দিচ্ছিলি নাকি?

-তোরা কি আমায় সন্দেহ করছিস নাকি? সন্দেহ করেও লাভ নেই, ডিয়ার্স! স্পৃহার ভাষ্যমতে, আমি ওর ভাইয়ের মতো।

এমন কথা শুনে প্রান্তি আর আনিলা চোখ বড়বড় করে তাকালো। প্রণব ওদের দিকে আড়চোখে তাকাতেই প্রান্তি আর আনিলা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিটকিটিয়ে হেসে দেয়। প্রণবও ঠোঁট বাঁকিয়ে হালকা হাসলো।

-ওকে এভাবে একটু দুশ্চিন্তায় ফেলাটা দরকার ছিল। আহিরের মৃত্যুর খবর শুনে কেমন থম মেরে গিয়েছিল, দেখিসনি? ওর চুপ হয়ে যাওয়াটা-ই সবচেয়ে বেশি খারাপ ইফেক্ট ফেলত। তাই এমন একটা পরিস্থিতিতে ওকে ফেলেছিলাম, যেন ও নিজে থেকেই কথা বলে, প্রশ্ন করে, আগ্রহ দেখায়। আই থিংক, আমি সফলও হয়েছি।

আনিলা এবার কৌতূহলী গলায় বললো,

-তুই স্পৃহাকে নিয়ে এতো ভাবছিস কেন বল তো?

প্রণব শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলো। রহস্য মিশ্রিত সেই হাসির আড়াল থেকে একটা বাক্যই ভেসে এলো,

-সব প্রশ্নের উত্তরই দিবো, কিন্তু সঠিক সময়ে সবটা প্রকাশ পাবে; তার আগে নয়!!!
___________________________

সকালের কুয়াশার চাদর ভেদ করে প্রকৃতির বুকে আছড়ে পড়ছে ফালি ফালি মিষ্টি রোদ। ঘোলাটে পরিবেশ ঘিরে ছড়িয়ে পড়ছে হালকা তপ্ততার আমেজ। গাছের পাতা ও ফুলের গায়ে চকচক করছে শিশিরের গোলাকৃতির কণা গুলো। সেই মোহনীয় বিন্দু গুলোর সৌন্দর্যের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে স্পৃহা। ছাদের এক কোণায় বসে বসে অদূরে সাজিয়ে রাখা ফুলের টবগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ তার। স্পৃহার ঠিক বিপরীত পাশে বসেই ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকার ওপর চোখ বুলাচ্ছেন মিস্টার চৌধুরী। স্পৃহা নিজ থেকেই ছাদে এসে তার পাশে বসেছে। নীরবতা ভেঙে সে বললো,

-আজ আপনি অফিসে যাবেন না, আংকেল?

মিস্টার চৌধুরী পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে তাকালেন। কফির মগে শেষ চুমুক বসিয়ে সেটা টেবিলের ওপর রাখলেন। পত্রিকা ভাজ করতে করতে অমায়িক হেসে বললেন,

-আমার মায়ের আজ ছেলের সাথে আড্ডা দেওয়ার শখ জেগেছে মনে হচ্ছে!!

স্পৃহা ঠোঁট টেনে নিঃশব্দে হেসে বললো,

-না, তেমন কিছু না। আপনি একা একা বসে আছেন যে! তাই জিজ্ঞেস করলাম।

-এই বুড়ো বয়সে কী আর কাজকর্মে মন বসে? তার ওপর একাকিত্ব তো আছেই!! প্রান্তি ছাড়া সারাদিনে নিজের সাথে কথা বলার মতো একজন মানুষও পাই না আমি।

স্পৃহাও বিষয়টা খেয়াল করেছে। নিজের আগ্রহ দমিয়ে না রেখে তাই প্রশ্ন করেই বসলো সে,

-কেন এমনটা হলো, আংকেল? আপনার কাছের মানুষ গুলো কেন আপনার পাশে থেকেও নেই?

মিস্টার চৌধুরী স্পৃহার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন,

-নিজের জীবন থেকে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছ তুমি! কাছের মানুষ কাছে থেকেও কীভাবে পর হয়ে যায়, সেই বিষয়ে তোমার ধারণা আমার থেকে বেশি থাকার কথা।

স্পৃহা একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে বললো,

-আমার জীবনের মতো জটিল তো আর আপনার জীবন নয়, আংকেল! আপনারা সবাই খুব ভালো। তবুও বিচ্ছিন্ন হয়ে কেন থাকেন, সেটাই জানতে চাইছি আমি।

মিস্টার চৌধুরী চোখ থেকে ভারী চশমাটা সরালেন। স্পৃহা আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে মিস্টার চৌধুরী বললেন,

-আমি এককালে পাগলা প্রেমিক ছিলাম, জানো? নিজের বউকে মন-প্রাণ উজার করে ভালোবাসবো বলে বিয়ের আগে কোনো নারীর প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি করা থেকে বরাবরই সংযত ছিলাম। ভালোবাসা নামক বস্তুটাকে নিজেকে হৃদস্থলে বাক্সবন্দী করে রেখেছিলাম, যেন সেটা খুলে শুধু নিজের প্রিয় মানবী-টাকেই দেখাতে পারি। কিন্তু সত্যি ও বাস্তবতার নিষ্ঠুরতার সাথে এসবের সম্পর্ক সমানুপাতিক। ভালোবাসার পরিমাণ যত বেশি হবে, ভাগ্যের পরিহাসও নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম হবে। আমিও সেই সেই নিষ্ঠুরতার অসহায় শিকার।

বলেই মিস্টার চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্পৃহা সবটা নীরবে শুনলো। কথাগুলো আসলেই সর্বাংশে যৌক্তিক। তাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো মিস্টার চৌধুরীর পরবর্তী কথা শোনার উদ্দেশ্যে,

-মেহরীনকে আমি নিজের সবটা দিয়েই ভালোবেসেছিলাম। আর সবশেষে ও-ই আমার সবটা কেড়ে নিয়েছে। কীভাবে কী হয়েছে, সেটা আমি বলতে চাই না! প্রণবের রাগের কারণ এটাই যে, আমি কেন ওর মাকে অবিশ্বাস করেছি। কিন্তু পরিস্থিতিটা তখন এইরকমই ছিল যে, না চাইলেও আমায় অবিশ্বাস করতে হয়েছিল। ওদেরও তো বোঝা উচিত ছিল, আমার অবস্থাটা। এতো কিছু সত্ত্বেও কেন আমি মেহরীনকে ডিভোর্স পেপার পাঠাতে পারিনি, সেটা ওদের মাথায় এলো না?

স্পৃহা অবাক চোখে তাকালো,

-আপনার আর আন্টির ডিভোর্স হয়নি? আপনার ডিভোর্স ছাড়াই সেপারেটেড?

মিস্টার চৌধুরী হাসলেন। হেসেই বললেন,

-পারিনি। অনেক বার চেষ্টা করেছি ডিভোর্স পেপারে সাইন করার। কিন্তু কলম ছুঁইয়েও নিজের নামটা লিখে দেওয়ার সক্ষমতা হয়নি আমার। সাইন করতে গেলেই ওর মায়াবী মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতো। কীভাবে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবো তার সাথে আমি? বড্ড ভালোবাসতাম যে! বলতে গেলে, আজও বাসি। আমার সন্তানের মা ও। ওকে দূরে ঠেলে দিলেও মন থেকে তো সরাতে পারিনি! আর তাই সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারিনি।

কথা গুলো শুনে স্পৃহার ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। সত্যিই ত্যাগ করাটা বড্ড কঠিন! কিন্তু আদ্র? তার কাছে তো এটা কঠিন কিছু ছিল না! কী অবলীলায়-ই না সে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল তাদের মধ্যকার পবিত্র সম্পর্কটাকে! একবারও কি তার বুক কাপে নি ডিভোর্স পেপারে সাইন করার সময়?
_______________________

-মিসেস নিস্তব্ধতা!!!

মেইনডোরের দিকে এগিয়ে যাওয়া পা দুটো থেমে গেল স্পৃহার। অদ্ভুত নামটা দিয়ে কে সম্বোধন করেছে আর কাকে সম্বোধন করেছে, সেটা বোঝার বাকি নেই তার। তাই আড়ালে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে। প্রণবকে সিড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,

-কিছু বলবেন?

-কোথাও যাচ্ছেন?

-হ্যাঁ, প্রান্তি তো আমাকে রেখেই চলে গেল বিকেলের ক্লাসে! তাই একাই যাচ্ছি।

-ওহ্! যান তাহলে। আমি তাহলে আনিলার কাছেই যাই।

বলেই প্রণব সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল। স্পৃহাও ব্যাগটা একবার চেক করতে করতে মেইনডোরের দিকে পা বাড়াতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। স্পৃহা খানিকটা চমকে উঠলো। পরমুহূর্তেই ভাবলো, সে নিজেও তো বাইরে যাচ্ছে। তাই দরজাটা তারই খুলে দেওয়া উচিত। ভেবেই দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো।

সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকে আবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই কপালের সুক্ষ্ম ভাজ গুলো মিলিয়ে গেল তার। দৃষ্টি হয়ে গেল স্থির। তার চোখের সামনে স্বয়ং আদ্র দাঁড়িয়ে আছে।

আদ্র চোখ তুলে সামনে তাকাতেই অক্ষিপট স্পৃহার ওপর বাঁধা পড়ে গেল তার। সারা দেহ যেন জমাট বেঁধে গেল মুহূর্তেই। স্পৃহা এখানে কী করছে? কীভাবে এলো? স্পৃহা কি এখন ওকে দেখে কাঁদবে? তার জন্য কোনো স্থান কি আদৌও স্পৃহার মনে অবশিষ্ট আছে? যদিও ভাবনা গুলো নিতান্তই যুক্তিহীন, তবুও কথা গুলো মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে শুধু তার। ঠোঁট ভেদ করে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই বেরিয়ে এলো,

-স্পৃহা, তুমি এখানে?

# চলবে……

[রিচেক হয়নি। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।]