এক মুঠো প্রেম পর্ব-৩৫+৩৬

0
376

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৫
✨রহস্যভেদ-০২✨

-উনি চেয়েছিলেন মিসেস স্পৃহার ম্যাটার্নিটি নষ্ট করে দিতে যেন তিনি কখনো মা না হতে পারেন!

আদ্র বিস্ফোরিত চোখে মিসেস সামায়রার দিকে তাকালো। চাহনিতে অবাকতা ও ক্রোধের সংমিশ্রণ দেখা যাচ্ছে তার। স্পৃহা তেমন বিশেষ ভাবাবেগ দেখাচ্ছে না। বিষয়টা সে আগেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু পরিস্থিতি তখন এসব নিয়ে আক্ষেপ বা ক্রোধ দেখানোর অবকাশ দেয়নি তাকে। এখনও এটা নিয়ে তার কিছু যায়-আসে না। মাতৃত্ব তো হারিয়েই গিয়েছে জীবন থেকে! কী হবে এখন এটার জন্য আফসোস করে বা কষ্ট পেয়ে? যেখানে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মৃত, সেখানে অপ্রাপ্তির জন্য দুঃখবোধ নিতান্তই অমূলক। কিন্তু এই ডক্টরকে এখানে এনে হাজির করিয়েছে কেন? আর কী কী বলবেন উনি? ভেবেই কিছুটা উৎসাহ নিয়ে ডক্টরের দিকে তাকালো স্পৃহা।

ডক্টর একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে বললেন,

-আমি অবাক হয়েছিলাম। কারণ এই অভিজ্ঞতাটা আমার জীবনে নতুন। কোনো শ্বাশুড়ি তার পুত্রবধূর অনাগত সন্তানকে মেরে ফেলতে চাইছে! জিজ্ঞেস করলাম, কেন উনি এমন করতে চান? তিনি রেগে গেলেন। এটা নাকি আমার জানার বিষয় না। আমিও ওনার প্রস্তাব রিজেক্ট করে দেই। উনি রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। হুমকিও দিয়ে গেলেন, আমি এ ব্যাপারে কাউকে কিছু জানালে নাকি খুব খারাপ হয়ে যাবে! তেমন একটা আমলে নেইনি কথাটা। কারণ ওনার এই কথা মানতে হলে আমি আনিলাকে কিছু জানাতে পারবো না। কিন্তু আনিলা সেই প্রথম থেকেই আমার মাধ্যমে মিসেস স্পৃহার সব খোঁজখবর রাখতেন। এরপর আমি বরাবরের মতো মিসেস সামায়রার বলা সব কথা আনিলাকে জানালাম। আনিলা আমায় সবদিকে নজর রাখতে বললো যেন উনি স্পৃহার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

ডক্টর এটুকু বলতেই আনিলা বলে উঠলো,

-আমি সব খোঁজ খবর নিতাম, কারণ স্পন্দন ভাইয়া আগেই বলেছিলো, স্পৃহাকে আদ্রের মা মেন্টালি অনেক এবিউস। যখন জানতে পারলাম স্পৃহাকে রিশাদের হসপিটালেই চেক-আপ করানো হয়, তখন মাঝে মাঝে খোঁজ নিতাম। কিন্তু এই নিউজ শোনার পর অনেক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, কীভাবে কী করবো? আহিরের শরীরের যে অবস্থা ছিল, ওকে এসব জানালে ও পাগল-ই হয়ে যেত। তাই নিজেই যতোটুকু পেরেছি, হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু উনি যে এভাবে বাচ্চাটা মিসক্যারেজ করিয়ে দিবেন, ভাবতেও পারিনি।

আনিলার কথা শেষ হতেই ডক্টর রিশাদ বললেন,

-এরপর মিসেস সামায়রা আরো একজন ডক্টরের কাছে গেলে আমি তাকে এরকম কিছু না করার জন্য সতর্ক করে দেই। যতোটুকু পারি, ওনাকে বিফল করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সপ্তাহ না গড়াতেই হঠাৎ এক রাতে মিসেস স্পৃহাকে হসপিটালে এডমিট করানো হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার দুদিন আগে আমি মালয়েশিয়া চলে যাই রিসার্চের জন্য। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানতে পারিনি। কিন্তু যখন জানতে পারলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। স্পৃহার বেবি অলরেডি মিসক্যারেজ করিয়ে ফেলেছিল মিসেস সামায়রা। সাথে সাথে ওর মাতৃত্বও নষ্ট করে দিয়েছিল। পরেরদিন আনিলা আমায় ফোন করে সবটা জানালে অনেক আফসোস হয়েছিল। কিন্তু ওখান থেকে ফেরাটা সম্ভব ছিল না। টানা চার মাস পর, গত রাতে আমি দেশে ফিরেছি। আর এখানে এসেছি, কারণ আমি এই নিকৃষ্টতর কাজের একমাত্র সাক্ষী।

সবাই হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এরকম কিছু ঘটে গেছে সবার কল্পনারও বাইরে ছিল সবার। গল্প-সিনেমায় এরকম ঘটলেও বাস্তবেও যে কেউ এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে, জানা ছিল না ওদের। আদ্র অগ্নি দৃষ্টিতে মিসেস সামায়রার দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপন মা নও তুমি আমার! সেটা না-হয় মানলাম। কিন্তু রক্তের টান বলে তো একটা কথা আছে! মায়ের পরে তো মানুষ খালাকেই বেআপন মনে করে। আর এখানে আমি আজীবন তোমাকে মা বলে জেনে এসেছি, মায়ের আসনে বসিয়েছি। তুমিও জন্মের পর থেকে আমায় লালন-পালন করেছো। একটুও কি মায়া তৈরি হয়নি তোমার আমার প্রতি? একবারও বিবেকে বাঁধলো না এমন একটা কাজ করার আগে? আমার অংশটাকে জন্মের আগেই পৃথিবীতে থেকে সরিয়ে দিলে কী করে? ওকে পৃথিবীর আলোটা অন্তত দেখতে দিতে!

আদ্র কথাগুলো বেশ কড়া গলায় বললেও ওর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। মিসেস সামায়রা কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। হাসফাস করতে করতে ভীত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন বারবার। কিছু অস্বীকার করারও মুখ নেই তার। কারণ ডক্টর রিশাদকে তিনি চেনেন, এটা আগেই মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন।

আদ্রের বাবা মিসেস সামায়রার দিকে তাকিয়ে ভরাট কন্ঠে বললেন,

-কী হলো? বলো! কেন করেছো এই জঘন্য কাজটা? না বলে কোনো উপায়ও তোমার নেই! সোজা ভাবে মুখ না খুললে অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে। তখন কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না। মনে রেখো!

মিসেস সামায়রার ভীতি আরেক ধাপ বেড়ে গেল। তিনি আমতা আমতা করে বললেন,

-আব্ … আমি আ… আসলে …

-স্পষ্টভাবে কথা বলুন!

প্রণবের রাশভারি কথা শুনে মিসেস সামায়রা মিইয়ে গেলেন। অগোছালো ভাবে বললেন,

-আমি আগে থেকেই চাইনি আদ্র কোনো বিয়ে করুক। কারণ বিয়ে করলেই ওর সন্তান আসবে পৃথিবীতে। কিন্তু অবশেষে ও বিয়ে করে ফেললো। স্পৃহাকে আদ্রের বউ ভাবলেই আমার রাগ হতো। ভেবেছিলাম কোনো একটা উপায়ে স্পৃহাকে আজীবনের জন্য বন্ধ্যা বানিয়ে দিবো। কিন্তু তার আগেই ও কন্সিভ করে ফেলে। তারপর আমি কীভাবে কী করবো, কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে ভাবলাম ডক্টর দিয়ে সেন্সলেস করিয়ে ওর অজান্তে ওর বাচ্চাটা নষ্ট করে দেবো। কিন্তু ডক্টর রিশাদ সেটাও হতে দিলেন না। তাই আমি নিজেই ওর খাবারে মেডিসিন দিয়ে আর নিয়মমতো অন্যান্য ওষুধের সাথে মেডিসিন মিলিয়ে সবটা করেছি। এরপর ওকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর যেই ডাক্তার ওর অপারেশন করিয়েছে তাকে ওর মাতৃত্ব দিতে বলেছি। এতে আমায় অনেক টাকাও দিতে হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, আদ্র কখনো বাবা হতে না পারলে এই সম্পদের কোনো উত্তরাধিকারী থাকবে না। আর আমার ছেলেদের বংশধরেরা সব কিছুর উত্তরাধিকারী হবে। কিন্তু ভাবতেই পারিনি যে, আদ্র স্পৃহাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।

-এতে আপনার পুরো প্ল্যানটাই নষ্ট হয়ে গেছে, তাই না? সো স্যাড!!!

বলেই প্রণব মুখটা কালো করে ফেলার অভিনয় করলো। মিসেস সামায়রা বিরক্তি নিয়ে প্রণবের দিকে তাকালেন। সবারই মনটা বিষিয়ে উঠেছে। রাগ ও দুঃখের মিশ্রিত এক অদ্ভুত অনুভূতি। আদ্রের বাবা বললো ,

-ছিহ্!! শুধু মাত্র সম্পত্তির লোভে একটা প্রাণ শেষ করে দিতে তোমার একটুও বাঁধলো না। একটা প্রাণের সাথে যে আরো দুটো জীবন জড়িয়ে আছে, সেটাও একবার ভাবলে না? নিজে একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের নারীত্ব পুরোপুরি শেষ করে দিলে? ছিহ্!!

কারো মুখেই কোনো কথা সরছে না। আদ্র নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে স্পৃহা নামক মানবীর ওপর। হয়তো কোনো অধিকার অবশিষ্ট নেই! কিন্তু মন আজ কোনো বাঁধা মানছে না। অনধিকারচর্চা করায় অদ্ভুত তৃপ্তি পাচ্ছে সে। স্পৃহার তেমন কোনো বিশেষ অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে না। ও চুপচাপ সবটা দেখছে আর শুনছে। নিজের নিঃস্ব সত্তাটাকে আজ বেশ কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারছে ও। জীবন থেকে ভালোবাসাটা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ভালোবাসার মানুষটাও। যার সাথে জীবন বাধার স্বপ্ন দেখেছিল, সেও হারিয়ে গেছে, মাতৃত্ব হারিয়ে গেছে। কিছুই তো অবশিষ্ট নেই!!

অকস্মাৎ প্রণব বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,

-আফসোস, আন্টি! আফসোস!! আপনার সবগুলো প্ল্যান-ই ফ্লপ হয়েছে। আদ্র মিসেস নিস্তব্ধতাকে ডিভোর্স দিয়ে যেমন আপনার প্ল্যানটা নষ্ট করে দিয়েছে, আরেকজনও অন্য ভাবে আপনার প্ল্যানটা নষ্ট করে দিয়েছে। ও স্পৃহাকে ডিভোর্স না দিলেও আপনার প্ল্যান স্পয়েল্ড হতো।

মিসেস সামায়রা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। সেটা আবার কীভাবে সম্ভব?

প্রণব ওর হাসিটা বজায় রেখেই বললো,

-আসলে আপনার প্ল্যানে কিছুটা ঘাটতি ছিল। যেদিন স্পৃহার অপারেশন হয়েছিল, সেদিন ওই হসপিটালের সিনিয়র ডক্টর ও অপারেশন ইন-চার্জ কে ছিল, জানেন?

সবাই প্রণবের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। প্রণব নিজের হাসিটা আরো প্রসারিত করে বললো,

-আমার মা, ডক্টর মেহরীন চৌধুরী।

মিসেস সামায়রা চোখ বড়বড় করে তাকালেন। অস্ফুটে বললেন,

-তার মানে……

-তার মানে, সেদিন আপনার ইন্সট্র্যাকশন অনুযায়ী কিছুই হয়নি। সবটা হয়েছিল আমার কথা ও প্ল্যান অনুযায়ী।

# চলবে……

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৬

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। প্রণবের কথার মানে সে বুঝে উঠতে পারছে না। মিসেস সামায়রার প্ল্যান ফ্লপ হওয়ার পেছনে প্রণবের হাত ছিল? কিন্তু প্রণব তো তাকে তখন চিনত-ই না! আর৷ মিসেস সামায়রার প্ল্যান ফ্লপ হলো কীভাবে? প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে তার। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে অবশেষে প্রশ্ন করেই ফেললো সে,

-আপনি আমায় আগে থেকে চেনেন?

প্রণব কথার মাঝে প্রশ্ন শুনে ঈষৎ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। পরমুহূর্তেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের কথার গতি অব্যাহত রেখে বললো,

-মিসেস নিস্তব্ধতার অপারেশনে অনেক কমপ্লিকেশন্স ছিল। আর এধরণের কেসগুলো ডক্টর রিশাদ হ্যান্ডেল করতেন। কিন্তু তিনি সেদিন দেশে ছিলেন না। এই সুযোগটাই আমি কাজে লাগাই। এক্সপেরিয়েন্সড্ ডক্টর হিসেবে মাকে ওটিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। মা যখন অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করলো, তখন তাকে বলা হয়েছে তিনি যেন অর্গান কেটে বা অন্য কোনো উপায়ে পেশেন্টের মাতৃত্ব নষ্ট করে দিতে। মা সম্মতি জানালেও তেমন কিছুই তিনি করেননি। আমার কথা মতো কৌশলে কাউকে কিছু বুঝতেও দেননি আর কেউ জানতেও পারেনি যে, স্পৃহার মাতৃত্ব নষ্ট হয়নি। বরং সবাইকে ভুল তথ্য দেওয়া হয় যে, স্পৃহা কখনো মা হতে পারবে না।

স্পৃহা থমকালো। তার মানে, সে এতোদিন ভুল জানতো! তার জীবনটা পুরোপুরি নিঃস্ব না। ভাবতেই চোখে পানি চলে এলো ওর। না চাইতেও মনের কোণে একটু শান্তির আভাস পেল স্পৃহা। সর্বাঙ্গে অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভূত হচ্ছে।

প্রণবের কথা শেষ হতেই মিসেস মেহরীন বললেন,

-সেদিন জানতাম না, আমার ছেলে একটা বিবাহিতা মেয়ের জন্য এসব কিছু কেন করছে! আজও জানি না ও স্পৃহাকে কীভাবে চেনে। আর জানতে চাইও না। তবে এটা আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, স্পৃহার অপ্রাপ্তির সাথে প্রাপ্তির হিসেব মেলালে স্পৃহার জীবন ধন্য। যতোবারই স্পৃহা আঘাত পেয়েছে, বিপদে পড়েছে, ততবারই প্রণব ওকে দূর থেকে বা কাছে থেকে আগলে রেখেছে। এর চেয়ে চাওয়ার কিছু কি একটা মেয়ের আদৌ আছে?

প্রণব বিরক্ত হলো। মিসেস মেহরীনের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললো,

-স্টপ ইট, মা! এসব এখানে বলার কোনো দরকার নেই।

-কেন বলবেন না উনি? উনি তো ভুল কিছু বলেননি!!

স্পন্দনের কথা শুনে প্রণব খানিকটা চমকে উঠলো। মনে মনে ভীতি নিয়ে ওর দিকে তাকালো। যদিও ভয়টা ওপর দিয়ে প্রকাশ করলো না। ভয়ের কারণ একটাই- স্পন্দনকে সে এতোদিন মিথ্যে বলেছে। স্পৃহা তার সাথেই ছিল, অথচ ও বলেছে স্পৃহাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। যদিও স্পন্দন সেটা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু প্রণব অনেক কষ্টে সামলে রেখেছিল স্পন্দনকে। তবে এখন তো স্পন্দনের চোখের সামনে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল। স্পৃহা দেশেই ছিল। এখন যদি স্পৃহাকে ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়! সবটা তো ও স্পৃহার ভালোর জন্য করেছিল! এতো কিছুর পরও কি স্পন্দন ওর ওপর রাগ দেখাবে?

ভাবতে ভাবতেই পলক ফেলে দেখলো স্পন্দন একদম ওর সামনে এসে দাড়িয়েছে। প্রণব আটকে যাওয়া কন্ঠে বললো,

– ভ্ ভাইয়া! আ… আসলে আমি মিথ্যে বলেছি কারণ ……

-পিহুর ভালোর জন্যই করেছো সবটা। আমি জানি।

প্রণব অবাক চোখে তাকালো। কথাটা বোধগম্য হতেই প্রশান্তিতে মনটা হালকা হলো। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,

-কীভাবে জানলেন?

-পিহুর সেইফটির জন্যই ওকে এতোদিন লুকিয়ে রেখেছো। যে মহিলা এতো জঘন্য কাজ করতে পারে, সে নিজের স্বার্থের জন্য পিহুর আবার কোনো ক্ষতি করবে না, এটা তো বলা যায় না। তাই না?

প্রণব হাসলো। স্পন্দনের চোখে পানি, মুখে হাসি। প্রণবের হাত দুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো,

-ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না তোমায়। তবে তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার বোনটাকে সবার আড়ালে এভাবে আগলে রেখেছো তুমি! ছোট থেকেই ওর জীবনটা রঙহীন। আমি ছাড়া ওকে কেউ কোনো দিন ভালোবাসেনি। ভেবেছিলাম ওকে কেউ একজন ভালোবেসে আগলে রাখবে। কিন্তু সেটাও বাস্তবে ঘটেনি। জানিনা তুমি ওকে কীভাবে চেনো! কিন্তু ওকে এতো বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছো। মৃত্যুর মুখ থেকেও বাঁচিয়েছো। এতোদিন এভাবে আগলে রেখেছো। এমন একটা ভরসার হাত-ই আমি আজীবন চাচ্ছিলাম। অবশেষে আল্লাহ মিলিয়েই দিলো।

প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্পন্দনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ওর হাতের ওপর হাত রেখে বললো,

-মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসময় কোনটা, জানেন ভাইয়া? নিজের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা নিজের কাছে পেয়েও সেটা গ্রহন করতে না পারার সময়টা। আমার অবস্থাটাও সেরকম। এই যে দেখুন, মিসেস নিস্তব্ধতা এখন আমার নিজের। কেউ বা কোনো বাঁধা নেই ওনার আর আমার মাঝে। তবুও আমি ওনাকে গ্রহন করতে পারবো না, শুধু মাত্র উনি সম্মতি দেয়নি বলে। বিয়েটা তো আমি ওনার মতের বাইরে বা ওনাকে ধোকা দিয়েই করেছি, তাই না? কীভাবে ওনার সম্মতি ছাড়া ওনাকে নিজের সাথে জড়াই, বলুন তো!

স্পৃহার চোখ পানিতে টলমল করছে। একথা শুনে অবশেষে গাল বেয়ে গড়িয়েই পড়লো পানি। কী নেই এই প্রণব মেহরাজের জীবনে? তবুও নিজের সবটা দিয়েই ওকে আগলে রেখেছে, নিজের অর্ধাঙ্গিনী করেছে। শুধু মাত্র ওর মতামতের কারনে প্রণব অধিকার থাকা সত্ত্বেও ওকে গ্রহণ করতে পারছে না। ব্যক্তিত্বটা অদ্ভুত হলেও শ্রদ্ধার দাবিদার।

প্রণব স্পৃহার দিকে এক পলক তাকালো। ওর অশ্রু পূর্ণ চোখদুটো আর লালাভ মুখশ্রী দেখে প্রণবের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল নিমেষেই। কেন কাঁদছে মেয়েটা? বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও কি ওর চোখের পানি ফেলাটা খুব জরুরি? চোখের পানি কি সবসময় রেডি থাকে নাকি?

স্পন্দনও মুখটা কালো করে রেখেছে। স্পৃহা কি কখনো এই সম্পর্কে সম্মতি দিবে? নিজের বোনকে ও ভালো করেই চেনে! প্রণব স্পৃহার মতের জন্য অপেক্ষা করছে, আর এদিকে স্পৃহার প্রণবের ডাকে সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাহলে কী পরিণতি হবে প্রণব আর স্পৃহার সম্পর্কের? ভাবতেই মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে স্পন্দনের।

এরই মাঝে কয়েকজন পুলিশ এসে মিসেস সামায়রাকে নিয়ে গেল। ওদেরকে প্রণবই সাথে নিয়ে এসেছিল। কেউ বাঁধাও দিলো পুলিশকে। মিসেস সামায়রারও বলার মতো কোনো ভাষা নেই। সবাই নীরব দর্শকের মতো পুলিশকে বিদায় জানালো। মিস্টার চৌধুরী প্রণবকে বললো,

-আমরা তাহলে বাসায় ফিরে যাই। এমনিতেই অনেক বেলা হয়ে গেছে। প্রান্তি বাড়িতে আশফিকে নিয়ে একা আছে।

প্রণব সম্মতি দিতেই মিস্টার চৌধুরী, মিসেস মেহরীন আর আনিলা চলে গেলো। প্রণব স্পন্দনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। বললো,

-আমারও থানায় কিছু ফর্মালিটি বাকি আছে। মিসেস নিস্তব্ধতা চাইলে আপনার সাথে যেতে পারে। আমি বাঁধা দেবো না। আসছি।

বলেই প্রণব কারো দিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। স্পৃহা কিছু বলার সুযোগ পেল না। কিন্তু ওর তো অনেক প্রশ্ন আছে প্রণবের কাছে! সেগুলো তো জানতে হবে! ওর জন্য এতো কিছু করলো, একবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটাও জরুরি। ভেবেই ও-ও প্রণবের পিছু পিছু ছুটে বেরিয়ে গেল। স্পন্দন বাঁধা দিলো না। চোখ ঘুরিয়ে আদ্রের দিকে তাকালো। আদ্র মাথার চুল আঁকড়ে ধরে সোফায় বসে পড়লো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে ওর। নিজেই নিজেকে বললো,

-আজ আমি সত্যি সত্যিই নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এটাই কি তাহলে স্পৃহার বিশ্বাস ভাঙ্গার পরিণতি? কীভাবে বাঁচবো আমি বাকি জীবনটা এমন নিঃস্ব একটা জীবন নিয়ে?

স্পৃহা বেরিয়ে এলো বাড়ির বাইরে। কিন্তু প্রণব নেই। চলে গেল ছেলেটা? ভাবতেই মনটা যারা হয়ে গেল!

-আমাকে খুঁজছেন, মিসেস নিস্তব্ধতা?

পরিচিত সম্বোধনটা শুনে স্পৃহা চমকে উঠলো। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটাকে দেখে না চাইতেও মনে অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করলো ওর। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলো না।

প্রণব স্পৃহাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে ওর দিকে এগিয়ে এলো। ওর দিকে সামান্য ঝুঁকে বললো,

-আমি জানতাম, মিসেস নিস্তব্ধতা। আপনি আসবেন, এটা আমি জানতাম।

স্পৃহা অবাক চোখে তাকালো। প্রণবের হাসিটা দেখে চোখ নামিয়ে ফেললো। বললো,

-আপনি যেমন ভাবছেন, তেমন কিছু না!

-আমি কী ভাবছি?

স্পৃহা চোখ তুলে তাকালো। প্রণব এক ভ্রু উঁচিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। স্পৃহা থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো,

-জ্… জানি না‌!!

প্রণব হেসে ফেললো। বললো,

-আমি জানি, আপনি আমার কাছে আমার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে আসেননি। বেশ দেরী হবে আপনার। তবে একটা কথাই বলবো। কালও বলেছিলাম। আজ সকালেও বলেছি। খুব বেশি দেরী করে ফেলবেন না যেন!

প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্পৃহার মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে পা ঘুরিয়ে চলে যেতে লাগলে স্পৃহা পেছন থেকে ডাক দিলো,

-শুনুন!!!

প্রণব থামলো। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকালো না। বললো,

-ধন্যবাদ বলার দরকার নেই। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রয়োজন নেই। আপনি আমার। একমাত্র আমার। আর আমার জিনিসটা অবশ্যই আমিই আগলে রাখবো। বলেছিলাম না, আপনার ছায়া আপনার থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও এই প্রণব মেহরাজ চৌধুরী আপনার থেকে দূরে সরবে না কোনোদিন।

বলেই প্রণব গটগট করে হেঁটে চলে গেল। স্পৃহা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে।

# চলবে…….