এক মুঠো প্রেম পর্ব-৩৭+৩৮

0
430

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৭

রাতগুলো নির্ঘুম কাটছে ইদানীং! অকারণেই! হাজারো ক্লান্তি শরীরে ভর করলেও ঘুম ধরা দিচ্ছে না। চৌধুরী ভবন থেকে আজ নিজের বাগান বাড়িতে চলে এসেছে প্রণব। পরিবেশ বদল করলে যদি মনে একটু শান্তি মেলে, সেই আশায়! কিন্তু ফলাফল শুন্য! বিছানায় মন টিকছে না। কপালে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে নিজের ওপরই বিরক্তি ঝাড়ছে অবশেষে। হঠাৎ ঘরের সব আলো নিভে অন্ধকারে ছেয়ে গেল। এতো রাতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল!! কিছুক্ষণ পরেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ! অবাকতা ও বিরক্তির মিশ্র প্রকাশ ছেয়ে গেল মুখশ্রী জুড়ে। একটু শান্তি কি কপালে নেই নাকি? শোয়া থেকে চট করে উঠে বসলো প্রণব। কপালে গভীর ভাজ ফেলে বললো,

-কাম ইন!

দরজা আনলকড্-ই ছিল! তাই কেয়ারটেকার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে অস্থির স্বরে বললো,

-স্যার, নিচের মেইন ইলেক্ট্রিক সার্কিটটাতে কী যেন হয়েছে! বারবার শুধু লাইটেনিং হচ্ছে।

প্রণব ফোনের ফ্লাশলাইটটা অন করে ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,

-বলো কী? এমনটা কীভাবে হলো? চলো, গিয়ে দেখি!

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলা থেকে নিচতলায় চলে এলো প্রণব। পিএ-কে ফোন দিয়ে ইমার্জেন্সি লোক পাঠাতে বললো। সার্কিটের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সত্যি সত্যিই লালচে বর্ণের স্ফুলিঙ্গ বারবার জ্বলে উঠছে। ভেতর থেকে পোড়া বিদঘুটে গন্ধ।

মিনিট দশেকের মধ্যে পিএ কয়েকজন ইলেক্ট্রিশিয়ান নিয়ে বাড়ির সামনে পৌছালো। তারা সবটা পরখ করে প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললো,

-এই সমস্যাটা তো আজকের নয়! বহু আগে থেকেই। আজকেরটা শুধু ক্লাইমেক্স ছিল। আরেকটু দেরি হলেই আগুন লেগে যেত! ভাগ্যিস!!

প্রণব চমকে উঠলো। অনেক বড় অঘটন ঘটতে চলেছিল আজ। ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো ওর। চোখ বন্ধ করে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিন্তু দৃশ্যপটের সামনে অকস্মাৎ স্পৃহার অবয়বটা ভেসে উঠলো। মায়া জিনিসটা অদ্ভুত! একবার জড়িয়ে গেলে সবকিছুতেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।

সব ঠিকঠাক করতে করতে রাত আড়াইটা বেজে গেছে। ইলেক্ট্রিসিটিও চলে এসেছে কিছুক্ষণ আগেই। প্রণব নিজের ঘরে এসে ক্লান্তির শ্বাস ছাড়লো। আজ নিঃসঙ্গতা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। প্রণব অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করলো, সব কিছু থাকতেও সে বড্ড একা! কাছের ও প্রিয় মানুষ গুলো ওর থেকে দূরে। আচ্ছা, সে যাদের প্রিয় মনে করে, তাদের কাছেও কি সে একই রকম প্রিয়? না কি বিষয়টা এক তরফা? প্রশ্নটা মনের কোণে নাড়া দিয়ে উঠলো।

-মিসেস নিস্তব্ধতা!

নিশ্বাসের সঙ্গে চাপা স্বরে এই শব্দ দুটোই বেরিয়ে এলো শুধু। মা আর বোনের পর এই একটা নারী-ই তার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে। প্রণয়টা শুধুই তার পক্ষ থেকে ছিল। পরিণয়টাও ছিল এক তরফা। কিন্তু বিশ্বাসের পরিচিত সত্তাটা বলছে পরিণতিটা দু-তরফাই হবে! আনমনেই হেসে ফেললো প্রণব। ইদানীং বিশ্বাসের ঢালটা প্রচন্ড মজবুত হয়ে গেছে ওর।

বিছানায় বসতেই সামনে আহিরের ছবিটার দিকে চোখ পড়ে গেল প্রণবের। তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এই ব্যক্তিটারই বিচরণ তার প্রণয়িণীর মনোজগৎ জুড়ে! ব্যক্তিটার সত্তাটা-ই ভদ্রতা দিয়ে ঘেরা। প্রফেসর মানুষ বলে কথা! সবদিক থেকেই সে ভালোবাসা লাভের যোগ্য।

প্রণব ছবিটার ওপর হাত বুলিয়ে বললো,

-হুট করেই আগমন ঘটেছিল আপনার। আমার আগেই মিসেস নিস্তব্ধতার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন আপনি। অথচ আমি ছিলাম প্রথম। আপনার জায়গায় আমার থাকার কথা ছিল। কিন্তু আপনার প্রতি কোনো রাগ বা জেলাসি আনতে পারি না আমি! হয়তো আপনি মিসেস নিস্তব্ধতার শুভাকাঙ্ক্ষী তাই। আমি হয়তো আপনার মতো ত্যাগি নই! বরং আপনার সত্তার উল্টোপিঠ। এজন্যই মনের মধ্যে হারানোর ভয়টা জেঁকে বসেছে আজকাল। সত্যিই শান্তি পাচ্ছি না!
____________________

খাটের ওপর উবু হয়ে জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে স্পৃহা। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে বাঁ হাতের তালুতে গাল স্পর্শ করে আরেকহাত দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে সে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় যাবৎ নিজের বাড়িতেই আছে স্পৃহা। তবে বাড়ির পরিবেশে পরিবর্তন এসেছে। এখন তাকে দেখে বাবা-মায়ের মুখে বিরক্তি প্রকাশ পায় না। ফুপি এটা-সেটা বললেও আগের মতো এ বাড়িটা বিষাক্ত মনে হয় স্পৃহার।

মনটা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই হালকা ও ফুরফুরে লাগে তার। আগের মতো মন খারাপেরা এসে মনোরাজ্যে ভীড় জমায় না। অকারণেই ঠোঁটে হৃষ্টতার ছোঁয়া ফুটে ওঠে। তবে কোথাও না কোথাও একটা শূন্যতা রয়েই যায়! মনে এসে উঁকি দেয় এক অপেক্ষমাণ সত্তা। ভেবেই হাসি মুখে ভাটা পড়ে স্পৃহার। চোখ চলে যায় হাতের পাশে অলস পড়ে থাকা ফোনের স্ক্রিনের ওপর। বুক চিরে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসে। রাগ নাকি অভিমান, জানা নেই! কিন্তু ভেতর থেকে কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি জেগে বসে! এতো দিনে একটা বার খোঁজও নিলো না তার। দেখা করা তো দূরে থাক! একবার কল তো করতে পারে! এই তার আগলে রাখার নমুনা? অথচ এতো মুড দেখিয়ে যখন বলে,

-আপনি আমার! একমাত্র এবং একান্তই আমার নিজের।আর আমার জিনিসটা অবশ্যই আমি আগলে রাখবো। এর বিনিময়ে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নিষ্প্রয়োজন ও অযৌক্তিক!

ভেবেই ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা ভেংচি কাটলো স্পৃহা। বইয়ের পৃষ্ঠায় মনযোগ দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। স্পৃহা চমকে উঠলো। অতি উৎসাহ নিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই মুখটা আবার কালো হয়ে গেল। আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির ফোন ছিলনা সেটা। মন খারাপ করেই ফোনটা কানে ছোয়ালো সে,

-হ্যাঁ, আহান! বল!

-কেমন আছিস?

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। আহান কখনো ওকে এসব জিজ্ঞেস করে না। তার মতে, “তোরা আমার বন্ধু! আর বন্ধুদের সাথে এসব ফর্মালিটি কেন? যারা কাছের মানুষ নয়, তাদের সাথে কথা বলার সময় ‘কেমন আছেন? ভালো আছি!’ এসব আজাইরা কথা বলে সবাই।” তাই স্পৃহা জিজ্ঞেস করল,

-এসব ফর্মালিটি কবে থেকে দেখানো শুরু করলি বল তো?

আহান হাসলো। বললো,

-আরে ফর্মালিটি না! তোদের সাথে কী ফর্মালিটি দেখামু?

-তাহলে কেমন আছি জিজ্ঞেস করছিস যে?

-অনেক দিন পর কথা বলছি, তাই খোঁজ নিলাম আর কি! এসব জিগাইতে ভালোও লাগে না, বইন। পাবলিক তো ভালো থাকলেও কয়, ভালো আছি! খারাপ থাকলেও কয় ভালো আছি!

স্পৃহা হাসলো। বললো,

-আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু এতোদিনে তোর হঠাৎ আমার কথা মনে পড়লো যে?

-তোর না, তোদের বল! নীড়ের মনে পড়সে তোর কথা!

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। বললো,

-মানে?

ওপাশ থেকে নীড়ের গলা শুনতে পাওয়া গেল,

-সেলিব্রিটির বউ! একটা গুড নিউজ আছে।

সম্বোধন শুনে স্পৃহা খানিকটা চমকে উঠলো। কিন্তু গুড নিউজের কথা মাথায় আসতেই বললো,

-তুই কি বিয়ে করে ফেলেছিস?

আহান কিটকিটিয়ে হেসে দিলো। নীড় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-হারামি! বিয়ে ছাড়া কি আর কোনো গুড নিউজ নাই না কি? সবে মাত্র তেইশ বছর চলছে। এটা কি বিয়ের বয়স? আমি এখনো অনেক ছোট, বুঝলি?

স্পৃহা মনে মনে হাসলো। বললো,

-হুম, বুঝলাম। তো গুড নিউজটা কী?

-আমার কানাডার স্কলারশিপ এপ্লিকেশনটা গ্র্যান্টেড হয়েছে, ইয়ার। অনার্স শেষ করেই আমি ওখানে চলে যেতে পারবো।

নীড়ের গলায় আনন্দের আভাস। স্পৃহারও বেশ ভালো লাগলো। কাছের মানুষগুলোর সাফল্য দেখে সত্যিই অদ্ভুত একটা আনন্দ কাজ করে। ওদের সাথে বেশ অনেকক্ষণ কথা বলে ফোন কাটলো স্পৃহা। জানালো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো, গোধূলির হলুদ আকাশ লালচে আভা ছড়াতে ব্যস্ত। মনের ভেতর শূন্যতাটা আবার জেঁকে বসলো। অপেক্ষার প্রহর কি শেষ হবার নয়?

হঠাৎ কিছু ভাঙার শব্দে চমকে উঠলো স্পৃহা। চিন্তা জগৎ থেকে বেরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। বেলকনির দরজা ভেদ করে লাল কাগজে মোড়ানো কিছু একটা ওর ঘরে ছুঁড়ে মেরেছে কেউ, যার আঘাতে একটা ছোট ফুলদানি টেবিল থেকে মাটিতে পড়ে ভেঙে গেছে। রাগে কটমট করে উঠলো স্পৃহা। যে এই কাজটা করেছে, তাকে ঝাড়ার জন্য বেলকনিতে গিয়ে নিচে তাকালো স্পৃহা। দোতলা থেকে নিচের খালি রাস্তাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পরিচিত গাড়িটা দেখে স্পৃহা থমকালো। গাড়ির ভেতরে কে আছে, বোঝা না গেলেও স্পৃহা নিশ্চিত যে, ভেতরে সেই পরিচিত মানবটি-ই! হঠাৎ গাড়িটা শা করে চলে গেল।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। জিনিসটার কথা মাথায় আসতেই ভেতরে ছুট লাগালো সে। ফ্লোরে পড়ে আছে লাল কাগজে মোড়ানো সেই বস্তুটা। স্পৃহা হাতে নিলো সেটা। পেচিয়ে রাখা লাল ফিতাটা খুলতেই কাগজ আলগা হয়ে গেল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বড় একটা পাথরের টুকরো। স্পৃহার কপালে ভাজ পড়লো। এটা দেওয়ার মানে কী? পরমুহূর্তেই লাল কাগজটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। কুঁচকানো কাগজটা ভালো ভাবে মেলে ধরতেই সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা শব্দমালা ফুটে উঠলো দৃষ্টির সামনে,

“আপনার মতো নিষ্ঠুর মানবী আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি, মিসেস নিস্তব্ধতা! এতো কঠিন কেন আপনি? কেউ একজন যে অধীর অপেক্ষায় আপনার পথ চেয়ে বসে আছে, সেটা কি আপনি জানেন? অপেক্ষার বিষাক্ত দংশনে কেন বারবার আহত করছেন আমায়? এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আর কতোদিন একাকী নিঃসঙ্গ রাত নির্ঘুমভাবে কাটাবো আমি? অন্তঃদহনে গোমরাতে আর ভালো লাগছে না কিন্তু! শুন্য এই বক্ষস্থলে কবে আপনাকে পাবো বলুন তো? আপনার কি আমার কথা মনে পড়ে না, মিসেস নিস্তব্ধতা? আমার তো প্রতিটা মুহুর্ত-ই বিষাক্ত লাগছে! সহ্যের সর্বোচ্চ সীমা পেরিয়ে গিয়েছি কিন্তু আমি! এরপর আপনার বিরহে দমবন্ধ হয়ে আমার শ্বাসরোধ ঘটলে তার দায়ভার কি আপনি নেবেন, মিসেস নিস্তব্ধতা?

-এক_মুঠো_প্রেমের জন্য অপেক্ষিত এক মানব…”

কাগজের লেখাগুলোতে স্পৃহার দিকে এক গাদা অভিযোগ ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। সম্বোধন-ই বলে দিচ্ছে চিঠিটার প্রেরক কে! শেষের কথাটা পড়ে স্পৃহা ফিক করে হেসে দিলো। পুরো চিঠিটাই আবেগে ভরপুর। আর এটা পাঠাতেই এতো কাহিনী! নিজের অজান্তেই স্পৃহার ঠোঁটের কোণে হৃষ্টচিত্তের রেখা ফুটে উঠলো।

# চলবে……

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৮

আকাশের কোলে সরু এক ফালি বাঁকা চাঁদ। হাত-পা হিম করার মতো শীত না থাকলেও উত্তরে শীতল হাওয়ার প্রবাহ কিন্তু থেমে নেই। জানালার কিনারা ঘেঁষে সেই বক্র চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্পৃহা মনে মনে আওড়াচ্ছে, “বসন্তের আগমন ঘটেই গেল তাহলে!”

হাতের মুঠোয় থাকা সেই অগোছালো ভাবো মোচড়ানো লাল কাগজ টার ওপর পুনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো সে। কুঁকড়ে যাওয়া জায়গা গুলো সমতল করার বৃথা চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। কিছুটা সফল হলো হয়তো। কিন্তু মনে তেমন তৃপ্তি পেল না। কাগজের ওপর লেখা বাক্য গুলো পড়লো আরেক বার। এই নিয়ে কতবার পড়া হলো, সেই হিসেব জানা নেই। লেখাগুলো ওর অধরপ্রান্তে কতবার তৃপ্ততার প্রসারণ ঘটালো, সেটাও বেখেয়ালি লক্ষ করেনি স্পৃহা। মনের ভেতরে থাকা কষ্টে দ্বি-খন্ডিত হৃদয়টা জানান দিলো,

-ভালো লাগছে চিরকুটটা পড়তে, ভালো লাগছে হাসতে, ভালো লাগছে আজ বসন্তের এই আগমনী প্রকৃতিটাকে! মনের জোয়ারে তাহলে দ্বিতীয় বসন্তের ঘটেই গেল নাকি অবশেষে?

প্রশ্নটা মনে জাগতেই ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হলো স্পৃহার। ঠোঁটের কিনারাও আগের চেয়ে প্রসারিত হলো একইভাবে। কী যে ঘটছে তার সাথে, জানা নেই! এই অজানা অনুভূতিরও কোনো নাম নেই। কিন্তু খুব শীঘ্রই যে তা প্রগাঢ়তা লাভ করবে, এতেও কোনো সন্দেহ নেই। মন জিনিসটা বাক্সে বদ্ধ করে রাখার মতো নয়। কারো না কারো মায়ায় সে জড়াবেই! ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্পৃহা। চিঠিটা দিকে তাকিয়ে আরেক বার হাসলো। ভাজ করে সযত্নে ডায়েরির ভাজে তুলে রাখলো। সেই সাথে কিছু কথা লিখেও রাখলো একপৃষ্ঠার কিনারা জুড়ে।

বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই বিছানার ওপর থেকে ফোনটা বেজে উঠলো। স্পৃহা অবাক হলো। আজ হঠাৎ এতো ফোন আসছে কেন? কই এতো দিন তো আসেনি? আচ্ছা, ফোন তুললে কি আবার মিসেস নিস্তব্ধতার প্রতি একরাশ অভিযোগ ছুড়ে দেবে অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি। ভেবেই খানিকটা চকিত দৃষ্টিতে তাকায় স্পৃহা। দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে ফোন হাতে নেয়। আননৌন নাম্বার! তার মানে কি তার ধারণাই সঠিক? কলটা সেই অপেক্ষিত মানবের-ই? কম্পিত হাতে ফোনটা রিসিভ করতে নিলেই সেটা কেটে গেল। স্পৃহা বিরক্ত হওয়ার অবকাশও পেল না। দুই সেকেন্ড গড়াতেই আবারও ফোনটা বেজে উঠলো।

অকারণেই হাসি পেল স্পৃহার। কল রিসিভ করে কানে ছোঁয়াতেই ওপাশের নীবরতা ব্যতীত অন্য কিছু কর্ণগোচর হলো না স্পৃহার। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কেটে গেল। স্পৃহার কথাগুলো গলায় আঁটকে আছে। এই প্রাপ্তবয়সেও আবেগ গুলো গলা আঁকড়ে ধরেছে যেন! অকস্মাৎ ওপাশ থেকে প্রতিধ্বনিত হলো,

-স্পৃহা!!!

উৎসাহ, উৎফুল্লতা, আবেগ ও আনন্দগুলো মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেল স্পৃহার। মুখের হাসিটাও উবে গেল মুহুর্তেই! এটা তো সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটা নয়! সে তো এই নামে সম্বোধন করে না! ‘মিসেস নিস্তব্ধতা’ বলে অভিযোগকারী ব্যক্তিটা ফোন করেনি ওকে। মুখটা কালো করে নিমীলিত কন্ঠে বললো,

-জ্বি, কে বলছেন?

অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটা হাসলো। হাসির আওয়াজটা স্পৃহার কানে হালকা ধ্বনিতও হলো। হাসিটাতে তাচ্ছিল্য ছিল! হয়তো ব্যক্তিটার নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যবোধ, নয়তো কারো প্রতি না! কিন্তু বিষয়টা স্পৃহার অজানাই রয়ে গেল।

-চিনতে না পারারই কথা! আমি তো তোমার মনের কোথাও জায়গা করে নিতে পারিনি। এতোটাই হতভাগা আমি!!

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। কথাগুলো বোধগম্য হতেই চোখে মুখে কাঠিন্য ফুটে উঠলো। শক্ত গলায় বললো,

-কেন ফোন দিয়েছেন আমায়, আদ্র? আমার মনে হয় না আপনার আর আমার মধ্যে বলার মতো কোনো কথা থাকা উচিত।

-স্পৃহা, প্লিজ। শেষবারের মতো আমার একটা কথা রাখো। আই সোয়্যার, তোমায় কোনোদিন ডিস্টার্ব করবো না।

আদ্রের কন্ঠে কাতরতা। কিন্তু স্পৃহা নরম হলো না। শক্ত ভঙ্গিতেই বললো,

-আপনাকে বিশ্বাস করিনা আমি। আজ বলছেন, কখনো ডিস্টার্ব করবেন না। কিন্তু ভবিষ্যতে এই কথাটা আপনি রাখবেন না।

-স্পৃহা! বললাম তো, শেষবার।

স্পৃহা চোখ বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ফেললো। সত্যিই বড্ড বেশি কঠোর আচরণ করছে সে! নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,

-আচ্ছা, বলুন!

আদ্র সংকোচ নিয়ে অগোছালো ভাবে বললো,

-আব্… আসলে তোমার সাথে সরাসরি কিছু কথা ছিল। তোমার বাড়ির বাইরে আমি দাঁড়িয়ে আছি। যদি একবার……

-যা বলার, ফোনে বলুন!

আদ্র অসহায় কন্ঠে বললো,

-প্লিজ, বেশি সময় নেব না আমি। অনলি পাঁচ মিনিট!

স্পৃহা স্বাভাবিক হলো। বারবার রেগে যাচ্ছে আজ! তাই যতটা সম্ভব শান্ত গলায় বললো,

-আচ্ছা, আমি আসছি!

বলেই ফোনটা রাখলো স্পৃহা। মাথায় গোমটা টেনে শালটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। এ সময়ে সবাই যার যার ঘরে ব্যস্ত। তাই বাইরে বের হওয়াটা কারো চোখে পড়েনি। নিচের গেইট পেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতেই সুনশান রাস্তায় অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল স্পৃহা। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল, গাড়ির সামনের বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্র। দৃষ্টি তার আকাশের দিকে নিবদ্ধ।

-বলুন, কী বলবেন?

স্পৃহার গলার আওয়াজে চমকে উঠলো আদ্র। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই চোখ গেল স্পৃহার ওপর। আবছা আলোয় মলিন মুখটা হৃদয় হরণ করার জন্য যথেষ্ট। আজ বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলে এই মুখটা ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা এভাবে দমিয়ে রাখতে হতো না। এমন এলোমেলো জীবনের অধিকারী হতেও হতো না হয়তো! ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে গেল আদ্রের। সেটা আড়াল করে মুখে কৃত্রিম হাসির রেখা টেনে বললো,

-কেমন আছো, স্পৃহা?

স্পৃহা স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

-ভালোই আছি। খারাপ থাকার মতো কোনো কারণ তো ছিল না!

আদ্র শুকনো হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-আমাকে এখনো ক্ষমা করতে পারোনি তুমি, তাই না?

স্পৃহার চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। কঠোর গলায় বললো,

-আজ হঠাৎ আমার ক্ষমা নিয়ে কেন পড়লেন আপনি? ‘আমি’ নামক ব্যক্তিটা হঠাৎ এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন হয়ে গেল আপনার কাছে? কই? এতোদিন তো আমার কথা আপনার মনে আসে নি! বেশ তো ছিলেন আপনি নিজের জীবন নিয়ে! যখন আমায় গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল, তখন তো আপনি স্বার্থপরের মতে নিজের সুখটাকে বেছে নিয়েছিলেন। নিজের জীবনটা সুন্দর করার জন্য সব প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটা বার দেখা পর্যন্ত করেন নি। যেই জীবনের জন্য এতো কিছু, আমার মতো সাধারণ একটা মেয়েকে নিয়ে ভেবে সেই জীবনটার গতি কেন নষ্ট করছেন?

একদমে কথাগুলো বলে শ্বাস ফেললো স্পৃহা। আদ্র ওর দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

-স্পৃহা, আমি……

-দয়া করে ক্ষমা চাইবেন না আমার কাছে। অনুরোধ রইলো আমার। আপনাকে ক্ষমা করার মতো মহানুভবতা আমার মধ্যে নেই। সত্যিই নেই। তবে আপনার প্রতি কোনো অভিযোগও আমার নেই এখন। অভিযোগ তখনই জন্মায়, যখন কোনো মানুষের প্রতি অনুভূতি থাকে। আর সে রকম কোনো অনুভূতি আপনার প্রতি আমার ছিল না। থাকুন না আপনি আপনার মতো! আমি না-হয় নিজের জীবনটা নতুন আঙ্গিকে সাজানোর চেষ্টা করবো। ভালো থাকবেন।

আর কথা বাড়ালো না স্পৃহা উল্টো দিকে পা বাড়ালো। আদ্র হাত বাড়িয়ে আটকাতে চেয়েও পারলো না। কী বলে আটকাবে? কোন অধিকারে আটকাবে? সম্পর্কটা আগেই ভেঙে গেছে। কিন্তু আজ চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্নতাই পরিণতি হিসেবে ধরা দিলো। একটা ভুল সিদ্ধান্ত জীবনের মোড়-ই ঘুরিয়ে দিলো তার। ভেবেই শার্টের হাতায় চোখ মুছলো।

মাথা নিচু করে বড় বড় পা ফেলে সামনে এগোচ্ছিল স্পৃহা। কিন্তু হঠাৎ কারো প্রশস্ত বুকের সাথে সজোরে ধাক্কা লাগলো তার। মাথা বারি খেলো ব্যক্তিটার গলদেশের নিচে। পড়তে পড়তেই কারো মুঠোয় হাত বাঁধা পড়লো স্পৃহার। ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো সে। পরমুহূর্তেই একটানে ওকে সোজা দাঁড় করিয়ে দিলো। চোখ খুলে মুখ তুলে তাকাতেই কারো রাগী দৃষ্টি চোখে পড়লো। সাথে সাথে কানে ভেসে এলো ভরাট কন্ঠের বাক্যস্রোত,

-এভাবে কেয়ারলেস ভাবে কেউ হাঁটে? আপনার সামান্য আঘাতে আপনার পাশাপাশি আরো একজন ব্যথা পায়। তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি আপনি কখনো বুঝবেন না, মিসেস নিস্তব্ধতা?

কথাগুলো আদ্রের কানেও ভেসে এলো। মলিন হাসলো সে। এ হাসিই হয়তো ভবিষ্যতের একমাত্র সঙ্গী। নীরবে স্থান ত্যাগ করলো সে।

#চলবে……