এক মুঠো রঙ পর্ব-০৪

0
1344

#এক_মুঠো_রঙ
#ফারজানা_আফরোজ
#চতুর্থ_পর্ব_পঞ্চম_পর্ব

আকাশটা আজ ভীষণ মেঘলা। একটু পরেই শুরু হবে তার ভয়ানক কান্না। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে এই কান্না আজ সারা দিন চলবে সেই কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে চলবে সিমরানের কান্না। অপমান বোধ তাকে ঘিরে ধরেছে। লজ্জা, অপমান বিনা কারণে কেউ পেয়ে থাকলে তার কষ্ট হয় ভীষণ। আজ সেদিনের দেখে যাওয়া পাত্রটির সাথে সিমরানের চাচাতো বোনের বিয়ে। সিমরানের চাচাতো বোন আইরিন মাত্র ক্লাস টেনে উঠেছে এই সময়েই বিয়ে ঠিক করা হয়েছে । আইরিনের বাবা মা এমন পাত্র কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চাচ্ছেন না তাই মেয়ের শৈশব উপভোগ করার আগেই সংসারের ঝামেলায় ঠেলে দিলেন। উনাদের মতে, মেয়েদের এত পড়তে নেই, বেশি পড়ালেখা করলে মেয়ে খারাপ হয়ে যাবে তখন বড়দের সাথে মাথা উচু করে কথা বলবে।

সিমরানের বাবা মা খুবই বিরক্ত আইরিনের বাবা মায়ের উপর। বিয়ে ঠিক করেছে ভালো কথা কিন্তু এই ছেলে কেন? অন্য কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দিতো তাদের আপত্তি ছিল না। যে ছেলের সাথে তাদের পরিবারের বড় মেয়ের সমন্ধ ঠিক হয়েছিল আবার ভেঙ্গেও গিয়েছে সেই ছেলের সাথে কেন বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ে হবে? রাগে তারা দরজা জানালা বন্ধ করে বসে আছেন।

প্রায় এক ঘন্টা বৃষ্টি হবার পর সিমরান ছাতা হাতে নিয়ে বাহিরে বের হলো। এই মুহূর্তে বাসায় থাকা তার জন্য ভালো না। কষ্ট,লজ্জা অপমান বোধ তার সামনে থাকা সব অন্ধকার করে ফেলবে। সাদা লং জামার কালো কালো প্রিন্ট , কালো প্লাজো , মাথায় কালো ওরনা দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। গেইটের কাছে যেতেই কারো দু-চোখের সাথে তার দু-চোখ মিলিত হলো। লোকটিকে দেখে সিমরান মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো। লোকটি আর কেউ নয় সেই পাত্র নাম ফয়সাল। সিমরানকে যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ফয়সাল ততক্ষণ পর্যন্ত তাকিয়ে আছে। সে যে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছে তার চোখ গুলোই প্রধান সাক্ষী। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো ফয়সাল। আইরিনকে সে মন থেকে বিয়ে করতে চাচ্ছে না কিন্তু পরিবারের বাধ্য ছেলে থাকায় তাকে যে করতেই হবে এই বিয়ে। নিষ্পাপ মেয়ের জীবন তাকে তো নষ্ট করতেই হবে। বার বার অনুতাপ করছে কেন সে এই পরিবারে জন্ম নিয়েছে। বার বার উপরের দিকে তাকিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালাকে ডাকছে।

সিমরান কিছু দূর যেতেই আবারো মুষল ধারা বৃষ্টি। দোকানের এক কোণে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বৃষ্টি কমার জন্য। নাহ বৃষ্টি আজ কিছুতেই কমতে চাচ্ছে না কিন্তু তার মন বৃষ্টির ছোঁয়াতে বার বার নাচতে শুরু করছে। আশ পাশটা দেখে ছাতা নিয়েই নেমে পরলো বৃষ্টির ছোঁয়াতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে।

—” এই যে মিস , আপনার ছাতাটা দেওয়া যাবে?”

একজনের ডাকে হুস ফিরে আসলো সিমরানের। সামনে তাকিয়ে থেকে বড় বড় চোখে বলল…..

—” আপনি আবারও? এতদিন তো প্রথমবার আপনার পাকা ভাই এসে জ্বালিয়েছে এখন দেখছি আপনি আসছেন। ফলো কেন করছেন?”

—” পৃথিবীটা গোল আমি এখন খুব ভালোই টের পাচ্ছি। কেননা, দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব ছিল যার জন্য সব সময় আপনার সামনেই পড়তে হয়।”

সিমরান মুখ বাঁকিয়ে ছাতাটা মাথার উপরে রেখে বলল…..

—” সরি ছাতা দেওয়া যাবে না। কজ আমার একটাই ছাতা।”

—” আপনি তো ভিজে গিয়েছেন এখন তো আর ছাতার দরকার নেই। আমার সামনে একটু কাজ আছে আমি কাজ শেষ করে এসে দিয়ে যাচ্ছি ততক্ষন আপনি ভিজতে থাকুন।”

—” ছাতা দেই আর আপনি নিয়ে পালিয়ে যান তাই তো!”

—” আমাকে দেখে চোর মনে হচ্ছে আপনার? নীরকে বলছেন চোর? আপনার ছাতার দাম কত এক্ষুনি দিচ্ছি , বলুন।”

—” আমি আপনার নাম জানতে চেয়েছি? আহা কি ভালো পদ্ধতি নাম বলার। এখন থেকে আমিও বলব, জানেন এই সিমরান কি? সিমরানের সাথে লাগতে আসলে গুম করে ফেলব।”

—” আমিও তো আপনার নাম জানতে চাই নি তাহলে কেন বললেন আপনার নাম। হয় হয় এত সুন্দর ছেলে সামনে থাকলে নাম জানানোর ইচ্ছা তো হতেই হবে তাই না মিস সিমরান।”

সিমরান নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে গিয়ে চলে যেতে নিলে গর্তে পড়ে যায়। বৃষ্টির পানিতে গর্ত ভরপুর। বেচারি পরে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল…..

—” আপনাদের দুই ভাইয়ের সাথে দেখা হলেই আমার দিনটা খারাপ হয়ে যায়। ধ্যাত।”

নীর মুচকি হেসে এক হাত বারিয়ে দিল সিমরান হাত ধরে উঠে মুখ ফসকে বলে ফেলল…..

—” ধন্যবাদ।”

নীর অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল…..

—” আমাকে আপনি ধন্যবাদ দিচ্ছেন? আমার এই জীবন স্বার্থক হল আজ।”

কথা ঘুরানোর জন্য সিমরান বলল…..

—” লাগবে ছাতা?”

—” এখন তো ভিজেই গিয়েছি আর ছাতার দরকার নেই। বাই দা ওয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”

—” মন ভালো ছিল না সেই জন্য ঘুরতে আসছিলাম।”

—” কিন্তু এখন বোয়াল মাছ ধরে ফেলেছেন হাহাহা।”

—” অসভ্য ছেলে। এখন আপনি কোথায় যাবেন?”

—” এইতো সামনেই। আসুন আমরা কথা বলতে বলতে যেতে থাকি মন ভালো হয়ে যাবে আপনার।”

সিমরান সায় দিল। দুইজন একসাথে হেঁটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। নীর তখন মনে মনে বলল…….

—” ইয়াহুউউউ প্ল্যান সাকসেসফুল। নিবিড়ের বুদ্ধিটা কাজে লেগে গেছে। ভাগ্যিস পা দিয়ে ইটটা পিছনে রেখেছিলাম সেই জন্যই তো পরে গেলো আর আমার লাইন ক্লিয়ার হলো। নিবিড় বস ইউ আর জিনিয়াস ব্রো। ”

গাড়ি থেকে নিবিড় শিখিয়ে দিয়েছিল ছাতা নেওয়ার উদ্দেশে গিয়ে কথা বলতে। যদি পারে কোনো না কোনো হেল্প করার জন্য। মেয়েদের হেল্প করলে নাকি তারা ভীষণ খুশি হয় আর ফ্রেন্ডলী ব্যাবহার করে।

গাড়ির হর্নের শব্দে পাশ ফিরলো নীর। জানালা দিয়ে বুড়ো আঙুল বের করে বেস্ট অফ লাক জানালো নিবিড়। নীর ফ্লাই কিস দিয়ে ইশারা করল…..

—” তোর গিফট পেয়ে যাবি আজ।”

দুই ভাইয়ের এইসব কারসাজি বেচারি সিমরান কিছুই জানলো না। সে মনে মনে নিজেকে বকতে লাগলো। এত ভালো ছেলের সাথে কত খারাপ ব্যাবহারেই না সে করেছে কিন্তু আজ ছেলেটা তাকে সাহায্য করেছে। মনে মনে লজ্জা ও খুব খুশি হলো।

_______________________

সিমরান বাসায় বসে আছে তার সামনে বসে আছে ফয়সাল ও আইরিন। আইরিনের দু-চোখ ফোলে কলা গাছ হয়ে আছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে সে সিমরানের কাছে বসে আছে আর কান্না করছে। তার এক কথা, বিয়েতে সিমরানকে থাকতে হবে, থাকতে হবে মানে থাকতে হবে। সিমরান রাজি না থাকায় ফোন করে ফয়সালকে ডেকে এনেছে। আইরিনের কান্না দেখে মনে হচ্ছে সে কারো মৃত্যু দুঃখে কান্না করছে। ফয়সাল তখন সিমরানের দিকে তাকালো অদ্ভুদ মিষ্টি ও অনুরোধের সুরে বলল…..

—” জানি দোষটা আমাদের তবুও বলছি প্লিজ আসুন বিয়েতে। তাছাড়া প্রথম দেখায় তো অনেকের বিয়ে হয় না সেই জন্য কি কেউ কষ্ট পায়। বুঝেছি সমস্যাটা পরিবারের তবুও ছোট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে তো একটু নরম হতেই পারেন। প্লিজ বিয়েতে থাকবেন।”

—” আপু ছোট বেলায় যত খেলা খেলেছি শুধু মাত্র তোর সাথে তাহলে কেন আজ আমার বিয়েতে থাকবি না? তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

অবশেষে রাজি হলো সিমরান। ছোট বোনের আবদার সে কিছুতেই বারণ করতে পারেনি। তার উপর ফয়সালের অনুরোধ।

___________

গায়ে হলুদের শাড়ি পরে হাতে হলুদের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিমরান। ফয়সালের বাড়ির গেইটের কাছে যেতেই লজ্জার বাতাস তার পুরো শরীরটা ছুঁয়ে দিলো। সে প্রথম আসতে চাইছিল না কিন্তু মায়ের কথা শোনে এসেছে। তার মা তাকে বলেছে…..

—” লজ্জা থাকা উচিৎ ওই বাড়ির লোকদের তোর কেন থাকবে? বিয়েটা আমরা ভেঙেছি ওরা নয়। আর তুই যে ভেঙ্গে পড়িস নি এইটা তো দেখাতে হবে ওই লোকদের। আমরা মেয়ে বলে কোনো সম্মান নেই আমাদের? লজ্জা কি শুধু আমাদের? আমরা কেন লজ্জা পাবো। লজ্জা তো পাওয়া উচিৎ ওই বাজে লোকদের যারা মেয়েদের সম্মান করতে পারে না। আর তোর চাচা চাচী তো ছেলের বাড়ি ঘর, চাকরি, মোটা অংকের টাকা দেখে এত ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এখন ওর খেলার বয়স কিন্তু ওকে এখন সামলাতে হবে সংসার। ওরা তো আর পড়াবে না আইরিনকে। বেচারি মেয়েটা পড়তে খুব ভালোবাসে কিন্তু আমাদের কথা তো শুনবে না ওরা। এখন তুই ভালো মেয়ের মত যা আর ওদের সামনে হেসে হেসে ঘুরাঘুরি করবি। মেয়েদের মাথা নিচু করা ঠিক নয় কজ মেয়েরা মা জাতি।”

মায়ের কথাগুলো বার বার রিপিট করছে সিমরানের কানে। পা চালিয়ে চলে গেলো ভিতরে। ট্রে, টেবিলের উপরে রেখে শাড়ি ঠিক করতে করতে অনেক গুলো রুমের পাশ দিয়ে সে যাচ্ছে হটাৎ এক জোড়া হাত তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলো। সামনে থাকা লোকটিকে দেখে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে সে। তার হাত ধরবে এই লোক সে ভাবতেও পারেনি।

চলবে…..

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।