এক মুঠো রঙ পর্ব-০৫

0
1351

#এক_মুঠো_রঙ
#ফারজানা_আফরোজ
#পঞ্চম_পর্ব

আচমকা কেউ হাত ধরে টান দিয়ে রুমের ভিতরে নিয়ে যাওয়াতে ভীষণ রকম ভয় পেয়ে গেলো সিমরান। বন্ধ চোখ গুলো ভয়ে ভয়ে মেলিয়ে সামনে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল…..

—” আপনি?”

লোকটি সিমরানকে দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। দেওয়ালে এক হাত দিয়ে বলল….

—” বাহ এত সহজে তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম। তোমাকে তো স্যালুট করা দরকার সিমরান জান।”

—” সাদাত তুমি এইখানে কেন এসেছ বা কি সম্পর্ক এইসব জানার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। কিন্তু তুমি আমাকে টাচ্ কেন করেছো?”

রাগী কণ্ঠে বলল সিমরান। বরের বাড়িতে সাদাতকে দেখে সে অবাক হয় তবে ভীষণ অবাক নয় কজ বিয়ে বাড়ীতে আত্মীয় স্বজন অনেক জনেই আসতে পারে। হতে পারে সাদাত এই আত্মীয়র মধ্য কেউ একজন সেই জন্য বিচলিত না হয়ে রাগ দেখালো তাকে স্পর্শ করার জন্য । সিমরানের কথা শোনে সাদাত সিমরানের শাড়ির আঁচলটা ধরে বলল…..

—” তোমাকে শাড়িতে খুব সুন্দর লাগে জান। আজ যদি তৃণা না থাকতো তোমায় বিয়ে করে নিয়ে যেতাম।”

—” ছিঃ কতটা বাজে লোক হলে এমন কথা বলতে পারে। এখন তো মনে হচ্ছে তুমি তৃণাকে আদৌ ভালোবাসো কিনা।”

খারাপ ভঙ্গিমায় ইশারা করে বলল সাদাত……

—” আমি তো সবাইকেই ভালোবাসি। যাকে আমার চোখে সুন্দর দেখা যায় আমি তাকেই ভালোবাসি।”

—” তুমি যদি এখন আমাকে যেতে না দাও আমি চিৎকার করব বলে দিলাম।”

সাদাত তার দুই হাত সিমরানের দু পাশের দেওয়ালে রেখে বলল…..

—” যাও তোমাকে কি আমি ধরে রেখেছি?”

—” বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে সাদাত। এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে যাবো কিভাবে? ”

—” হুম তাইতো?”

সাদাত পথ ছেড়ে দিল। সিমরান এক দৌড়ে সেই জায়গা পরিত্যাগ করলো।

_________________

মানুষের জীবন বড় অদ্ভুদ। যার সাথে দেখা করতে একদম ইচ্ছা করে না কিন্তু দেখা যায় বেলাশেষে তার সাথেই দেখা হয়ে যায়। মনে প্রাণে যাকে মন থেকে ঘৃনা করা যায় পরে দেখা যায় ঐ মানুষটার প্রেমেই হাবুডুবু খেতে হয়। মন মানসিকতা পরিবর্তন কখন কিভাবে হয় বুঝা মুশকিল। ঠিক এমনি ভাবে নীর কিভাবে সিমরানকে পছন্দ করতে শুরু করেছে সে ভেবে পায় না। তবে তার এই দুই একদিনের পরিচয়ে পছন্দ কিংবা ভালোবাসা তৈরি হয় নি। আজ তার ভালোবাসার তিনটি বছর হতে চলেছে। সিমরান তার কিছুই জানে না। তিন বছর আগে নিবিড় সিমরানের ছবি দেখে সে প্রথম পুতুল ভেবে নীরকে জানিয়েছিল……

—” ভাইয়া আমাকে এই পুতুলটা কিনে দিবে। দেখো কি সুন্দর পুতুল। আমার বউ পুতুল।”

নিবিড়ের হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নীর প্রথম সিমরানকে দেখেছিল। ঠোঁটে হাসি, নাকের ডগায় ছোট্ট তিল, চোখ নীল কালো যেন একটা জল জ্যান্ত পুতুল। সেদিনের কথা মনে পড়াতে হেসে দিল নীর। ছোট্ট নিবিড় ছোট থেকেই বিয়ে পাগল ছিল। কোথাও কোনো মেয়ে দেখলেই বলতো……

—” ভাইয়া দেখো আমার বউ যাচ্ছে।”

বউ যাচ্ছে, বউ যাচ্ছে বলতে বলতে সিমরানকে রাস্তা দিয়ে পার হতে দেখেছিল সামনে থেকে। সিমরানের পিছু নিলো সেদিন থেকেই নীর।

—” এহেম, এহেম, বউয়ের কথা ভাবছো ভাইয়া?”

দরজায় টোকা দিয়ে এক পা বাহিরে অন্য পা ভিতরে রেখে বলল নিবিড়। অতীত থেকে ফিরলো নীর, নিবিড়কে দেখে হেসে বলল….

—” তোর মত বিয়ে পাগল আমি না যে সব সময় মেয়েদের কথা ভাববো।”

—” ছোট ছেলেরা বিয়ের কথা ভাববে না এইটাই তো স্বাভাবিক তাই না?”

নিবিড়ের কথা শোনে ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকালো নীর। এত বড় ইনসাল্ট এইটুকু ছেলের কাছে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও পরবর্তী প্ল্যানের জন্য হজম করে নিল। নিবিড় তখন মাথায় হাত দিয়ে তার ছোট ছোট চুল গুলো টেনে বলল….

—” ভাইয়া মাথায় কিছু সমস্যা হচ্ছে!”

—” মানে?”

—” দেখো না একটা বুদ্ধি আসছে আবার চলে যাচ্ছে।”

—” যখন আসছে তখন গেঁথে রাখ তাহলেই তো হয়।”

—” চুল গুলো কেমন যেনো উসকো হয়ে যাচ্ছে। ভাইয়া তোমার চুলে কি জেল ইউজ কর? মানে আমিও ইউজ করতে চাচ্ছি। এখন তো বাংলাদেশের মেয়েরা পিছনে ঘুরে তখন পৃথিবীর মেয়েরা আমার পিছনে ঘুরবে। বলো না কি হেয়ার জেল?”

নীর এখন নিজের চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। ছোট ভাইয়ের পাকনামো এখন তাকে খুব জ্বালাচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপে সাহায্য করার এক মাত্র উপায় ছোট ভাই তাই চুপ থেকে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলল…..

—” চল তোকে আজ সুন্দর একটা ছড়া শিখাই। এই ছড়া শিখলে তোর অনেক খেলার সাথী হবে।”

—” সত্যি?”

—” হুম।”

—” তাহলে বলো?”

—” বল,
আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মৌ,
এতো ডাকি তবু কথা
কও না কেন বউ।

বল চুপ করে আছিস কেন?”

নিবিড় কিছুক্ষণ নিজেই নিজের মাথার চুল গুলো ধীরে ধীরে টান দিয়ে বলল…..

—” তোমার ছড়া তো হয় নাই। এই ছড়া বললে তো কোনো মেয়েই আসবে না আমার পাশে। তখন তো সবাই রাগ দেখাবে।”

নিবিড়ের কথা শোনে আড় চোখে তাকিয়ে বলল নীর…..

—” তাহলে কোন ছড়াতে সবাই তোর কাছে দৌঁড়ে আসবে, শুনি?”

—” শুনো তাহলে, আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মৌ,
রাস্তা ঘাটে যেদিকেই তাকাই
সব জায়গায় দেখি দাঁড়িয়ে আছে বউ।”

নীর এইবার রাগের ছুটে মারতে যায় নিবিড়কে। খিলখিল করে হেসে দৌঁড়াতে শুরু করে নিবিড়। দুই ভাইয়ের বয়সের এত তফাৎ তবুও তাদের দুষ্টুমি, ভালোবাসা, বন্ধন, ঝগড়া ফাইজলামি কোনো কিছুরই কমতি নেই। যেন তারা সমবয়সী। ভাই বোনের বা ভাই ভাইয়ের প্রতি অথবা বোন বোনের প্রতি ভালোবাসা হওয়া উচিত ঠিক এমন। যেখানে থাকবে দুষ্টমি, মাঝে মাঝে শাসন, ভয়ানক আনন্দময় আবদার, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। যাদের ছোঁয়াতে মেতে থাকবে বাড়ি। বাড়ির ভিতরের সব আসবাবপত্র গুলো হাসবে সারাক্ষণ তাদের এই খুনসুটি গুলো দেখে। যেদিন দেখবে ভাই বোনের মান অভিমান সেদিন যেন আসবাবপত্র, ঘর বাড়ি, সব কিছুর মাঝে কষ্টের বিরাজ প্রকাশ পাওয়া।

***** ভাই এবং বোন হলো আপনার হাত এবং পায়ের চেয়েও বেশি নিকটের সম্পর্ক।
— ভিয়েতনাম প্রবাদ******

________________________

বিয়েটা হয়ে গেলো আইরিনের। ভালো ভাবেই মিটেছে বিয়েটা। আইরিনের মা বাবা যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে এমন একটি ভাব নিচ্ছে।

সিমরান আজ অনেকদিন পর কলেজের উদ্দেশ্য হাঁটা দিল। মনটা আজ তার ভীষণ ভালো। আজ বসন্ত , চারদিকে অশান্ত বাতাস তার মনকে করছে প্রফুল্ল। কথায় আছে, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। কিন্তু বসন্ত যখন এসেছে ফুল তো অবশ্যই ফুটবে। চারদিকে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সিমরানের মন পাগলপারা। গাঁদা ফুলের ফুলে আজ সেজেছে সিমরান। গায়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি, খোঁপায় গাজরা ফুল, মাথায় টায়রা আর হাতে পড়েছে কাঁচের চুড়ি। দূর থেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীর। যেন আজ সে বসন্তের রাণীকে দেখছে। নাকের ডগায় ছোট্ট তিলটা খুব সহজেই ধরা পড়লো তার চোখে। কিন্তু বড় আফসোস আজ সে সাজেনি । তবে নিবিড় আজ বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি পরে নেমেছে রাস্তায়, তাকে দেখতে একদম পুতুল মনে হচ্ছে। রাস্তা দিয়ে নেচে নেচে যাচ্ছে আর মেয়েরা তার সাথে পিক নিচ্ছে, গাল টেনে দিচ্ছে, অনেকে চুমুও খাচ্ছে। মেয়েদের কাছ থেকে সরে এসে নীরকে বলল…..

—” দেখো ভাইয়া, মেয়েগুলো কত অভদ্র , রাস্তাঘাট কিছু দেখে না নাকি হুম? আমার গালে পাপ্পি দিচ্ছে ছিঃ কি লজ্জা।”

—” তুমি এতটাই কিউট দেখতে আমারই তো পাপ্পি দিতে ইচ্ছা করছে । দিবো নাকি পাপ্পি?”

পিছন থেকে সিমরানের কণ্ঠ শোনে তাকালো দুই ভাই। নিবিড় দৌড়ে গিয়ে তার গাল পেতে বলল….

—” ভাবী, তোমার জন্য তো আমার গাল দুটো ফ্রী। নেও পাপ্পি দেও।”

সিমরান নিবিড়ের গালে পাপ্পি দিতেই নিবিড় চোখ টিপ দিলো নীরের দিকে তাকিয়ে। ইশারাতে বুঝালো এই পাপ্পি সে তার জন্য নিচ্ছে না নীরের জন্য নিয়েছে। পাপ্পি নিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে দাঁড়ালো নীরের সামনে আবারো চোখ টিপ দিয়ে বলল….

—” ভাইয়া তুমিও একটা পাপ্পি দেও এই গালে।”

নীর পাপ্পি দেওয়ার পর নিবিড় মুখ চেপে হাসতে লাগলো। নীর রাগী চোখে তাকাতেই বলল….

—” যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর, আব্বু বলেছে সকালে।”

সিমরান এদিক ওদিক তাকিয়ে নওশীনের জন্য অপেক্ষা করছে হটাৎ তার চোখ জোড়া সামনে একজনকে দেখে আটকে গেলো। মুখের হাসিটুকু নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। চোখের কোণে পানি এসে জমতে শুরু করলো। এ কাকে দেখছে সে? এতগুলো বছর ধরে যার জন্য সে অপেক্ষা করছে আস কিনা সে…….

চলবে……

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।