এক মুঠো রঙ পর্ব-০৬

0
1221

#এক_মুঠো_রঙ
#ফারজানা_আফরোজ
#ষষ্ঠ_পর্ব

বিয়ের দিন রাতে বাবা মায়ের ঠিক করা ছেলেকে বিয়ে করবে না বলে পালিয়ে গিয়েছিল সেতু। তিন দিন সে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু কেউ তার কথা শুনেনি। অতঃপর এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে ত্যাগ করতে হলো পরিবার। আজ দশটি বছর পর সেতুকে দেখে সিমরানের চোখে পানি। সিমরানের খেলার সাথী, ভালোবাসা প্রকাশ করার একজন মাত্র ব্যাক্তি ছিলেন সেতু। সেতু সম্পর্কে সিমরানের ফুফু হয়। নিজের নামের সাথে মিল রেখে নাম রেখেছিলেন ভাতিজির। আজ দশটি বছর পর ফুফুকে দেখে ঠিকই চিনে ফেলল সিমরান। পা দুটো বার বার বলছে…..

—” এই সিমরান দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দেখ কে তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চিনতে পারছিস না আরেহ উনি তো তোর ফুফি। যার কাছেই তোর ছোট বেলার দিন গুলো অর্ধেক কেটে যেতো। যা তাড়াতাড়ি যা উনার কাছে, জড়িয়ে ধর উনাকে।”

পার্কের কোণে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস সেতু রহমান এবং তার স্বামী জনাব শরীফ আহমেদ। বয়স বাড়লেও ভালোবাসা কিংবা আনন্দ কিছুই কমেনি তাদের। মুখ জোরে রয়েছে আনন্দের হাসি। সিমরান সেদিকে পা বাড়ালো কিন্তু মাঝ পথে কিছুটা অভিমান, কষ্ট, রাগ গেঁথে বসলো তার মনে। এক আকাশ অভিমান নিয়ে মনে মনে বলল…..

—” ভালোই তো আছো তুমি তাহলে কেন যাবো তোমার কাছে। তোমার কাছে তো এখন আমার কোনো মূল্য নেই। যদি থাকতো তাহলে কি এই ছোট্ট সিমরানকে রেখে চলে যেতে পারতে? যাবার আগে আমার কথা কি তোমার মনে আসেনি। আসবেই বা কেন তুমি যাকে চেয়েছো তাকেই তো পেয়েছ আমার কথা কেন ভাববে। যাবো না তোমার কাছে, সম্পর্ক নেই আমাদের।”

মনের ভিতরের অভিমান হলো চোখ বেয়ে পানি হিসেবে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। হঠাৎ নওশীনের কথা শোনে হুস ফিরলে চোখ পরিষ্কার করে রাগী কণ্ঠে বলল….

—” এতক্ষণ ধরে ওয়েট করছি কিন্তু মেডামের তো কোনো খবরই দেখছি না। বলি এত দেরি কিসের?”

—” সাঁজতে দেরি হলো কিন্তু তুই কান্না কেন করছিলি? ওই সাদাত ফাদাত কে কি মনে পড়লো নাকি তোর?”

—” সাদাত আবার ফাদাত কেমনে হয়? বাই দা ওয়ে ওই ফাজিলের কথা কেন মনে করবো। শোন, আমার চোখের পানি এত তুচ্ছ নয় যে খারাপ লোকের কথা ভেবে কান্না করব। আমি তো এত এত কাপল দেখে কান্না করছি। আজ সবাই কাপল হয়ে এসেছে আর আমরা দুজন কিনা সিঙ্গেল হয়েই এসেছি। জানিস নওশীন, আমাদের কপালে প্রেম, ভালোবাসা এবং বিয়ে তিনটার থেকে যেকোনো একটাও লেখা নাই। তাই তো একুশ বছর ধরে নামের আগে সিঙ্গেল উপাধি নিয়ে ঘুরছি।”

হেসে দিল নওশীন। এই ফাঁকে সিমরান এড়িয়ে গেলো তার কান্নার রহস্য। দুই বান্ধবী পা মিলিয়ে কলেজের ভিতর চলে গেলো।

অন্যদিকে, নিবিড় আইস্ক্রিম খাবার বায়না করে টেনে হিচড়ে নীরকে নিয়ে চলে গেলো। বেচারা নীরের আর প্রেম করা হলো না। মনে মনে নিবিড়ের গুষ্টি উদ্ধার করে পরে নিজেকেই বকতে লাগলো। কেননা, নিবিড়ের গুষ্টি মানে সেখানে সে স্বয়ং আছে। ছোট ভাইকে বকতে গিয়ে নিজেকেও দিয়ে দিলো অবশেষে।

__________________

কলেজ মাঠের এক কোণায় বিভিন্ন ধরনের রঙ নিয়ে বসে আছে একদল তরুণ। সিমরান অবাক হয়ে নওশীনকে বলল…..

—” বসন্ত বরণে রঙ খেলা হয় নাকি?”

—” হ্যাঁ। এইবার তো কলেজে বসন্ত উৎসবে রঙ খেলা হবে কেন জানিস না তুই?”

মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ‘না’ অর্থ বুঝালো সিমরান। নওশীন তখন নিজের মাথায় নিজেই চাপড় মেরে বলল…..

—” মাইয়া তুমি কোনোদিন ঠিক হইবা না। কলেজের সবাই এই কথা জানি আর তুমি কিনা ঢং দেখানোর জন্য কলেজ ভর্তি হইছো মাইয়া।”

নওশীনের রাগ উঠলে সে তখন মাইয়া মাইয়া বলে সম্মেধন করে। ওর রাগ দেখে মনে হচ্ছে সিমরান ভুল কিছু করে ফেলেছে। রঙ খেলা বিষয়ক সে কিছু জানে না তারমানে সে কঠিনতম অপরাধ করে ফেলেছে। এই অপরাধের জন্য তাকে অবশ্যই মৃত্যু দণ্ড দেওয়া উচিৎ।

*** বসন্ত বাতাসে সইগো

বসন্ত বাতাসে

বসন্ত বাতাসে সইগো

বসন্ত বাতাসে

বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ

বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ

আমার বাড়ি আসে

সইগো বসন্ত বাতাসে*******

নাচ শুরু হয়ে গেলো। ছেলে মেয়েদের নাচে মেতে উঠলো পুরো কলেজ। কলেজও মনে হচ্ছে নাচছে তরুণ তরুণীদের সাথে। কিন্তু নওশীন ও সিমরান ব্যস্ত রঙ খেলা নিয়ে। হঠাৎ কেউ একজন এক মুঠো রঙ সিমরানের গায়ে ছুঁয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেলো। চোখের ভিতর রঙ যাওয়াতে ভালো করে দেখতে পেলো না ছেলেটি কে। তবে ঝাপ্সা চোখে শার্টের কিছুটা অংশ দেখতে পেয়ে বুঝে গেলো ছেলেটি কে। ছেলেটি হলো নীর। সিমরান হেসে আবারও নওশীনকে রঙ লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

এইবার চোখ জ্বলছে সিমরানের। নওশীনকে বলে ওয়াশ রুমের দিকে হাঁটা দিল সে। চোখ মুখ পরিষ্কার করে ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই কেউ একজন হেচকা টান দিয়ে ক্লাস রুমের ভিতরে নিয়ে গেলো। সিমরান লোকটির বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। চোখ মেলে সেই চিনা শার্টটি দেখে রেগে বলল…..

—” হঠাৎ কি হলো আপনার? আপনার ব্যাবহার কিন্তু মোটেও ঠিক লাগছে না।”

হাসলো নীর। সিমরানের নাকের ডগায় তিলটায় হাত বুলিয়ে বলল….

—” আমাকে চিনতে পারছো না তুমি? কি এমন দেখলে যে অচেনা লাগছে। তাছাড়া আপনি করে কেন বলছো? তোমার কথাতেই তো এসেছি আমি।”

সিমরান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। নীর কি পাগল তাগল হয়ে গেলো নাকি ভাবাচ্ছে তাকে। তবুও শক্ত হয়ে বলল….

—” মজা কেন করছেন? আজব!”

—” তোমার কণ্ঠ হঠাৎ চেঞ্জ কেন হলো? ঠাণ্ডা কিছু খেয়েছো তাই না? সাজি।”

—” হোয়াট? কে সাজি? ভাই আমি সাজি পাজি না আমি সিমরান।”

অবাক হওয়ার ভান ধরে ছেড়ে দিল সিমরানকে। অনেক বড় ভুল করেছে এমন একটি ভাব নিয়ে বলল…..

—” এই ছিঃ ছিঃ আপনি এইখানে কেন? এইখানে তো আমার গার্লফ্রেন্ড সাজিয়া থাকার কথা ছিল। সরি মিস।”

সিমরান কিছু না বলে চলে যায়। সিমরান যাবার পরেই হাসতে থাকে নীর। ইচ্ছা করেই সিমরানকে রাগিয়েছে সে। সিমরানকে রঙ লাগানোর পর এক চিলতে হাসি দেখেছিল দূর থেকে। হাসির কারণ সিমরান যে একটু একটু করে পছন্দ করতে শুরু করেছে। নীর সে তো একটু একটু পছন্দ চায় না সে চায় অনেক অনেক ভালোবাসা, তাইতো রাগিয়ে দিয়ে মনের ভিতরের অনুভুতি প্রকাশ করার ইচ্ছা জাগালো।

__________________

পরের দিন…….

স্কুলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে নিবিড়। মনটা আজ তার ভীষণ খারাপ কেননা মিশু আজ স্কুলে আসেনি। চুপটি মেরে বসে বসে ক্লাস করছে সে। স্যার তখন তাকে প্রশ্ন করল…….

—” বলো তো নিবিড় কোন প্রাণী দাঁড়িয়ে ঘুমায়?”

—” স্যার, আমি তো মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে ঘুমাই। তাহলে উত্তর হবে নিবিড়।”

স্যার বোকা বনে গেলো। এই ছেলেটিকে তিনি আজও মানুষ করতে পারলেন না। ক্লাসে সব সময় অমনোযোগী থাকলেও পরীক্ষার রেজাল্ট যখন আসে তখন দেখা যায় ওই প্রথম স্থান অর্জন করেছে। তাই কোনো স্যার ম্যাম আর তাকে ক্লাস থেকে বের করে দেয় না। স্যার তখন আরেকটি প্রশ্ন করলো…..

—” সত্যিই তুমি আজব প্রাণী। তো এখন বলো তো? কোন প্রাণী মুখ দিয়ে মলত্যাগ করে?”

প্রশ্ন শোনে নিবিড় তার ছোট্ট মুখটাকে টেনে টেনে বলল….

—-” ইয়াক থু থু ওয়াক কি বলছেন স্যার? ছিঃ এই রকম খচ্চর প্রাণী পৃথিবীতে আছে? ইশ কেন যে আমি আগে জানলাম না তাহলে তো রুম থেকেই বের হতাম না ওয়াক।”

নাক ধরে কথাগুলো বলতে লাগলো। স্যার আর কোনো প্রশ্ন না করে উনার কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

চলবে…..

বানান ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।