এক সমুদ্র ফুল পর্ব-০১

0
6019

এক_সমুদ্র_ফুল
#পর্ব_1
Writer::Shaanj Nahar Sanjida

মেয়ে হয়ে একটা মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছি।আর সে মেয়েটা আর কেউ নয় আমারই ননদ।নিজের অবস্থার কথা ভেবে হাসবো না কাদবো এই চিন্তায় আছি।

এপ্রিল মাসের এই কড়া রোদের মধ্যে দিয়ে প্রচন্ড বেগে স্কুটার চালিয়ে যাচ্ছি।যদিও বাতাসের কারণে বেশি রোদের আলো লাগছে না।তবুও ঘামছি।কিন্তু এই ঘামা রোদের আলোর জন্য না এই ঘামা ভয়ে।কারণ এই খবর আমার শ্বশুর বাড়িতে গেলে আমার কপালে শনি।বিশেষ করে আমার শ্বশুর মশাই জানলে আমাকে কিছু বলার আগেই উনি হার্ট এ্যাটাক করবে।এইসব জানার পরেও আমি ওকেই সাহায্য করছি।কি কপাল আমার!আগে কুমির পিছে খাল। কোথাও যাওয়ার রাস্তা নেই আমার।
এইটা ভেবেই একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলাম।

আমার নাম ফুল।না এই ফুলের আগে কিছু আছে না পরে।শুধুই ফুল।আর যাকে নিয়ে পালাচ্ছি সে আমার ননদ আমার স্বামীর এক মাত্র ছোটো বোন।আমার বয়স 21 হলেও বিয়ে আমার অনেক আগেই হয়েছে।
এইসব কথা ভাবছি তখনই পিছন থেকে সোনালী(আমার ননদ) ভয়ে ভয়ে বললো

ফুল তুই কাপছিস কেন?

(উনি আমার বয়সে বড়ো।ছোটো বেলা থেকেই উনি আমাকে তুই বলেই ডাকে আর আমি ডাকি সোনালী আপু বলে।সম্পর্কে পরিবর্তন আসলেও আমাদের একে অপরকে ডাকাতে পরিবর্তন আসেনি)

এমন এক পরিস্থিতিতে এনে দাড় করিয়ে বলছো কেনো কাপছি।(আমি শুকনো ঢোক গিলে)

সরি ফুল।বাবা জানলে তোকে খুব বকবে তাই না?(সোনালী)

ব্যাপার না।আমার কথা চিন্তা করতে হবে না।তুমি রাকিবের সাথে খুশি থাকলেই আমার হবে।(আমি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে)

(রাকিব,,যাকে ভালোবেসে আমার ননদ পালাচ্ছে)

অবাক করার বিষয় হলো ফুল!(সোনালী)

এখন এর থেকে কি তোমাকে বেশি অবাক করছে সোনালী আপু?(আমি দাত চেপে চেপে)

এইযে,,যেই তুই আমার বাবার বিরুদ্ধে কখনও কথা বলিস না আজ সেই তুই কি করে বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় সাহায্য করতে আসলি!(সোনালী অবাক হয়ে)

আমি সোনালী আপুর কথায় ভাবতে লাগলাম
যেই আমি কোনো দিন আমার শ্বশুরের অবজ্ঞা করিনি আজ সেই আমি তার বিরুদ্ধে যাচ্ছি।কারণ আমি জানি এখানে যদি একজন থাকতো তাহলে কোনোদিন তার বোনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে বিয়ে দিতো না।যদিও সে এখন নেই তাই আমিই তার এই কাজটা সম্পূর্ন করছি। স্বামীর কাজ সম্পূর্ন করা তো স্ত্রীর কর্তব্য।আমি সেই কর্তব্য পালন করছি।

কী হলো বল?(সোনালী আমাকে ধাক্কা দিয়ে)

সব হয়েছে তোমার জন্য।তুমি যদি আগে আমাকে বলতে তাহলে এমন হতো না।আমি নিশ্চয়ই বাবাকে মানিয়ে নিতাম।(আমি)

দেখ ফুল।আমি কিন্তু বাবাকে সব বলেছি উনি কিছুতেই আমার বিয়ে রাকিবের সাথে দিবে না।আর তোর কথা তো বলিসও বাবা যদি পূর্বকে পশ্চিম বলে তুই সেটাতেই হা বলবি।(সোনালী মুখ ফুলিয়ে)

তাহলে এখন কি করছি শুনি?(আমি ভ্রু কুঁচকে)

ভাইয়ের কথা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছি বলে তুই সাহায্য করছিস!না হলে কি করতি?(সোনালী বিড়বিড় করে)

কিছু বললে?জোরে বলো। হাওয়ার কারণে শুনতে পাচ্ছি না।(আমি)

কিছু না।তাড়াতাড়ি চল।(সোনালী)

আমি আর তর্ক না করে স্কুটার চালাতে লাগলাম।


আমরা গিয়ে রাকিবের যেই বাড়িতে থাকে সেই বাড়িতে ঢুকলাম।রাকিব একটা পাঁচ তলা ভবনের ভেতরে দ্বিতীয় তলাতে থাকে।আমরা দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখলাম রাকিবের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা।আমি হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবো তখনই সোনালী আপু আমাকে আটকে বললো
ফুল।আমি গিয়ে বরং ওকে সারপ্রাইজ দেই!তুই চল গিয়ে দেখবি ও কতো খুশি হয় আমাকে দেখে।(সোনালী এক্সসাইটেড হয়ে)

বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড নেকামি।(আমি বিরক্ত হয়ে)

তুই কি বুঝবি?চল।
বলেই সোনালী আপু আমাকে টেনে নিয়ে গেল ভিতরে।


ভিতরে
রাকিবের রুমের দরজা হালকা খোলা ছিল।ওর রুমের ভিতর রাকিব আর ওর দুজন ফ্রেন্ড ছিল।তাদের মধ্যে কথা বার্তা চলছে।আমি আর সোনালী আপু বাহিরে দাড়িয়ে আছি চুপ করে

কী করে এতো বড়োলোকের মেয়েকে ফাসিয়েছিস রাকিব?(রাকিবের বন্ধু)

আরে বুঝলি বড়োলোকের মেয়েরা বলদ হয় বুঝলি!এদের খালি একটু ইমোশন দেখাও,, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলো,একটু ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকো ব্যাস হয়ে গেলো।উনি আপনার প্রেমে পাগল।(রাকিব হাসতে হাসতে)

কিন্তু শুনেছি ওর বাবা নাকি তোদের বিয়েতে রাজি না।(রাকিবের আরেক বন্ধু)

তাতে কি? উনার মেয়ে তো রাজি!জানিস ওই বলদ মেয়েকে বলেছি “”তুমি এসে পরো আমরা পালিয়ে বিয়ে করে নেই।দেখবে তোমার বাবা একদিন ঠিক মেনে নিবে””।আর ওই স্টুপিড বিশ্বাসও করেছে।একবার আসুক বিয়েটা করার পরেই ওকে বাধ্য করবো ওর বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে আর এক বার টাকা পেয়ে যাই ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিবো।

বলেই রাকিব হো হো করে হেসে উঠলো।

দোস্ত ফেলে দেয়ার আগে আমাদের একটু দিস আমরাও টেস্ট করবো।কি বলিস?(রাকিবের বন্ধু)

আরে তোদের না দিলে কি হবে?(রাকিব হেসে)

এইটা শুনতেই ঘৃণায় আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।চোখ খুলে সোনালী আপুর দিকে তাকাতেই দেখলাম উনার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।যখনই উনি কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করে তখনই এমন চোখ মুখ লাল হয়ে যায়।এদিকে আমারও চোখ মুখ লাল হয়ে আছে কিন্তু আমারটা রাগে।

আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম কিছু আছে কি না!পরেই সোফার কাছে দুটো ক্রিকেট ব্যাট দেখতে পেলাম। ব্যাস হয়ে গেল,,পেয়ে গেলাম নিজের রাগ ফালানোর জায়গা।গিয়ে ব্যাট হাতে নিয়ে একটা সোনালী আপুর কাছে দিলাম।সোনালী আপু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে শিকদার বাড়ির বউ আর মেয়ে কি জিনিস?(আমি হাতে ব্যাট ঘুরিয়ে)

হুম।চল।আমি ডিজিটাল যুগের মেয়ে।ধোঁকা খেয়ে না কাদবো না সুইসাইড করবো।বরং যে ধোঁকা দিয়েছে তার দাঁত ভেঙ্গে দিবো।(সোনালী চোখ মুখ মুছে)

পরেই আমরা ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম।

আরে সোনালী তুমি?(রাকিব এক মুহুর্তে নিজের রং পাল্টে)

হুম।(সোনালী ভয়ংকর ভাবে হেসে)

কী হয়েছে ভাবী?(রাকিবের বন্ধুরা)

ভাবী ডেকেছেন?আবার সেই ভাবীর উপর কু নজর দিচ্ছেন!(আমি)

মানে?উনি কি বলছেন?সোনালী কে উনি?আর কেনই বা উনি আমার বন্ধুদের অপমান করেছেন!(রাকিব)

উনি হচ্ছে আমার ভাবী।শিকদার বাড়ির সিংহী।আর যেহেতু আমি তোমার সব সত্যিই জানি।সেহেতু তোমাকে এখন নিজের হাতে শাস্তি দিবো। থ্যাঙ্ক ইউ ভাবী আমাকে সাহস দেয়ার জন্য।(সোনালী)

ওয়েলকাম ননদিনী।তো খেলা শুরু করা যাক।(আমি)

কিসের খেলা!(রাকিব অবাক হয়ে)

অবশ্যই ভাবী।
বলেই সোনালী আর আমি ইচ্ছে মতো রাকিব আর ওর বন্ধুদের পিটালাম।সোনালী রাকিবকে মারতে মারতে কেঁদে দিলো।

পরেই ননদ আর ভাবী।সেই জঘন্য জায়গা থেকে চলে আসলাম।

রাকিব ওর এতো সাহস কি হলো?(রাকিবের বন্ধু)

ওর সাহস না ওর ওই ভাবীর সাহস।(রাকিব দাত চেপে চেপে)


আমি আর সোনালী আপু বাড়ি ফিরছি।সোনালী আপু আমার পিঠে মাথা রেখে চুপ করে আমার পিছনে বসে আছে।আর আমি স্কুটার চালাচ্ছি।

আপু তুমি ঠিক আছো?(আমি পিছনে আড় চোখে তাকিয়ে)

আরে তুই কি ভেবেছিস ওই অসভ্য ছেলের জন্য কেদে নিজের চোখের ক্ষতি করবো?(সোনালী)

আমি হেসে
ভালো।তা এখন কি করবে?(আমি)

ভাবছি বাবার দেখা পাত্রর সাথেই বিয়ে করে ফেলি।কি বলিস বয়স তো আর কম হলো না।24 বছর হয়ে গেছে।(সোনালী)

যা ভালো মনে কর।(আমি মুচকি হেসে)

ও হ্যা ভালো কথা তুই কিন্তু বাড়ির কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলিস না।নাইলে কিন্তু কেয়ামত হয়ে যাবে।(সোনালী)

সমস্যা নেই।শপিং এ যাবো বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলাম।যাওয়ার আগে কিছু কিনে নিও যাবো কেউ সন্দেহ করবে না।(আমি)

ওয়াও।তুই কতো বুদ্ধিমতী ফুল।
বলেই সোনালী আপু আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।

আপু আমার সুড়সুড়ি লাগছে।ছাড়ো নাহলে অ্যাকসিডেন্ট হবে।(আমি)

ওকে ওকে।আমি বাবা এখন মরতে চাই না।তুই মনোযোগ দিয়ে চালা।
বলেই সোনালী আপু চুপ করে বসে রইল।


শিকদার বাড়ি
আম্মুউউউ,,(আলো)
আমি ভিতরে ঢুকতেই আম্মু আম্মু বলে চিৎকার করতে করতে এক দৌড়ে আলো আমার কোলে চলে আসলো।

এসেছে একজন।আম্মু বলতে অজ্ঞান।(সোনালী আলোর গাল টেনে)

এমন করো কেনো ফুপি?আমি কি তোমার আসি না?(আলো আদো আদো গলায়)

আমার মেয়ে আলো।নামের মত আমার জীবনেও আলো হয়েছে এসেছে।কিছু পরিস্থিতির জন্য মাত্র 17 বছর বয়সে আমি মা হওয়ার সাধ পাই।সত্যিই মা হওয়া অনেক গর্বের।এই চার বছরের বাচ্চার মধ্যে যেনো আমার জান রয়েছে।আমি আলোর দিকে তাকিয়ে কথা গুলো ভাবছি তখনই বাবা এলো,,

আলো এখন জান ফিরে পেয়েছে কারণ ওর মা ফিরে এসেছে।তাই না আলোমনি।(আরমান শিকদার — আমার শ্বশুর।যাকে আমি নিজের বাবা থেকে বেশি ভালোবাসি।যার কথার অবাধ্য হওয়া আমি ভাবতেও পারি না।যদিও আজ একটুর জন্য বেচেঁ গেছি)

ঠিক বলেছেন বাবা।আলো মাকে পেয়ে যেনো আমাদের চিনতেই চায় না।(মিতু শিকদার — উনি আমার ভাসুর সাগরের স্ত্রী।আর আমার ভাসুর আর্মিতে তাই বেশিরভাগ সময়ই উনি বাড়ির বাহিরে থাকে)

আম্মু আমার ঘুম পাচ্ছে।(আলো সবাইকে মুখ ফুলা লুক দিয়ে)

হ্যা হা।নিয়ে যাও যেনো ওরই একটা মা আছে।আমাদের নেই।
বলেই সোনালী ওর গাল টেনে দিলো।

আমি মুচকি হেসে আলোকে নামিয়ে ওর হাত ধরে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম,,

আলোর মার কথা শুনে মনে পড়লো।আমার মা কই?দেখছি না যে।(সোনালী এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো)

তোর মা সমুদ্রের সাথে কথা বলছে।ও হ্যা বৌমা।দু এক দিনের মধ্যে সমুদ্র দেশে আসবে।এইবার আসলে আর যাবে না বলেছে।(আরমান)

আমি বাবার কথা শুনে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলাম

আলো আমার হাত ঝাকিয়ে বললো

আম্মু।আমার বাবা আসবে!অনেক মজা হবে না।

আমি আলোর চোখে চোখ খুশির ঝলক দেখতে পেলাম।এই প্রথম মেয়েটা তার বাবাকে দেখবে বলে কতই না খুশি হলো।কিন্তু আমার যে ভয় হতে শুরু করছে। যার সাথে আমার আজ প্রায় পাঁচ বছর ধরে কোনো কথা হয় না,,যার সাথে আমার সম্পর্ক আছে কি না আমি তাও সঠিকভাবে জানি না।আর আজ হটাৎ শুনলাম সে আসবে,,।এতে কি আমার খুশি হাওয়া উচিত?


চলবে