এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-০৪

0
171

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ০৪
সানজিদা মাহি
________________________________________

” আরে আরে! করেন কি! ”

কর্তা মশাই শুতে যাচ্ছিলেন। আমার চেঁচানো শুনে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।

” কি হয়েছে? ”
” নামাজ পড়বেন না? ”
” ইয়ে মানে…ক্লান্ত লাগছে। একটু শুয়ে নেই ”
” আগে নামাজটা পড়ে নিলে ভালো হবে। আসুন একসাথে পড়ি। আসুন না ”

এভাবে বললে কাউকে মানা করা যায় না। সুতরাং কর্তা মশাইকে আমার কথায় অজু করে আসতে হলো।
” আচ্ছা আপনি ক্লিন শেভ করেন কেন? দাঁড়িতে কত সুন্দর লাগে জানেন? আর ক্লিন শেভ করলে লাগে হুতুম পেঁচার মতো! ”

আমার কথা শুনে আপনাতেই উনার হাতটা গালে চলে গেল। মুখটাও সেই দেখতে হয়েছে। আমার ভীষণ হাসি পেল। হাসি চেপে দুটো ছোট শীতলপাটি সামান্য উপরে-নিচে করে পাশাপাশি বিছিয়ে দিলাম।

” নিন, আপনি ইমামতি করুন ”

কর্তা মশাই একটু একটু করে সহজ হচ্ছেন তা বেশ বুঝতে পারছি। যেকোনো কিছুর ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়া হলেও করেন। খুব বেশি কথা না বললেও যেটুকু বলেন তাও চুপ থাকার চেয়ে ঢের ভালো। কিছুক্ষণ আগে নামাজ শেষ করে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিয়ে খাটে বসেছি। চুলায় ভাত বসিয়েছিলাম৷ এখনো হয়নি। আজ বেশ শীত শীত লাগছে। বৃষ্টিতে ভিজে দীর্ঘক্ষণ ভেজা কাপড়ে থাকার ফল। তবুও আমার জানালা খোলা রাখার অভ্যেসটা অব্যাহত আছে। তিনি একবার বলেছিলেন বন্ধ করে দিতে। বললাম, জানালা বন্ধ করলে দম বন্ধ লাগে। আমি নিজের বাসায় থাকাকালীন সময়েও রাতের বেলায় জানালা বন্ধ করতাম না। শুধুমাত্র মশার হাত থেকে রেহাই পেতে সন্ধ্যার দিকে আটকে রাখতে হতো। ওইসময়ে মশার উপদ্রব বেশি। তারপর ঘন্টা দুয়েক পর আবার জানালা খুলে দিতাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে জানালার বাইরে তাকানো চাই৷ আর গরমকালে তো বন্ধ করার উপায়ই নেই৷ বিশেষ করে লোডশেডিংয়ের সময় বাসার সব কয়টা জানালাই খোলা থাকে। চোরের উপদ্রব তেমন একটা নেই আমাদের এলাকায়। এই একটা কারণে জানালা খোলা রাখা নিয়ে কেউ কিছু বলতো না আমাকে। তবে ছোট বোনটা যতদিন ছিল ততদিন ওর জন্য জানালা খোলা রাখতে পারতাম না। একবারে ভীতুর ডিম একটা৷ জানালার বাইরে অন্ধকারে চোখ পড়লেই নাকি ভয় হয়। কিসব অদ্ভুত কথা!

খোলা জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া গায়ে লাগতেই শিরশিরে অনুভূতি হলো। কাঁথাটা একটু গায়ে জড়িয়ে বসলাম। চুলের খোপা খুলে গেল হাতের ধাক্কায়। অভিজ্ঞ দু’হাতে ফের খোঁপা করে নিলাম। কর্তা মশাই খানিকটা দূরে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছেন। আমার দৃষ্টি বাইরের দিকে। এদিকটায় নিচু দেয়াল বলে নদীটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। নদীর ওপারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃত্তাকার আলো গুলো আজ কিছুটা কম। হয়তো লাগাতার বৃষ্টির কারণে ওদিককার দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা কিছু দোকান খোলাই হয়নি। সেকারণে নদীটা ঠাহরানো যাচ্ছে না পরিষ্কারভাবে। বৃষ্টি নেই আপাতত। ব্যাঙেরা ডেকে চলেছে অবিরত। হঠাৎ মনে হলো, এই জায়গাটা ছেড়ে যদি কোনোদিন চলে যেতে হয় আমাকে তবে প্রকৃতিকে কাছ থেকে অনুভব করার প্রতিটা মুহূর্তকে প্রবলভাবে মিস করব। স্মৃতিচারণ করা আমার ব্যক্তিবৈশিষ্ট। চলে যাওয়া প্রতিটা মুহূর্ত যেন আমাকে কিছু না কিছু অনুভূতি দিয়ে যায়। হোক তা সুখের বা বেদনার।

” আপনি মানুষটা অন্যরকম ”

চমকে ফিরলাম তার দিকে।
” অন্যরকম বলতে? ”
” মানে একটু চঞ্চল, পাগলাটে, বৃষ্টি পাগল আর ছেলেমানুষ ধরনের ”
লাজুক হাসি দিয়ে সামনের চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বললাম,
” খেয়াল করেছেন তাহলে…”
” তা করেছি ”
” আপনি কি সবসময় এমন কথা কম বলেন? ”
” আগে খুব কথা বলতাম। এখানে আসার পর চুপচাপ হয়ে গেছি। কথা বলার মতো তেমন কেউ নেই তা তো দেখলেনই ”
” এখন থেকে বেশি বেশি কথা বলবেন আমার সঙ্গে। আমি একজন আদর্শ শ্রোতা জানেন তো? ” বলেই খিলখিল করে একচোট হাসলাম৷ পরক্ষণেই লজ্জায় লাল হতে হলো। অনুনয়ের সুরে বললাম,
” আচ্ছা একটা গল্প বলুন না ”
” কি গল্প? ”
” যেকোনো ”
” আমি তো গল্প পারি না ”
” জ্বীন টিনের গল্প পারেন না? বা আপনার সাথে ঘটে যাওয়া কোনো অদ্ভুত গল্প? এ-ধরনের গল্প শুনতে আমার অনেক ভালো লাগে! ”
আগ্রহ নিয়ে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। কর্তা মশাই চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলেন।

” আম্মার মুখ থেকে একটা ঘটনা শুনেছিলাম। সেটাই বলব? ”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
” হ্যা বলুন না ”
” অনেকদিন আগের কথা। আমি তখন খুব ছোট।
আমার দুই বুবু ছিলেন আমার চেয়ে অনেকটা বড়। আমার আব্বা তখন বাজারে নাইট গার্ডের চাকরি করতেন। একবার খালামনি আর নানাভাই পিঠা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। তাতে মিষ্টি কম হয়ে গিয়েছিল। আমার আব্বা আবার মিষ্টি পছন্দ করেন খুব। তো আম্মা আর খালা গিয়েছিলেন পাশের বাড়িতে চিনি আনতে। চিনি কিনতে গিয়ে আম্মা শুনতে পেলেন, আব্বা গান গাইতে গাইতে আসছেন। আব্বা আসছেন বলে আম্মা তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে এলেন। এসে ভাত বেড়ে বসে আছেন অথচ আব্বার আর খোঁজ নেই। আব্বা গিয়েছিলেন আমাদের এলাকার একটা সালিশে। আম্মা তো এদিকে দুশ্চিন্তায় পড়লেন।
আমাদের বাড়িটা গ্রামের ভিতরের দিকে। বাড়িতে মানুষজনও কম ছিল। গ্রামের লোকেরা খুব দ্রুত ঘুমিয়ে যেতো। রাত আটটা বাজতেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। আম্মা খালাসহ রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন আব্বার খোঁজে। কাউকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখলেই আব্বার কথা জিজ্ঞেস করতেন আম্মা। অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থাকার পরও আব্বার দেখা মিলল না। কিছুক্ষন পরে আম্মা দেখলেন সাদা কাপড় পরা এক বৃদ্ধ মহিলা এদিকেই আসছেন। আম্মা ভেবেছেন চেনা শোনা কেউ হবে। তাই তাকে ডাকলেন কিন্তু তিনি কথার উত্তর দিলেন না। আম্মা কয়েকবার তাকে ডাকলেন কিন্তু সাড়া মিললো না৷
খালামনি অন্যকিছু আঁচ করতে পেরে আম্মাকে বললেন, “বুবু সরে আয়। উনি মানুষ না! ”
আম্মা একই সঙ্গে বিস্ময় ও মৃদু রাগে হতচকিত হয়ে বললেন, ” মানুষ না এ আবার কেমন কথা! ”

আম্মা বিরক্ত হয়ে মহিলাকে উদ্দেশ্য করে খানিকটা কড়া সুরে বকা দিলেন। তখন তিনি রাস্তার ওইপাশ থেকে আম্মার দিকে ধেয়ে এলেন রাগত হয়ে মারমুখো ভাবে। খালামনি আম্মাকে টেনে নিয়ে বাড়ির ভিতর চলে এলেন। আম্মা খুব জেদি আর সাহসী ছিলেন বরাবর। তিনি দেখবেনই ওটা কে ছিল। তাই তিনি আবার রাস্তায় গেলেন। গিয়ে দেখলেন একটু সামনেই তিন রাস্তার মোড়ে বৃদ্ধ মহিলা একবার ঘোড়ায় রূপ নিলেন তারপর রূপ বদলে বিড়াল এবং এরপর একজন নতুন বউয়ের সাজে পুনরায় মানুষে পরিণত হলেন। আর তারপর আগুনের গোলার ন্যায় আকাশে উঠে গেলেন। এটা দেখে আম্মা ভয়ে কোনেরকমে ত্রস্ত পায়ে বাড়ির ভেতর ফিরে এলেন। পরে আব্বা আসার পর সবকিছু জানালেন তাকে “*
” এটি সত্যিকার ঘটনা? ”
” সত্য মিথ্যা কতটুকু আল্লাহই ভালো জানেন। আমি যতটুকু শুনেছি তাই বললাম ”

টের পেলাম হাতের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। বাতাসের শো শো শব্দটাকে এখন কি একটু অন্যরকম লাগছে? কর্তা মশাই মৃদু হেসে বললেন, ” কি ভয় পাচ্ছেন নাকি? ”
ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম, ” আমি অত ভীতু নই ”
” আপনি ঠিক শান্তার মতো। সেও ভয় পেলে বলে, আমি মোটেই ভীতু না ”
” শান্তা? ”
ভাতের মাড় উপচে পড়ার শব্দ হতেই তিনি দৌড়ে উঠে গেলেন। আমার মাথার ভেতর ঘুরতে লাগলো একটি নাম, শান্তা। এই শান্তাটা কে? কর্তা মশাইর কোনো বোনের নাম তো শান্তা না!

***

পরের সপ্তাহে একদিন তুমুল ঝড় বৃষ্টি হলো। সেই ঝড়ে কোথাও রেললাইনের উপর গাছ পড়ে রেললাইন ভেঙে গিয়ে ট্রেন আসা বা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কর্তামশাই দু’দিনের ছুটি পেলেন। যদিও দু’দিনে রেললাইন ঠিক করে ফেলা হবে এ ভাবনা অতি আশ্চর্যের। বাংলাদেশে সরকারি কাজের দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। কর্তা মশাইয়ের এক দূর সম্পর্কের ফুফা অচিন্তপুর থাকেন। অনেকবার করে তাকে যেতে বললেও বিভিন্ন কারণে অনেকদিন ধরে যাওয়া হয়নি। তাই ঠিক হলো দুদিনের জন্য আমরা সেখানে বেড়াতে যাব। ঘুরাঘুরি আমার এমনিতেই ভালো লাগে। তবে একটা ক্ষীণ দ্বিধা ছিল যে, এই বর্ষায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কারো বাড়ি যাওয়াটা একটু বেয়াক্কেলি ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে না তো? ভদ্রলোকেরা আমাদের দেখলে কি না কি ভেবে বসেন। কর্তা মশাই বললেন, ফুফা নুরুল আলম খুবই অতিথিপরায়ণ। মানুষ দেখলে বরং তিনি খুশি হন। আর তার স্ত্রীও ঠিক তেমনি। অতি সাধারণ, সরল একজন মহিলা। আমি যাবার ব্যাপারে আপত্তি করলাম না।

অচিন্তপুর এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। নৌকায় নদী পাড় হয়ে আর হেঁটে এক কি দেড় ঘন্টার মতো লেগেছে। এদিকে প্রচুর গাছপালা, ঘরবাড়ি কম। আমরা যে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম সেটাকে তিনদিক থেকে গাছপালা ঘিরে রেখেছে। একটা বড় দোচালা ঘর। সামনে লম্বা ও খোলা বারান্দা। প্রতিটি রুম থেকে বারান্দায় আসা যায়। এই ঘরের অতি সন্নিকটে আরেকটা একচালা ঘর। বড় ঘর আর এ ঘরের মাঝে যাতায়াতের জন্য একটুখানি সরু জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে। ঘরের দরজাগুলো উঠোনের উল্টোদিকে। যথাসম্ভব একচালা ঘরটা রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উঠোনটাও যথেষ্ট বড়। বলা যায় ছোটখাটো একটা ফুটবল খেলার মাঠ। উঠোনের একপাশে একটা ছোট ছেলে ডাব কাটছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন চল্লিশোর্ধ্ব ভদ্রলোক। হাত নেড়ে নেড়ে ছেলেটিকে ডাব কাটার নির্দেশনা দিচ্ছেন৷ কর্তা মশাই তার কাছে গিয়ে সালাম দিলেন।

” আসসালামু আলাইকুম ফুফাজি। কেমন আছেন? ”

ভদ্রলোক অবাক দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে একবার মাহমুদ ও একবার আমার দিকে চাইলেন। তারপর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন,
” আরে মাহমুদ না? ”
” জ্বি ফুফাজি ” আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ” আমার স্ত্রী”
” তুমি বিয়া করছো? মা শা আল্লাহ। খুব ভালো খুব ভালো। জামালের মা তাড়াতাড়ি বাইরে আইসা দেখো কারা আইছে! ”

ভদ্রলোকের চেঁচানি শুনে ঘোমটা টানতে টানতে একজন মহিলা সলজ্জ মুখ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পরিচয় পর্ব সারতেই আমি তার সাথে ভেতরে চলে এলাম। আমি বোরকা খুলে একগ্লাস পানি চাইলাম তার থেকে। তিনি স্টিলের গ্লাসে করে পানি এনে দিতেই তিন ঢোকে পানিটুকু শেষ করলাম। এরপর ভদ্রমহিলা অর্থাৎ ফুফুজান আমাকে হাসিমুখে রান্নাঘরে নিয়ে এলেন। নয়-দশ বছরের একটা মেয়ে পিঁড়িতে বসে চুলায় ডালের বড়া ভাজছে। আমাদেরকে দেখেই উঠে একপাশে সরে দাঁড়ালো। ফুফুজান মেয়েটাকে বললেন,
” যা তো ফুলবানু তোর ভাবীরে একখান পিড়া আইনা দে ভিতরতে ”
ফুলবানু পিঁড়ি এনে দেয়ার পর ফুফুজান হাসিমুখে আমাকে বললেন,
” বসেন আম্মা ”
ফুফুজান নিজে বসে বড়া ভাজতে লাগলেন। একটুপর আরেকটা পাঁচ-ছয় বছরের মেয়ে এসে ফুলবানুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে চোরা চোখে আমাকে দেখতে লাগলো। ফুফুজান ভাজা বড়াগুলো ঝুড়িতে নিতে নিতে মেয়েদেরকে মৃদু ধমক দিলেন।
” এহানে দাঁড়ায় থাহিস নাহ। যা তোর আব্বারে ক মাছের ব্যবস্থা করতে ”
মেয়ে দুটো দৌড়ে চলে গেল৷ আমি একটু আড়ষ্ট হয়ে বসেছি। বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। অপরিচিতদের সামনে আমি বরাবরই মুখচোরা স্বভাবের। ফুফুজান নিজেই কথা বলে যাচ্ছিলেন,
” আমি হইলাম মাহমুদের বাপের খালতো বইন৷ হেই ছোডবেলাততে ওরে চিনি৷ এইদিকে চাকরি ফাইলো যহন, আইতো মাঝে সাঝে। একলা একলা থাকতো। কি না কি খায়৷ জামালের বাপরে কইতাম, যান একটা খোঁজ লন। পোলাডা কেমুন না কেমুন আছে। কেমনে থাহে, কেমনে চলে। এইরমইধ্যে যে পোলা বিয়া করছে হে তো আমরা জানতাম নাহ। তাইলে তো আমিসহ যাইয়া আপনাগোরে লইয়া আইতাম। আপনারা আইছেন মেলা খুশি হইছি। তয় আম্মাজান কোনো সংকোচ কইরেন না। আর কইলাম আইচেন যহন কয়দিন নাহ থাইকা যাইতে ফারবেন নাহ। কি খাইতে মন চান আমারে কন জামালের বাপরে দিয়া সব ব্যবস্থা করাম ”
” আপনি যা খাওয়াবেন তাই খাব ফুফুজান। আমার খাবার নিয়ে তেমন বাছবিচার নাই ”
ফুফুজান হাসলেন।
” মাহমুদডাও এরুম। কুনো বাছবিচার নাই। কইব, ফুফুজান আপনে যা রান্দেন তাই তো ভাল্লাগে ”

ফুফুজান বেশ সরল প্রকৃতির মহিলা। এমনভাবে আমার সাথে মিশে গেলেন যেন অনেকদিন ধরে চেনেন। মেয়েগুলো আরও একধাপ উপরে। প্রথমে দূর থেকে আমাকে দেখতে লাগলো। তারপর ফুফুজান যখন আমাকে রসুন ছিলতে দিলেন, দুইজন পাশাপাশি এসে বসে গেল রসুন ছিলতে। হেসে হেসে নাম জিজ্ঞেস করতেই দুটোর আড় ভেঙে গেল। সেই থেকে ওরা আমার পিছু ছাড়ে না। বলা যায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে রইলো। এর মাঝখানে জামাল অর্থাৎ ফুফুজানের বড় ছেলে এলো গ্লাস হাতে ডাবের পানি নিয়ে। খাওয়া শেষে গ্লাস হাতে দেয়ার পরও ছেলেটা গেল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগ্রহ সমেত বোনেদের সাথে আমার কথোপকথন শুনতে লাগলো। ফুফুজান হঠাৎ ওকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” কিরে দাঁড়ায় আছোস ক্যা? তোর আব্বা মাছের জোগাড় করতে ফারলো কিনা দেইখা আয় ”
জামাল মুখ দিয়ে বিরক্তসূচক শব্দ করে চলে গেল।
” বুঝলেন আম্মা, আমাগো ফাশের আরেক গেরামেই মাছ চাষ করে এক লোক। যার ঘরেই মেজ্জান আইব উনার ফুকুরেততে মাছ আনা চাই! ”

ঘন্টাখানেক পর ফুফাজি মোটামুটি সাইজের দুইটা রুই মাছ ভিতরে পাঠিয়ে দিলেন জামালের হাতে করে। আমি বড় মাছ কাটতে জানি না। তাও ইচ্ছে হলো ফুফুজানের সাথে হাত লাগিয়ে মাছ কাটতে। ফুফুজান কি করে বুঝলেন যে আমি মাছ কাটতে পারি না তা বুঝতে পারলাম না। তবে খুব যত্নসহকারে আমাকে মাছ কাটা শেখালেন। একটা মাছ তিনি নিজে কাটতে কাটতে শিখিয়ে দিলেন। পরেরটা আল্লাহর রহমতে আমি নিজেই কাটতে পেরেছি। ফুলবানু আর জমিলা দুই বোন খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মাছ কাটা দেখলো। তাদের মুখে সারাক্ষন খুশিতে ঝলমল করছে৷ আমার মাছ কাটতে পারাটাও তাদের কাছে যেন বিশাল আনন্দের ব্যাপার। মাছ দুটো রান্না করা হলো বরবটি ও আলু দিয়ে। দুপুরে কর্তামশাই গোসলে গেলেন ফুফাজি ও জামালের সাথে। এরপর তিনজন নামাজ পড়তে গেল একসঙ্গে। এই ফাঁকে ফুফুজান আর আমি ওদের জন্য খাবার বেরে ফেললাম৷ সামনের ঘরে ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশের ঘরের দরজায় পর্দা দেয়া। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাশেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো ফুলবানু আর জমিলা। ফুফাজিরা এলে ফুফুজান ওদেরকে খেতে দিয়ে সেখানে বসলেন একটা তালপাখা নিয়ে। মাঝে মাঝে কার কি প্রয়োজন সে অনুসারে খাবার পাতে তুলে দিচ্ছেন আর তালপাখা দিয়ে বাতাস করলেন। ফুফাজি হাতের লোকমাটা মুখে পুরে দিয়ে খাওয়া শেষ করলেন। তারপর বিরক্তির সঙ্গে বললেন,
” জামালের মা তুমার মাতামুতা ঠিক আছে? বাদলার দিনে আবার বাতাস করন লাগে? অহন কি গরম আছে? ”
ফুফুজান দমলেন না। স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলেন।
” মাত্র হাঁইটা আসছেন, গরম লাগব না ক্যারে? ”

কর্তামশাইকে দেখলাম প্রথমে ডালের বড়া, রসুন ভর্তা আর মসুর ডাল দিয়েই চেটেপুটে খেলেন। মাছ নিচ্ছেন না দেখে ফুফাজি জোর করে দুই পিস মাছ উনার পাতে তুলে দিলেন। শেষে ফুফুজান আর ফুফাজির জোরাজুরিতে রুই মাছ দিয়ে অল্প কয়টা ভাত খেলেন। উনার খাওয়া দেখেই আমার তৃপ্তি লাগছিল। একটা মানুষ এতটা আড়ম্বরহীন হতে পারে? খান তৃপ্তি নিয়ে অথচ অতি সামান্য ও সাধারণ সব খাবার। আমি পর্দার ফাঁক দিয়ে তার দিকে চেয়েছিলাম৷ হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো হুট করে ঠিক আমার দিকেই তাকালেন হাসিমুখে। আমি লজ্জা পেয়ে চটজলদি পর্দা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম।

চলবে ইন শা আল্লাহ….