এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-০৫

0
166

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্ব- ০৫
সানজিদা মাহি
________________________________________

দুপুরে খেয়ে ফুলবানু, জমিলা আর জামাল মিলে জড়ো হয়ে বসেছি খাটের ওপর। কর্তা মশাইকে দেখলাম ঘুমাচ্ছে। ফুফুজান আর ফুফাজি তাদের ঘরে। বাচ্চাগুলো আমার কাছে আবদার করেছে গল্প শুনবার জন্য। এদিকে গল্প করবার মতো কোনো গুণই নেই আমার মাঝে। আমি একজন আদর্শ শ্রোতা মাত্র। ওদের জোরাজোরিতে শেষে স্কুলে পড়াকালীন সময়ে বান্ধবীদের নিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিলো সেটাই শুনিয়ে দিলাম। তারপর ওরা নিজেরাই আমাকে বাঁচালো। একেক জনের কাছ থেকে হালি হালি গল্প বেরোলো বলা যায়। তার উপর নিজেদের গল্প বলা নিয়ে সে কি আগ্রহ! একজনের বলা শেষ হবার পূর্বেই আরেকজন নিজের কথা বলতে শুরু করে দেয়। আমার উৎসাহ দেখে সে তৎপরতা আরও বাড়তে লাগলো ওদের। আমাদের গল্পের মাঝখানেই সারাদিন পর হুট করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। আজ দিনটা কিছুটা রোদেলা ছিল। তেজহীন রোদে পথ ঘাট অনেকটা শুকিয়ে আসছিলো। বৃষ্টি এসে গল্পের আসর ভেঙে দিল তৎক্ষনাৎ। ফুলবানু অনুনয়ের সুর তুলে বলল,
” ভাবি আইয়েন না বৃষ্টিতে ভিজমু! ”

ওর দেখাদেখি বাকিগুলোও অনুনয়-বিনয় শুরু করলো। উঠানে ভেজার ব্যাপারে মানা করলাম। কারণ ঘর থেকে উঠান স্পষ্ট দেখা যায়। সোৎসাহে সবকটা মিলে বলতে লাগলো, ঘরের পিছনেই পুকুর আছে। ফুফাজি কয়েক মাস আগেই অনেকগুলো টাকা খরচ করে ঘাট পাকা করিয়েছেন। সেখানে বসেই অনায়াসে ভেজা যাবে। বৃষ্টিতে ভিজব ভাবতেই ছেলেমানুষী মন ছটফটিয়ে উঠলো। কিন্তু বুঝদার মন ঋণাত্মক সংকেত দিচ্ছে পুনঃ পুনঃ। একজনের বাড়ি এসে শেষে বাচ্চাদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা? ফুফুজান জানতে পারলে নিশ্চিত এটাকে ভালো মনে করবেন না। দোলাচালে ভুগতে ভুগতে শেষে ছেলেমানুষী মনটাই বিজয় বরণ করে নিল।

পুকুরটা খুব একটা বড় না। আশেপাশে অসংখ্য জানা- অজানা গাছপালা দিয়ে ঘেরা। যেন এরা পুকুরটির এক নিরাপদ বেষ্টনী। নিরাপত্তাদানে মাথা উঁচিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পিছন দিকে এক নিবিড়, নির্জন, নিভৃত বনানী। গাছের আধিক্যে তমসা জমেছে কুয়াশারূপে। হঠাৎ এই নিরালা বন, ঝোপঝাড়ে আচ্ছাদিত সবুজ শ্যওলা জমা গভীর পুকুর, পুকুরের উপরান্তে ঝুঁকে পড়া বনচালতা গাছ, বড় বড় ফোঁটায় পড়া বৃষ্টিজল এই অতি পরিচিত গ্রামীণ দৃশ্যগুলোকে নিবিষ্টমনে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে জাগলো খুব করে । ছোট একটা বাচ্চাকে তার কাঙ্ক্ষিত জিনিস হাতে ধরিয়ে দিলে যেভাবে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, নইলে মনে ঘোরতর সন্দেহ জাগে ছেড়ে দিলেই বুঝি এ পালিয়ে যাবে। ঠিক সেভাবে এই প্রকৃতিকে আপন আলয়ের মতো জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো।

আমাকে সে ডেকেছে স্বপ্রনোদিত হয়ে বহুদিন পর
স্বপ্নোত্থিত জলে মাখা ছলছলে বদনে আমি পা বাড়িয়েছি তারই পানে,
আজ সে ডেকে নিয়ে কি সুধাতে চায় জানিনে
দীর্ঘ দিবস-রজনী কাটিয়ে কাছে টেনে নেবে নাকি করে দিবে পর?

মনে পড়ে যায় আমার আশৈশব কাটিয়ে দেয়া একেকটি অসাধারণ দিনকে। সবুজে বেষ্টিত ছোট্ট একটা গ্রামে বেড়ে ওঠা, প্রাঞ্জল, সতৃষ্ণ, আকাঙ্খিত এক জোড়া চোখ নিয়ে এক দুরন্ত বালিকার বেণুনি দুলিয়ে দুলিয়ে এ পথ হতে ও পথ ঘুরতে ঘুরতে কোন অদূরে, অচেনা কোনো জায়গায় পথ ভুলে হারিয়ে যাওয়া। অচিন পথের ধারে যত্নহীন বেড়ে ওঠা গাছে ফোটা বুনোফুল আর তার উপর উড়ে বেড়ানো রঙিন প্রজাপতির মুগ্ধতার রেশ নিয়ে তার ঘরে ফেরা। ঘরের পেছনের বিশাল আগাছার জঙ্গল দেখে গা ছমছম করার বিপরীতে সোৎসাহে এক পা দু’পা করে সে জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করা। বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ডালপালা মেলা গাছে বহু কষ্টেসৃষ্টে ঠেলাঠেলি করে প্রবেশিত রোদ্দুরে গুছে যেত আবছা তমসা। চেনা- অচেনা কতরকম ফুলের ভেজা ভেজা গন্ধ এসে নাকে এসে ঠেকতো। বহু যুগ ধরে বেঁচে থাকা কোন একটা গাছ হয়তো জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে নুয়ে পড়েছে মৃত্তিকাকে লক্ষ করে। তার বিবর্ণ পাতাগুলো প্রাণ হারিয়ে ঝরে পড়েছে দীর্ঘদিন আগে মাথার অগ্রভাগকে সম্পূর্ণ ন্যাড়া করে দেবার তাগিদে। আবার কোনো গাছ যৌবনের রূপ প্রদর্শনে উদীয়মান সূর্যের দিকে মাথা তুলে দিয়েছে সন্তর্পণে। গহীন বনের এসকল দিক অবলোকন করে বেরোবার পর হাতে থাকতো ক’খানা ওলকচু, সদ্য মাটি থেকে গাছ ওঠানোর পর সংগৃহীত নিগূঢ় পেলব রাঙা হলুদ। বাচ্চাদের দলবদ্ধ হুল্লোড়ে অতীত থেকে এক ধাক্কায় বের করে দিল কে যেন এক দমকে।

আমি সিঁড়িতে বসতেই বাচ্চাগুলো একের পর এক লাফ দিয়ে পুকুরে নেমে গেছে। ওদের শৈশবের এই উচ্ছ্বাস, কৃত্রিমতা বর্জিত আনন্দ দেখে কিঞ্চিৎ ঈর্ষা হলো। তবু এই যে এত বড় হয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারছি একটা গ্রামের পুকুরের পাকা ঘাটে বসে, সেও বা কম কিসের? শহরের চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ পাখিটা আজ যেন ছাড়া পেয়েছে বহু প্রতীক্ষার
পর আন্তরিক প্রার্থনায় দৈবাৎ বলে। বাচ্চাগুলো ডুব সাঁতার দিয়ে “চোর চোর “খেলছিল। প্রথমে যে চোর হবে তার কাজ হলো অন্য আরেকজনকে খুঁজে বের করে ধরে ফেলা। যাকে ধরবে সে আবার চোর হয়ে যাবে৷ এভাবে খেলাটা চালিয়ে যেতে হয়। বৃষ্টিও আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে। কখনো তার গতিধারা বাড়ছে প্রবলবেগে তো কখনো কমতে কমতে এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় যে মনে হয়, এক্ষুনি বুঝি বৃষ্টিটা পড়া বন্ধ হলো। আমি একটু ইচ্ছে করেই নারকেল গাছের নিচে বসেছি। যাতে বৃষ্টিটা গায়ে কম লাগে। বাচ্চারা হৈ চৈ করে খেলছে সেটা দেখতেই ভালো লাগছে ভীষণ।

একটা সিঁড়ি নিচে নেমে পানিতে পা ভিজিয়ে বসলাম। সবুজ শ্যাওলা জমা পুকুর জলে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গুলো ছন্দপতন ঘটিয়ে যাচ্ছে অনবরত। এই অতি সামান্য একটা দৃশ্য পুনরায় পিপাসিত নয়নে তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখবার জন্য আমি বোধহয় ছটফট করে যাব আজীবন। এইসব সুখ বারবার আসে না। মানুষ যা একনিষ্ঠ মনে আঁকড়ে ধরতে চায় তাই যেন হারিয়ে যাওয়া অবধারিত। আসন্ন বিরহে মনটা কেমন কেমন করে উঠলো। তারপর মনে হলো এই সামান্য জিনিসের বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সইতে না পারার চেষ্টায় কতটা ব্যাকুল হয়ে আছি। অথচ পুনরুত্থানের দিন প্রকৃত বিচ্ছেদ ঘটবে আমার। এ জাগতিক ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষা সবই বৃথা। এই মায়ার জাল ছিন্ন করতে না পারলে মৃত্যুকে কি করে হাসিমুখে গ্রহণ করে নেব?

গা বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মাটির ঘর ভিজে চুপচুপ হয়ে যাচ্ছে দেখে দ্রুত হেঁটে ভেতরে ঢুকলাম। কর্তা মশাই জেগেছেন কখন কে জানে। বিছানার উপর পা গুটিয়ে উদাসীন মনে জানালার বাইরে কিছু একটা দেখছিলেন৷ আমাকে দেখেই কৌতুহল চোখে তাকালেন। লজ্জা পেয়ে জামা কাপড় নিয়ে চট জলদি রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেলাম।

ফুফুজান আমার বৃষ্টিতে ভেজার কাহিনী বাচ্চাদের মুখে শুনতে পেয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ” আম্মা দেহি ছুটো পুলাপান হইয়া গেছে ”
আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারিনি। মুখ অবনত করে বসেছিলাম। কর্তা মশাই তার সাথে সায় দিয়ে বললো,
” তোমার আম্মা ছোট পোলাপানই ফুফুজান। বৃষ্টি দেখলে হুশ থাকে না ”
” ছুটো পুলাপান থাকোনই ভালা। প্যাঁচগোচ থাকতো না ”
” সরল বলেই তো ভালো আছি ফুফুজান। নইলে প্রথমেই হয়তো বলতো, এ কোন বন জঙ্গলে এনে ফেললেন আমাকে? ”
” আম্মার সাহস আছে দেইখা। নইলে একলা কেমুন কইরা থাকতো ওইখানে। বাপরে! আমার নিজরই তো মন টিকতো না। মুহমুইদদা হুন, তুই কইলাম কাম ফুরাইলেই বাড়ি আইহা ফড়বি। বউডার তাইলে বেশিক্ষণ একলা থাকোন লাগতা না ”
” জো হুকুম ফুফুজান ”

আমাকে নিয়ে এতো কথা হচ্ছে অথচ আমি সবটা সময় ছিলাম নিশ্চুপ। ভেতরে যতোই চঞ্চল হই না কেন বাইরে আমি বেজায় মুখচোরা। লজ্জা কিংবা সংকোচে কথা বলতে পারি না। বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ আগে। আসরের সালাত আদায়ের পর কর্তা মশাই হঠাৎ বললেন,
” বাইরে যাবেন? পাশেই একটা দীঘি আছে ”
” বাচ্চাদেরকে সঙ্গে নেব? ”
” নিন ”

মাটির রাস্তা দুপুরে হওয়া বৃষ্টিতে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে আছে। সে কাঁদা বাঁচিয়ে হাঁটা মুশকিল। বাচ্চারা কেউ সঙ্গে আসেনি। বৃষ্টি থামার পর ফুফুজান মেয়ে দুটোকে গুড় আনতে পাশের গ্রামে পাঠিয়েছেন। জামাল বসেছে নারকেল ছিলতে। অগত্যা ফুফুজানকে বলে দু’জনে বেরোলাম গ্রাম দেখতে। বাতাসে ভাসছে তাজা বৃষ্টির ঘ্রাণ। বৃষ্টি জলে ধুয়ে যাওয়া গাছের স্নিগ্ধ সবুজ পাতারা সগর্বে দুলছে মৃদু বাতাসে। আকাশ এখন পরিষ্কার। বৃষ্টিধৌত মেঘহীন শ্রাবণের আকাশ নীলিমায় আচ্ছাদিত। খোলা আকাশের নিচে ফসলের দোলাচল সে এক অপার্থিব দৃশ্য। ক্ষেতে পানি যা জমেছে তাতে কৃত্রিম উপায়ে পানি দেবার আর প্রয়োজন হবে না৷ হেঁটে হেঁটে অনেক দূর আসার পর চোখে পড়লো বিশাল এক দীঘি। হাওয়ার দমকে কম্পন তুলে আপন মনে খেলছে দীঘির জল। এককোণ জুড়ে পুষ্ট, সতেজ, সবুজ জলজ কলমি শাক ভেসে আছে। পাড়ের একটা তালগাছে বাঁধা একটা ডিঙ্গি নৌকা। কর্তা মশাই নৌকার বাঁধন খুলে দড়িটা হাতে নিয়ে আমাকে নৌকায় উঠে বসতে নির্দেশ দিলেন। আমি নিরাপদে বসার পর তিনিও উঠে বসলেন। নৌকার কাঠ তুলে ভেতর থেকে একটা বৈঠা বের করলেন।

” এটা ফুফাজির নৌকা। গতবার এসেছিলাম আর জামালসহ দীঘিতে ঘুরে বেড়িয়েছি। তখন পানি কম ছিল। আপনার ভয় লাগছে না তো? ”
” না না ঠিক আছি। ভালো লাগছে আমার ”

বাতাসে তিরতির করে আমার হিজাব, নিকাব উড়তে লাগলো। দীঘিতে হাত দিতেই ঠান্ডা একটা শুরশুরি খেলে গেল শরীরে। নৌকা এখন দীঘির মাঝামাঝি। দুষ্টামি একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। শীতল জল গায়ে এসে পড়তেই ঘটনার আকস্মিকতায় কর্তা মশাই প্রথমে কুঁকড়ে গেলেন তারপর দ্বিগুন উৎসাহে একহাত দীঘিতে ডুবিয়ে দিলেন। প্রথমে তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারিনি। বুঝেছি যখন ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। বোরকা, হিজাব ভিজে একাকার হলো। মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললাম,

” এটা কি হলো? ”
” প্রতিশোধ ”
” আমি তো আপনাকে এতখানি ভিজাইনি ”
” না, বুঝিয়ে দিলাম আমার সাথে লাগতে এলে দ্বিগুণ হারে প্রতিশোধ নেয়া হবে ”
” দাঁড়ান মজা দেখাচ্ছি ”

এবার কোনোকিছু পরোয়া না করেই ভীষণ আক্রোশে প্রতিশোধের উপর পাল্টা প্রতিশোধ নিয়ে নিলাম। একটুর জন্য কর্তা মশাইয়ের হাত থেকে বৈঠাটা পানিতে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে।
” দেখলেন তো অবস্থা। বৈঠাটা পানিতে একবার পড়লে আর বাড়ি যাওয়া হতো না ”
” সরি ভুল হয়ে গেছে ”
” ক্ষমা করলাম না। তুলে রাখলাম শাস্তি। তারপর সময় বুঝে প্রতিশোধ নেব ”
আমি হেসে ফেললাম তার বাচ্চাসুলভ স্বভাব দেখে।

আমরা বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যার পর। মাগরিবের পর ফুফুজান চুলা জ্বালিয়ে নারকেল পুলি বানাতে বসলেন। তাকে ঘিরে বসেছি আমি, ফুলবানু, জমিলা আর জামাল। আগুনকে ঘিরে বসা পাঁচটি মানুষের ছায়া প্রেতের ন্যায় নড়ছিল টিনের রান্নাঘরে। গুড় আর নারকেল দিয়ে তৈরি গরম গরম নারকেল পুলি খাওয়ার স্বাদ আলাদা। বাচ্চাদের ধৈর্য ধরে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। সবার চোখ চুলার উপর বসানো তাওয়ার উপর। ফুফুজান কয়েকটা পিঠা বানানো শেষ হলে সেগুলো মাটির তাওয়ায় ছেঁকে জামালের হাতে করে ফুফুজান আর কর্তা মশাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তারা দু’জন মোড়া পেতে উঠানে বসে গল্প করছে। মেঘ সরে যাবার পর স্বচ্ছ আকাশে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। জোছনার আলোয় আবছাভাবে দুটো কালো কালো ছায়া দেখা গেল উঠানের মাঝখানে। রান্নাঘরের ছোট জানালাটা খোলা থাকায় পাঁচ-ছয় হাত দূরে বসে থাকা মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছিলাম অস্পষ্টভাবে। বাচ্চাগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। একটা একটা পিঠা হয় আর সবগুলো হাত বাড়িয়ে দেয় নেয়ার জন্য। ফুফুজান ধমক দিয়ে ওদেরকে থামালেন। একজন একটা পিঠা পাওয়ার পর অন্যদেরকে অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকতে হয়। এই ছোট বিষয়গুলো নিয়ে আমি বেশ মজা পাচ্ছিলাম। আমার ছোটবেলারই একটা দৃশ্যের যেন চোখের সামনে পুনরাবৃত্তি ঘটছে। সেসময় পরিবারে সদস্য সংখ্যা ছিল বড় অঙ্কের। মামাতো ও খালাতো ভাই বোনেরা সবাই উঠানে জড়ো হতো। হয়তো রান্নাঘরে মুড়ি ভাজা হচ্ছে। একটু পরপর কেউ একজন গিয়ে ভাজা মুড়ি আনতে যাচ্ছে। তারপর নিমিষে এতগুলো মানুষের হাউকাউেয়ের মাঝে মুড়ির পাত্রটি শূন্য হয়ে যেত। পেটে হয়তো সামান্যই পড়তো। কিন্তু সবাই মিলে খাওয়ার এ আনন্দটা ছিল ব্যাপক উপভোগ্য।

এশার আজানের পর একা একাই পুকুর ঘাটে গেলাম অজু করতে। চাঁদের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। অর্ধ চাঁদ হতে জোছনা বৃষ্টি ঝরে ঝরে পড়ছে গাছের উপরিভাগে, পুকুরের সবুজ জলে। পুকুরের সবুজ জলকে এখন কালো বলে আখ্যায়িত করাই শ্রেয়। পাড় ঘেঁষে হালকা শব্দে মাছেদের হুটোপুটি শোনা গেল। ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন বন হতে একাধারে ভেসে আসছে কোলা ব্যাঙ্গের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ জাতীয় শব্দ। নাম না জানা কিছু পোকামাকড়ও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ছন্দ তুলে ডেকে চলেছে অনবরত। কৃত্রিমতা বিবর্জিত প্রকৃতির নৈসর্গিক শব্দ ছাড়া আর কিছু পৌঁছালো না কর্ণকুহরে। পা টিপে টিপে আমি সিঁড়িতে কদম ফেলছি যাতে আছাড় খেতে না হয়। নইলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে একবারে। কোমড় তো যাবেই, হাত-পা ভাঙারও সম্ভাবনা রয়েছে। হঠাৎ একজোড়া ভারী, পুরুষালী হাত চেপে বসলো দু’চোখের ওপর! ঘটনার আকস্মিকতা ও বিপুলতায় মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না কিয়ৎক্ষন।

চলবে ইন শা আল্লাহ….