এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-০৬

0
168

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ০৬
সানজিদা মাহি
________________________________________

” ভয় দেখিয়ে লাভ নেই! অতো সহজে আমি ভয় পাই না ”
” হ্যা সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি ”

হাতের শক্ত ভাবটা কমে গিয়ে ধীরে ধীরে চোখ থেকে সরে গেলো। কয়েক সেকেন্ড লাগলো স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে পেতে।

” এই অন্ধকারে কি করা হচ্ছিল? ”
” এই তো ওজু করতে এলাম ”

পেছন থেকে সরে গিয়ে কর্তা মশাই নিঃশব্দে সিঁড়িতে পা গুটিয়ে বসলেন। জানতে চাইলাম,

” সিঁড়ি ভেজা নেই তো? ”
” না শুকনোই। বসতে পারেন এখানে ”

সাধারণ একটা কথা। অথচ কথাটা কেমন কেমন ঠেকল। মৃদু একটা সুখের ঢেউ… দোল খেতে খেতে মন সায়রে কম্পন তুলে আচ্ছন্ন করে দিল ভালো লাগার অনুভূতি দ্বারা। দ্বিধান্বিত পা জোড়া টেনে টেনে দূরত্ব রেখে বসলাম পাশাপাশি। অনেক সময় কোনো কিছু আঁচ করবার আগে আচম্বিতে পরিস্থিতি বদলে যায়। এই যে আমাদের পাশাপাশি বসে থাকা… এই বসাটা যেন স্বাভাবিক, সাধারণ দৃশ্যপট নয়। একটু অন্য রকম । পুকুরের নির্জন ঘাটে, জোছনা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে থাকা দুটো প্রাণ…। এই যে সামান্য হাওয়া পেলেই মনের সমুদ্দুরে হঠাৎ হঠাৎ ছলকে উঠে জল, কি নাম এই অনুভূতির? আমি যেন জানি না কি হতে পারে এই অনুভূতির নাম। আবার যেন খানিকটা জানিও। এই যে ব্যাঙেরা ডাকছে, ঝিঁঝিরা সব ছন্দ তুলছে, সেটাকে কি পোকামাকড়ের ডাক বলে? নাকি বলে সুর তুলে গাওয়া গান? দুই হাত দূরে বসে থাকা মানুষটা, যার সাথে নিয়তি বেঁধে দিয়েছে মন…. তার মনে কতখানি জুড়ে আছি আমি? মন সমুদ্দুরে ঢেউয়ের দোলাচল থমকে গেল৷ বিরহ…বিরহ..বিরহ…পাশাপাশি বসেও অনেক দূরের বলে নিজেকে মনে হতেই বিরহে আচ্ছন্ন হলো মন। বিরহেও ভালো লাগা থাকে? তবে আমার কেন ভালো লাগছে? মন চাইছে বিরহকে ঝাপটে ধরে বলি যেও না, আরেকটুখানি থাকো…

” কি ভাবছেন? ”
ভাবনায় ছেদ পড়লো। মুখ তুলে তাকালাম জোছনা ভেজা শান্ত মুখটার পানে। তুলির আঁচড়ে সুনিপুণ হস্তে আঁকা দুটো চোখ। সেখানে অবসাদ নেই, বিষন্নতা নেই, আছে শুধু শীতলতা। হাসি হাসি, সুস্নিগ্ধ, কথা বলা চোখগুলো কি কিছু বলছে আমায়?

” তেমন কিছু না “, চটপট জবাব দিলাম।

কথা বলা চোখের ভাষা পড়তে না জানলে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে নেই। অপর মানুষটা জানতে পেলে শান্ত চোখে ভর করবে একরাশ বিষন্নতা। সে বিষন্নতায় শেষে ঘায়েল হতে হবে স্বয়ং নিজেকেই। কে চায় যেচে কষ্ট পেতে? পুকুরের দিকে দৃষ্টি দিলাম। তিমির রঙে মুড়ানো জলে জোছনার আলোয় ভেসে আছে চাঁদের আবছা প্রতিবিম্ব। মাথার উপর অর্ধ চাঁদ আলোর ছাউনি পেতে দিয়েছে৷ যেন বলতে চাইছে, এই যে দিলাম আলো-সুখ। সুখটুকু নিয়েও নাও প্রাণে তুলে।

” আপনার চাঁদের আলো ভালো লাগে? ”

মানুষটা আমার ভালো লাগার ব্যাপারে জানতে চাইছে। তবে কি একটু একটু করে তার মনের অতলে জায়গা করে নিচ্ছি আমি? হাওয়ার দমকে গাছের পাতা যেভাবে নড়ে ওঠে তেমনি করে উল্লাসিত উত্তর বেরিয়ে এলো নিজের মুখ থেকে,

” অনেক! আমার তো জোছনা বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে খুব। জোছনা বৃষ্টি গা ভেজায় না। কেবল সন্তর্পণে মন ভিজিয়ে দিয়ে যায়। জোছনায় ভেজা মন… সুন্দর না ব্যাপারটা? ”
” জোছনা বৃষ্টিটা কি? ”
” এই যে চাঁদ থেকে জোছনারা ঝরে ঝরে পড়ছে এটাই জোছনা বৃষ্টি ”
” আপনি দেখি ভালোই কাব্যিক আছেন “, মুচকি হেসে কথাটা বললেন তিনি। হাসিটা অনেকক্ষণ যাবত লেগে রইলো ওষ্ঠের এককোণে। সায় দিয়ে আমিও সামান্য হাসলাম। লজ্জাবনত মুখটাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে কানের কাছে ছোট চুলগুলো গুঁজে দিলাম ত্রস্ত হাতে।
” আপনিও তো কম না। সেদিন যে একটা কবিতা শোনালেন। আরেকটা শোনান না আজকে “, ছোট বাচ্চার মতো অনুনয় করে বললাম।
” আমি আসলে তেমন কবিতা পারি না। সেদিন হঠাৎ কেমন করে কবিতাটা যেন চলে এলো। ব্যস অমনি বলে ফেললাম”
” আচ্ছা আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন? ”
কিশোরীদের মতো রিনরিনে সুরে নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম কথাটা। অপর পাশ হতে সংকোচহীন জবাব এলো।

” বই পড়ে এমন মানুষকে ভালোবাসি ”

একটা বেগতিক ধাক্কা সজোরে এসে হৃদপ্রোকোষ্ঠের দেয়ালে বারি খেল। ঝরঝর করে ভেঙে গেল ধ্যানমগ্ন মনের সমস্ত দরজা, জানালা । পলেস্তারা খসে পড়তে লাগলো হুড়মুড় করে। আমি ঠাঁই খুঁজে চলেছি একরত্তি নিরাপদ স্থানে মাথা গুঁজবার আশায়৷ কই এমন করে তো কেউ কখনো বলেনি! এভাবেও ভালোবাসার কথা বলা যায়? এতটা দৃঢ়তা নিয়ে স্বচ্ছ, সাবলীল, সংকোচহীন কন্ঠে!

চোখের কোণে দেখতে পেলাম একজোড়া মুগ্ধ চোখ, সতৃষ্ণ নয়নে আমার পানে চেয়ে আছে। ঘোর লাগা এই চোখে খেলা করে অনুভবের দল। দলবেঁধে হানা দেয় অতর্কিতে নিটোল সাগরের নোনাজলে৷ নোনজলে মিষ্টতা ছড়িয়ে দিতে থাকে একটু একটু করে। প্রগাঢ় মায়ায় জড়িও না এখুনি…মন ঋণাত্মক সংকেত দিল। অথচ মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে আছি সেই কখন! আমি আর আমি নেই। আমি তোলপাড় করা ঝড়ে ভেসে থাকা অনিয়ন্ত্রিত জাহাজ। এই জাহাজ শেষ পর্যন্ত তীরে পৌছাবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। তবু আমার মাঝে নেই ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে তীরে পৌছাবার তাড়া। আমি কি ডুবতে শুরু করেছি?

দু-হাত দূরের মানুষটা এখন আমার অতি কাছে। যতটা কাছাকাছি হলে নিঃশ্বাসের সুগভীর শব্দ কর্ণকুহরে পৌছানোর ক্ষমতা রাখে। মনের সমুদ্দুরে আলোড়ন ঘটাতে জানে যখন তখন। কোলের উপর আলগোছে পড়ে থাকা কাঁপা কাঁপা, উষ্ণ হাতটাকে আমার কাছ থেকে অনুমতি ব্যতিত কেউ নিয়ে গেল তার বুকের উপর ঠেকাতে। ঠিক তখুনি হাজারটা গন্ধরাজ ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করে উঠলো চতুর্দিক। এই ফুলের গন্ধ বুঝি মানুষের গা থেকেও বের হয়? যখন অনুভূতিরা এসে হানা দেয় দলবেঁধে? নিজের অনিয়ন্ত্রিত মন নিয়ে, অসংবদ্ধ আবেগগুলোকে ডানা মেলে উড়তে দিয়ে আরেকটু সম্মুখে ঝুঁকে পড়লো মাথাটা। শিরশিরে অথচ কি এক অপার্থিব ভালো লাগা! কি দেয়া যায় এই ভালো লাগার নাম? কে থাকে এই হৃদয় ঘরে? কার একান্ত বসবাস? মানুষটার বুকের ধুকপুকানি হাতের শিরা- উপশিরা হয়ে আমার মনের সমুদ্দুরের ঝড়ের তেজকে আরও বাড়িয়ে দিল দমিত হারে। বড় বড় ঢেউ এসে জাহাজের মাস্তুল ভেঙে হলো খান খান। আমি হেরে যাচ্ছি ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে। কানে বেজে উঠলো সেই গম্ভীর, শান্ত, দৃঢ় কন্ঠ।

তোমার সাথে হঠাৎ দেখা
শেষ বিকেলের মিষ্টি মেয়ে,
কেমন করে দেখাই তোমায়
হৃদ প্রকোষ্ঠে লেখা নাম?
জানতে যদি হৃদায়াভাস, অনুভূতির প্রজাপতি-
উড়তে জানে ফুলের উপর, বাসতে জানে ভালো।
কেবল বলতে গেলেই মুখর অধিক
আসল কথা আসতে দেরি, অমনি মুখে আঁটবে কলুপ।
চোখে চোখে বলা কথা বুঝতে হলে, মুখোমুখি হাঁটতে চাও?
হাতে হাত রাখতে চাইলে, একটু দেরি সইতে চাও?
বৃষ্টি দেখলেই আমি ভেবে অমনি সোজা মুখ লুকাও?

পূর্ণোদ্দমে বইছে বাতাস। তার ক্ষোভ নাকি প্রতিহিংসা দিয়ে কে জানে এলোমেলো করে দিতে চাইছে সব। আজই যেন সব ধ্বংস করে দেবার শপথ করে বেরিয়েছে সে বাড়ি থেকে।আমি ডুবে যাচ্ছি বেপরোয়া ঝড়ে…মাতালা হাওয়ায়…। বাতাসের শো শো শব্দে আর্তনাদ শোনালো সামান্য হাহাকারের ন্যায় । তবে কি আর তীরে পৌছানো হবে না শেষ অবধি?

” এই যে! কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে? ”

আচমকা ঝড় থেমে গেল। থেমে গেল বাতাসের প্রবল গতি। সমুদ্রের কোথাও নেই ঝড়ের চিহ্ন, অনিয়ন্ত্রিত মনের স্বেচ্ছায় ডুবে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। প্রচ্ছন্ন, তাল-মাতাল চোখ তুলে চাইলাম সম্মুখে। ওই তো মানুষটা তো আগের জায়গাতেই বসে আছে, আমার কাছ থেকে দুই হাত দূরে। এতক্ষণ যা ঘটেছিলো সব কি তবে মিথ্যে? হারিয়ে গেল গন্ধরাজের তীব্র ঘ্রাণ। এই যে শাড়ির ওপর পড়ে থাকা আমার নির্জীব হাত৷ না কেউ ছুঁয়ে দেখেনি। অনুমতি ব্যতিত টেনে নিয়ে ঠেকায়নি বুকে। মিথ্যে… সবই মিথ্যে প্রহসন! কেন তবে ভেবেছিলাম অন্যকিছু? কিছু তো হবার কথা ছিল না। কল্পনার রাজ্য থেকে এক ঝটকায় বেরিয়ে মাথাটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। ইচ্ছে করলো চিৎকার করে কাঁদি। শক্ত হাতে তার হাতটা ধরে বলি, এতো কঠিন কেন আপনার মন? একটু…সামান্য একটু সহানুভূতিও নেই আপনার কাছে আমার জন্য? এই যে দূরে দূরে সরে থাকা তার কারণ কি শুধুই আমাকে অবহেলায় , আলগোছে জীবনের শক্ত আসনে বসবার পূর্বেই জীবন থেকে সরিয়ে দেয়া? আমি এতো ভাবাবেগে তাড়িত মনের মেয়ে নই। তবু কি যে হলো আজ। এই জোছনা বৃষ্টি, পাশাপাশি বসে থাকা, প্রকৃতির সৌন্দর্য বিলানো— সবই হঠাৎ বিষিয়ে দিল মনকে। একটা গরম জলের ফোঁটা চোখ হতে গাল বেয়ে নেমে গেল টের পেলাম। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কি একটা ক্ষীণ আশায় অসংবৃত অনুভূতিরা ডেনে মেলে ওড়ার আকুতি জানিয়েছিল। উচিত হয়নি। মনকে এমন করে প্রশ্রয় দেয়া উচিত হয়নি। এই অনুচিত কাজের ফল ভোগ করতে হবে নিশ্চয়ই আমাকে।অবসাদগ্রস্থ মন নিয়ে উঠে পড়লাম। ওজু করে নামাজটা সেরে ফেলা দরকার।

আমার স্বামীর মনে কি আছে জানি না। তবে স্বামীর মন পাবার জন্য মেয়েদের যে একটা বিশেষ যোগ্যতা থাকে, সে যোগ্যতা যে আমার নেই— তা বুঝতে বেশি কসরত করতে হয় না। বহুদিন পর সেজদায় বিগলিত হয়ে কান্নারা ভিজিয়ে দিল শীতলপাটি। এখানেই শান্তি। এখানে কাঁদার জন্য কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয় না। শুধু এখানেই মনের সব ব্যাথা, যন্ত্রণা আর আর্তনাদ উগরে দেয়া যায় অবলীলায়। হে রাহমানুর রাহিম, পরীক্ষা যেহেতু দিয়েছো সবরে জামিলও দিও। তোমার উপর ভরসা করে কষ্ট ভোলার তৌফিক দিও৷ নিয়তির পরিণতি শুধু তোমারই জানা।

কোনো কোনো রাতকে অতিদীর্ঘ মনে হয়। যেন দু-তিনটা রাতকে এক সুতোয় যোগ করে বেঁধে দেয়া হয়েছে। আজকের রাতটাও তেমনি। গভীর বেদনায় দীর্ঘরাত নির্ঘুম আমি কাটিয়েছি অনেকবারই। তবে সেসবের কারণ হিসেবে কারো মন না পাবার ব্যাথা ছিল না। অবহেলা আর সুক্ষ্ম অপমানে কাতর হবার কষ্ট ছিল না।

ফুফুজান আমাকে দেখে প্রায় চমকে উঠলেন। উদ্বেগভরা কন্ঠে জানতে চাইলেন, কি হয়েছে আমার? এড়িয়ে গিয়ে বললাম, কই কিছু হয়নি তো। কারো চোখ ফাঁকি দেবার ক্ষমতা আমার কস্মিনকালেও ছিল না। আমি অভিনয়েও বড় কাঁচা। আদোও কোনো কাজে আমার যোগ্যতা আছে কিনা সে বিষয়ে আমি ঘোর সন্দিহান। রক্ত রাঙা চোখগুলো অভিনয়ে হারিয়ে দিল। তারপর অজুহাত দিয়ে বললাম, মাথা ব্যাথা করছে। সত্যি খুব মাথা ধরেছিলো। নামাজ শেষ করে ওঠার পর থেকেই মাথটা এমন ভার হয়ে আছে যে মনে হলো এক মণ বোঝা চাপানো হয়েছে মাথার উপর। দীর্ঘক্ষণ ফুলবানু আর জমিলার শোবার ঘরে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম৷ মানুষটার সামনে যেতে না পারলেই যেন বাঁচি। ফুফুজান এক হাতে ওদেরকে খাওয়াবার ব্যবস্থা নিলেন। এই এমনতর মন খারাপে দিয়ে একটা সুখের কান্না চলে এলো। যখন ফুফুজান নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দিলেন। কান্না আটকাবার প্রয়োজন মনে করিনি। ফুফুজানও কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করেননি। বোধহয় বুঝে নিয়েছেন, বাড়ির লোকের কথা ভেবে কাঁদছি। আরও বেশি যত্ন করে তিনি ভাতের লোকমা মুখে তুলে দিলেন। মায়ের কথা মনে পড়লো খুব৷ সেই ছোটবেলায় না ফেরার দেশে চলে যাওয়া আমার মা যদি আজ থাকতো, তিনিও হয়তো এই ভূমিকাটাই পালন করতেন। কিছু কিছু কষ্ট এমন হয়, যখন কাউকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। যে ব্যাকুল হয়ে কাঁদার কারণ জানতে না চেয়ে শক্ত হাতে ধরে রাখবে আমায়। খাবার পর আর থাকা যায় না ওখানে৷ তবু নানা বাহানায় দেরি করলাম আরও কিছুক্ষণ। ভেবেছিলাম এসে দেখব কর্তা মশাই ঘুমিয়ে গেছেন। কিন্তু তাকে জেগে বসে থাকতে দেখে বিরক্ত লাগলো খুব। কোনো কথা না বলে মশারি উঠিয়ে কোণায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

” আপনার নাকি শরীর খারাপ? কি হয়েছে? ”
জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ পড়ে রইলাম। আরও কিছুক্ষণ পর কর্তা মশাই আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
” শরীর কি বেশি খারাপ? বেশি খারাপ লাগলে তো ডাক্তার দেখাতে হবে। এই গ্রামে কোনো ডাক্তার নেই। বাজারে যেতে হবে ”

এবারও কিছু বললাম না। চুপচাপ আগের মতোই শুয়ে রইলাম। কর্তা মশাইও জবাব না পেয়ে আর কিছু না বলেই শুয়ে পড়লেন।

ঘুম উবে গেছে আমার চোখ হতে। ঘুমাতে যে খুব ইচ্ছে করছে তাও নয়। বাইরে ব্যঙের ডাক, ঝিঁঝি পোকার একটানা ছন্দ তোলা শব্দ— সবই আগের মতো আছে। কিন্তু এসব কিছু আমার মন ভালো করতে পারলো না। বিবশ মন নিয়ে আমি কেবল নিজের অযোগ্যতার ধারা গুনতে ব্যস্ত। কখনো কারো এতো কাছে আসা হয়নি। হয়তো সেকারণেই আবেগটা বেশিই তৈরি হয়ে গেছিলো। আবেগকে শেকল বন্দি করতে হবে যে করেই হোক। আবার হঠাৎ মনে হলো, নিজের স্বামীকে নিয়ে আবেগ কাজ করবে না তো আর কার উপর খাটবে এ অধিকার? আমি কি একটু বেশিই ভেবে ফেলছি? এমনও তো হতে পারে কর্তা মশাইয়ের মনেও আমাকে নিয়ে অনুভূতি জন্মেছে। হয়তো নিতান্ত লাজুক আর মুখর বলে সেসব প্রকাশ করতে পারছেন না। আমার কি উচিত ছিল না তাকে আরেকটু সময় দেয়া? না দোষ তো আমারই। একটু বেশিই ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে গেছিলাম। নিজেকে দোষারোপ করে কর্তা মশাইয়ের উপর থেকে সব অভিযোগ তুলে নিলাম। শুধু শুধুই মানুষটাকে ভুল বুঝছি আমি। যদি আমাকে পছন্দ না হতো তাহলে নিশ্চিয়ই শীতল ব্যবহার না করে কঠোর আচরণই করতেন, তাই না? হ্যা তাই হবে। তাছাড়া আর কি হতে পারে?

পাশ ফিরে দেখলাম কর্তা মশাই গভীর ঘুমে অচেতন। তার শান্ত মুখের কোথাও তো আমার প্রতি বিরূপ মনোভাব নেই। উফ কি যে আমি! একটা পুরোদস্তুর বোকা ও অতিরঞ্জিত ভাবুক মেয়ে। মানুষটার মুখে এতো মায়া যে সব দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নিতে ইচ্ছে হয়। নিজের কার্যকলাপে নিজেরই হাসি পেল। ইশ কি কাঁদাটাই না কেঁদেছি!

অনেক রাতে চোখটা লেগে এসেছিল। এসময় প্রচন্ড চেঁচামিচি শুনে তন্দ্রা ভেঙে যেতেই হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। বুঝতে পারলাম না এত রাতে হঠাৎ কি হলো! কর্তা মশাইয়েরও ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি তৎক্ষনাৎ উঠে দৌড়ে গেলেন পাশের ঘরে।

চলবে ইন শা আল্লাহ….