এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-৭+৮

0
170

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ০৭
সানজিদা মাহি
__________________________________________

” ঠাস! ”

হাতটাকে সামনে ধরে চোখ পিটপিট করে কয়েকবার তাকালাম। ইশ রক্ত লেপটে গেছে একবারে। আর মশাটার কথা না ই বা বললাম। এক থাপ্পড়ে চিরেচ্যাপ্টা। একদম উচিত জবাব হয়েছে। আর আসবি রক্ত খেতে? পৈশাচিক আনন্দ হলো মনে মনে। কিন্তু পরক্ষণেই মায়া জন্মালো অন্য কথা মনে পড়ে গিয়ে। বাইরে বেঁধে রাখা লোকটার না জানি কি অবস্থা হয়েছে এতক্ষণে। জানালা খোলা পেয়ে মশারা যদি এমন উপদ্রব করতে পারে তবে যাকে মশার খাদ্য হিসেবে মুক্ত হস্তে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তার অবস্থা কতটা বেগতিক তা স্বচক্ষে না দেখলেও সহজেই অনুমেয়।

ভালো করে ঘুমানো গেল না রাতে ৷ বইয়ে পড়েছি, তীব্র মন খারাপ বা অতি কান্নার পর ভালো ঘুম হয়। এদিকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর নিজের সাথে নিজের বোঝা পড়া করতে গিয়ে বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিলাম ধাঁধার মধ্যে। মানুষটার ব্যবহার আর অভিব্যক্তি দুটো যেন আলাদা আলাদা কিছু ইঙ্গিত করে। কখনো মনে নয় এটাই স্বাভাবিক। কখনো মনে হয়, এটা স্বাভাবিক হতে পারে না। কোনো ‘কিন্তু ‘ না থেকে যায় না। ভাবনার অতল সমুদ্রে ডুবছিলাম, ভাসছিলাম বারংবার। আর ইচ্ছে করছিলো মানুষটাকে ডেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে প্রশ্ন করি৷ আজ সব দ্বিধার দেয়াল ভেঙে চুরমার হোক। মেনে নেবার মতো কষ্টকর কিছু হলেও সেটা হবে সত্য। আর সত্য কঠিন হলেও, মিথ্যা ছলের চেয়ে সেই কঠিন সত্যকে ভালোবাসা যায় অনায়াসে ৷ যদিও আমি জানি, এহেন কাজ আমার দ্বারা কখনো সম্ভব নয়। যে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সামর্থ্য নেই। তাকে অহেতুক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবার ক্ষমতাও আমার নেই সে সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহে নিশ্চয়তা দিতে পারি নিজেকে। কিন্তু নিজের সাথে লড়াই করে আপন মনে গুমরে মরাও বেদনা বিষাদ সিন্ধুর অতলে প্রবেশের শামিল। দ্বিধা ও অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত থাকার কষ্ট সে মুহূর্তে ছিল আর বাকিসবের চেয়ে অধিক। রাজ্যের ভাবনা অবগাহনে আকুৃন্ঠ ডুবতে ডুবতে তন্দ্রা লেগে এসেছিল চোখে৷ সেসময় উঠলো দারুণ হৈচৈ। কর্তা মশাই ঘুম ভেঙে ছুটে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ফুলবানু আর জমিলা এলো আমাকে খবর জানাতে৷ সিঁধ কেটে চুরি করতে গিয়ে নাকি চোর ধরা পড়েছে। ফুফাজির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল শব্দ শুনে৷ শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার পর যখন বুঝলেন চোর মশাই ঢুকেছে ঘরের ভেতরে, অমনি অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার উপর। চেঁচামিচি শুনে ফুফুজানেরও ঘুম ভেঙে গেল। ফুফাজি তখন চোরকে মাটিতে শুইয়ে তার উপর চেপে বসেছেন। ফুফুজান আলো জ্বেলে তাড়াতাড়ি গামছা দিলেন ফুফাজির হাতে। তিনি গামছা দিয়ে চোরের হাত-পা বাঁধলেন। চোরটাকে এখন বাইরে বেঁধে রাখা হয়েছে।

একটুপর ফজরের আজান দিবে। তাই এখন ঘুমানোও ঠিক হবে না৷ তের তম হামি সম্পন্ন করে বাইরে দিকে আরেকবার চোখ বুলালাম৷ নাহ, ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলো ফুটতে এখনো ঢের দেরি।

” ভাবি, বেহেন হইলেই দেখবেন কেমুন মজা হয় ”
বলে খানিকক্ষণ আপনমনে হাসলো ফুলবানু। তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে ভুললো না জমিলা। মজার কোনো ব্যাপার মনে হলো না এটাকে। চোরের বিচার হবে। এটা কি মজার ব্যাপার হতে পারে? যদিও ঠিক না তবুও খানিকটা করুণা হচ্ছে চোরটার জন্য। এত কষ্টে করে এই বর্ষায় ঝুঁকি নিয়ে সিঁধ কেটে যেই ঘরে ঢুকলো অমনি গৃহ কর্তার সামনে ধরা পড়ে গেল। তবে করুণার কারণ এটা নয়। করুণার কারণ হলো এই চোর মহাশয়ের জীবনে এটি ছিল দ্বিতীয় বারের মতো চুরি করবার প্রয়াস। এবং বলাই বাহুল্য প্রথম ও দ্বিতীয় দুটো প্রয়াসেই তাকে চুরি করবার আগে হাতেনাতে ধরা খেতে হয়েছে। একটি চোরের দুটি ব্যর্থতার আত্মকাহিনী। বাহ দারুণ তো! আমাকে ফিক করে হাসতে দেখে মেয়ে দুটো উৎসুক চোখে চাইলো আমার দিকে। হাসির কারণ না জিজ্ঞেস করে নিজেরাও হাসতে লাগলো। ব্যাপার কি!আজ সবার হাসির রোগ পেল নাকি?

ফজরের আজান দিতেই দলবেঁধে তিনজনে পুকুর ঘাটে গেলাম অজু করতে। শেষরাতে এমনিতেই ঠান্ডা লাগে। এখন পুকুরের পানিও যথেষ্ট ঠান্ডা। ঝিঁঝি পোকাগুলো কি করে এমন অবিরাম ডেকে চলে কে জানে! আচ্ছা এদের গলা ব্যাথা করে না? নিজেদের ডাকে নিজেদের মাথা ধরে যায় না? আমার অবশ্য বেশ লাগে ঝিঁঝিদের গান। তবে বিরতিহীন, একটানা ডেকে যায় কি করে সেটাই প্রশ্ন। হারিকেন ঘাটে রেখে আমরা অজু করতে বসেছি। পানিতে ছলাৎছলাৎ শব্দ হচ্ছিলো। কয়েকটা জোনাকি পোকা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে উড়ে চলেছে পুকুরের উপর৷ জোনাকি পোকা কাঁচের জারে ঢুকিয়ে আলোর ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? বদ্ধ জারে বেশিক্ষণ বাঁচবে কি? থাক মুক্ত প্রাণী স্বাধীনতা নিয়েই সুন্দর।

ওজু করে এসে তিনজন নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজের পর শুনলাম, ফুফাজি, কর্তামশাই আর জামাল মিলে গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তিদের ডাকতে গিয়েছে। আরো কিছুক্ষন ফুফুজানের সঙ্গে চোর বিষয়ক আলোচনা চলল। বাইরে একটু একটু করে আলো ফুটছে। মোরগের হাঁকডাক শুরু হয়েছে। ফুফজান মিলে আমরা সবাই নাস্তা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলাম। এ বাড়িতে যেহেতু বিচার বসবে তাই নাস্তার ব্যবস্থাও বিশাল হওয়া চাই।

চারদিকে ভালো করে আলো ফুটতেই একে একে গ্রামের লোকজন উঠোনে এসে জড়ো হতে লাগলো। চোরটাকে গরু ঘরে বেঁধে রাখা হয়েছে। জমিলা একটু পরপর এসে খবরা-খবর জানিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের দুইজন মহিলা এসে আমাদের সঙ্গে জুটে গেলেন কাজে হাত লাগাতে। বিশাল পাতিলে ময়দার খামির তৈরি করা হয়েছে। ভাজির জন্য আলু কাটা হচ্ছে। এরমধ্যে জমিলা এসে বলে গেল উঠানে যারা জড়ো হয়েছে তাদেরকে ফুফাজি চা দিতে বলে পাঠিয়েছে। প্রায় পঁচিশ- ত্রিশ জন মানুষকে চা আর মুড়ি খাওয়ানো হলো৷ গ্লাস কম থাকায় দুই বাড়ি থেকে গ্লাস আনা হয়েছে। জমিলা, ফুলবানু আর জামালের আগ্রহ সর্বোচ্চ। যেভাবে ওরা দৌড়োদৌড়ি করে চা- মুড়ি দিয়ে আসছিলো তাতে মনে হচ্ছিলো চোরের বিচারসভা না বসে বোধহয় কারো বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। চা পর্ব শেষ করে মূল বিচার পর্ব আরম্ভ হলো। মহিলারা ঘরের ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে বিচারকার্য দেখতে লাগলো। আমিও ফুলবানু আর জমিলার সঙ্গে জানালার সামনে পর্দার ফাঁক দিয়ে সেদিকে চেয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছি।

বিচারকদের একজন ফুফাজি, একজন গ্রামের মেম্বার আর আরেকজন গ্রামেরই গন্যমান্য কেউ হবেন। বিচারক তিনজন ও কর্তামশাই চারজন চারটা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। কেউ কেউ মোড়া, পিড়িতে বসেছে। বাকিরা সবাই মাটিতেই বসে পড়েছে। এতগুলো মানুষের বেষ্টনির মাঝখানে এক চিলতে ফাঁকা স্থানে চোর লোকটি অবলীলায় ক্লেশহীন মুখে বসে আছে। তার হাত পিছমোড়া করে গামছা দিয়ে বাঁধা। তবে পায়ে বাঁধন নেই। সম্ভবত প্রয়োজন নেই বিধায় খুলে দেয়া হয়েছে। ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে নিজেও বিচারকার্য শুরু হবার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহ নিয়ে বসেছে। মেম্বার সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
” মজনু মিয়া তুমি নিজে কও তুমি কামডা ঠিক করলা কিনা ”
এতক্ষণে বোঝা গেল চোরের নাম মজনু। মজনু মিয়া অধিকতর উৎসাহ নিয়ে দুইপাশে মাথা দুলিয়ে জবাব দিল,
” না চাচা। ঠিক করি নাই ”
” চুরির আগে এই কতাডা মনে হইলো না? ”
” চুরির আগেও মনে হইছে “, মজনুর চটপটে জবাব।

বিচারকরা উসখুস করা শুরু করলো। এ আবার কেমন চোর? সবটাতেই হ্যা! ফুফাজি গমগমে স্বরে বললেন,
” চুরির আগে মনে হইলে চুরি করতে আইলা ক্যারে? ”

মজনু মিয়ার মুখটা করুণ হয়ে গেল। গোবেচারার মতো মুখ করে বলল, ” স্বাদ কইরা কেউ চোর অয় কন দেহি? ”
” মানে কি কইতে চাও? ”
” কোনোখানে কাম পাই না বইলাই তো এই কাম করতে হইলো। নিজের ক্ষিদা সইহ্য করন যায় কিন্তু বউ বাচ্চা না খায়া থাকলে কয়দিন সইহ্য করন যায়? ”

ভেতর ঘর থেকে নারী কন্ঠের গুনগুন করে কাঁদার শব্দ ভেসে এলো। ফুলবানু এক দৌড়ে দেখে এসে আমাকে বলল, মজনু মিয়ার বউ কাঁদছে।

” এইডা কি কইলা মিয়া? কামের অভাব ফড়ছে? আমার কাছে আইলেও তো তোমার কামের ব্যবস্থা আমি কইরা দিতাম ” উচ্চস্বরে বললেন মেম্বার সাহেব। মেম্বার সাহেবের চিৎকার শুনেই হয়তো মজনু মিয়ার বউয়ের কান্না থেমে গেল তৎক্ষনাৎ।

উৎসুক জনতার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মজনু শান্ত স্বরে বলল,
” চাচি আম্মারে জিগায়েন কয়দিন গেছি আফনার বাড়িতে। একদিনও তো ফাই নাই ”
” আইচ্ছা মানলাম আমি গেরামের মেম্বার। আমার থাহে মেলা কাম। কিন্তু গেরামে আর কেউ ছিল না তুমারে কাম দেওনের? ”
মজনু এবার তৃতীয় বিচারকের দিকে তাকিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল, ” ফরিদ চাচা আমনের কাছে দুইবার যাই নাই? আমনে তহন কাম নাই কইয়া ফিরায়া দেন নাই? কন অহন হগলরে হেই কতা ”
প্রশ্নবানে তৃতীয় বিচারক কিছুটা হকচকালেন। তারপর সায় দিয়ে বললেন, ” হ গেছো আমার কাছে। কিন্তু আমার কাম আছিল না। দিমু কইত্তে? ”
মজনু এবার আক্রোশে বলতে লাগলো, ” ব্যাক মানুষ এক কথা কইলে কেমনে হইব? আফনারা জানেন এর আগেও আমি চুরি করতে গিয়া ধরা খাইছি। কিন্তু চুরি করবার পারি নাই। এইবারও তাই। আসল কতা আমার চুরি করবার ইচ্ছাও নাই। কিন্তু আফনাগো কাছে আমি বহুবার গেছি কামের লিগা কেউ কাম দেয় নাই। আফনাগো মতো আমারও কি মন চায় না পোলাপাইনরে ভালো-মন্দ খাওয়াই? অহন আফনারা কন বিচার কি আমার হওনের কতা নাকি আফনাগো? ”

মজনু মিয়ার প্রশ্নে এবার উপস্থিত সকলের মাঝে সোরগোল শুরু হলো। আসলেই তো মজনু ভুল কিছু বলেনি। গ্রামের দ্বায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন যারা এসব বিষয়ে তাদেরই খেয়াল করবার কথা। শালিসের সময় সবাইকে পেলেও প্রকৃত কাজের সময় পাওয়া যায় কদাচিৎ। একজন চোর যখন দায়িত্বে অবহেলারত গন্যমান্য কাউকে নিজের অবস্থানের জন্য দায়ী করে তখন স্বাভাবিকই অন্য সাধারণ মানুষের চোখে আরও কিছু দোষ-ত্রুটি ধরা পড়ে৷ কিন্তু এ নিয়ে মানুষ ক্ষ্যাপলে অশান্তি সৃষ্টি হবে নির্ঘাত। অথচ বিচারকদের বিচার করবে কে? বিচারক কাঠগোড়ায় দাঁড়ালে সাধারণ জনগণের মাঝে প্রতি বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিবে। সমস্যার সমাধান দিলেন ফুফাজি নিজে৷
” ঠিক আছে মজনু৷ আমার মনে হইতেছে তুমি আসলেই সৎ লোক। আমি তুমারে কাম দিমু। এহন থিকা তুমি আমার ধানী জমি দেখবা। ফারবা না? ”
মজনু মিয়ার মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল। জোর দিয়ে বলল,
” ফারমু না ক্যারে? অবশ্যই ফারমু? ”

উপস্থিত ব্যক্তিদের মাঝে একটু আগে যে হৈ চৈ আর আলোচনার ঝড় উঠেছিলো তা ফুফাজানের কথায় থেমে গেল। এ সিদ্ধান্তে সকলেই খুশি। ফুফাজির ইঙ্গিত পেয়ে জামাল দৌড়ে গিয়ে মজনু মিয়ার হাতের বাঁধন খুলে দিল। বিচার সভা এখানেই সমাপ্ত। ফুফাজি সবাইকে নাস্তা করে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।

ঘরের ভেতর মহিলাদের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল দ্বিগুণ উৎসাহে। প্লেটে প্লেটে রুটি আর ভাজি উঠানে যাচ্ছে বাচ্চা তিনটের হাত দিয়ে৷ উঠানে বড় দুটি শীতলপাটি বিছানো হয়েছে। পুরুষরা সবাই সেখানেই বসেছে। রান্নাঘরে ফুফুজানের প্রচন্ড ব্যস্ততা৷ দুইজন রুটি বেলছে আর ফুফুজান রুটি সেঁকে দিচ্ছেন । পুরুষদের খাওয়া হয়ে যেতেই উঠান খালি হয়ে গেল ধীরে ধীরে। মহিলাদের সংখ্যা হাতেগোনা। তাদেরকে ভেতর ঘরেই খেতে দেয়া হলো। খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর একেকজন একেক কাজে সাহায্য করায় সবকিছু তাড়াতাড়ি করে ফেলতে সহজ হলো৷

পুরো বাড়িতে পুনরায় আগের মতো নিরবতা। ফুফুজান জামাল আর ফুলবানুকে দিয়ে দুপুরে খাবার জন্য একটা হাঁস জবাই করালেন। আমি কখনো হাঁস কাটিনি। ফুফুজানকে দেখলাম অত্যন্ত দক্ষতার সাথে হাঁসের চামড়া ফেলে দ্রুত হাতে হাঁসটা কেটে ফেললেন। কাজ করতে করতেই আমার সাথে টুকটাক গল্প করতে লাগলেন।

আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়নি। নির্মেঘ, নীল আকাশে ফকফকা রোদ। রোদ পেয়ে উঠান, মাটির রাস্তা শুকাতে শুরু করেছে। তবে ঠান্ডা বাতাস থাকায় গরম লাগছিল না৷ ঘরের পেছনের বাগানটাতে বাচ্চাদের সঙ্গে বেড়িয়ে এলাম৷ ফুলবানু পুকুরপাড়ে দুটো গাছের সঙ্গে বড় ওড়না বেঁধে দোলনা বানালো। যদিও ইচ্ছে ছিল দোল খাওয়ার কিন্তু বসবার মতো সাহস হয়নি। এমন বড়ো ধিঙি মেয়ে হয়ে দোলনায় বসে পরে ছিঁড়ে পড়ে গেলে বেজ্জতি কান্ড হবে। ফুলবানু আর জমিলা মিলে দোল খাচ্ছে। আমি ওদের কাছ থেকে উঠে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে যেতেই কর্তা মশাইয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হলাম।

” আপনি শরীর ঠিক আছে? অসুখ সেরেছে? ”

তার উদ্বেগ ভরা কন্ঠ অর্বাচীন আবেগের বেসামাল মনে ধাক্কার মতো লাগলো৷ এই তো সেই শীতল, গম্ভীর, মায়া মায়া কন্ঠ। গানে বাজতে লাগলো সুরের ঝংকার। টের পেলাম মন সায়রে পুনরায় ঝড়ের আবাস৷ সামনে দাঁড়ানো মানুষটির চোখে স্নেহমাখা উৎকন্ঠা। চোখের ভাষা পড়তে পারি কদ্দুর? তবু ভালো লাগলো। এও ভালো। একটু যত্ন…উদ্বেগ প্রকাশ…আমাকে নিয়ে ভাবেন তবে!
কর্তা মশাই একটা হাত আমার কপালে ছোঁয়ালেন। শিরশিরে হাওয়া বইলো যেন সারা গায়ে৷ চোখ দুটো মুহূর্তে বিস্ময়ের আধিক্যে চলনহীন দৃষ্টিতে তারই দিকে চেয়ে রইলো। বড় বড় ঢেউ এসে সমুদ্রকে উত্তাল করে তুলছে ক্রমশ৷
” যাক! জ্বর নেই তাহলে “, স্বস্তিমাখা স্নিগ্ধ হাসি গেল তার ওষ্ঠদ্বয়ে৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো বললেন পরের কথাগুলো।
” খারাপ লাগলে সংকোচ না করে আমাকে জানাবেন। কেমন? ”

কখন কর্তা মশাই চলে গেলেন টের পেলাম না। সম্মোহিত হয়ে সময় জ্ঞান ভুলে দাঁড়িয়ে রইলাম। সঙ্গী হলো প্রথম স্পর্শের অনুভূতি আর কর্ণকুহরে সুরের মূর্ছনা, হদয় সমুদ্রে অনিয়ন্ত্রিত ঝড়।
” যাক! জ্বর নেই তাহলে”
” খারাপ লাগলে সংকোচ না করে আমাকে জানাবেন। কেমন? ”
“কেমন” টা যেন একটু বেশিই আদুরে। একটু বেশিই স্নিগ্ধ, পেলব, তুলতুলে পেখমের মতো। ইশ কি যে আমি! আবার ভাবনার জাহাজ নিয়ে ডুবতে শুরু করেছি। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপানি নিয়ে একছুটে পুকুরের ঘাটের সিঁড়িতে ধপ করে গিয়ে বসে পড়লাম। এমনও হয়? সামান্য জিনিসে এতটাও আনন্দ হয়? প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে করে। কিংবা ফুলের মতো সামান্য হাওয়া পেয়ে দুলেদুলে নাচতে ইচ্ছে করে!

চলবে ইন শা আল্লাহ…

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ০৮
সানজিদা মাহি
________________________________________

চোখের পলকে দুটো দিন শেষ হয়ে গেল। সকাল বেলাতেই আমরা ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। বেশি সময় লাগেনি। কারণ জামাকাপড় বা অতিব প্রয়োজনীয় জিনিস যা সঙ্গে এনেছি তাকে সামান্যই বলা চলে। মনের মধ্যে ‘চলে যাব’ ‘চলে যাব’ একটা ভাব। আবার মনে হয়, কি যেন রেখে যাচ্ছি। কোথাও গেলে এমনটা আমার সবসময়ই হয়৷ তবে নাস্তা করে প্রস্তুত হবার পর টের পেলাম সব কেমন গম্ভীর, থমকানো, নিশ্চুপ। বাচ্চাগুলোর হৈ হুল্লোড় নেই। বড়দের মুখেও অপ্রয়োজনীয় কথা নেই। মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পেরে হয়তো আশেপাশের পরিবেশেও থমথমে ভাব। আর নয়তো ওটা আমার অস্বাভাবিক ধারণা৷ সবকিছু হয়তো আগের মতোই। শুধু আমার মনে হচ্ছে গাছপালা, বাতাস এমনকি আকাশেরও মন খারাপ। যদিও নির্মেঘ আকাশে তেজহীন রোদের খেলা৷

গতকাল রাতেও ফুফুজান বারবার বলছিলেন যেন আর কয়টা দিন থেকে যাই। আমিও মনে মনে তাই চেয়েছিলাম৷ কিন্তু কর্তা মশাই সরাসরি জানিয়ে দিলেন তিনি আর থাকতে পারবেন না। তাকে কাজে যোগ দিতে হবে। তারপর আর কি করার। উনার মুখের উপর তো আমার কথা চলবার সুযোগ নেই৷ বাচ্চাদের শত অনুরোধ আর অনুনয় কানে না তুলে পাশ কাটিয়ে যেতে হলো। অবশ্য এতেই ভালো হয়েছে। মায়া বাড়ালে আরও খারাপ লাগবে পরে।

সবাইকে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে। জামাল আর ফুফাজি সঙ্গে এলেন এগিয়ে দিতে। একবার পিছনে ফিরে চাইলাম। ফুলবানু আর জমিলা তাকিয়ে আছে ছলছল চোখে। মাত্র দুটো দিন। অথচ কি ভীষণ মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি। চাইলেই সব করা যায় না। এই যে ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে বলি, তোমরা আমার সঙ্গে চলো, কয়েকদিন বেড়িয়ে এসো৷ এতো সহজ একটা কথা অথচ বলতে পারলাম না। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কর্তা মশাইয়ের পিছন পিছন হেঁটে চললাম। মনে হচ্ছে কি একটা রেখে গিয়েছি, সঙ্গে নিতে ভুলে গেছি। এটাকেই বুঝি মায়া বলে? নৌকায় উঠিয়ে দেয়ার পর অনেকক্ষণ অবধি ফুফাজি আর জামাল ঘাটে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর দূর হতে দেখলাম তারা চলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে দৃষ্টিপট থেকে হারিয়ে গেল। আজ একটা মন খারাপ করা দিন। হয়তো সারাদিনেও এই মন খারাপ ভালো হবে না। একটা শূন্যতা নিয়ে কেটে যাবে সারাটা দিন…

________________

চিঠিটা বিছানায় রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। বাবা চিঠি পাঠিয়েছেন। সেই যে এলাম প্রায় মাস খানেক হয়ে গেল। এরপর মাত্র একবারই বাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছি। বাবা একবার গিয়ে বেড়িয়ে আসতে বললেন। কিন্তু কর্তা মশাই ছুটি নিতে পারবেন কিনা কে জানে। এতদিন তো বাড়ির জন্য মন কেমন কেমন করেনি। অথচ যেই আজ চিঠিটা পেলাম অমনি মনটা ছুটে যেতে চাইছে চিরচেনা, পুরনো আস্তানায়। এই এতদূর থেকেও যেন আমার নিজের ঘর, জানালা, জানালার বাইরের এক চিলতে আকাশ আর আমগাছের গাঢ় সবুজ পত্রে আচ্ছাদিত ডাল, আমার নিজের হাতে কাজ করা বিছানা সব স্পষ্ট দেখতে পেলাম মনের আয়নায়। আর আমার বালিশের আপন আপন ঘ্রানটা যেন এখনও নাকে লেগে আছে। ইশ কবে যে যাব ও বাড়িতে! আজ কিছুতেই আর কাজে মনোযোগ দিতে পারব না। আর কাজই বা কি? সকাল সকাল রান্না হয়ে যায়। ঘর গুছানো, ঝাড়ু দেয়া। এছাড়া আর কাজ কি? সময় কাটতেই চায় না যেন। কর্তা মশাইয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কয়েকদিনে বেশ অনেকগুলো বই পড়া হয়েছে৷ আমি ভাবতেও পারিনি তিনি এতো দ্রুত একটা বই শেষ করতে পারেন। আমার চেয়েও ফার্স্ট রিডার। এদিকে আজকাল কি যে হয়েছে। বইটই পড়তে ভালোই লাগে না। বই ধরলেই হাই তুলতে থাকি।

চা শেষ করে চিঠি লিখতে বসলাম। তবে বাবাকে নয়। যাকে লিখছি তাকে দেবার উদ্দেশ্যে লিখছি না। শুধু সময় কাটানোর জন্য লিখছি বললে মন্দ হয় না৷ বরং এটাই অধিক উপযুক্ত কারণ৷ আজ বেশ মেঘ করেছে আকাশে। নীলচে আকাশে শুভ্র মেঘগুলো ক্রমশ রূপ নিল ঘোর কৃষ্ণ রঙে। আকাশে মেঘ জমছে অনেকক্ষন ধরে। তবে বৃষ্টি নামার লক্ষন নেই। হুট করেই হয়তো আকাশ কাঁদতে শুরু করবে। ছোট একটা টেবিল আনিয়েছিলেন কর্তা মশাই। সেটাকে শোবার ঘরের জানালার সামনে রেখেছি৷ এখানে বসে মাঝে মাঝে বই পড়ি। কাগজ কলম নিয়ে বসেছি। কিন্তু লিখবার মতো কথা গুছিয়ে নিতে পারছি না৷ বাতাসে গাছের পাতা দুলছে। নদীর পানিতে ছোট ছোট স্রোত ঢেউ হয়ে খেলছে৷ আকাশে মেঘ করেছে বলেই হয়তো নৌকা চলছে না তেমন৷ এখানে বসে বসে নদী দেখাটা আমার প্রিয় কাজের অন্তভূক্ত হতে বেশি সময় লাগেনি। নদী দেখার মাঝে রোমাঞ্চকর কিছু নেই। তবু দেখতে ভালো লাগে। ভালো করে দেখলে নদীর রূপ ক্ষনে ক্ষনে যে পরিবর্তিত হয় তা বেশ উপলব্ধি করা যায়। যাক নদী পরে দেখা যাবে৷ চিঠিটা লিখি।

প্রিয়জনেষু,

এই যে আপনাকে নিয়ে ভাবছি, চিঠি লিখতে বসেছি তার কি স্পষ্ট কোনো কারণ আছে? হয়তো নেই কিংবা আছে যা আমি ধরতে পারছি না। অথবা আমি জানি তবু স্বীকার করতে চাইছি না। বিয়ে নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা ছিল না আমার। অতি আবেগী বয়সটা কোনো ঝঞ্জাট ছাড়াই পার করে দিয়েছিলাম। একাকী মানুষের কল্পনা জগতে আর কিছু থাক বা না থাক একটা প্রিয় মানুষ থাকে। আমার কল্পনায় এমন কিছু ছিল না৷ আমি যে ভালোবাসতে জানি, আমারও যে এই বিশেষ অনুভূতিটি আছে তা কস্মিনকালেও টের পাইনি। কেমন করে যেন নির্ভাবনায় আচম্বিতে একটা মানুষের সাথে হুট করে বিয়ে বন্ধনে জড়িয়ে গেলাম। বিয়ের পর কিছু নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হলো। তারা আমাকে আপনার মানুষ করে নিতে চাইলো। আমি নিতান্ত মুখচোরা স্বভাবের হয়েও চেয়েছি তাদের প্রত্যাশাগুলোকে সামান্য হলেও পূর্ণতা দিতে। কিন্তু স্বামী জিনিসটি যে কি আর তার প্রতি কেমন অনুভূতিই বা থাকতে হয় সে নিয়ে বরাবরের মতো অজ্ঞ আমি ভাবলেশহীন মুখে সময়ের স্রোতে গা এলিয়ে দিলাম। সময় যেখানে নিয়ে যাচ্ছিলো আমি সেখানেই যাচ্ছিলাম। কোনটাকে যে অবজ্ঞা বলে আর অবহেলা দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা যে কি তা বুঝতে বেশ সময় লেগেছে। অথচ কি সুনিপুণ কায়দায় নিজের মায়ায় জড়িয়ে নিলেন তা কি একটাবারের জন্যও বুঝতে পেরেছিলেন?

রোদের মতো কুসুম রাঙা মুখটায় যখন স্নিগ্ধ লাজুক ভাব এসে একটা ছোপ ছোপ লালচে আভা ভর করে। নেত্র পল্লবের নিম্নদেশে এক জোড়া চোখে রাজ্যের মায়া এসে জায়গা করে নেয়, যেখানে একটা স্থির, অচঞ্চল নদীর বসবাস। মনে হয় আমি বুঝি এই মুখ আর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারব। অথচ এ কেবল আমার ভ্রান্ত কল্পনা। দু’সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকবার সাধ্যি আদৌ কখনো হয়নি আমার। ভারী ভয় হয়, বুঝি আমার চোখ দেখে মনের ভাষা পড়ে ফেলেন। যদি তখন আরো দূরে সরে সরে থাকেন? কাছে থেকেও আপনাকে কত দূরের লাগে। এতটা দূরে যেন হাত বাড়ালেই ছায়া হয়ে সব মিলিয়ে যাবে কর্পূরের ন্যায়৷

আপনি আশেপাশে থাকলে অনুভূতি শূন্য হৃদয়ে ফুলের মতো পেলবতা ঠাঁই করে নেয় এক লহমায়। এই অনুভূতির কি নাম জানেন? আমি আপনাকে ঠিক বুঝতে পারি না। আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তাদের ছুঁতে জানি না। একটা রহস্যে নিজেকে আবৃত করে রাখেন যে মনে হয়, এই দেয়াল ভেঙে কখনো হয়তো ওপারের মানুষটাকে বোঝা হবে না। এতো আড়াল আমার ভালো লাগছে না৷ সরাসরি প্রশ্ন করবার ক্ষমতাও আমার নেই। দু’আ ছাড়া আর কোনো সম্বলও নেই আমার। সত্য যাই হোক তবু চাই আপনি এ রহস্য ভাঙ্গুন। আপনার মন কি চায়? আপনার সিদ্ধান্তকেই সবকিছুর উর্ধ্বে প্রাধান্য দিতে চাই। তবু একবার শুধু মুখ ফুটে বলুন….

আপনার
অর্ধাঙ্গী

চিঠি লিখবার পর দু’বার পড়লাম। মনে হলো, ছিঃ কিসব লিখে রেখেছি! সস্তা প্রেমপত্র! সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে জানালার বাইরে ফেললাম। এতক্ষণে খেয়াল হলো চারদিক ভীষণ আঁধার করে বৃষ্টি নামব নামব করছে। এখনো দুপুর হয়নি অথচ এতটা অন্ধকার করেছে যে সন্ধ্যা বলে ভ্রম হয়। আমি উঠে গোসল সেরে ফেললাম। এসে দেখি তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। চট জলদি জানালা আঁটকে দিলাম৷ টেবিল ক্লথটা এতক্ষণে অনেকখানি ভিজে গেছে। দরজা জানালা বন্ধ করতেই ঘরের ভেতরটা প্রচন্ড অন্ধকার হয়ে গেল। পাশের ছোট ঘরটায় গিয়ে জানালা খুলে দিলাম। এ ঘরে জিনিসপত্র প্রায় নেই বললেই চলে। মেঝে ভিজলে সমস্যা নেই। বৃষ্টির পাশাপাশি দারুণ ঝড় তুফান হচ্ছে। জোরালো বাতাস বৃষ্টির গতিকেও এলোমেলো করে দিতে চাইছে। গত কয়েকদিন বৃষ্টির তেমন একটা দেখা মেলেনি। আজ তাই একসঙ্গে আকাশ তার রাগ, জেদ ঝাড়ছে প্রবল আক্রোশে।

কর্তা মশাই সকালে ভালো করে না খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ আগে। কিন্তু তিনি এখনো ফেরেননি। একা একা কিছু করেও সময় কাটছে না। তাই ভাবলাম খাবার নিয়ে না হয় চলে যাই স্টেশনে। এটুকু সাহস নিশ্চয় করাই যায়। তারপর সাতপাঁচ নাহ ভেবে বক্সে করে খাবার নিয়ে স্টেশনের দিকে যাওয়ার জন্য বের হলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছেন তাই আসতে পারেননি। আচ্ছা যদি দেখেন আমি খাবার নিয়ে এসেছি তখন উনি কি ভাববেন? খুশি হবেন নাকি নারাজ? না ওনাকে কখনো নারাজ হতে দেখিনি। আর এটাতে নারাজ হওয়ারই বা কি আছে?
ঝড় বৃষ্টিতে কাঁদামাখা পথ হেঁটে নৌকার জন্য অপেক্ষা করেও একটা নৌকাও পেলাম না। মাটির রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে সময় লাগবে। আর কোনো উপায় না পেয়ে হেঁটেই স্টেশনে যেতে হলো। স্টেশনে পৌছানোর পর উনার অফিস ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাব তখন নজু ছুটে এলো আমার দিকে।
‘ ভাবী আপনে এইহানে?’ উদ্বেগ, উৎকন্ঠা,ক্লেশ ফুটে উঠলো ওর কন্ঠে।
‘ হ্যা তোমার স্যার আজকে খেতে যায়নি তো তাই খাবার নিয়ে এলাম। উনি আছেন নাহ?’
‘ স্যা..স্যার তো…’
‘ আচ্ছা সমস্যা নেই আমি যাচ্ছি উনার কাছে ‘
নজুকে কিছুটা বিব্রত লাগছে কোনো কারণে। আমি সামনে কয়েক কদম এগোতেই ও আবার পেছন থেকে ডাক দিল।
‘ কি? কিছু বলবে? ‘
নজুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল, কিছু না। আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে অফিস ঘরের দিকে এগোলাম। স্টেশন এখন খালি। শুধু চায়ের দোকানে মুরুব্বি গোছের দু’জন মানুষ বসে আছে। অফিস ঘরের জানালার সামনে আসতেই আমার পা শ্লথ হয়ে এলো। মনে হলো পৃথিবী থমকে গেছে। অপ্রত্যাশিত ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বলিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কর্ণকুহরে অতি অপ্রিয় কিছু কথা এসে পৌছালো। যা কখনো আমি ভাবিনি।

” আমি কি করতাম তুমি বলো? চিঠির পর চিঠি পাঠিয়ে যাচ্ছি তুমি একটিরও উত্তর দিলে না ”
” আমি কি করতাম তুমি বলো! বাবা এতবেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন৷ তাকে নিয়ে সবার টানাটানি। ভয়াবহ দুশ্চিন্তার মধ্যে আমি তোমার চিঠি খুলে পড়বার সময়টুকু পর্যন্ত পাইনি৷ তুমি তো জানো বাবার কিছু হয়ে গেলে আমার পুরো পৃথিবীটাই এলোমেলো হয়ে যেত। কিন্তু একটা ছেলে হয়ে তুমি বিয়ে আটকাতে পারলে না? ”
” কি মনে হয় আমি আটকাবার চেষ্টা করিনি? আমি বলেছি যে মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়নি। অথচ মা-বাবা, বুবু সবারই ওকে পছন্দ হলো। মা কান্নাকাটি শুরু করলেন। একা একা এখানে তিনি আমাকে থাকতে দেবেন না৷ তোমার কথা যে বলব কিসের ভরসায় বলোতো? ”

মনে হলো কেউ ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হৃদয় নামক যন্ত্রটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে৷ মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগ অবধি যে সুখটুকুকে হৃদয়ে ধারণ করে এসেছিলাম, এক লহমায় সেটাকে কেউ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। ঝনঝন শব্দ করে পুরনো দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়লো। ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, এই ছিল সে সত্য। একে তুমি পারবে গ্রহণ করতে? এতটা সৎ সাহস আছে তো তোমার?

মেয়েটি ধপ করে টুলে বসে পড়লো। তার গাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় নোনাজল গড়িয়ে পড়তে লাগলো অবিরাম ৷ কর্তা মশাই হাঁটু গেড়ে বসলো তার সামনে।
” বিশ্বাস করো শান্তা! আমার কোনো দোষ নেই। আমি চাইনি তোমাকে আঘাত করতে বিশ্বাস করো…”
শান্তা দু’হাতে মুখ গুঁজে চাপা স্বরে কাঁদতে লাগলো। আমি স্তম্ভিত হয়ে কেবল দেখলাম যে মানুষটিকে আমি নিজের বলে দাবি করতে চেয়েছি সে মানুষটি দু’চোখে মায়ার সমুদ্র নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে৷ অথচ এতটা মায়া, এতটা পাবার আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমা লাভের তৃষাতুর চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকায়নি সে কখনো।

” আমাকে ক্ষমা করো প্লিজ ”
শান্তা মুখ থেকে হাত নামিয়ে কর্তামশাইয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” কেন এমন করলে আমার সাথে? কেন করলে বলো! কেন করলে? ” তার কন্ঠের নিনাদ বাড়লো।

আমি কেবল অসহায়ের মতো দেখে গেলাম বিয়ে করেও যে মানুষটির হাত ধরার অধিকার পাইনি সে মানুষটিকে আমার চোখের সামনে একটা পরনারী পূর্ণ অধিকার নিয়ে হাত চেপে বসে আছে। আমাকে অবহেলা করার দরুন যাকে অভিযোগ করবার সাহস পাইনি কস্মিনকালেও, তাকে অন্য একটা মেয়ে অবলীলায় অভিযোগ করে যাচ্ছে অনায়াসে। ভালো করে মেয়েটির দিকে তাকালাম। জলপাই রঙের শাড়ি পরিহিত একপাশে বেণুনি করা উজ্জ্বল, লাবন্যময়ী মেয়েটি নিঃসন্দেহে আমার চেয়ে অধিক সুন্দর। তবু মন মানলো না। দোষ কিছু তো আমিও করিনি। তবু…তবু শাস্তি পেতে হলো আমাকে। কার ভুলে সব এলেমেলো হলো তবে? কে দায়ী এ পরিস্থিতির জন্য? কিছু না করেও এত বড় শাস্তি পাবার আক্ষেপে নিজস্ব গোটা পৃথিবীটা দুলে উঠলো।

” আমার সত্যিই দোষ ছিল না৷ আমি চাইনি…”

মস্তিষ্ক ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা ঠেকলো। ইচ্ছে করলো বসে পড়ি সেখানেই। এমন আকন্ঠ অপমানে, দুঃসহ অসহায়ত্ব আর নিঃসীম কষ্টে গলা ধরে এলো। চোখ বুজে এলো না চাইতেই। নিকাব ভিজে গিয়ে গালের সাথে লেপ্টে গেল। মানুষটা কখনো আমাকে চায়নি। অথচ বোকার মতো ভেবে গেলাম নিছক লাজুক বলেই হয়তো… না ভুল ছিলাম আমি! সব ভুল ভুল! মায়াসিক্ত চোখের গভীর দৃষ্টি…অসুস্থতা দেখে কুন্ঠিত হওয়া…সবই ছিল কেবল কর্তব্য পালন। অন্তঃকরণের বীভৎস দহনে পুড়ে ছাঁই হতে লাগলো সমস্ত মন। বুকের ভেতর একটা ভারী পাথর চেপে বসতে লাগলো। তারপর এমনভাবে ঠাঁই করে নিল সমস্ত স্থান যেন আর কখনোই সে স্থানচ্যুত হবে না। চিরস্থায়ী হয়ে সে চেপে বসলো কঠিন, নিষ্ঠুর জন্তুর মতো। আর কিছু শুনতে চাই না। যথেষ্টই হয়েছে। ভেতর ঘরের দুটো মানুষের কথোপকথন শেষ হবার পূর্বেই সম্বিত ফিরে পেয়ে ধীরপায়ে উল্টোদিকে হাঁটতে লাগলাম। নজু আমাকে ঘুরতে দেখেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার শুধু মনে হলো এখান থেকে পালাতে পারলেই আমি বেঁচে যাব। চরম ক্লান্তিতে ভেঙে এলো শরীর। এতটা অসহায়ত্ববোধ আর কখনো জাগেনি মনে। নিজের বিষাদগ্রস্ত মন নিয়ে এতটা বিভোর ছিলাম যে আশেপাশে তাকাবার সুযোগ পাইনি।

আকাশ কাঁদছে। কার কষ্টে কে জানে। তবু মনে হলো আমাকেই সঙ্গ দিতে সে এসেছে। প্রচন্ড বারিপাতের সঙ্গে মিশে গেল আমার কষ্ট জর্জরিত নিনাদ। মেঘের আর্তনাদের নিচে চাপা পড়লো ভীষণ দুঃখী মেয়েটির ভাঙা গলার আর্তনাদ।

বৃষ্টি তুমি সঙ্গে নিও আমার দুঃখগুলো,
উড়িয়ে দিও কষ্টগুলো পেঁজা তুলোর মতো।
তোমায় দেব কুসুম রাঙা পেলব একখান মন
সে মনেতে বাস করে বিষাদ গহীন বন…

চলবে ইন শা আল্লাহ….