ওয়েডিং স্টোরি পর্ব-০৮

0
645

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

সামান্য দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছটায় অনেক ফুল ধরেছে। গাছটাকে এই মুহূর্তে ” নতুন বধূ”র মত লাগছে। টকটকে লাল রং সম্পূর্ণ গাছ জুড়ে। রক্তিম লাল আবার আভার খুব পছন্দের। তাই এই মুহূর্তে এই কৃষ্ণচূড়া গাছটাও আভার পছন্দের খাতায় নাম লেখালো।

— ” আভা, আমরা চলে যাচ্ছি রে। ”

সিনথিয়ার কথা শুনে আভা ওর দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— ” এখন? দাড়া আমি যাবো তোদের সাথে। মা অপেক্ষা করছেন। ”

তারা আভার কাছে এসে দাঁড়ালো। কাচুমাচু কণ্ঠে বললো,
— ” এই, তুই সত্যিই মেয়ে তো? তোরে আমরা জিজুর সাথে একা টাইম স্পেন্ড করতে দিয়েছি। বাসায় যেতে দেয়নি। যা এখন জিজুর কাছে। আমরা যাচ্ছি। ”

আভা তারার দিকে চোখ বটে নিয়ে তাকালো। বললো,
— ” খুব না! আমিও যাবো। একা টাইম স্পেন্ড করার মতো কিছুই হয়নি। চল এখন। ”

আভা বেঞ্চ থেকে ব্যাগ তুলে কাধে নিলো। নাকের নীচে জমে থাকা ঘামটুকু মুছে নিয়ে এক পা এগুতেই পিছন থেকে কেউ তার ব্যাগ খপ করে ধরে নিলো। আভার বুঝতে বাকি নেই কে সে? আভা পিছন ফিরলো। আহনাফ ভ্রু নাচিয়ে বললো,
— ” কই যাচ্ছো? ”

আভা সোজাসাপ্টা বললো,
— ” বাসায়। ”

আহনাফ ব্যাগ একহাত দিয়ে ধরে দুপা এগিয়ে এলো আভার দিকে। আভার কানে মুখ এগিয়ে এনে বললো,
— ” শর্ত ভুলে গেছো? ”

শর্ত! আভা মাথা ঘাটালো। গত এক ঘন্টার স্মৃতি ধাপিয়ে বেড়ালো। কিন্তু কোনো শর্তের কথা মনে পড়লো না। আভা প্রশ্ন ছুড়লো,
— ” শর্ত? ”
— ” আমি যা চাই তাই দিবে বলেছিলে! মনে পড়েছে? ”

আভা দাত দিয়ে জিহ্বা কাটলো। সে তো ভুলেই গিয়েছিলো! কিন্তু আভা এত সহজে আহনাফের কাছে ধরা দিতে চাচ্ছে না। তাই সে নিজেকে তাড়াহুড়ো করে আহনাফের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
— ” মা অপেক্ষা করছেন। অন্য কোনো দিন হবে। আজ না।”

আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,
— ” প্রমিজ ভাঙছো তুমি। পাপ হবে কিন্তু। ”

আভা পড়লো মহাফ্যাসাদে। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না পেয়ে হাফ ছাড়লো। বললো,
— ” ঠিক আছে। বলুন কি চাই? ”

তারা, সিনথিয়া আর রাইমা ইতিমধ্যে রিকশায় চড়ে গেছে। রিকশা যখন আভার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখন সিনথিয়া আভার উদ্দেশ্যে চেচিয়ে বললো,
— ” বেস্ট অফ লাক দোস্ত। ”

আভা সিনথিয়ার কথা শুনে আহনাফের থেকে চোখ সরিয়ে রিকশার দিকে তাকালো। চোখ রাঙালো। ” একবার পাই তোকে। খবর করে দিবো। ” চোখের ভাষা যেনো এই কথাই বলছে। সিনথিয়া আভার সেই চাহনি হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে রিকশা নিয়ে চলে গেলো।
আহনাফ ইতিমধ্যে বাইকে উঠে বসেছে। মাথায় হেলমেট দিয়ে বাইক চালিয়ে আভার পাশে এসে থামালো। বাইক দেখে আভা ভ্রু কুঁচকে বললো,
–” বাইক দিয়ে যাবো? নো ওয়ে। ”

আহনাফ নিজেও ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
–” কেনো? বাইকে উঠা কি পাপ? ”
— ” পাপ না। কিন্তু এভাবে একসাথে… ! ”

হায়রে মেয়ে মানুষ! আহনাফ মাথা নিচু করে শ্বাস টানলো। তারপর আভার দিকে চেয়ে বললো,
— ” আমাদের মাঝখানে তোমার ব্যাগ দিয়ে দিও। তাহলেই হবে। এখন উঠো জলদি। দেরি হচ্ছে। ”

আভা এবার কিছু না বলে বাইকে উঠে বসলো।

______________________
বাইক কোথায় যাচ্ছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আভার। সে চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। বাইকের স্পিডের কারণে খুব বাতাস লাগছে গায়ে। আভা আপাতত এই মুহূর্তটাকে উপভোগ করছে। একসময় আহনাফ বললো,
— ” ধরে বসো। পড়ে যাবে। ”

আভা উত্তর করলো,
— ” লাগবে না। এভাবেই ঠিক আছি। ”

আহনাফ কিছু বললো না। শুধু হাসলো। কয়েক মিনিট পার হতেই আচমকা ব্রেক কষলো সে। সঙ্গেসঙ্গে আভা টাল সামলাতে না পেরে আহনাফের কাধের শার্ট খামচে ধরলো। আহনাফ এতে মুচকি হেসে নিজের কাধের দিকে তাকালো। আভা যখন পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলো তখন আহনাফের কাধ ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— ” আপনি এটা ইচ্ছে করে করেছেন,না? ”

আহনাফ বাঁকা হেসে বললো,
— ” ইউ নো বউফ্রেন্ড, আমি মানুষটা কিন্তু ততটা ভালো নই। নিজের জিনিস কি করে আদায় করতে হয় আমি সেটা খুব ভালো করেই জানি। ”

আভা রাগী চোখে আহনাফের দিকে তাকালো। কত শেয়ানা ছেলে! ওকে জিনিসের সাথে তুলনা করলো! ভাবা যায়! কিন্তু আহনাফের বলা এই দৃঢ় কথাই কিছু একটা ছিলো। কিন্তু কি ছিলো? অধিকারবোধ?

__________________

বাইক এসে থামলো একটা পার্কে। আভা নেমে দাড়ালো বাইক থেকে। আহনাফ হেলমেট খুলে নিজেও আভার পাশে এসে দাঁড়ালো। পার্কে মানুষের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। দূরে কোথা থেকে একটা গান ভেসে আসছে,
“তোমায় হৃদমাঝারে রাখিব
ছেড়ে দেবো না।
তোমায় বক্ষ মাঝে রাখিব
ছেড়ে দেবো না। ”

গানটা শুনে আভার মনটা হঠাৎই ফুরফুরে হয়ে গেলো। আভার পছন্দের গান কেউ গাইছে। মন থেকে, হৃদয় থেকে উপলব্ধি করে গাইছে। হঠাৎ আহনাফ আভার একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। আভা অবাক হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালে আহনাফ গভীর কণ্ঠে বললো,
— ” তোমায় মনের পিঞ্জরে রাখবো… কখনোই ছেড়ে দেবো না। আমার প্রাণ যতদিন থাকবে,কথা দিচ্ছি তোমায় আগলে রাখবো। কখনোই ছেড়ে দিবো না। ”

আভা বিস্ময় নিয়ে আহনাফের দিকে চেয়ে রইলো। আহনাফের বলা কথাটা কি গভীর! কিন্তু কতটা গভীর? সমুদ্রের মতন নাকি কুঞ্জভরা মেঘের মত। আহনাফের কথাটা শুনে আভার শিরা উপশিরা কেপে উঠলো। বলতে ইচ্ছে হলো, ” এভাবে আমায় কেউ কখনো বলেনি। আপনার মত কেউ কখনো আমায় এতটা ভালোবাসেনি। ” কিন্তু বলতে পারলো না। কোথায় একটা সংকোচ থেকে গেলো। আহনাফ নিজেকে সামলে আভার হাত ছেড়ে দিলো। আভা মাথা এদিক সেদিক তাকিয়ে নজর লুকানোর চেষ্টা করলো। আহনাফ সেটা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বললো,
— ” চলো হাঁটি। ”

অতঃপর ওরা হাঁটতে শুরু করলো। পার্কের সাদা রং দিয়ে মার্ক করা জায়গায় এলোমেলোভাবে পা ফেললো দুজন। আভার একহাত আহনাফের হাতের মুঠোয়। আভার প্রথমে অস্বস্থি লাগলেও এখন ভালো লাগছে। অতিরিক্ত ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, “একজীবনে ও যে ভরসার হাত খুঁজছিল এটাই সেই হাত। “তবে নিশ্চিত নয় ও।

— ” আফা হাওয়াই মিঠাই নিবেন? ”

আভার পাশে এসে দাঁড়ালো এক কিশোরী মেয়ে। আভা তার দিকে তাকালো। মুখের মধ্যে হাজারো কালো দাগ তার। চুলের মধ্যে হয়তো অনেকদিনের জট পাকানো। চুলে চিরুনি পড়েনি হয়তো কয়েকমাস। তবুও কি মায়াবী চেহারা। আভা মেয়েটার পাশে হাঁটু ভেঙে বসলো। আলতো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— ” নাম কি? ”

মেয়েটা হেসে উত্তর দিলো,
— ” চন্দ্রা। সবাই চন্দ্র বলে ডাহে। ”

আভা মেয়েটার মাথায় চুলগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে হেসে বললো,
— ” ঠিকই তো বলে। তুমি চন্দ্রের মতোই সুন্দর। ”

মেয়েটা হাসলো। কথাটা যদি মিথ্যেও হয় তবুও যেনো তার আফসোস নেই। আভার নরম গলা শুনে চন্দ্রার অযথাই হাসি পাচ্ছে। সুখ সুখ অনুভুতি হচ্ছে। আভা হাওয়াই মিঠাইর দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” দাম কত এগুলোর? ”
— ” দশ টাহা। ”

আভা বললো,
— ” দুটো দেও তাহলে। আমি তোমায় একশো টাকা দিবো। ”

চন্দ্রা অবাক হলো। বললো,
— ” এত টাহা? ”
— ” হুম। কেনো? নিবে না? ”
— ” কিন্তু এত টাহা? ”
— ” তুমি আমায় দুটো দেও। টাকার ব্যাপার নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমার তোমাকে খুব ভালো লেগেছে। তাই দিচ্ছি। ”

মেয়েটার হাসি এবার প্রসারিত হলো। হাওয়াই মিঠাইর বাঁধন থেকে তিনটা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আভার হাতে দিলো। বললো,
— ” একটা আমার থাইকা বোনাস দিলাম আপনারে। আমারও আপনারে অনেক ভালো লাগছে। ”

আভা হাসলো। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাবে তার আগেই আহনাফ একটা একশো টাকার নোট মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলো। আভা আহনাফের দিকে তাকালে আহনাফ বলে,
— ” তোমার টাকা আর আমরা টাকা ত একই। তাইনা? ”

আভা ভ্রু কুটি করে বললো,
— ” আপনার কাছে নাকি টাকা নেই। তাহলে একশো টাকা কোথা থেকে আসলো? ”

আহনাফ বুকে হাত ভাজ করে ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
— ” ওটা তোমার হাতে ফুচকা খাওয়ার একটা বাহানা ছিলো, দ্যাটস ইট। ”

#চলবে।