কখনো বৃষ্টি নামলে পর্ব-১৫+১৬

0
542

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে
#সুরাইয়া_আয়াত

১৫.

‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি লাবণ্য। পারলে ক্ষমা করো আমায়। আমি জানি আমি খারাপ,,, কিন্তু তবুও আমি তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি কখনো। ‘

লাবণ্য বুঝলো আদর্শ জ্বরের ঘোরে এসব বুলি আওড়াচ্ছে। সে নিজেই জ্বরে কাহিল তার ওপর এই মাঝরাতে ছেলেটা তার ঘরে এসে ওর অবস্থা শোচনীয় করে তুলেছে।

রাত যখন দু টো লাবণ্য তখন জ্বরের ঘোর কাটিয়ে সবে চোখটা মেলে তাকালো, ঘুমটা ভাঙে পাশে কারোর উপস্থিতি অনুভব করে। ভূতে লাবণ্য বিশ্বাস করে না কখনোই তাই তার পাশের ভারী বস্তুটা কি তা দেখার জন্যই লাবণ্য চোখ মেলে তাকাতেই আদর্শর থমথমে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে পেলো। আদর্শকে দেখে লাবণ্যর মনে হওয়া উচিত যে তার মুখ জ্বরের ঘোরে লাল আভা ধারন করেছে কিন্তু সেই সময় লাবণ্যর তেমন কিছু মনে হয়নি কারন সে জানে যে আদর্শ বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়ে বসে। লাবণ্য আদর্শকে দেখে চমকে উঠলো, অবাক আর হতবিহ্বলতায় বাক শূন্য হওয়ার মতো অবস্হা, কিছুটা সময়ের জন্য হলেও লাবণ্যর মনে হলো যে তার শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতো রাতে একটা মেয়ের ঘরে পরপুরুষের উপস্থিতি!

লাবণ্য লক্ষ করলো আদর্শ জুবুথুবু হয়ে তার বিছানার একটা প্রান্ত জুড়ে হাত পা গোটানোর ভঙ্গিতে শুয়ে আছে, তাকে একটা হালকা ধাক্কা দিলেই সে পড়ে যাবে।
লাবণ্য কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বরে ডেকে উঠলো,
‘আআআপনি! আপনি এখানে কি করছেন আদর্শ? ‘

লাবণ্যর কথা কতোটা আদর্শর কানে গেল তা লাবণ্য বলতে পারে না। লাবণ্য ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। আদর্শর সায় শব্দ নেই কোন। লাবণ্য ওর কম্পমান হাতটা বাড়িয়ে আদর্শ কে স্পর্শ করলো। ডেকে দেওয়ার ভঙ্গিমায় জিজ্ঞাসা করলো
‘ শুনছেন? ‘
লাবণ্য বুঝলো আদর্শ জ্বরে কাতর। সাহস করে আদর্শর কপালে হাত রাখতেই চমকে হাতটা সরিয়ে নিল ও। ১০২ ডিগ্ৰি জ্বর হবে সম্ভবত।
লাবণ্য দ্রুত বিছানা থেকে নামলো। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
‘কেন এলেন আপনি?আমার সমস্যা বাড়াতে? একটা মুহুর্তের জন্য যদি একটু শান্তি দিতেন আমাকে। ‘

লাবণ্য ফ্যানের স্পিড বাড়ালো, তার নিজের জ্বরটা কমেছে তাই সে নড়তে পারছে নতুবা সে আর আদর্শ দুজনেই একই রকম ভাবে পড়ে থাকতো।
একটা বাটিতে জল আর এক টুকরো কাপড় এনে বসলো লাবণ্য, আদর্শ আগের ন্যায় তার বিড়বিড়ানি বহাল রেখেছে।
লাবণ্য জল পট্টি দিতে লাগলো তারপর একটা সময় আচমকা আদর্শ বলতে লাগলো,
‘জানো তো লাবণ্য সেদিন উনি আমাকে ওই কথাটা না বললে আমি কখনো তোমাকে বিয়ের আসরে একা ফেলে চলে যেতাম না। ‘

লাবণ্যর হাত দুটো থেমে গেল। আদর্শ কি কিছু বলছে?
লাবণ্য এবার শোনার চেষ্টা করলো আদর্শর কথা।
ভালো করে শুনতে চাইলে শুনতে পেল আদর্শর বলা কথাগুলো। এক এক করে সব সত্যি বলছে আদর্শ যেটা লাবণ্য কখনোই জানতো না।
টানা পনেরো মিনিট ধরে আদর্শ অনর্গল সবটা বলতে লাগলো। লাবণ্য হতভম্ব হয়ে গেল।
লাবণ্যর চোখে রাগ ঘৃনা আর ক্ষোভ মিশ্রিত একটা রুপ ভেসে উঠলো। অবশেষে আদর্শর মুখের দিকে তাকিয়ে লাবণ্যর চোখের কোনা বেয়ে এক টুকরো জল ও গড়িয়ে পড়লো।

লাবণ্য দম ছাড়লো একটা। আদর্শর শরীরে চাদর টেনে সে নিজে আদর্শর পাশে শুয়ে পড়লো। রাত তিনটে বাজে প্রায়। আদর্শর বলা কথা গুলো লাবণ্যর চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। লাবণ্য আদর্শর হাত ধরে কেবল একটাই কথা বলল,
‘ আপনার ডাইজেস্ট সিস্টেম বেশ ভালো বলতে হয়। এতো কষ্ট একা কি করে হজম করেন একটু বলবেন আদর্শ? ‘

লাবণ্যর চোখ দিয়ে জল গড়ালো। আদর্শর হাতটা ছেড়ে দিল ও। উল্টো দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
‘আমাকে ক্ষমা করবেন আদর্শ। আমি আপনাকে আর আপন করে নিতে পারবো না। আমি কারোর বাগদত্তা। ‘

কথাটা বলে লাবণ্য চোখের নোনা জলের সাথে এক অশান্তিপূর্ন নিদ্রার প্রস্তুতি নিলো। আজ আদতেও কি এ চোখ জুড়ে ঘুম আসবে?

/

‘নাহ আপনার মেয়ে রাতবিরেতে পরপুরুষ ঘরে টেনে নিয়ে আসবে তা আমরা কি করে মেনে নিই বলুন? আমরা তো এটা মেনে নেবো না। আজ আপনার মেয়ে এনেছে এটা দেখে অন্য কেও সাহস দেখাবে। এভাবে আমাদের সোসাইটি নষ্ট হবে। তা আমরা কি করে হতে দিই বলুন তো মশাই। ‘

লাবণ্যর বাবার শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। এতোগুলো মানুষের সাথে কথার লড়াইয়ে উনি পেরে উঠছেন না, শুভ একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওর বুকের ভিতর টিমটিম করছে। কারন ভুলটা ওর ই। ও ই মাঝ দরজাটা খুলে রেখেছিল যাতে আদর্শ অনায়াসে বাড়ির ভিতর আসতে পারে, কিন্তু শুভ যদি জানতো যে ওর দিদির একটু ভালোর জন্য এতো অপমান সহ্য করে পড়ে থাকতে হবে তাহলে শুভ কিছুতেই এটা হতে দিতো না। শুভর চোখ ছলছল করছে। বারবার ও লাবণ্যর ঘরের দিকে তাকাচ্ছে, এই বুঝি সবাই দরজা ভেঙে লাবণ্যর ঘরে ঢুকে না পড়ে এই ভয়ে।
কথার মাঝে হঠাৎ একটা মধ্য বয়স্ক লোক বলে উঠলেন,
‘আজ তো এটা না বললে তো জানতেই পারতাম না যে আপনার মেয়ের চরিত্র এমন। ছিহ ছিহ। আপনাদের তো ভালো আর ভদ্র মনে হয় কিন্তু ভিতরে ভিতরে এতো কিছু! ‘

পাশ থেকে একটা মহিলা বলে উঠলেন,
‘ আরে দাদা জানেন না নাকি যে মেয়েটার এর আগে এর বিয়েটা ভেঙে গেছে। তাই বলে এভাবে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে আনবে? ছিহ ছিহ! ‘

মাহিম সাহেব মেয়ের নামের এমন অপবাদ আর সহ্য করতে পারলেন না, জোরে চিৎকার দিয়ে বললেন,
‘ থামুন আপনারা। যা খুশি তাই বলে যাচ্ছেন আপনারা। আমি আমার মেয়েকে ডাকছি আপনারা নিজেরাই দেখুন। ‘

কথাটা বলে উনি শুভর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘শুভ তোর দিদিকে ডাক। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ‘

শুভ এক পা এক পা করে এগোতে লাগলো। শুভর পা যেন আর চলতে চাইছে না। লাবণ্যর ঘরের দিকের দরজা খুলতে যেতে নিলেই লাবণ্য আচমকা দরজা খুলে বার হয়ে এলো।
হঠাৎ লাবণ্য কে বাইরে আসতে দেখে শুভ সহ সবাই চমকে গেল।
লাবণ্য কে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখে একজন ওর দিকে তেড়ে এসে বললেন,
‘ ছি ছি ছি তোমার থেকে এসব আশা করিনি। ‘

লাবণ্য অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘ কেন কি করেছি আঙ্কেল?আর আপনারা সবাই এখানে যে। আজকে কি আমার বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান আছে? বাবা কই আমাকে কিছু বলোনি তো। ‘

লাবণ্যর বাবা একটু অবাক হচ্ছেন বটে তবে তিনি মেয়েকে সমর্থন করে বললেন,
‘ দেখ না ওনারা তোর নামে নোংরা কথা বলছেন। ‘

লাবণ্য ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কেন? কি করেছি আমি? ‘

একটা মহিলা তেড়ে এসে বললেন,
‘ কি করোনি আগে বলো। এই মেয়ে এতো কথা কিসের তোমার? ওর ঘরটা আগে খুঁজে দেখি কে আছে। ‘

কথাটা বলে লাবণ্য কে একপ্রকার সরিয়ে দিয়ে উনি লাবণ্যর ঘরে ঢুকে গেলেন। উনি যেতেই ওনার পিছন পিছন মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে সকলে লাবণ্যর ঘরে ঢুকলেন, কোথায় কোন ছেলে নিয়ে লাবণ্য সারা রাত রাত্রিবিলাস করেছে তা দেখার জন্য। লাবণ্য ওর বাবা আর শুভর দিকে তাকালো, শুভর চোখ মুখ ছলছল করছে পারলে কেঁদেই দেয় তবে লাবণ্য কে খুবই শান্ত দেখাচ্ছে। আর লাবণ্যর বাবা তার মেয়ের দিকে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন কারন তার তার মেয়ের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা আছে। লাবণ্য শুভকে ইশারায় আস্থা দিল।
লাবণ্যর ঘরের ভিতর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে, তারা যেন কাওকে খুঁজে না পেয়ে ফাসট্রেটেড। ওনারা গজগজ করতে করতে বেরিয়ে আসতেই লাবণ্য বলে উঠলো,
‘ আজকে এমন করেছেন আর নেক্সট টাইম সাহস দেখাবেন না। এমন হলে আমি আপনাদের নামে থানায় কমপ্লেইন করবো। আর যে আপনাদের বলেছে তাকে গিয়ে বলবেন যে এভাবে লোকের ওপর নজর না রেখে রাতে ভালো করে ঘুমাতে। বেরিয়ে যান। ‘

কথাটা বলতেই লোকজন গটগট করে বেরিয়ে গেল। ওনারা বেরিয়ে যেতেই লাবণ্যর বাবা লাবণ্য আর শুভকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন আর মনে মনে ভেবে নিলেন যে তিনি কিছুতেই আর এখানে থাকবেন না।
লাবণ্য একটা সস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভোর পাঁচটার দিকে যখন লাবণ্যর ঘুম ভাঙে তখন ও ওর পাশে আদর্শ কে আর দেখেনি, তার জ্বর কমা মাত্রই সে নিজেই চলে গেছে। সে লাবণ্য কে কোনরকম কোন বিপদে ফেলেনি।

লাবণ্য মুচকি হাসলো তার শুভর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। শুভর বুকটা এখনো ধুকধুক করছে যেন সে বিরাট যুদ্ধ জয় করেছে।

#চলবে,,,

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে
#সুরাইয়া_আয়াত

১৬.

সকালের ব্রেকফাস্টের সময় অন্যদিন আটটা হয়, আজকে তা গড়িয়ে এগারোটার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। লাবণ্যর বাবা লাবণ্যর মুখোমুখি বসে আছেন নিস্তব্ধ হয়ে, তার মুখে চিন্তার ছাপ। লাবণ্য উশখুশ করে উঠলো বাবার মুখ দেখে।

‘কি এতো ভাবছো বলো তো তুমি? বলছি তো এসব মানুষদের এভোয়েড করে চলো দেখবে জীবনটা সহজ মনে হবে। ‘

মাহিম সাহেব খাবার মুখে তুললেন না আর। প্লেটটা সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘আমার গলা দিয়ে আর খাবার নামছে না রে মা। তুই তো নিজেই দেখলি কি কি অপবাদ গুলোই দিলো তোর নামে। আমার কানে ওদের বলা প্রত্যেকটা শব্দ গমগম করে তারস্বরে ভেসে আসছে। তুই এতো মনের জোর কোথায় পাস মা, আমি সত্যিই তোকে দেখে অবাক হচ্ছি। তুই কি আমার সেই লাবণ্য যাকে কেও ধমক দিলে সে ভ্যা করে কেঁদে উঠতো। ‘

লাবণ্য এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। বাবার বলা কথায় সে আনন্দ পেয়েছে বেশ। হেসে বলে উঠলো,
‘ তোমার থেকেই তো শেখা। তাছাড়া দূর্বল হতে যাবো কেন? দূর্বল হলেই মানুষ সুযোগ খুজতে থাকে, পেয়ে বসে। জীবনের অনেক ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি আর না বাবা। ‘

কথাটা বলে লাবণ্য খেতে শুরু করলো পুনরায়। ওর বাবা প্লেটটা দূরে সরিয়ে লাবণ্যর দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘চল না মা আমরা এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাই। ‘

লাবণ্য মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল,
‘উহুম। একদম না। আমরা কি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার মতো মানুষ নাকি। একদম না। আর এখানে আমরা নিজেরা নিজেদের হকে থাকি, অন্যদেরকে কেন সুযোগ দেবো। তুমি ভুলেও এসব আর বলবে না আর ভাববেও না। ‘

‘আমার এখানে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই রে মা। রাকিব যেখানে বলছে আমরা বরং সেখানেই চলে যায়। ‘

রাকিবের নাম নিতেই লাবণ্যর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর। গম্ভীর মুখ করে বলল,
‘ একদম না। ‘

লাবণ্যর বাবা আর কিছু বললেন না। নিরবে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন।
দিন দিন লাবণ্যর এই রাকিব নামক মানুষটার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা কাজ করছে। যেখানে তার সাথেই লাবণ্যর আগামী জীবন গড়ে উঠতে চলেছে সেখানে লাবণ্যর এমন আচরন খুবই অস্বাভাবিক হলেও লাবণ্যর তাতে বিন্দুমাত্র আফশোষ নেই।

/

শরীরটা মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠছে লাবণ্যর, তার বাবা তার যত্নে কোন ক্রুটি রাখছে না। লাবণ্য পা মেলিয়ে চোখ বন্ধ করে বিছানার সাথে গা এলিয়ে বসে আছে। শুভ রুমে ঘুমাচ্ছে। দুপুরের হালকা খাবারটা যেন শুভর হজম হয়নি। বারংবার একই কথা বলছে যে রাতে ভারী কিছু খাবার হোক। যার অর্থ দুপুরের এই খাবার তার পছন্দ হয়নি। লাবণ্য অসুস্থ দেখে তার বাবা এমন হালকা খাবার বানিয়েছে। ছেলেটার কান্ড দেখে লাবণ্য গোপনে হেসেছে খুব।
চোখে ঘুম ঘুম ভাব ছেয়ে আসার আগেই লাবণ্যর কল এলো। ফোনটা ধরতেই একটা অচেনা নাম্বার ভেসে উঠলো। এই নাম্বার থেকে এই প্রথম কলটা এলো তাই বুঝতে অসুবিধা হলো কে। লাবণ্য ফোনটা ধরলো,
‘হ্যালো। কে বলছেন? ‘

‘ অফিস থেকে বলছি। মিস লাবণ্য আজকে বিকাল পাঁচটাই সাউথ সিটিতে যে Omega coffe house আছে সেখানে আপনি পাঁচটার আগে পৌছে যাবেন। আমাদের কোম্পানির একটা মিটিং আছে। বড়ো প্রজেক্ট বলতে পারেন। আর আপনি যেহেতু আদর্শ স্যারের পি এ তাই আপনাকে সেখানে প্রেজেন্ট থাকতে হবে। স্যার অসুস্থ তিনি হয়তো যেতে পারবেন না। আপনি তাই টাইমের আগে পৌছে যাবেন। ইটস আরজেন্ট। আর হ্যাঁ এটা অফিসের ল্যান্ডলাইন নাম্বার। ‘

একনাগাড়ে মেয়েটার বলা অনর্গল কথাগুলো শুনে লাবণ্যর ভীষন রকম বলতে ইচ্ছা করলো,
‘রিল্যাক্স একটু জল খান। আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। ‘

কিন্তু সব ইচ্ছা তো পূরন হওয়ার নয় তাই লাবণ্যর ও হলো না। লাবণ্য চুপচাপ শুনে নিলো কথাগুলো আর উত্তর জবাব দিলো।
‘একচু্য়ালি আমি নিজেও একটু অসুস্থ আর কি। বাট ইটস ওকে। আমি সময় মতো পৌছে যাবো। ‘

লাবণ্যর অসুস্থতার কথা কতোটা মেয়েটার মন গলালো কি লাবণ্য বলতে পারে না তবে সে যে কোনরুপ সিমপ্যাথি দেখাবে সেটাও লাবণ্য আশা করেনি।

উত্তর দিল মেয়েটি,
‘বাট আপনাকে আসতেই হবে মিস লাবণ্য। ‘

লাবণ্য সব মোহ মায়া ত্যাগ করে বলল,
‘ ওকে। ‘

মুহূর্তে কলটা কেটে গেল। লাবণ্যর দম ফেলার আগেই এমন আকস্মিক ঘটনা লাবণ্যর মানতে কিছুটা সময় লাগছে।
ফোনটা রেখে বিছানা ছাড়লো। তার বাবা তাকে কোনরুপ ভাবে বেরোতে দেবে না সে জানে তবে সে কিভাবে তার বাবাকে মানাবে সেটা তার একান্ত দায়িত্ব।

/

সময় বহমান, তা কখনো কারোর সুখ দুঃখ কষ্টের জন্য থেমে থাকে না। সময় একবার পার হয়ে গেলে তার কখনো আর পুনরাবৃত্তি হয় না।
ঠিক ঠাক সময়ে পৌছানোর জন্য বাড়ি থেকে অনেকটা আগেই বার হয়েছিল লাবণ্য আর পৌছেও গেছে। কফি শপ টাতে মিটিং ডাকার প্রয়োজনীয়তা লাবণ্য বুঝতে পারলো না যেখানে তাদের অফিসের একটা বড়ো পরিপাট্য মিটিং রুম আছে। লাবণ্য চুপ করে বসে আছে, দিশা নামের মেয়েটা ছাড়া আর বিশেষ কাওকেই ও চেনে না, নেহাত মেয়েটা অফিসেরই। আদর্শ আসবেনা। লাবণ্য তাকে ফোন ও করেনি একটিবারের জন্যও, সে কেমন আছে তা জানতেও চাইনি। আচ্ছা তার প্রতি করা আচরন গুলো কি খুব অন্যায় নয়? লাবণ্য এই কথাগুলো মাঝে মাঝেই ভেবে ওঠে তবে উত্তর পায় না। সবাই নিরব হয়েই রয়েছে হয়তো পারফেক্ট পাঁচটা বাজার অপেক্ষাতে সবাই, তার আগে যেন কেও কোন কথা বলবে না বলে পন করে রেখেছে। লাবণ্য মাথা নীচু করে বসে আছে মাঝে মাঝে এদিক এদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ ওর ভাবনার সীমারেখা অতিক্রম করে আদর্শ এলো তাকে আসা মাত্রই সবাই গুড ইভিনিং বলে উঠতেই লাবণ্য থতমত খেলো। সহজ ইংরেজিতে আনএক্সপেক্টেড যাকে বলে আরকি। লাবণ্য বিড়বিড় করে গুড ইভিনিং জানাতে জানতে সবাই এলরেডি বসে পড়েছে তার নিজের নিজের জায়গায়। আদর্শ এক পলক লাবণ্য কে দেখে চোখ সরিয়ে নিল। আদর্শর চোখের দৃষ্টি নরম তবে মুখে আর মনে কোথাও না কোথাও একটা লুকায়িত গাম্ভীর্য রয়েছে।
মিটিং শুরু হলো, সবাই একে একে অনেক কিছু বলছে তবে তার কোন কিছুই লাবণ্যর ধরা ছোঁয়ার মধ্যে নয়, তাকে এমন অপ্রয়োজনীয় কারনে কেন যে মিটিংটাতে ডাকা হলো লাবণ্য বুঝছে না। কালকে রাতের পর আদর্শর প্রতি ওর আর আগের মতো ঘৃনা আসে না, রাগ হয় না তবুও কেন সে এতোটা উদাসীন।
মিটিং এর দরুন আদর্শ লাবণ্যর দিকে বিন্দু মাত্র দৃষ্টিপাত করেনি, লাবণ্যও চুপচাপ ছিল।
এভাবে ছয়টার দিকে মিটিং এর সমাপ্ত হলো। লাবণ্য আদর্শ চেয়ারে বসে আছে, বাকিরা একে একে প্রস্থান নিয়েছে। লাবণ্য নখ খচখচ করছে অস্বস্তিতে। লাবণ্য যেতে নিলেই আদর্শ বলল,
‘বসুন মিস লাবণ্য। কোথায় যাচ্ছেন? ‘

লাবণ্য আদর্শর কথাতে থতমত খেল। মিস লাবণ্য?
লাবণ্য চুপচাপ বসে রইলো, দুজনেই নিরব। আদর্শর চোখ দুটো লাল আর ছলছল করছে তা লাবণ্যর নজর এড়াইনি। লাবণ্য কি বলবে বুঝতে পারছে না।

হঠাৎ ওয়েটার আসতেই লাবণ্য বলে উঠলো,
‘ওয়েটার! ‘

আদর্শ তাকালো না, সে মাথা নীচু করে নির্বাক হয়ে আছে।
‘দুটো কোল্ড কফি দেবেন প্লিজ। আইস কম করে।’

লাবণ্য অর্ডার দিল।

দুজনের মৌন নিরবতা ভেঙে লাবণ্যর ফোনে কল এলো,
‘ হ্যাঁ রাকিব বলুন। ‘

‘–‘

‘আমি বাইরে আছি। এই মুহূর্তে দেখা করা সম্ভব না। ‘

‘–‘

‘ আপনি বরং কালকে আসুন।’

কলটা কাটলো লাবণ্য। আদর্শ হঠাৎই বলে উঠলো,
‘আপনার বিয়ে কবে মিস লাবণ্য? ছুটি নেবেন তো? ‘

লাবণ্য অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। এটা সে কোন আদর্শ কে দেখছে সে! এটা সেই আদর্শ নয় যে লাবণ্য কে এক মুহুর্তের জন্যও অন্যের সঙ্গে ভাবতে পারতো না। লাবণ্য শিউরে উঠলো, নরম কন্ঠে বলল,
‘খুব শীঘ্রই। ‘

আদর্শ ঠোঁট আটার ভঙ্গিমায় শব্দ করে বলল,
‘উমমম বেশ। বাই দা ওয়ে আপনার শরীর ঠিক আছে? আর আই এম এক্সট্রিমলি সরি আমি জোরজবরদস্তি আপনাকে কালকে বৃষ্টিতে ভেজালাম। আমার উচিত হয়নি। নেক্সট টাইম আর এমন ভুল হবে না। ‘

আদর্শর প্রতিটা কথায় লাবণ্য অবাক হচ্ছে তবে তা মুখ প্রকাশ করছে না।

ওয়েটার কফিটা দিয়ে গেল। লাবণ্য কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘কফিটা খেয়ে নিন।’

আদর্শ কফিটা দূরে সরিয়ে বলল,
‘আমি কফি খাইনা। ‘

লাবণ্য মুখ ফসকে বলল,
‘ কোল্ড কফি তো আপনার ফেভারিট। ‘

লাবণ্যর কথা শুনে আদর্শ হেসে উঠলো।

‘সব অভ্যাস চিরদিনের হয় না। কিছু অভ্যাস হয় চিরকালের যেমন কারোর মোহে আটকে পড়া। আর ভিশন রকম ভাবে কষ্ট পাওয়া এটা ভেবে যে আমার প্রতি তার আর কোন অনুভূতি নেই। আপনি খান আমি অপেক্ষা করছি। ‘

লাবণ্যর গলা দিয়ে এ খাবার আর নামবে না। কফিটা না খেয়েই ও নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। আদর্শ হো হো করে হেসে উঠলো লাবণ্যর যাওয়াতে। কষ্ট পেয়েছে সে লাবণ্যর ব্যাবহারে। যেখানে সে একশো দুই ডিগ্ৰি জ্বর নিয়ে তাকে দেখতে গেছে আর সেখানে লাবণ্য মানবতার খাতিরে হলেও তাকে একবার ও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। আদর্শর বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে বারবার। সত্য কথা গুলো জ্বর এর ঘোরে লাবণ্যকে বলে ফেলেছে সে কিন্তু বাস্তব তার মনে নেই সে আদতে কি কি বলেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

#চলবে,,,,,