কখনো বৃষ্টি নামলে পর্ব-১৭

0
528

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে
#সুরাইয়া_আয়াত

১৭.

সময় তার নিজের মতো করেই এগোচ্ছে শুধু বদলে যাচ্ছে সম্পর্কের রিতিনীতি আর একে অপরের প্রতি গুরুত্ব।
লাবণ্য আর আদর্শর সম্পর্কটা আর আগের মতো খুনসুটিময় নেই, হয়ে গেছে বিষাদময়। এখন আর আগের মতো আদর্শ আর লাবণ্য কে বিরক্ত করে না, অনেকটা ফরমালিটি মেইনটেইন করে কথা বলে। তুমি থেকে আপনিতে এসে দাঁড়িয়েছে এ সম্পর্ক, ভালোবেসে ডাকা লবঙ্গ ফুল নামটাও হয়ে দাঁড়িয়েছে মিস লাবণ্য তে। প্রতে্্যবারই অবাক হয় লাবণ্য আর মানতে পারে না বিষয়টা তবে মুখ ফুটে কিছু বলেও না। মাস শেষে চুপচাপ স্যালারি নেই আর ভাবে কবে তার সম্পূর্ণ টাকা শোধ হবে আর সে আদর্শর এই টানাপোড়েন থেকে রেহায় পাবে তবে মন মানতে চাইনা এখন আর।

বেশ কয়েক দিন হলো আদর্শ অফিসে আসেনি আর কি কারনে আসেনি তা সমন্ধে অবগত নয় লাবণ্য। আদর্শর বাবার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্য, সে দু দিনের ছুটি নিতে চায়। তার বাবার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই ওনাকে ডক্টর দেখাতে নিয়ে যাবেন।

কেবিন থেকে একজন বার হতেই লাবণ্য নক করে রুমে ঢুকলো, উনি মনোযোগ দিয়ে ফাইল ঘাটাঘাটি করছেন।
লাবণ্য প্রবেশ করা মাত্রই উনি আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন,
‘কেমন আছো লাবণ্য? ‘

লাবণ্য মিথ্যা হাসি হাসলো,
‘জ্বি ভালো। আসলে আমি একটু দরকারে এসেছিলাম। ‘

উনি কপালে চিন্তার ছাপ ফেলে বললেন,
‘ স্যালারি ঠিকঠাক পেয়েছো তো নাকি কোন সমস্যা হয়েছে? ‘

লাবণ্য ব্যাতিব্যাস্ত ভাবে বলল,
‘ না না আঙ্কেল, সে সব কিছু না। আসলে আমি দুইদিনের ছুটি চাইছি। বাবা অসুস্থ তাই একটু ডক্টর দেখাতে নিয়ে যাওয়া দরকার। ‘

‘তা তোমার বাবা এখন কেমন আছেন? ওনার সামনে কোন মুখে যাবো সেটাও জানি না। ‘

লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘এভাবে বলবেন না আঙ্কেল। তাছাড়া ভুল হয়ে গেছে এটা আর মনে করে মন খারাপ না করায় ভালো। ‘

‘আচ্ছা বেশ। দরকার লাগলে আর কদিনের ছুটি নিও। ‘
লাবণ্য উঠে দাঁড়ালো। চলে যেতে নিয়ে আদর্শর কথা ভেবে আচমকা বলে উঠলো,
‘আদর্শ স্যার আসছেন না যে আর! উনি কি অসুস্থ? ‘

‘ও আর অফিসে আসবে না। ওর এসব কাজে মন বসে না। আমিও আর জোর করিনি। ‘

‘ওহ আচ্ছা। ‘

লাবণ্য বেরিয়ে এলো। চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে আদর্শর অনুপস্থিতির কথা শুনে।
রাস্তার পাশ দিয়ে ফুটপাত ধরে হাটছে লাবণ্য। মাথায় হাজারো চিন্তাগুলো একসাথে এসে ভর করছে। না পেরে যাত্রী প্রতিক্ষালয়ে গিয়ে বসলো ও। চোখ দুটো বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। তারপর একটা সময় ফোন বার করে আদর্শ কে কল করলো,
‘আপনি এক্ষুনি আসুন, আমি যাত্রী প্রতিক্ষালয়ে অপেক্ষা করছি। ‘

‘–‘

লাবণ্য ধমক দিয়ে বলল,
‘তাড়াতাড়ি আসুন। আর একটাও কথা না। ‘

লাবণ্য ফোনটা কেটে দিল। চোখ বন্ধ করে বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছে। পুরো যাত্রী প্রতিক্ষালয়ে ফাকা। লাবণ্য শুভকে ফোন করলো,
‘হ্যা রে বাবা ঠিক আছে তো? ‘

‘বাবা ঠিক আছে তবে ওষুধ খেতে চাইছে না ঠিকমতো শুধু বলছে ঔষধ না খেলেও নাকি সুস্থ হয়ে যাবে শুধু একবার তোর বিয়েটা হয়ে যাক। ‘

কথাটা শোনামাত্রই বিরক্তিতে লাবণ্য ফোনটা কেটে দিল। বিগত কয়েকদিন ধরে তার বাবা তার আর রাকিবের বিয়ের জন্য উতলা হয়ে পড়েছেন। লাবণ্য বুঝছে না হঠাৎ তার কি হলো। রাকিব দেশে ফিরেছে দু দিন হলো। সে এখন বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেও লাবণ্য যেন কোন ভাবেই বিয়েতে রাজি হতে পারছে না, এভাবে কয়েকদিন সময় পিছিয়েছে ও।

এসব ভাবতে ভাবতে লাবণ্যর সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো, ভিতর থেকে উত্তর এল,
‘গাড়িতে উঠে বসো। ‘

লাবণ্য নিরৃবাক্্যে গাড়িতে উঠে পড়লো, গাড়ি আপন মনে চলছে আর লাবণ্য চুপ হয়ে বসে আছে।

একটা পর্যায়ে আদর্শ হাসতে হাসতে বলল,
‘ আপনি যেভাবে আমাকে ধমক দিলেন আমি তো একদম ভয় পেয়ে গেছিলাম মিস লাবণ্য। ‘

আদর্শর মুখ থেকে আপনি কথাটা শুনে লাবণ্যর মেজাজ বিগড়ে গেল। পুনরায় ধমক দিয়ে বলল,
‘চুপ। কি সেইদিন থেকে আপনি আপনি করছেন হ্যাঁ? আমি কি বলেছি আমাকে আপনি বলে সম্মহোন করতে? ‘

আদর্শ দমে গেল, সে জবাব দিল না। কোথাও না কোথাও লাবণ্যর বলা কথাগুলো তাকে কষ্ট দেয়। আদর্শ গাড়িটা নিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে থামলো।
লাবণ্য কিছু না বলে নেমে গিয়ে একটা গাছের ছায়ায় বসলো।
আদর্শ পিছুপিছু গেল।
‘কোন সমস্যা মিস লাবণ্য? ‘

লাবণ্য এবার আদর্শর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আদর্শ কে একটা ঠাস করে চড় মারলো। আদর্শ গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বোধহয় তার ভুল গুলো বুঝতে পারছে না। লাবণ্য রাগে ফুপিয়ে উঠলো, আদর্শর গাল থেকে হাতটা নামিয়ে দিয়ে বলল,
‘নেক্সট টাইম আপনি বলে ডাকবে না আর আমিও না। তোমার মুখে আপনি ডাকটা মানায় না। ‘
আদর্শ এখনও চুপ। লাবণ্য আচমকা আদর্শ কে জড়িয়ে ধরলো। আদর্শ যেন চমকাচ্ছে লাবণ্যর প্রতিটা ব্যাবহারে। লাবণ্য এবার কেঁদে উঠলো,
‘তুমি কেন আমার থেকে সবটা লুকিয়েছিলে বলো। তুমি তো আমাকে বলতে পারতে যে আমার বাবা তোমাকে বিয়েটা করতে বারন করেছিল বলে তুমি বিয়েটা করোনি বিয়ের আসর ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। ‘

কথাটা বলে লাবণ্য কাঁদতে লাগল। আদর্শ লাবণ্যর মুখ থেকে কথাগুলো শুনে অবাক হলো। তার যতোদূর মনে আছে সজ্ঞানে থাকা অবস্থায় সে লাবণ্য কে কিছু বলেনি। আদর্শ কথা লুকেতে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ একি না না তুমি এসব কি যা তা বলছো তোমার বাবা কেন বারন করতে যাবেন?

লাবণ্য এবার আদর্শর মুখটা হাত দিয়ে চেপে বলল,
‘চুপ একদম চুপ। আর একটাও মিথ্যা কথা বলবে না তুমি। আমি জানি সব। তুমি সেদিন জ্বর এর ঘোরে আমায় সবটা বলেছিলে, আর সেদিনের পর থেকে আমি যখনই তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম তুমি ঠিক ততোটাই দূরে সরে যেতে লাগলে। বলো কেন? ‘

কথাটা বলে লাবণ্য কাঁদতে লাগলো। আদর্শ কি বলবে বুঝতে পারছে না।
‘বিশ্বাস করো লাবণ্য এসব কিছু না। ‘

লাবণ্য রেগে গেল, আদর্শ এমন কেন করছে কিছু বুঝতে পারছে না ও। লাবণ্য আদর্শর হাত ওর মাথায় রেখে বলল,
‘তাহলে আমার মাথায় হাত রেখে বলো যে এ সব মিথ্যা। যদি তুমি বলতে পারো তো আমিও কখনো সত্যি টা তোমার কাছ থেকে জানতে চাইবো না। ‘

আদর্শ হাত সরিয়ে নিয়ে সেখান থেকে দ্রুত সরে গেল।
‘ চলো আমরা ফিরে যায়। ‘

‘নাহ। আজ আমি সব বলবো তারপর বাকি সব। ‘

‘থাক না ওসব কথা। পুরোনো কথা আমি মনে করতে চাই না। ‘

‘আমার বাবা যখন জানতে পারেন যে তোমার কোন বংশপরিচয় নেই তখন তোমাকে বারন করে যে আমার সাথে বিয়ে না করতে কারন আমার বাবা কখনো চাননি যে কোন এতিম ছেলের সাথে তা মেয়ের বিয়ে দিতে। কি তাইতো? ‘

আদর্শ রেগে গিয়ে বলল,
‘আমি এতিম না। আমার বাবা মা আছে আর তাদের নিয়েই আমার পরিবার। তাই এই কথাটা আর কখনো বলবে না তুমি। ‘

লাবণ্য আদর্শ কে পিছন থেকে জড়িয়ে বলল,
‘তুমি এতিম না, তোমার পরিবার আছে আর আমি তোমার পরিবারের একজন হতে চাই। আঙ্কেলের মেয়ে হতে চাই যে তোমাকে নিজের ছেলের থেকে কোন অংশে কম ভাবেননি। আন্টির মেয়ে হতে চাই যে নিজের ছেলে হিসাবে তোমাকে বড়ো করেছে। ‘

আদর্শর চোখে জল চলে এলো। মনে পড়ে যেতে লাগলো পুরোনো স্মৃতি। আদর্শ নিজেও জানে না যে তার আসল পরিবার কে বা কোথায় কারন আদর্শর বাবা মা তাকে কখনো জানায়নি এ বিষয়ে কিছু আর আদর্শ কখনো জানতেও চাইনি তা। তবে বিয়ের দিন যখন কারোর মাধ্যমে লাবণ্যর বাবা যখন জানতে পারেন যে আদর্শ ওনাদের ছেলে নন তখন লাবণ্যর বাবা এই বিয়েতে না করেন আর আদর্শ সেদিন ভীষনরকম কষ্ট পেয়েছিল ওনার এমন কথায়। আদর্শ সেদিন গোপনে কাওকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিল লাবণ্যকে ছেড়ে। কয়েকবছর পর সে নিজেও ভাবেনি যে সে তার লাবণ্যকে ফিরে পাবে। সারাজীবন কষ্টে গুমরে মরার থেকে নিজের ভালোবাসাকে জয় করে সারাজীবন কান্না করতে করতে বেঁচে থাকাও সুখের। আদর্শ নিজেও তাই করেছিল তবে যখন দেখলো যে লাবণ্যর তার প্রতি এখন আর কোন অনুভূতি নেই বরং সে নিজে একটা নতুন জীবন খুঁজতে চাইছে আর আদর্শ তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন আদর্শ সরে এলো লাবণ্যর থেকে।

লাবণ্য কাঁদছে, আদর্শ লাবণ্য কে জড়িয়ে ধরলো।
‘ফিরে যাও লাবণ্য। আঙ্কেল তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

লাবণ্য আদর্শর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আর তুমি? ‘

আদর্শ হাসতে হাসতে বলল,
‘ আমি আর কি। ওই যে তোমার বিয়েতে যাবো বলে অপেক্ষায় আছি। ‘

লাবণ্য আদর্শর বুকে কিল মেরে ওকে জড়িয়ে ধরলো। আদর্শ নিজেও আগলে নিল আদর্শ কে।

#চলবে,,,,,