কখনো বৃষ্টি নামলে পর্ব-১৩+১৪

0
486

#কখনো বৃষ্টি নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

১৩.

বড়ো রাস্তা থেকে কাচা রাস্তায় ব্যাক নিলো গাড়িটা। লাবণ্য গম্ভীর মুখে চোয়াল শক্ত করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকটা অস্বস্তি আর বিরক্ত ও হচ্ছে ভীষন। আদর্শ মাঝে মাঝে গানের সাথে তাল মিলিয়ে শিষ দিচ্ছে আর আড়চোখে দেখছে লাবণ্য কে যা লাবণ্যর ধারণাতীত।

বহুদিন পর শহরের বাইরে এমন একটা গ্ৰাম্য পরিবেশে এসেছে লাবণ্য, ভাবলেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে তার। তার মামার বাড়িও গ্ৰামে, সেখানে খুব একটা যাওয়া হয় না তাদের তাই প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা হয় না খুব একটা। গাড়ির দরজায় চোয়াল ঠেকিয়ে হাতের ওপর হাত রেখে খুব মনোযোগ দিয়ে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করছে লাবণ্য। তার বাবার মুখ থেকেই শোনা যে তার বাবার আর মায়ের নাকি পালিয়ে বিয়ে। কতো লুকিয়ে লুকিয়ে তার বাবা গ্ৰামে দেখা করতে এসেছে হিসাব নেই।
কথাগুলো ভাবতেই লাবণ্যর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
গাড়ি আপন গতিতে চলছে, পাশে বসে থাকা মানুষ টার প্রতি লাবণ্যর ধ্যান জ্ঞান নেই। লাবণ্য এখন প্রকৃতিবিলাসী।

লাবণ্যর ঘোর ভাঙিয়ে গাড়িটা একটা ছোট খাটো ব্রেক এর মাধ্যমে থামলো একটা পুকুর জাতীয় ছোট খাটো লেকের সামনে। লাবণ্য আদর্শর দিকে তাকালো, ড্রাইভিং সিটে আদর্শ নেই। সে গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নিঃশব্দে লাবণ্য গাড়ি থেকে নামলো, আদর্শ তার দিকে তাকালো না। লাবণ্য গাড়ি থেকে নেমে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আদর্শ কে সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন লাগছে যেন সে এ জীবনের সমস্ত মোহ মায়া ত্যাগ করেছে। বিরক্ত লাগছে না লাবণ্যর বরং আদর্শর উপস্থিতিটা বেশ পরিপূর্ণতা দিচ্ছে তাকে।

এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়, এতোটা সময় পার হওয়ার পর ও লাবণ্য বুঝলো না যে এখানে কাজের কাজ কি হতে পারে। দুজনেই নির্বিকার।

হঠাৎ লাবণ্যকে চমকে দিয়ে আদর্শ বলল,
‘এহেম এহেম।’

লাবণ্য আদর্শর দিকে তাকালো, কিছু বললো না। তার নিরবতাকে লক্ষ করে আদর্শ বলল,
‘পছন্দ হয়েছে জায়গাটা? ‘

লাবণ্য কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলো বোধহয় এমন কথা শোনার জন্য। সে এমন ভাবে কথাটা লাবণ্য কে বলল যেন সে জায়গাটা তাকে উপহার দিতে চলেছে।

লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত একটা শ্বাস ফেলল।
‘জ্বি। ‘

আদর্শ লাবণ্যর কাছে গিয়ে আচমকাই তার হাতটা ধরে তাকে একপ্রকার টেনে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো,
‘ সবাই বলে বেশি সুন্দর জিনিস নাকি দূর থেকেই সুন্দর লাগে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। সুন্দর সুন্দরই হয়। ‘

লাবণ্যর চোখের দিকে তাকিয়ে আদর্শ এই সরলউক্তি করতেই লাবণ্য দৃষ্টি নামিয়ে নিল। লজ্জা পাচ্ছে সে। এটাই স্বাভাবিক নয় কি? কোন পুরুষের থেকে এমন একটা সান্দর্যিক উক্তি পেলে যে কোন নারীই লজ্জা পাবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

লাবণ্য ঘটনার রেশ কাটাতে হাতটা ছাড়ানোর একটা ছোট্ট প্রচেষ্টা চালিয়ে বলল,
‘হাতটা ছাড়ুন। আর এটা আপনি কোথায় এনেছেন মিটিং এর নাম করে? কোথায় আপনার ক্লায়েন্ট? ‘

আদর্শ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘মিটিং করতে কি সবসময় ক্লায়েন্ট দরকার? আমরা নিজেদের মধ্যে একটা ছোটখাটো মিটিং করতে পারি না বুঝি? ‘

লাবণ্য ঝাড়ি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে উল্টোপথে হাটার উদ্যোগ নিয়ে বলল,
‘ নাহ হতে পারে না। আমি বাড়ি যাবো। ‘

আদর্শ বেশ জোরেই ধমক দিল।
‘এক পা এগোলেই পা দুটো কে*টে এই পুকুরে ফেলে দেব। একদম দুপ। দাঁড়াও ওখানেই। ‘

হঠাৎ এমন ধমক শুনে লাবণ্য থমকে গেল। আদর্শ ওর হাতটা ধরে পুনরায় টেনে হাটতে লাগলো, লাবণ্য নির্বাক হয়েছে এক ধমকেই। আদর্শ বিড়বিড় করে বলল,
‘মাথামোটা। অল টাইম কিছু না কিছু ত্যাড়ামো করা লাগবেই। ‘

হাত ধরে টেনে লাবণ্যকে ঝিলের ধারে নিয়ে এলো আদর্শ। দূর দূরান্তে নৌকা দেখা যাচ্ছে। অল্পস্বল্প ঢেউ ও হচ্ছে। জলের এমন মাতাল আন্দোলনে লাবণ্যর মনটা আনচান করে উঠলো।

আদর্শ লাবণ্যর হাতটা ছেড়ে বলল,
‘বসো এখানে। ‘

লাবণ্য অদ্ভুত চাহনিতে আদর্শর দিকে তাকাতেই সে বলল,
‘ এখন এভাবে না তাকিয়ে বসো। আমার মুখ দেখার জন্যই এতোদূর এনেছি চিন্তা নেই। ‘

আদর্শ বসলো সঙ্গে লাবণ্যকেও হাত ধরে বসালো। লাবণ্য মুখ গোমরা করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
লাবণ্যর ভাবনাকে দূরে ছূড়ে দিয়ে আদর্শ বলল,
‘আমার মন খারাপ লাবণ্য। খুব মন খারাপ। যতোটা মন খারাপ হলে আকাশের বুক চিঁড়ে বৃষ্টি নামে, মেঘেরা ফুঁপিয়ে গর্জন করে ওঠে। ঠিক ততোটাই। ‘

আদর্শর কথাতে লাবণ্য রিয়েক্ট করলো না, তবে তার বুকের মাঝে কোথাও না কোথাও একটা হাহাকারের বন্যা হয়ে গেল ঠিকই।

লাবণ্য নিরব। আদর্শ পুনরায় বলল,
‘শুনেছি মানুষ প্রেমে ট্রেমে পড়লে তাদের এমন হুঠহাঠ করে মনে খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু আমি তো তোমার প্রেমে পড়েছি অনেক আগেই। তাহলে আমার এই মন খারাপের কারন বলতে পারো? ‘

লাবণ্য সামনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আদর্শর সামনে নিজেকে তার প্রতি দূর্বল প্রমান করা বোকামো ছাড়া আর কিছুই নয়।

একটা পর্যায়ে আদর্শর কন্ঠস্বর থমকে গেল। হয়তো তার চোখ থেকে নোনা জল ও গড়াচ্ছে নিরবে।

‘আমাকে ক্ষমা করো লাবণ্য। আমি জানি ভুলটা আমারই ছিল। তার কারন আমি তোমাকে জানাবো কখনো না কখনো কিন্তু এটা জেনে রেখো যে আমি ভালোবাসি, আগে যেমনটা বাসতাম ঠিক তেমনটাই হয়তো তার তুলনায় খানিকটা বেশি। ‘

লাবণ্য আদর্শর দিকে তাকালো, তার ভাবনা সত্য। আদর্শর চোখ থেকে অশ্রুবিন্দু গড়াচ্ছে নিরবে। লাবণ্যর বুকের মাঝে একটা লুকায়িত চাপা কান্না গুলো অশ্রু ঝরতে লাগলো। মনে আর মস্তিষ্কে একটা প্রশ্নই ঘোরে,
‘কেন? ‘

লাবণ্য তাকিয়ে রইলো আদর্শর দিকে নিষ্পলক ভাবে। আদর্শ তার দিকে তাকাচ্ছে না। হঠাৎ ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে লাবণ্যর ফোনে ফোন এলো। কেঁপে উঠলো লাবণ্য, আদর্শ ও হয়তো ভাবনার ঘোর থেকে কাটিয়ে উঠলো।

লাবণ্য আদর্শর দিকে তাকিয়ে ফোনের দিকে তাকালো, রাকিবের ফোন। লাবণ্য ফোনটা নিয়ে উঠে গেল।

দূরে চাপা কন্ঠস্বরে বলল,
‘আপনি এই অসময়ে কল দিলেন যে? ‘

লাবণ্যর শান্ত শীতল কন্ঠস্বরের বিপরীতে রাকিব ঝাঁঝালো কন্ঠে জবাব দিল,
‘তোমাকে না বললাম জলদি বাড়ি খালি করতে। করোনি কেন? নাকি বিশ্বাস করো না আমাকে কোনটা? ‘

হঠাৎ এমন কিছুর জন্য লাবণ্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না, রাগে খানিকটা গুমরে উঠলো সে।
‘এভাবে কথা বলছেন কেন আপনি? তাছাড়া এগুলো কি খুব তাড়াহুড়োর বিষয়? আর আপনি নিজেই হুঠহাঠ এমন সিদ্ধান্ত নিলেন আর এখন আমাকে এভাবে কথা শোনাচ্ছেন যে। ‘

হঠাৎ যেন লাবণ্য থ হয়ে গেল রাকিবের কন্ঠস্বর শুনে। সে এবার একেবারেই শান্ত।
‘আই এম সরি, সরি। আসলে আমি এভাবে বলতে চাইনি। বুঝতে পারছো তো আমি কতোটা চিন্তত। আসলে আমি বাইরে যাওয়ার আগে সবটা সেটেল করতে চাইছি। ‘

লাবণ্যর মেজাজটা বিগড়ে গেল। সে এসব শোনার পরিস্থিতিতে আর নেই।
‘ইটস ওকে। আমি এখন অফিসের বাইরে। মিটিং এ আছি। রাখছি। ‘

কথাটা বলে কলটা কেটে দিল লাবণ্য। ফোনের স্ক্রিন টার দিকে তাকাতেই বুঝলো আবহাওয়ার অবস্থা করুন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো আকাশটা কেমন ঘোলাটে আবছা।
বৃষ্টি নামার আগে পরিবেশটা এতোটা শান্ত হয়ে যায় লাবণ্য বোঝেনি।

দূরে দাঁড়িয়ে দেখলো আদর্শ আগের মতোই বসে আছে। লাবণ্য দ্রুত পায়ে সেদিকে গিয়ে বলল,
‘এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে। চলুন। ‘

কথাটা আদর্শ কানে নিলো কি নিলো না লাবণ্যর জানা নেই। সে গাড়িতে গিয়ে বসলো। এক মিনিট বসার পরই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। আদর্শ নড়ছে না, এক বিন্দুও নড়ছে না। বৃষ্টির ছাটের জন্য লাবণ্য জানালা বন্ধ করে দিলো তার আগে আদর্শ কে জোর গলায় ডেকে উঠলো,
‘আদর্শ ভিজছেন কেন? দ্রুত গাড়িতে আসুন। ‘

আদর্শ ভাবলেশহীন। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে, আকাশে গুড়গুড় ও করছে। লাবণ্য মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। জানালার ওপাশ থেকে আদর্শকে আর দেখা যাচ্ছে না। উপায়ন্তর না হয়ে লাবণ্য গাড়ি থেকে নেমে আদর্শর দিকে ছুটে গেল। আদর্শ হাত ধরে তোলার চেষ্টা করে বলল,
‘ আদর্শ উঠুন। বৃষ্টি পড়ছে ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘

হঠাৎ লাবণ্য কে চমকে দিয়ে আদর্শ এক গগনবিদারী হাসি হেসে বলল,
‘কি মিস লাবণ্য হেরে গেলেন তো। ‘

লাবণ্য হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো। আদর্শ কে বেশ খুশি দেখাচ্ছে। লাবণ্য কারন বুঝতে পারছে না কোনরকম।
আদর্শ উঠে লাবণ্যর কপালে টোকা দিয়ে বলল,
‘খুব তো বলেছিলে আমার সাথে আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজবে না। দেখ তুমি আমার এতো কাছে আর আমরা বৃষ্টিতে ভিজছি। কি রোমান্টিক না? ‘

রাগে লাবণ্যর শরীর রি রি করে উঠলো। কিছু বলল না, চলে যেতে নিলেই আদর্শ হাতটা ধরে বলল,
‘একবার পেয়েছি যখন আর ছাড়ছি না। ‘

কথাটা বলে লাবণ্যর হাত ধরে ঝিলের কাছে গিয়ে নৌকা ডাকলো আদর্শ। লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল
,
লবঙ্গ ফুল আজ তোমার সাথে আমি বৃষ্টিবিলাস করবো। ‘

কথাটা শুনে লাবণ্য আদর্শকে ধাক্কা মেরে কাঁদায় ফেলে দিল। তা দেখে নৌকার ছইয়ের মধ্যে বসো থাকা একটা ছোট্ট বাচ্চা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

লাবণ্য চলে যেতে নিলেই আদর্শ লাবণ্যর হাত ধরে কাঁদায় ফেলে লাবণ্যর গালে একটু কাদা লাগিয়ে বলল,
‘তুমি+ আমি+বৃষ্টি+ কাঁদা+ ধপাস করে কাদায় ফেলে দেওয়া+ বাচ্চাটার খিলখিলিয়ে হাসি= পারফেক্ট ডেট। ‘

লাবণ্য ছটফট করে ওঠার চেষ্টা করলো।

‘যতই ছটফট করো আজ পালাতে পারবে না লবঙ্গ ফুল। ‘

কথাটা বলে নৌকার দিকে গেল দুজনই।

#চলবে,,,,

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে
#সুরাইয়া_আয়াত

১৪.

‘কি রে মা আজ অফিসে গেলি না যে। শরীর খারাপ নাকি?’

লাবণ্যর বাবা প্রশ্ন করে উঠতেই চোখ পিটপিট করে তাকালো লাবণ্য। সত্যিই তার জ্বর। লাবণ্য গায়ে থাকা চাদরটা আর একটু শরীরের সাথে লেপ্টে নিয়ে বলল,
‘কই না তো। আমি তো ঠিক আছি। ‘

লাবণ্যর কন্ঠস্বর কাঁপছে। সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে সে অসুস্থ। লাবণ্য র বাবা লাবণ্যর কাছে গিয়ে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলেন। সত্যিই সে অসুস্থ। উনি চটজলদি লাবণ্য কে কিছু একটা বলে ডক্টর ডাকতে বেরিয়ে গেলেন। লাবণ্য অনেক কিন্তু কিন্তু করলেন তবুও উনি তার কথা শোনেননি। শুভ বাড়িতে থাকার দরুন উনি বেশ নিশ্চিন্তে ডক্টর ডাকতে গেছেন। লাবণ্যর চোখ দুটোতে অসম্ভব ব্যাথা করছে, তার চোখ খুলে তাকানোর জো নেই। শুভ লাবণ্যর ঘরে এসে লাবণ্যর ফোনটা নিল তারপর লাবণ্য কে কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল।
শুভ লাবণ্যর ফোন থেকে আদর্শ কে একটা কল করলো। আদর্শ নিজেও জ্বরের ঘোরে ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,
‘হ্যা বলো। ‘

শুভ ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল,
‘আদর্শ দা আমি শুভ বলছি। দিদি না খুব অসুস্থ কালকে থেকে। অফিস থেকে তো ফিরতে লেট করেছিল আর ভিজে গিয়ে জ্বর চলে এসেছে। তুমি কি একবার দিদিকে দেখতে আসতে পারবে? দিদি অসুস্থ অনেক। চোখ খুলে তাকাতে অবধি পারছে না। ‘

আদর্শ শরীরের সমস্ত বল দিয়ে উঠে বসে বলল,
‘তোমার বাবা বাড়িতে আছেন নাকি? ‘

‘নাহ বাবা এখন বাড়িতে নেই, ডক্টর ডাকতে গেছেন। খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে। তুমি এখন এসো না নাহলে ধরা খেয়ে যাবে। কখন আসতে হবে আমি জিনিয়ে দেবো তোমাকে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। ‘

শুভ ফোনটা কেটে দিয়ে নি শব্দে ফোনটা লাবণ্যর পাশে রেখে দিয়ে চলে যেতে নিলেই লাবণ্য পিছু ডাকলো,
‘শুভ? ‘

হঠাৎ এভাবে ডাকায় শুভ চমকে গেল।
‘হ্যাঁ দিদি? কিছু বলবে? ‘

লাবণ্য বহু কষ্টে বলল,
‘ তুই ওনাকে ফোন করেছিলিস তাইনা? ‘

শুভ না বোঝার ভান করে বলল,
‘ কা কাকে? ‘

লাবণ্য যথাসম্ভব ধমক দিয়ে বলল,
‘কাকে মানে আদর্শ কে। কেন কল করিস ওনাকে তুই। আমি তোকে বারন করেছি না যে ওনার সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখবি না। ‘

শুভ চোখ কান বুজে নিল যেন। লাবণ্যর কথার যথাসম্ভব উত্তর না দিতে পারায় ‘সরি’বলে চলে এলো।

লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। জ্বরের ঘোরে এতোটা দূর্বল ওর কখনো লাগেনি। লাবণ্যর চোখ বেয়ে জল গড়ালো। শরীর টা আর পেরে উঠছে না একেবারেই।

/

সারা দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা পার করে রাত গড়ালো আদর্শ আসেনি তাতে শুভ বেশ অবাক হলো। লাবণ্যর আদর্শর কথাটা মাথায় নেই। কালকে আদর্শকে অনেকবার বারন করেছিল সে যেন বৃষ্টিতে না ভেজে কিন্তু আদর্শ তার কথা কানেতে নেইনি, সে নিজেও ভিজেছে সঙ্গে লাবণ্যকেও তার বৃষ্টিবিলাসের সঙ্গী বানিয়েছে যা লাবণ্য কখনো চাইনি। ওষুধ খেয়ে জ্বর আর গলা ব্যাথা খানিকটা কমেছে লাবণ্যর। জানালাটা খোলা ছিল তাই বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। রাত ৯টা বাজে প্রায়। লাবণ্যর বাবা খাবারের প্লেট সহ রুমে ঢুকলেন। লাবণ্যর তাতেও কোনরুপ পরিবর্তন হলো না।
‘লাবণ্য তোর ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে খাবারটা এবার খেয়ে নে। ‘

লাবণ্য ওর বাবার দিকে ঘুরে তাকালো, তাকে বিষন্ন লাগছে, লাবণ্যর অসুস্থতা তাকে অনেক বেশি চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। লাবণ্য উঠে বসলো,
‘তুমি এলে কেন আমাকেই ডাকতে না হয়। ‘

উনি খাবারটা ঢালতে ঢালতে বললেন,
‘চুপ কর তুই। কি দরকার ছিল এতোটা ভেজার। জানিসই তো তোর ঠান্ডার ধাত আছে। তাও কি দরকার ছিল ভিজে ভিজে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার। ‘

লাবণ্য মুখ নীচু করলো। সে মিথ্যা বলেছে বাড়িতে যে সে অফিস থেকে ফেরার পথে ভিজে গেছে কিন্তু আদর্শ তাকে বাড়ি অবধি পৌছে দিয়েছে তা তিনি জানেন না বরং বাড়ি ফেরার পূর্বে সে যে আদর্শর সাথে টানা দুই ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজেছে তা সে কি করে বোঝাবে। লাবণ্য নিরুপায় হয়ে চুপ করে রইলো। ওর নিরবতা কাটাতে উনি বললেন,
‘শোন কাল তুই অফিসে যাবি না। তোর শরীর খারাপ, তোর বসকে বলে দিস। আর যদি না শোনে তোর কথা তো আমাকে কল ধরিয়ে দিবি আমি তার সাথে কথা বলবো। ‘

ওনার কথাটা শোনা মাত্রই লাবণ্য শিউরে উঠলো। ওর বাবা এখনও পর্যন্ত জানেন না যে আদর্শ পুনরায় তার জীবনে ফিরে এসেছেন। আর লাবণ্য তা কখনো জানাতেও চাইনা। লাবণ্য মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। লাবণ্যকে তার বাবা খাইয়ে দিতে লাগলো।লাবণ্যর সেই ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যেতে লাগলো, লাবণ্য আর লাবণ্যর ভাই যখন খুব ছোট তখন অল্প বয়সেই মারা যান লাবণ্যর মা। লাবণ্যর বাবা ওনার মৃত্যু টা মেনে নিতে পারেননি। প্রায় একবছর এর বেশি সময় তিনি মানসিক রোগির মতো জীবন যাপন করেছেন। তাদের প্রেম করে বিয়ে ছিল। প্রেয়শীকে এতো তাড়াতাড়ি বিদায় জানতে হবে তা ওনার কল্পনাতীত। লাবণ্য ওর বাবার দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলো। ওর বাবাই ওর সব, উনি কখনো তার ছেলেমেয়ের কথার অমান্য করেননি, শুভ আর লাবণ্যর ভাবনা চিন্তার ওর তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন।

‘বাবা একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? ‘

উনি মুচকি হেসে বলল,
‘ হ্যাঁ বল না।’

লাবণ্যর ওর মায়ের কথা মনে পড়ে গেল, লাবণ্যর চোখ জোড়া ছলছল করছে। মনের মাঝে থাকা সমস্ত ব্যাথা বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। লাবণ্য আচমকাই ওর বাবাকে আলতো করে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা। ‘

কথাটা বলে লাবণ্য ঢুকরে কেঁদে উঠলো। আচমকা এমন কিছু হওয়াতে লাবণ্যর বাবা চমকে গেলেন। মেয়ের কান্নাতে তার পাঞ্জাবি ভিজছে, ওনার বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠলো। মেয়েকে আগলে নিলেন, লাবণ্য আগে কখনো এমনটা করেনি। উনি লাবণ্যর কপালে ভালোবাসার পরশ একে বললেন,
‘কি হয়েছে মা, কোন কারণে বা কোন কিছুতে কষ্ট পেয়েছিস? নাকি কেও কিছু বলেছে আমাকে বল। ‘

লাবণ্যর ওনার পাঞ্জাবি টা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘কেও কিছু বলেনি বাবা। আর যাই হয়ে যাক তুমি কখনো আমাকে ভুল বুঝোনা প্লিজ। ‘

উনি লাবণ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে লাগলেন। মেয়ের হঠাৎ এমন ব্যাবহার ওনাকে ভাবাচ্ছে।

লাবণ্যকে খাইয়ে দিয়ে তার বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। লাবণ্য গায়ে চাঁদর টেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে মাঝেমাঝে। লাবণ্য পুরোনো সব কথা ভাবছে আর কল্পনা করছে যে আজ তার সেই পুরোনো আদর্শ তার জীবনে থাকলে তার জীবনটা কতোটা পরিবর্তন হতো।
কিছুখন ভাবার পর যেন আর ভাবতে ইচ্ছা করলো না ওর, লাবণ্য চাঁদর মুড়ি দিয়ে দিল। ফোনটা যে কতো ঘন্টা ছুঁয়ে দেখেনি তার হিসাব নেই। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রাত এগারোটা, লাবণ্যর জ্বরটা অনেকটা কম তাই সমস্ত কিছু সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবতে পারছে। আদর্শ তাকে কল করেনি একটিবার ও সে কথা ও তার মাথাতে এলো।
লাবণ্য জানে খুব সামান্য ভিজলেই আদর্শর জ্বর চলে আসে। তাহলে সেও কী লাবণ্যর মতো জ্বরের ঘোরে? লাবণ্যর আদর্শর জন্য খানিকটা হলেও মন খারাপ হয়ে গেল।
এভাবেই কিছুখন পর ঘুমে চোখ জোড়া বুজে এলো।

#চলবে,,,,