কতোবার বোঝাবো বল পর্ব-৪১

0
2076

#কতোবার_বোঝাবো_বল 🌿
#ইফা_আমহ্নদ
পর্ব::৪১(ফিরে আসা)

৫ বছর ধরে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকার পর আজ আমার জ্ঞান ফিরেছে।। কিন্তু দুঃভাগ্যবসত আমি সব ভুলে গেছি।। ভুলে গেছি নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে,,, আমার বিয়ে,,বেবীদের কথা।। অরিনেশনের রাতে জ্ঞান হারানোর পরের কথা কিছু মনে নেই আমার।।
জ্ঞান ফিরতে সবচেয়ে বড় অবাক হয়েছি ,, আমার পাশে কাউকে খুঁজে না পেয়ে।। আমার জ্ঞান ফিরতেই সবার কথা খুব মনে পড়লো ,,, উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করছি ,, কিন্তু আমি বারবার ব্যর্থ হচ্ছি।। তবুও কষ্টকরে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে এ বেরিয়ে গেলাম।।
৩ ঘন্টা পর বাড়িতে পৌঁছালাম।। একদিকে আমার দিকে আমার কাছে টাকা নেই অন্যদিকে হাঁটতে পারছি না।। একটু হাঁটছি জিরিয়ে নিচ্ছে।। অনেকবার পড়েও গেছি।।
প্রায় ১০ মিনিট দরজা নক করার পর ভাইয়া এসে দরজা খুলে দিয়ে ভূত দেখার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে।। দরজা থেকে সরছে না আবার ভেতরেও যেতে দিচ্ছে না।।

— ভভভাই সসরবি দদরজা থথেকে!! ( অনেকদিন কথা না বলাতে গলার স্বর আটকে আটকে যাচ্ছে।।)

তবুও খাম্বার মতো লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।। আমি কোনো উপায় না পেয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে হনহন করে ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে পড়লাম।। এতোক্ষণে পাপা ,, মাম্মাম,, ঋতু আর তুয়ানও এসে দাঁড়িয়েছে।। ইচ্ছে করছে বেশি করে ঝগড়া করতে ।। কিন্তু এখন শেষ মুডটা নেই ।।

— একগ্লাস পানি আর একটু খাবার হবে ।। পেটের ভেতরে ইঁদুর গুলো স্পীডে গাড়ি ড্রাইভ করছে।। মনে মনে কতো বছর যেন কিছুই খাই নি ।। অথচ কালকেই যাওয়ার আগে মাম্মাম আমাকে ধরিয়ে কতো গুলো খাইয়ে দিলো।। ( কেউ আমার কথায় কোনো রিয়েক্সেশন দিচ্ছে না তা দেখে আবার আমি) দেবে না তো খেতে লাগবে না দেওয়া ,,আমি নিজেই নিয়ে খেয়ে নিচ্ছি।।

উঠতে গেলেই ঋতু আমাকে ধরে বসিয়ে দিয়ে নিজে খাবার আনতে চলে গেল।। কিন্তু ঋতু এখানে কি করছে কিছুই বুঝতে পারছি না।। খাবার নিয়ে আসতেই পাল্টা প্রশ্ন করলাম।।

— ঋতু তুই এখানে কি করছিস।। এতো বউয়ের মতো সেজেছিস কেন ।। আর এই ছোট বাচ্চাটা কে ??

— বাচ্চাটা কে মানে তুই ভুলে গেছিস।। কতো কষ্ট করে পাপা মাম্মামকে আমাদের বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছিস।। আর হে ,, তুই কোমায় থাকার সময় আবির জোর করে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো।।( খাবারের প্লেট টা হাতে নিয়ে হিয়ান)

— কিসব আজে বাজে বকছিস ।। আমি আবার তা কবে করলাম !!!( একটু ভেবে আবার আমি) না মনে করতে পারছি না,,, মাথায় প্রচুর ব্যাথা করছে।।।

— তোকে কিছু মনে করতে হবে না মা ।। হিয়ান তোকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে ,,তুই খেয়ে নে ।। তারপর একটু শাওয়াল নিয়ে নে ভালো লাগবে।।।( আমার পাশে বসে,,, মাথায় হাত বুলিয়ে তানজিম,,রাইসা)

আমিও লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে শাওয়াল নিতে রুমে চলে এলাম।।।।

🍁

আবির পাগলের মত ড্রাইভ করে হসপিটালে চলে এসে দৌড়ে হানির কেবিনের কাছে গিয়ে দেখে সবাই একসাথে চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে করিডোরে বসে আছে।। আবিরকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে যায় সবাই ।। আবির গিয়ে সোজা ডাক্তারের কলার চেপে ধরলো।।

— মিষ্টি কোথায় চলে গেছে মানে টা কি ।। আমার ওয়াইফ কে আমি তাহলে কার ভরসায় এখানে রেখে গেলাম বলতে পারবেন।। আমার ওয়াইফ কে যদি আমি খুঁজে না পাই ,,তাহলে আমি এই হসপিটালের কি অবস্থা করি আপনি দেখে নিয়েন।। ( আবির)

— কি করছিস টা কি !! হানি নিজের ইচ্ছেতে চলে গেছে।।(নিবিড়)

— পাপা আমার মাম্মা কোথায়।। প্লিজ পাপা আমার মাম্মাকে এনে দাও ।। (কাঁদতে কাঁদতে আদ্র আদ্রিতা)

আবির তার ছেলে মেয়েদের চোখে আজ পর্যন্ত পানি আসতে দেয়নি।। আর আজ তারা কাঁদছে ।। আবির ডাক্তারের কলার ছেড়ে দিয়ে আদ্র আদ্রিতার কাছে গিয়ে ,, ওদের জরিয়ে ধরে বললো….

— মাম্মা কোথাও যায় ।। এইতো এখুনি চলে আসবে।।( সবাইকে উদ্দেশ্য করে আবির) ওদের এখানে কে নিয়ে এসেছে,,,আমি জানতে চাই কে ওদের এখানে নিয়ে এসেছে।। ( চিৎকার করে আবির)

— আসলে আমি ভেবেছিলাম ,, ওরা ওদের মাকে দেখতে খুশি হবে তাই…..!!! ( নিলিমা)

— তাই নিয়ে এসেছো।। এসেছো তো ভালো করেছো,, এবার ওরা কাঁদছে কেন সামলাও ।।

আর কিছু বলার আগেই আবিরের ফোনে একটা ফোন আসে ।। আবির আদ্র আদ্রিতাকে কোলে নিয়ে একসাথে বেরিয়ে যায়।। ফোনটা ছিলো হানির পাপা তানজিমের।। তাই সে সেখানেই গেছে হানিকে ফিরিয়ে আনতে।।।

শাওয়াল নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছি আমি আর তুয়ান ।। তুয়ানের সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গেছে।। আর আমাদের ঘিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিয়ান,, ঋতু ,, পাপা মাম্মাম।। তারা কি সব আজে বাজে কথা বলছে আমার মাথায় ঢুকছে না,,আমি নাকি কোয়ায় ছিলাম।। তার চেয়ে বড় কথা আমার বিয়ে হয়েছে আর আমি দুটো বাচ্চার মা।। তাদের এই ফালতু বকবক শোনার চেয়ে টিভি দেখা ভালো ।। তাই টিভি দেখছি ।।

ঠাস করে কোনো শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখি আবির।। হে আবিরকে আমি চিনি ।। আমাদের ভার্সিটির সিনিয়র ভাই।। আমাকে আর জানভিকে কতো বাজে কথা বলেছে ।। কিন্তু সে আমাদের বাড়িতে কি করছে ।। আমার ভাবনার মাঝে আবির এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ,,,আমাকে আস্টে পিস্টে জরিয়ে ধরলো।। এমনিতেই আমার গায়ে একদম শক্তি নেই।।।তার উপর এমন ভাবে ধরে আছে ।। আমার জান যায় যায় অবস্থা ।। হাতের বাঁধন একটু হালকা হতেই ধাক্কা দিয়ে সর আমি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।।

— আরে আজব তো এমন করছেন কেন।। ২ দিনের পরিচয়ে এভাবে জরিয়ে ধরেছেন কেন।। আপনার অনেক নেকামো আমি মরা সহ্য করেছি আর করতে পারছি না।। প্লিজ এখন থেকে চলে যান!!!( কড়া কড়া গলায় বললাম আমি)

— কি বলছো তুমি মিষ্টি ।। আমি কেন তোমার ২ দিনের পরিচিত হতে যাবে।। তুমি ভুলে গেছো আমাদের বিয়ে হয়েছিল ঐ যে ২ টো বাচ্চাও আছে।। ( হাত দিয়ে ইশারা করে আবির)

আমি বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে পুরো অবাক হয়ে গেছি।। ঐ বাচ্চা ২ টো তুয়ানের সাথে ঝগড়া করছে তাও আবার আমাকে নিয়ে।।।

— এই শয়তান পুচকি ।। দেখে তো মনে হয় ভাজ মাছটাও উল্টে খেতে পারিস না।। আবার আমার মাম্মার কোলে বসে টিভি দেখছিস!!( কোমরে হাত দিয়ে আদ্র)

— এবার প্রথম তাই কিছু বলছি না ,,নাহলে তোকে ঐ টিভির তেভরে ঢুকিয়ে দিতাম।।আর বেরুতে পারছিস না !!( আদ্রিতা)

আবিরের ডাকে আমার ধ্যান ভাঙে ।।।

— আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো ।। ঐ ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাও।। আদ্র আদ্রিতার দিকে তাকাও ,, তোমার পাপা মাম্মামের দিকে তাকাও ।। হিয়ান ঋতু ,,তুয়ানের দিকে তাকাও ।।

আমি একবার সবার দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম ।।কেমন যেন আমার পুরো মাথা ঘুরছে ।। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখি ৮+ বছর পেরিয়ে গেছে।। পাপা মাম্মামকে একটু বয়স্ক লাগছে ।। ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে আবার তার একটা বেবীও আছে ।। আমার মাথায় ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিলেই আবির ধরে ফেললো।।।

জ্ঞান ফিরতেই সবাই আগে আমার পেটে হাতটা গেল ।। স্লিম অনুভব হওয়ায় লাফ দিয়ে উঠে বসলাম।। তখন আবির আমার পাশে বসে ছিল ,,,আমি আবিবের কলারটা চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম…

— আমমার বেবী ককোথায় আআবির????

প্রথমে একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবির আমাকে সবটা খুলে বললো।। তারপর আদ্র আদ্রিতাকে ডেকে আমার কাছে নিয়ে এলো। ওরা আমার উপর রাগ করে ছিলো।। আমি কেন ওদের আগে তুয়ানকে কোলে নিলাম তাই ।।কানে ধরে উঠবস অবধি করিয়েছে।। আগে আমি ওদের পাপাকে উঠবস করাতাম এখন আমাকে করাচ্ছে।। নিজের সন্তানদের বুকে নিয়ে মনে হলো আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ।।

🍂 🍂 🍂

বিকেলে বাড়ি ফিরে এসেছি।। এতোক্ষণ নিজের বেবীদের সাথে কাটিয়েছি ।। ওদের সাথে মেতে ছিলাম এতোক্ষণ।। নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ মনে হয়েছিল।। মাতৃত্ব যে কি সেটা আজকে অনুভব করলাম।। আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে ।। আমার সাথে গল্প করেছে।। খেলেছে।। নীড় আর হীড় আমার কাছে এসেছিল।। ওরা ওদেরকে বের করে দিয়ে দরজা লক করে দিয়েছে।।
এখন রাত ২ টা বাজে ।। একটু আগে ওরা ঘুমিয়েছে।। ওদের কথা একটাই ওরা ঘুমালে আমি আবার আগের মতো ঘুমিয়ে পড়বো ।। ওদের সাথে কথা বলবো না।। অনেক বুঝিয়ে একটু আগে ওদের ঘুম পাড়িয়েছি।। ঘুমের মধ্যেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।।
আমি ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে বেলকেনিতে দোলনায় বসে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম।।

“”সবকিছুই বদলে গেছে।। আমার জন্য কিছুই থেমে নেই।। হয়তো আমি বেঁচে ছিলাম বলে আবির কাউকে নিয়ে নতুন করে জীবন সাজাতে পারে নি।। যদি মরে যেতাম ,,তাহলে ঠিক নতুন করে জীবন সাজাতো ।। আমার বেবীদের দায়িত্ব নিতো ওর নতুন মা।। যদি সে ভালো ,,তাহলে ওরা সুখে থাকতো ।। নাহলে খুব কষ্টে থাকতো।। তখন আমি ওদের মনে সবসময় বিরাজ করতাম””

হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখি আবির আমার কাঁধে মাথা রেখে এক হাতে আমাকে জরিয়ে ধরে আছে।। আবির আমার আরেকটা হাত শক্ত করে ধরে চুমু খেল।। আমি জানি তুমি কি ভাবছো…..

— আমি কেন তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি ।। নতুন ভাবে জীবনটা শুরু করলেই পারতা।। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে।। আমি তোমাকে ছেড়ে নতুনভাবে বাঁচতে চাই না মিষ্টি।।‌সেদিনই মরে যেতাম ,,,যেদিন তুমি কোমায় চলে গিয়েছিলে!!!!!!

চলবে…..💞💞