কল্পকুঞ্জে কঙ্কাবতী পর্ব-২১+২২

0
241

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২১|

প্রাদশা প্রহর। গ্রীষ্মের তপ্ততা যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে আছে। দিদির হাতে-পায়ে মেহেদী লাগানোর পরপর দিয়া আর সুপ্তির হাতেও লাগিয়ে দিয়েছি। এখন আমার হাতের অর্ধমৃত অবস্থা। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কবজি চেপে ধরে, ছাদের রেলিঙের উপরটায় দু’পা তুলে চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। ইদে তো দিদি একাই সবটা সামলে নেয়, কিন্তু এখন! ধ্যাৎ! কেমন লাগে! গা’টা ম্যাচ ম্যাচ করছে। খিদেও পেয়েছে। কিন্তু আলস্যতা যে জেঁকে বসেছে আমার উপর! উঠতেই ইচ্ছে হচ্ছে না।

আড্ডা-গান চলছে সমানতালে। এরই মাঝে যোগ হয়েছে আরও কিছু মানুষ— পাশের বাড়ির ভাইয়েরা, আপুরা, দিদির মামার বাড়ির ভাই-বোন, আরও অনেকেই। খানিকক্ষণ আগেই সবাই আলাদা আলাদাভাবে গিয়ে রাতের খাবার সেড়ে এসেছে; আমি, রাহী আর আপি বাদে। ঘণ্টাখানেক হয়েছে, কুঞ্জ ভাই গেছেন। মিনিট পাঁচেক আগেই মেজমা এসে সুপ্তিকে নিয়ে গেলেন।

“নবু, এদিকে ঘোর তো!”

পাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেয়ে রয়ে সয়ে ঠিক করে উঠে বসলাম। তাকিয়ে দেখলাম, হাতে ভাতের থালা নিয়ে কুঞ্জ ভাই বসে আছেন। রাহীকে আমার পাশে এসে বসতে বলে আপিকে বললেন, “অনেক রাত হচ্ছে, রজনী। যাও, খেয়ে এসো। কাকিমণি ডাকছে তোমায়।”

আপি বলল, “মেজমা ডাকছে!”

“হুম। খেতে।”

“আচ্ছা, যাচ্ছি। আসিফ খেয়েছে?”

কুঞ্জ ভাই মাথা দু’দিকে নেড়ে বলল, “মুরুব্বিদের মাঝে ফেঁসে গেছে, গিয়ে উদ্ধার করে একসাথে খেতে বোসো।”

আপি যেন এক প্রকার ছুটেই পালাল। কুঞ্জ ভাই রাহীকে ভাতের লোকমা মুখে পুরে দিয়ে বললেন, “বেশি রাত জাগবি না। এক ঘণ্টা পরেই ঘুমোবি। কাল সকালে উঠতে হবে।”

রাহী চিবাতে চিবাতেই বলল, “আচ্ছা, ভাইয়া।”

এরই মাঝে কুঞ্জ ভাই আমার মুখের সামনে খাবার আনতেই আমি মুখ পিছিয়ে নিলাম, এতে উনি ভ্রু কুঁচকে ফেলে শুধালেন, “কী?”

আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আড়চোখে তাকিয়েই বললাম, “আমার হাত আছে, আমি একাই খেতে পারি। এত আদিক্ষেতা দেখানোর কিছু নেই।”

কুঞ্জ ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কত খেতে পারবি, জানা আছে। হাতের যে অবস্থা! ফুপি আর ফুপাও ব্যস্ত, তোকে খাইয়ে দিতে পারবে না। চুপচাপ খেয়ে নে।”

আমি পূর্বের ভঙ্গিতেই বললাম, “খাব না।”

“কেন?”

আমার কাছে এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, আমি ঈর্ষান্বিত। আমার পুরুষটা যখন আমারই সামনে পরনারীর প্রশংসায় মত্ত থাকে, তখন তার হাতের ছোঁয়াও যেন জ্বলন্ত অগ্নি-কাঠ লাগে। লাগবে না সেই পুরুষ, যে আমার হয়েও আমার না। আংশিক কিছুতে তৃপ্ত না আমি। আর অতৃপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিই ঢের ভালো।

আমার মুখ থেকে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন না উনি। এরই পূর্বে মুখের সামনে ভাতের লোকমা তুলে এনে বললেন, “পাশের জন তোর বেস্টফ্রেন্ড হলেও, আমার আপন ছোটো বোন। সিন ক্রিয়েট না করে চুপচাপ গিলে ফেল।”

একবার রাহীর দিকে তাকালাম। দু-হাত ভর্তি মেহেদী। ডান হাতে সদ্য লাগানো আর বাঁ হাতেরটা শুকনো, সেই শুকনো হাত দিয়েই ফোন চাপছে, কানে হেডফোন লাগানো। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকালাম, এই মেয়েটা হেডফোন কখন লাগাল?

কুঞ্জ ভাই আমার অবাক হওয়ার ছোট্ট হা-টাতে ভাত পুড়ে দিলেন। আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম ওঁর দিকে। এতে যেন ওঁর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজের মতো খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছেন।

খাওয়ানোর মাঝেই ওখানে খালামণির আগমন ঘটল। ধীরপায়ে ছাদের কর্ণারের এদিকটায় একদম আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমি বিষয়টা বুঝতে পারার পরপরই বুক ফেটে একটা অশ্রবণীয় চিৎকার বেরিয়ে এলো— “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।”

খালামণি একটা চেয়ার টেনে আমার কাছে বসতেই বলে উঠল, “বাহ! কুঞ্জ! কী সুন্দর দুই বোনকে খাইয়ে দিচ্ছ!”

কুঞ্জ ভাই কথাটা শুনতেই থালা থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন বড্ড অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে, ওঁর চাহনিতে বিষয়টা বোধগম্য হলো আমার। ভেতর থেকে ‘নায়ায়ায়ায়ায়া, এএএএ হতেএএএএ পারেএএএ নায়ায়ায়ায়া’ এর সাথে বেরিয়ে এলো বিষম। রাহীর পাশ থেকে পানির বোতলটা দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে দিলেন উনি। আমি পানি খেতে খেতে লক্ষ করলাম রাহীর ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে।

“কী এত ভাবো, খাবার সময়? একটু শান্তিমতো খাবে না? এখনই তো খাবার গলায় আটকে যাচ্ছিল!”

বিপরীতে কেউ কিছু বলল না। তবে আমার খুউব করে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘তোমার জন্যই তো হলো! আমার কী দোষ? এভাবে যাকে তাকে ভাই বানিয়ে দেবার কোনো মানে আছে, হু? আমাকে ওঁর বোন নয়, বলো— বউ। বুঝলে?’

কিন্তু বলার সুযোগটা না দিয়েই খালামণি আবারও বলে উঠল, “কুঞ্জ তো খাইয়ে দিচ্ছে তোমাকে। তুমি বরং খেতে খেতে আমায় মেহেদী লাগিয়ে দাও দেখি।”

এই ভয়টাই তো পাচ্ছিলাম। খালামণিকে ‘না’ বলতে পারছিলাম না। তাই তো মেকি হাসি দিলাম তার দিকে তাকিয়ে। ওরপরই কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করলাম চোখ দ্বারা।
কুঞ্জ ভাই ঝটপট খাওয়ানো শেষ করে বললেন, “না না, মামনি। ও নয়। আজ তো তোমাকে মেহেদী আমি লাগিয়ে দেব।”

খালামণি বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “তুমি পারো?”

“অবশ্যই। ভুলে গেছ, কুঞ্জ মাল্টিট্যালেন্টেড!”

“বেশ বেশ! দাও তবে। এই যে, হাতের কনুই দেখছ না? এর উপর থেকে শুরু করবে। আর তালুতে মানডালা করবে। আঙুলগুলোর প্রথম কর ফিলআপ করে দেবে। আর এইখানটায় ‘N’ লিখে দেবে। তোমার ফুপার নামের ফার্স্ট লেটার। ঠিকাছে?”

কুঞ্জ ভাই এতসব বুঝলেন কি না— জানা নেই। সামান্য ঘাড় নেড়ে বললেন, “আমি ফ্লাওয়ার অ্যান্ড টাউন ডিজাইনের মাঝে হালকা ন্যাচার মেশাতে বেশ ভালো পারি। দেখতেও ভালো লাগে। দিয়ে দিই?”

এরকম ডিজাইনের নাম আমি বাপের জন্মে শুনিনি, ঠিক তেমনই খালামণিও কোনোদিন শোনেনি। আমি তার মুখভঙ্গি দেখে যতদূর বুঝলাম, তার কাছে এই ডিজাইনটা বড্ড ইউনিক লেগেছে। অ্যান্ড অভ্যিয়েসলি, খালা আমার ইউনিক দেখাতে ভীষণ ভালোবাসে। তাই তো, খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে রাজি হয়ে গেল। এদিকে আমি আর রাহীতো বুঝলাম, ওঁর মেহেদী ডিজাইনটা; সেবছর ইদে এক্সামের প্রিপারেশনের জন্য যখন বাড়ি আসতে পারলাম না আমি আর রাহী, তখন কুঞ্জ ভাই এমনই এক ডিজাইন এঁকেছিলেন আমার হাতে। রাহীকে আমিই লাগিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ডান হাতটায় ওর ভাই লাগিয়ে দিয়েছিল। এঁকেছিল— তিন পাপড়ির ফুল, জোঁকের মতো পাতা, ধানখেত, সূর্য, আকাশ, সাঁইসাঁই করে উড়ে বেরানো সুতোর মতো বাতাস, কয়েকটা দালান, ছয়-সাতটা দাগ দিয়ে বানানো চুলবিশিষ্ট একটা মেয়ের দড়িলাফ খেলার দৃশ্য, একটা মই (কী কাজে যে ধানখেতের মাঝে রাখা হয়েছিল, জানি না), সুতোর মতো প্যাঁচানো কিছু ছিল ( ডিএনএ-র ক্রোমোজম হবে), আর খালি জায়গাগুলোতে ছোট্টো ছোট্টো অসংখ্য ফোঁটা (খুব সম্ভবত এত ইউনিক ডিজাইনে আমার উপর যাতে নজর না লাগে, সেজন্য দেওয়া)। ভাবতেই পেট ফেটে হাসি পেল। কুঞ্জ ভাইয়ের সেই মহান কারুকার্য এখন দ্বিতীয় বারের মতো পরিলক্ষিত হতে যাচ্ছে। আহা! আনন্দ! মহানন্দ! তবে এখানে বেশিক্ষণ থাকা বিপজ্জনক, অতিদ্রুত প্রস্থান ঘটালাম।

___________
রাত বাড়ছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সবাই ছাদেই মাদুর পেতে রয়ে গেছে। কিন্তু আমি! আমি সেই যে নিচে নামলাম! আর উপরে গেলামই না। কেন যেন আর সেখানে যেতে ইচ্ছে হলো না। সর্বাঙ্গে তুমুলভাবে আলস্যতার রাজত্ব চলল।
খুব করে মনে পড়ল, ছোটোবেলার সেসকল কাণ্ড! ইশ্! কী জ্বালাতাম আমি কুঞ্জ ভাইকে! রাহী হচ্ছে ভীতু আর পড়াকু মেয়ে। ওর কাজ সারাটাক্ষণ রুমবন্দি হয়ে নিঃশব্দে পড়াশোনা করা। কিন্তু আমি! একগুঁয়ে হলেও, কিছু মানুষের কাছে খুবই বাচাল, অতি চঞ্চল, দুষ্টুমিতে পারদর্শী আর শ্যেইমলেস একটা মেয়ে। লাস্ট বিশেষণটি কার দেওয়া, এটা নিশ্চয়ই বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই?

ছেলেবেলায় আমি খুব, খু-ব বেশিই অগোছালো ছিলাম। আর কুঞ্জ ভাই ছিলেন একদম আমার বিপরীত। আমি যতবার মণির বাসায় যেতাম, ততবারই আমার পদার্পণ হতো কুঞ্জ ভাইয়ের রুমে। আর সব সময়ই সেই রুমে ঢুকে একটা কাজই করতাম! এলোমেলো!

আমার বের হবার পর যেই রুমে ঢুকত, সেই বিরক্তির শীর্ষে চলে যেত। কুঞ্জ ভাই এই নিয়ে আমাকে কখনই কিছু বলতেন না। খুব আগলে রাখতেন কি না! সেজন্যই তো তার উপর পিছলে গেছি। আর উনি যে কখন অন্য নারীতে মত্ত হলেন, তা ভাবনায় রাখার সময় পাইনি।
ভাবতে ভাবতেই হাসি-খুশি মুখটা উদাস হয়ে গেল।

“উফফ! ভেবেছিলাম অলসরানিটা ঘুমিয়ে গেছে। যাক বাবা! জেগে আছিস।”

আওয়াজটা কর্ণে পৌঁছতেই সর্বাঙ্গে ভালো লাগা ছেয়ে গেল। এই মুহূর্তে ওঁকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। পাশে কুঞ্জ ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। উনি পা চালিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বাহুতে ধরে টেনে নিয়ে বসালেন খাটে। উনি হাতের মেহেদীকোণ দিয়ে আমার ডান হাতের তালুতে মেহেদী লাগাতে লাগলেন। আমি জানি, উনি কেমন লাগাবেন। তবুও আজ বাঁধা দিলাম না। এক দৃষ্টিতে কেবল ওঁকে দেখে যেতেই লাগলাম।

বড়ো বড়ো চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবসময় ক্লিন শেভ করা থাকেন। তবে আজ গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখা যাচ্ছে। এতেও ভালো লাগছে। বাতাসে চুলগুলো খুব জ্বালাচ্ছে ওঁকে। কিছু না ভেবেই অন্য হাতটা দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দিলাম। উনি আমার হাত থেকে দৃষ্টি সরালেন। আমার চোখে চোখ স্থির রেখে অধর প্রসারিত করে সামান্য হাসলেন। আমিও মুচকি হাসলাম।

মিনিট বিশেক যেতেই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “দেখো তো, কেমন হচ্ছে?”

আমি ওঁর কথা শুনে হাতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। মুহূর্তেই বিস্ফোরিত নেত্রে ওঁর দিকে তাকিয়ে জোরেসোরেই বলে উঠলাম, “শিখলেন কবে?”

উনি মাথা চুলকে হাসলেন। নত মাথা থেকে দৃষ্টি আমার চোখের মাঝে সীমাবদ্ধ রেখে বললেন, “যাতে তাকে কোনোবার নিজের মেহেদী নিজে লাগাতে না পারার জন্য আফসোস করা না লাগে, এজন্য সেবারই শিখে রেখেছিলাম।”

আবারও হাতের দিকে তাকালাম। কী সুন্দর!

চলবে…

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ

|পর্ব ২২|

রাজধানীতে হাড়-কাঁপানো শীত পড়েছে। এই তো! ক’দিন আগেও ফেসবুকে ধুমসে পোস্ট হচ্ছিল, ‘ঢাকা শহরে মানুষ শখ করে সোয়েটার পরে।’
বোধহয় শীত-বাবাজি তা সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছে। নয়তো উত্তপ্ত শহরে হুট করে এরকম শীত বর্ষণ নামে?

ঘুম থেকে জেগেছি মিনিট পাঁচেক হয়েছে। তবুও চোখ খুলিনি। বন্ধ দু’চোখেও বুঝতে পারছি, বেলা হয়েছে। উম… সাড়ে বারোটা বাজবে হয়তো! অভ্যেসবশত জাগ্রত আমিটা বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই পড়ে রইলাম। সময় খানিকটা যেতেই আস্তে-ধীরে বেডে হেলান দিয়ে উঠে বসলাম। মাথাটা ঠেকিয়ে দিলাম ওয়ালে। উফফ! এত ভার হয়ে আছে! কাল সারারাত মাথা-ব্যথায় কাতরিয়েছি। সে নতুন না! প্রতি বছরের শেষ রাতেই এমনটা হয়ে থাকে। তখন আমি আলাদা রুমে, দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়ে থাকি।

আমার মতো মানুষ এই শহরে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। থার্টিফাস্ট নাইটে সবাই যেখানে আনন্দ-উল্লাসে মত্ত থাকে; এই বাসার ছোটো মেয়েটি তখন এত শব্দে বিরক্ত হয়, মাথা ব্যথায় ছটফট করে, একা রুমবন্দী হয়ে থাকে। তার সাথে এই মুহূর্তে কথা বলার সাধ্যি কেবল একজনেরই আছে, কিন্তু সে যে থেকেও বহুদূরে।

নতুন বছর, নতুন দিন, নতুন শুরু! উঠে জানালাটা খুলে দিলাম। চোখের সামনে দৃশ্যায়িত সমগ্র কোলাহলপূর্ণ শহরটির যতটুকু পর্যন্ত দৃষ্টি যায়, বড্ড সূক্ষ্ম নজরে অবলোকন করে নিলাম। নাহ! নতুন ক্যালেন্ডার বাদে আর কোনো নতুনত্ব নেই। সব আগের মতোই আছে। কিন্তু… কিছু তো পরিবর্তন দরকার ছিল! এই যে, কতগুলো মাস ধরে যে এই চোখজোড়া তৃষ্ণার্ত! তৃপ্তি পাওয়ার যে খুব দরকার ছিল!

বুক চিরে বেরিয়ে এলো প্রিয়তমের নামে একটা দীর্ঘশ্বাস। দিদির বিয়ে হয়েছে, বহু মাস পেরিয়েছে। মেহেদী ভাইয়ের সাথে এখন সে চুটিয়ে সংসার করায় ব্যস্ত। বিয়ের পরপরই আমার ইয়ার চেঞ্জ এক্সামের রুটিন দেওয়া হলো। কিছুটা তড়িঘড়ির মাঝেই ঢাকা ফিরতে হয়েছিল। সেই যে, আমার আর তাঁর একসাথে থাকা, সেটা একসাথে ফেরা অবধিই ছিল। কত্ত বকবক করেছি! উনি হয়ে গিয়েছিলেন, আমার একমাত্র মনোযোগী শ্রোতা! কী তার মনোযোগ! কখনও ভুল করেও যেন দৃষ্টি সরাতেন না।

সে ঘটনার আজ অনেক মাস হয়েছে। ক’মাস পর আমার এইচএসসি। উনিও ভার্সিটিতে ফিরেছেন। ওঁর স্নাতক শেষ, মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন। কতগুলো মাস চলে গেল! কিন্তু ভদ্রলোক আর আমার মুখোমুখি হননি। শুরুরদিকে একবার বাসায় এসেছিলেন, তাও আবার রাতে থাকেননি। অজ্ঞাত সেই কারণটার জন্য আবারও মামার সাথে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়েছেন। রাহী আর আমি তখন এক্সামের প্রিপারেশনের জন্য আমাদের বাসায় ছিলাম বিধায়, সেই ঝগড়ার আংশিক কারণও জানতে পারিনি।

শুরুরদিকে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো, ইদানিং উনি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। কেন যেন আমার ফোনটাও পিক করার সময় পান না। নারী-হৃদয় বড্ড কোমল। উনি যে না চাইতেও বার বার এখানে আঘাত হানছেন, তা ওঁকে কীভাবে জানাব?

মুহূর্তেই মনটা বিষিয়ে গেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। তাঁকে মনে পড়তেই কেন এত কষ্ট লাগে? কই! মনে ধরতে তো কেবল সুখ লেগেছিল!
পাতা ঝাপটিয়ে অশ্রুকণা শুষে নিলাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে নিলাম, একটা বেজে গেছে। ৩টায় নৌশির বাসায় যাব, গ্রুপ স্টাডিজ-এর জন্য।

_______
ইদানিং খাওয়া-দাওয়ায় ভীষণ অনিয়ম করছি। শুধু যে, খাওয়ায়, তা নয়। ঘুমও আসি শেষরাত্রিতে। আমার সহস্র বিনিদ্র রাত অপেক্ষারত হয়ে কাটার একমাত্র কারণ আপনিই, কুঞ্জ ভাই! মুখ ফুটে তা বলা হয় না ওঁকে।

শাওয়ার নিয়ে কিছুটা খেলাম, আম্মুর জোরাজুরিতে। বেরোনোর সময়ই আমার ফোনটা বেজে উঠল। বুকটা ধুক করে উঠল। চটজলদি ফোনটা বের করলাম। বিগত ক’মাসে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটেছে। কল কিংবা ম্যাসেজ টিউন শোনা মাত্রই ফোন বের করেছি, ভেবেছি— এই বুঝি সে আমার নিল খোঁজ!
কিন্তু আফসোস! বরাবরের মতোই এবারও হলো সেটাই।
কান্না গিলে কলটা রিসিভ করে বললাম, “হ্যাঁ, রাহী! বল।”

“বাসায় তুই?”

“না, অ্যাপার্টমেন্টের নিচে। তোদের বাসার দিকে যাব না কি তুই আসবি?”

“এই! না-না! আসতে হবে না। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মাত্রই উঠলাম।”

“তো, অপেক্ষা করব?”

“না, তুই এক কাজ কর। মিনিট সাতেকের রাস্তা তো! তুই চলে যা। আমি ঘণ্টাখানেক বাদেই আসছি।”

“এতক্ষণ?”

ওপাশ থেকে মেকি হাসার আওয়াজ এলো। পরপরই রাহী বলল, “শাওয়ার নেব, খাব, রেডি হব। এক ঘণ্টায় যে হচ্ছে, এ-ই অনেক!”

“আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।”

“হুম, যা।”

হাঁটতে হাঁটতে বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। সামনের গলিটাতেই নৌশির বাসা। রোড ক্রস করছিলাম। হঠাৎ চেনা, বড্ড চেনা একটা স্মেল আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে এসে ঠেকল। সেই ম্যানলি স্মেলটা! মাঝ-রাস্তায় তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। এদিক-ওদিক ক্রমাগত চোখ বোলাচ্ছি। গাড়ির হর্নের সাথে সাথে আশেপাশের মানুষজনের ধমকানো স্বরও কানে এসে বেজে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল দেওয়ার সময় নেই। আমার চোখ তাঁকে খুঁজে যাচ্ছে, হাই স্পিডে বিট করতে থাকা হৃৎপিণ্ড তো তার নামেই কম্পিত হচ্ছে, বারংবার!

হঠাৎ এক রিকশা আমার খুব কাছ দিয়ে গেল, কনুইয়ে হালকা লাগল বোধহয়। পাশাপাশি একটা শক্তপোক্ত হাত আমাকে টেনে রাস্তার ওপাশে নিয়ে গেল। চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে রেখেছি। শরীর থরথর করে কাঁপছে। বুঝতে সময় লাগল, পেশিবহুল হাতটা আমাকে এপাশে দাঁড় করিয়েই ছেড়ে দিয়েছে। তীব্রতর হওয়া সেই স্মেলটা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই সামনে তাকালাম। বিস্ফোরিত নেত্রে ভিড়ের মাঝে মিশে যাওয়া ব্ল্যাকহুডি পরিহিত লোকটিকে একঝলক দেখতেই পেয়েই আনমনে আওড়ালাম, “কুঞ্জ ভাই!”

________
নৌশির বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। শরীরটা কেমন কাঁপছে। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কনুইয়ের উপরিভাগ চেপে ধরে আছি। পরনের শালটা খানিক উপরে উঠিয়ে দেখলাম, ফুল স্লিভসের গোলজামাটির কনুইয়ের এদিকে ছিঁড়ে গেছে, শরীরের চামড়ার কিছুটা অংশ ছিঁলে গেছে। তা থেকে নির্গত লাল তরল আমার বাঁ হাত ভিজিয়ে দিচ্ছে। সামান্য ক্ষত, তবুও রক্তপাতে মনে হচ্ছে— বড়ো-সড়ো কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়েছি। জ্বলছেও প্রচুর! তবে হৃদ-দহনের বেশি নয়!

পরপর কতগুলো চাপাশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলাম। কলিং বেল চাপার মিনিট তিনেকের মাঝেই দরজা খুলে গেল। চিত্রা দাঁড়িয়ে।

আমাকে দেখেই কোমরের দু’পাশে হাত গুঁজে বলল, “এত দেরি করলি কেন, হারামি! তোদের জন্য আমি আর নৌশি অপেক্ষা করছিলাম। আমি যে কীভাবে নিজের ঘুম চেপে রেখেছি, আল্লাহ নৌ’জ! আর ওদিকে নৌশি গালি দিতে দিতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছে। ইউটিউব দেখে ১০টি ভিন্ন কৌশলে মারার উপায়ও শিখে রেখেছে, তোদের উপর অ্যাপ্লাই করবে বলে।”

চিত্রার কথায় আমি ব্যথা ভুলে হেসে দিলাম। ও এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাই কই রে? ওকে কোন চিপায় লুকিয়ে রেখেছিস?”

আমি ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, “একটু আটকা পড়ে গেছে, ৪টার দিকে আসবে। আন্টিরা কই?”

চিত্রাও আমার পিছু পিছু আসতে লাগল। উত্তর দেওয়ার খাতিরে বলে উঠল, “আঙ্কেল অফিসে, আন্টি তার বোনের বাসায়। আর নৌশির বোন, মৌশি স্কুলে।”

“এই টাইমে?”

“স্কুলে ফাংশন আছে। এজন্য দেরি হচ্ছে।”

“মানে, বাসায় শুধু আমরা। তাই তো?”

“হ্যাঁ, তাই। এই তোর হাতে কী হয়েছে?”

শেষ বাক্যটি বলতে গিয়ে চিত্রার গলা কিছুটা উঁচু হয়ে গেছে। আমরা নৌশির রুমের সামনেই দাঁড়িয়ে। আওয়াজের উৎস পেয়ে নৌশি আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

আমি রুমে ঢুকে বললাম, “ফার্স্ট-এইড বক্সটা বের কর তো!”

এবার চিত্রা আর নৌশি একত্রেই বলে উঠল, “কী হয়েছে?”

আমি দু’জনের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করলাম। ওদের চোখে রাশভারি চিন্তা, কথায় প্রবল উৎকণ্ঠা। আমি আশ্বাসবাণী দিলাম, “তেমন কিছু না। ইট’স অ্যা… অ্যা স্মল এক্সিডেন্ট।”

দু’জনের কেউই মানল না— এটা ছোটো কোনো অ্যাক্সিডেন্ট। চেপে ধরায় আমি কুঞ্জ ভাইকে স্কিপ করে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। নৌশি এতে বেশ রাগারাগী করল। চিত্রা আমার ডানহাতের তালুটি নিজের মুঠোয় নিয়ে রেখেছে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্ষতের দিকে। হয়তো দেখতে পেলাম তার টলমল চোখে আমার ব্যথায় ব্যথিত হওয়ার সেই দৃশ্যটি।
নৌশি উঠে গিয়ে ফার্স্ট-এইড বক্সটি নিয়ে এলো। আলতো হাতে যখন তুলোতে স্যাভলন মিশিয়ে ক্লিন করতে লাগল, আমি মৃদু কেঁপে উঠলাম। ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এলো তীব্র ব্যথার অস্ফুট কিছু স্বর।
সঙ্গে সঙ্গে নৌশি হাত সরিয়ে নিয়ে অসহায় চোখে আমার দিকে তাকাল। তালুবন্দি করা হাতটিতে চিত্রা আরও জোর প্রয়োগ করে চেপে ধরল। এখানে রাহী থাকলে নিশ্চয়ই ফোঁপাতে ফোপাঁতে কেঁদে দিত। কুঞ্জ ভাইকে দোষারোপ করে বলত, ‘ওই হাদাটা করছে কী? ওর জন্যই হচ্ছে। ভাই থাকলে এরকম কিছুই হতো না। এবার আসুক, কাজী ডেকে তোর সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেব। এরপর দেখব, বউ রেখে যায় কই!’

আমি ওদের দু’জনের দিকে পালাক্রমে তাকিয়ে হেসে দিলাম। ইহজনমে আর সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করার সুযোগ নেই। এদের পেয়েছি যে!

_________

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বেজে গেল। রাহীকে ওর বাসার সামনে রেখে নিজের বাসায় চলে এলাম। রাত হবার সাথে সাথেই হাতের ব্যথা তিরতির করে বেড়ে চলেছে। উফফ! কলিং বেল না বাজিয়ে এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ডানে বামে না তাকিয়ে সোজা কুঞ্জ ভাইয়ের রুমে চলে গেলাম। মাস চারেক আগেই এই রুমে শিফট হয়েছি। বুকের ব্যথা এতই বেশি যে, এখন আর একা ঘুমোতে ভয় লাগে না। খট করে দরজা লাগিয়ে লাইট অন করতেই সামনে আপিকে দেখে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।

মেকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “ত…তুমি? এখানে কী করছ?”

আপি কিছু বলল না। কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ডান হাতটি পেছনে লুকোনোর আগেই আপির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তা ধরে ফেলল। আহত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বাহানা সাজাতে লাগলাম। কিন্তু তা কাজে লাগল না। আপি আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “ফ্রেশ হয়ে আয়।”

আমি হতবাক হয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। চেঞ্জ করার সময় সাদা ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্ত এলো। কী যন্ত্রণা! কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বেরোলাম। আপি কোনো শব্দ ব্যয় না করে ড্রেসিং করে দিল। নিষ্ঠুর আপি! ব্যথা পাচ্ছি, দেখছেই না। এত পাষাণ কেউ হয়?
ড্রেসিং শেষে আপি বেরোনোর আগে আমার হাতের ভাজে একটা চিরকুট দিয়ে গেল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তো হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।

আপির যাবার পর আমি চিরকুটটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। এটা কি তাঁরই চিরকুট?

সময় নিয়ে চিরকুটটি খুলতেই বেরিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত সেই শব্দগুচ্ছ, “ওখানে আমার একমাত্র আমানত তুমি। মেয়ে, নিজের প্রতি এত রাগ কীসের? তোমার না হলেও আমার একমাত্র আমানতের খেয়াল রেখো। যেভাবে রেখে এসেছিলাম, সেভাবেই আমার চাই। আর বেশি সময় না। একটু। একটু নিজের খেয়াল রেখো। তারপর তো তুমি আমারই। সম্পূর্ণরূপে, সমগ্র অধিকারে…”

চলবে…