#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৫|
রাত হতেই আম্মু আমাকে রাহীর সাথে এ-বাসায় থাকতে বলে চলে যায়। মামা ব্যবসায়িক কাজে প্রায়শই শহরের বাইরে থাকেন। রাতে খাওয়া শেষে আমি কুঞ্জ ভাইয়ের রুমে এলাম। মণি ওঁকে খাইয়ে দিয়ে মাত্রই উঠে দাঁড়াল। আমাকে এখানে আসতে দেখে বলল, “বোস, নবু। আমি প্লেটটা রেখে আসছি।”
যেতে যেতে রাহীকে উচ্চস্বরে ডেকে গেল, “রাহী, শোন তো! নবুর জন্য তোর এক সেট জামা বের করে দে।”
মণি চলে গেল। আমি পায়ের নখ দিয়ে মেঝে ঘষছিলাম। চরম অস্বস্তিতে ভুগছিলাম। আড়চোখে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা কুঞ্জ ভাইয়ের তুখোড় দৃষ্টি পরখ করে নিয়ে মাথা নত করে ফেললাম। বক্ষে কম্পন হচ্ছে। উনি যে আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন!
সময়ের কাঁটা মিনিট পেরোনোর আগেই উনি আমাকে ডেকে উঠলেন, “নবু!”
কেন যেন সাড়া দিলাম না। হয়তো রাগ.. উঁহু! অভিমান! নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে এদিক-সেদিক তাকালাম। কুঞ্জ ভাই উত্তরের অপেক্ষাও করলেন না। বড্ড কোমল কণ্ঠে শুধালেন, “একটু পাশে বসবি?”
কী নিঃসংকোচে আবেদন! কী বাচ্চামো ভঙ্গিতে আবদার! ফেলা যায় কি? যায় না তো! আমিও পারিনি। এগিয়ে গিয়ে বিছানার কোণ ঘেঁষে বসলাম। বসতেই উনি বললেন, “শাড়ি পরেছিস যে!”
“হুঁ, তো?”
“আমি না বললে তো কখনও পরিসনি!”
“আমাকে না বলে তো কখনো অপেক্ষায়ও রাখেননি!”
“অপেক্ষায় ছিলি?”
“হুঁ, ছিলাম।”
“আমার জন্য?”
“না, আপির দেবরের জন্য। তার জন্যই তো শাড়ি পরেছি!”
“কী!”
তাকিয়ে দেখলাম— কুঞ্জ ভাই চোখ-মুখ শক্ত করে বসে আছেন। আমার রাগটাও নেমে গেল। কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওঁকে! একদম অভিমানী একটা বাচ্চার মতো। গাল দুটো খানিকটা ফুলল কি? কী জানি! হয়তো, হ্যাঁ।
আমি খানিকটা কেশে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কুঞ্জ ভাই এতক্ষণ ফ্লোরের দিকে তাকিয়েছিলেন। এবার আমার দিকে তাকালেন। আমি মলিন হেসে বললাম, “অভ্যেস, কুঞ্জ ভাই! অভ্যেস। এই সময়টাতে আপনিই তো বলেছেন— হয়তো পড়তে নয়তো সাজতে। আপনি না হয় আমাকে কল দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু আমি তো অভ্যস্ত!”
উনি হয়তো বুঝলেন— আগের কথাটি আমার রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিল, তাই সামান্য গললেন। আফসোসের সুরে বললেন, “ইশ! কেউ যদি আমাতেও অভ্যস্ত থাকত!”
আমি সূক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে বললাম, “তবে?”
জবাবে তাঁর মুচকি হাসি আমার দুনিয়া এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। তখন সেই হৃৎতান্ডব না হয় বুঝিইনি!
প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম, “রাত বিরেতে আর কখনও যেন আমার বাসার সামনে আপনাকে না দেখি, কুঞ্জ ভাই। বুঝলেন?”
“বুঝেছি, ম্যাডাম!”
“গুড। মনে থাকে যেন!”
“ইচ্ছে করেই ভুলে বসব।”
আমার এবার ভারি রাগ হলো। জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”
উনি যেন আবৃত্তি করলেন,
“ইচ্ছে করেই ভুলে বসব।
মাঝের সব দেয়ালগুলো,
দেখো,
আমি অদৃশ্য করেই ছাড়ব।
তাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখা
আজন্মকাল চালিয়ে যাব।
শোনো, শোনো, হে বর্ষা! তুমি রইলে সাক্ষী তবে। তোমার বর্ষণকে সাক্ষী রেখেই এই প্রেম থেকে প্রণয় অতঃপর পরিণয় গাঁথব।”
আমি অবাক কণ্ঠে বললাম, “কাকে?”
“সিক্রেট।”
উনি মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। আমার ভীষণ জ্বলছে। রাগে কি না ঈর্ষায় —জানা নেই; তবে জ্বলছে আমার। রাগ দেখাতে গিয়েও পারলাম না। কেন যেন এই মানুষটার দিকে তাকালে, আর রাগ আসে না। তবুও আমার মন খারাপ হলো। মিনমিনে কণ্ঠে বললাম, “আপনি এভাবে ভিজবেন না, কুঞ্জ ভাই।”
“তাহলে তোকে দেখব কী করে?”
“এখন যেভাবে দেখছেন।”
“এভাবে হচ্ছে না।”
“তো কীভাবে দেখতে চাইছেন? আপনার মতলব ভালো ঠেকছে না।”
“সাধে কি তোকে ‘বোকা’ বলি?”
“হুহ!”
“শুনবি কি?”
“বলুন, শুনছি।”
“আমি তোকে..”
“হুম, হুম। এরপর?”
“দেখতে চাই।”
“তা-তো বুঝেছি। এরপর কী?”
“এরপর কী— মানে কী?”
“উফফ! কীভাবে দেখতে চান, এটা বলুন।”
“বলছি।”
“শুনছি।”
“নবু, বলতে দে না!”
“মুখ আটকে ধরেছি নাকি?”
“বড্ড জ্বালাচ্ছিস তুই।”
“এ মা! আমি এত নম্র-ভদ্র-সভ্য মেয়ে। আমার ব্যাপারে এসব বলছেন কী করে?”
“তোর বকবকানি দিন দিন বাড়ছে, নবু।”
“আচ্ছা। চুপ করছি। এবার বলুন।”
উনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। সময় খানিকটা পেরোতেই উনি বললেন, “বৃষ্টি সুন্দর না কি বৃষ্টিতে সজ্জিত স্বয়ং বৃষ্টিবিলাসী নিজে অধিকতর সুন্দর তা দেখার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু দুটোর সাথে তুলনা করা তো দূর, বৃষ্টিবিলাসী থেকে চোখই ফেরাতে পারিনি।”
আমি এত কঠিন কথাগুলো তখন বুঝিনি। ফ্যালফ্যাল নেত্রে তাকিয়ে ছিলাম। আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, উনি হেসে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, “কোনো কিছু জানার আগ্রহের চেয়ে বড়ো আগ্রহ কিচ্ছু না, পিচ্চি। আমারও এই জিনিসটা জানার আগ্রহ অ-নে-ক। আর তার জন্য বারবার আমাকে ছুটে যেতে হবে তোর আঙিনায়, বুঝলি?”
দু’পাশে মাথা নেড়ে বললাম, “বুঝিনি আমি। আপনি আসবেন না, ব্যাস! বোঝেন না কেন— আপনাকে অসুস্থ দেখতে, আমার ভালো লাগে না।”
উনি সে-সময় মোহময় হেসে ঘোর লাগানো আওয়াজে বলেছিলেন, “তবে তুই চলে আয় আমার কাছে.. আমার হয়ে।”
তখন আমি খুব ছোটো ছিলাম। ওঁর কথাগুলোর সঠিক মানে —আমি বুঝতাম না। তবুও সেই কথাগুলোকে ভিত্তি করেই এগোনোর সাহস পেয়েছিলাম। এমনি এমনি তো মন ওঁর উপর দুর্বলতা প্রকাশ্যে আনেনি! তবে, আজ! আজ তো আমি সেই কথাগুলো বোঝার মতো বড়ো হয়েছি। উনি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হলেও, আমি মোটেও বদলাইনি। উনি আমার বদলে যাওয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিলেন যে!
ওঁর প্রতি আমার অনিশ্চিত অনুভূতি নিয়েও সে-সময়ে এতটা এগোতে পেরেছিলাম। আর, এখন তো আমি নিশ্চিত প্রেমরোগে শয্যাশায়ী। এখন তো আমি জানি। আমি জানি, উনিও আমাকে… তবে হেরে যাই কী করে? ছেড়ে দিই কী করে?
আমার অতীতের ধ্যান ভাঙল বাসের কন্ডাকটরের উচ্চ আওয়াজে।
________
আধাঘণ্টা হলো, ঢাবির ক্যাম্পাসে এসেছি। কোনো এক ফাংশন চলছে। আমি এই ‘ভালো রকমের ভিড়’-এর মাঝে কুঞ্জ ভাইকে খুঁজে চলেছি। কোত্থাও পাচ্ছি না। কাউকে জিজ্ঞেস করাটাও সাহসে কুলোচ্ছে না। কিছুটা এগোতেই দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকা দু’টি মেয়ের কথপোকথনের আংশিক কানে এলো—
“ছেলেটা কী করেছিল রে?”
“ভুল করেছিল রে, ভুল। সাংঘাতিক রকমের ভুল।”
“মানে কী? খোলাসা কর, ভাই।”
“বলছি, বলছি। ফাহিম ভাইদের বিরুদ্ধে গেছিল ছেলেটা। খুব সম্ভবত ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। ডিপার্টমেন্টের কিছু একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল, সে তো করলই না। উলটো বাপের দাপট দেখাল। ফাহিম ভাইকে যা-তা বলল।”
“বলিস কী!”
“হ্যাঁ। এটুকুতেও এত কাহিনি হতো না। ফাহিম ভাইয়ের ধৈর্য থাকলেও অরুণ ভাইয়ের একদমই নেই। তাই ফাহিম ভাইকে নিয়ে আওয়াজ উঠাতেই, সোজা তেতে উঠেছিল। হাতাহাতির এক পর্যায়ে ওই ছেলেটাও অরুণ ভাইয়ের কর্লার চেপে ধরেছিল।”
“ইয়া আল্লাহ! ভুল নয় রে, রিমু। পাপ করেছে, পাপ।”
“একদমই তাই।”
এসব কথা বলতে বলতেই মেয়ে দুটো চলে গেল। নিশ্চয়ই ক্যাম্পাসে কোনো গণ্ডগোল লেগেছে। আপি বলত, ঢাবির ক্যাম্পাসে ৩৬৫ দিনের মাঝে ৩৬৬ দিনই ফাংশন আর ঝামেলা! সে তো অল টাইম লেগেই থাকে। যদিও বা ফান করেই বলত!
মেয়ে দুটো যেদিক থেকে এলো, সেদিকে তাকালাম। ওদিকে যাওয়ার জন্য মনটা নিশপিশ করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, কুঞ্জ ভাইকে ওখানেই পাব। কিন্তু যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
ঠিক-বেঠিককে পাত্তা না দিয়ে সেদিকে পা বাড়ালাম। কিছুটা এগোতেই পা থেমে গেল। চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। কিছুটা দূরেই তিনটে ছেলে মিলে একটি ছেলেকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। ছেলেটার অবস্থা মোটেও ভালো নয়। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত। সে বারবারই বলে যাচ্ছে, “মাফ করে দেন আমারে। আর হবে না। সব কথা শুনব।”
কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। সব সময় আমার কাছের মানুষজনদের জন্য খুব আগলে আগলে বড়ো হয়েছি। এরকম কিছু চোখে পড়েনি বললেই চলে। তাই এমন দৃশ্য প্রথমবারের মতো দেখতে পেয়ে আমি ভীষণ ভীত হয়ে পড়লাম। কিন্তু বিস্মিত হলাম তখন, যখন সেই তিনটে ছেলের মাঝে একজনকে চিনতে পারলাম। পরে লক্ষ করলাম— তিনজনকেই এর আগে আমার আশেপাশে দেখেছি। যখনই কোনো বিপদে পড়তাম, এই ভাইয়াদেরই কেউ একজন কোত্থেকে যেন আমাকে বিপদমুক্ত করত। আর একজনের সাথে কথাও বলেছি। মাঝে মাঝে দেখতাম— আমার সামনে আসার আগেই কোথাও একটা লুকিয়ে পড়ত; হয়তো খেয়াল করত না, আমি দেখে ফেলেছি। আবার সামনাসামনি দেখা হলে মুচকি হেসে বলত, “কী খবর, বনু? সব ঠিকঠাক? কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। তোমার ‘অরুণ ভাই’ সব ঠিক করে দেবে, বুঝলে?”
ওহ্ হ্যাঁ! অরুণ ভাই! উনিই তো অরুণ ভাই। কী অমায়িক ব্যবহার তাঁর! আমি সর্বদা মুগ্ধ নজরে দেখে যেতাম। আমার ভাই থাকলে, নিশ্চয়ই এমন হতো! মাঝে মাঝে তো প্ল্যান কষতাম— অরুণ ভাইকে আমাদের বাসায় আনার। আম্মু-আব্বুকে দেখিয়ে বলতাম, “দেখুন! আমার ভাই আমি নিজেই খুঁজে এনেছি। আজ থেকে ইনি আপনাদের বড়ো ছেলে, মনে থাকবে? আর অরুণ ভাই! ওঁদের আব্বা-আম্মা ডাকুন। ফাস্ট।”
কিন্তু কখনও হয়ে উঠত না। হঠাৎ মস্তিষ্কে খেলল— ওই আপুরা তো অরুণ ভাইয়ের কথাই বলছিল। আর..
আর কিছু মনে করার আগেই অরুণ ভাই ছেলেটির এক হাত টেনে একজনের সামনে ফেলল। হাতা গোটানো ঘর্মাক্ত কালো শার্টটি পেশিবহুল শরীরের সাথে লেপ্টে, প্রতিটি অঙ্গের ভাঁজকে নিপুণভাবে দৃশ্যায়ন করছে। উদাম বুকের সামনের দুটো বোতাম খোলা। বাঁ হাতে একটা ব্ল্যাক ওয়াচ এবং হাতটি পকেটে। অন্য হাতের দু’আঙ্গুলের ভাঁজে সিগারেট, যা মাঝে সাঝেই ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া। মাঝে মাঝে পৌষের হিমশীতল হাওয়া অবাধে বেড়ে ওঠা চুলগুলোর সাথে দারুণভাবে খেলা করে যাচ্ছে।
কুঞ্জ ভাইকে এমন অবস্থায় দেখে আমার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ল। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। আমার সাথে হেসে-খেলে দুষ্টুমিতে মেতে থাকা মানুষটা তো এত পাষাণ নয়। ছেলেটি কুঞ্জ ভাইয়ের একটি পা জড়িয়ে বলে যাচ্ছে, “ফাহিম ভাই, ভুল হয়ে গেছে। এবারের মতো ছেড়ে দেন।”
কুঞ্জ ভাই নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। অরুণ ভাই আরও দু’টো লাথি মারল। কুঞ্জ ভাইয়ের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বললেন, “শালারে ভাঙ্গা মুখে ‘আব্বা’ ডাকার জন্য ওর বাপের সামনে ছুড়ে আয়। অরুণ, তুই থাক। কাজ আছে।”
বাকি দু’জন ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এতক্ষণে কুঞ্জ ভাইয়ের দৃষ্টি আমার উপর পড়ল। ভেবেছিলাম— উনি ঘাবড়ে যাবেন, বিচলিত হবেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি নির্লিপ্ত থাকলেন। চোখ-মুখ বড্ড গম্ভীর। সেকেন্ড দুয়েক আমাকে দেখেই উনি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন; যেন আমাকে চেনেনই না। তারপর অরুণ ভাইকে নিয়ে ওদিকে চলে গেলেন। বুঝতে পারছিলাম না— এটা কী হলো?
চলবে…
#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৬|
লোকে বলে– প্রেম করবে আর প্রেমে মরবে না.. তা কি হয়? এ তো হলো তেমন– সাঁতার কাটবে, তবে জলে না নামবে!
মরণ তো নিশ্চিত, যদি তুমি কোনো কঠোর-শক্তপোক্ত-একরোখা-জেদী-গম্ভীর-অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কোনো পুরুষের মায়ায় আটকে যাও.. তার প্রেমেতে ডুবে যাও।
নবনী! হুমায়ূন আহমেদের ‘নবনী’ উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র ছিল স্বয়ং নবনী নিজেই। সে ছিল পোড়া কপালি। মায়ের কাছে জেনেছি, আমার জন্মের বেশ কিছুদিন আগেই মা এই উপন্যাসটি পড়েছিল। এর রেশটা এতটাই গভীরভাবে ছেয়ে গিয়েছিল তার মাঝে যে, আমার নাম নবনী রেখেই শান্তি পেল। অথচ, মা আমার বুঝল না। বুঝল না, আমার কপালেও ওমন কিছুই আছে।
আবার, হুমায়ূন আহমেদের ‘তেতুঁল বনে জোছনা’ উপন্যাসটিতেও নবনী ছিল। সেখানে নবনী তার ডাক্তার সাহেবকে বলেছিল, ‘ডাক্তার সাহেব, তুমি আমার জন্য দু‘ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ, তার প্রতিদানে আমি জনম জনম কাঁদিব।’
আচ্ছা! নবনীদের ভাগ্যে কি কেবলই কান্না? এত শোক কেন নবনীদের জন্যই?
টিএসসিতে বসে বসে ভেবে চলেছি, বিগত ঘটনাগুলো। বুকের মাঝে অদ্ভুত এক পীড়া হচ্ছে। সব কিছু কেমন যেন আওলিয়ে যাচ্ছে। বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে। অস্থিরতা তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। হয়তো চোখের কোণ বেয়ে মাটি স্পর্শ করল বেশ কিছু মুক্তোর মতোন জলকণা। অনুভূতির প্রখরতা দিনকে দিন আমাকে যেন বদ্ধ উন্মাদ করে তুলছে। আলগোছে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলের এপিঠ-ওপিঠ দিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুটুকু মুছে নিলাম। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শেষবারের জন্য আবারও সামলে নিলাম। আমার কৈফিয়ত লাগবে। ওঁকে জবাবদিহিতা করতেই হবে।
এর মাঝে আমার ফোনে লাগাতার কল এসে চলেছে, রাহীর কল। মস্তিষ্কের এই বিশাল দ্বন্দ্বে আমি বারংবার হেরে যাই। এই যে, কল রিসিভ করব কি করব না, এটা ভাবারও ফুরসৎ মিলছে না। পরপর দুই বার লম্বা করে শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্ত করে কল রিসিভ করব বলে তৎক্ষণাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। রাহী সচরাচর আমাকে এভাবে কল করে না!
আমি দ্রুত কল রিসিভ করেই ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলাম, “হ্যালো!”
“কই তুই?”
ওপাশ থেকে রাহীর রাগী স্বরের স্থির ও গম্ভীর কথাটায় আমি নড়েচড়ে বসলাম। এতক্ষণের মন খারাপ ভাব না কাটলেও, বিরহে কাতর আমার দেবদাসী ভাবটা যেন মুহূর্তেই ওই আকাশে উড়ে গেল। সে-যাক! ওসব গোনার সময় কই? সময় এখন রাহীর এমন আওয়াজের কারণ জানা। কোমল রাহী এমন রণচন্ডী রূপ ধারণ করল কীসের প্রেক্ষিতে? বুঝলাম না। তবুও অপরাধীর মতো মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললাম, “কেন? কী হয়েছে?”
“কই আছিস? টেক দ্যা নেইম অব্ দ্যাট প্লেস।”
রাহীর তীক্ষ্ণ, ধারালো আওয়াজের পরিপ্রেক্ষিতে আমি না ভেবে বলে দিলাম, “টিএসসির মোড়ে…”
ওপাশে রাহী থামল। বেরিয়ে আসা তীব্র রাগ যেন গভীরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস টেনে দমিয়ে আনল। সে-শব্দ আমি পেলাম।
এরপর নরম গলায় বলে উঠল, “আমি চিত্রা আর নৌশির সাথে আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে আছি। এখানে চলে আয়।”
“কোচিং-এ থাকার কথা ছিল না তোদের?”
“হুম, যাইনি। আর..”
“আর?”
“তোর বাসায় গণ্ডগোল বাঁধল বলে।”
“মানে?”
“ওখানে আর এক সেকেন্ড দাঁড়াবে না, নবনী। জলদি এসো।”
রাহী খুব রেগে গেলে আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ‘আসছি’ বলে, ফোন কেটে দিলাম। বিপদ চারদিক দিয়েই আসে। ভাই-বোন, দুটো বোধহয় মিলিত ষড়যন্ত্র করেছে, আমাকে চিন্তার চাপে পিষে মারার।
প্রস্থান ঘটানোর আগেই একটা বাচ্চা মেয়ে আমার কাছে এলো। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। সে ভুবন ভোলানো এক হাসি দিলো। কী স্নিগ্ধ সেই হাসি! আমি একটু এগিয়ে ওর মুখোমুখি হয়ে সামান্য ঝুঁকে নিচু স্বরে শুধালাম, “কিছু বলবে?”
সে উপর-নিচ জোরেশোরে মাথা নাড়ল। খিলখিল করে হাসছে, কখনও বা মুচকি হাসছে। হাসি যেন সরছেই না। সে আমার দিকে একটা কালো গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপা, আপনারে দিছে এইটা।”
আমি ফুলটা হাতে নিয়ে বললাম, “কে দিয়েছে?”
সে আবারও হেসে বলল, “ভাইয়ে কইতে না করছে।”
আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বয়স ১০ কি ১২ হবে! এরই মাঝে মেয়েটি আবারও বলল, “আপা, আরেকটা কথা কই?”
“বলো।”
“আপনে দেখতে ম্যালা সুন্দর।”
আমি বিস্মিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আমার বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দিতে হাতে একটা কাগজের টুকরো দিয়ে বলল, “এইটাও ভাই কইছে। আপনে কিন্তু আসলেই সুন্দর।”
তারপর এক দৌঁড়ে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ হা করে মাত্র ঘটা ঘটনাটি পর্যেক্ষণ করলাম। এরপরই তড়িৎ বেগে হাতে থাকা কাগজটি খুলতেই গুটি গুটি অক্ষরে সামান্য কয়েকটা শব্দ পেলাম। তাতে লেখা আছে, “তোমার জানার পরিসীমা বাড়ছে তবে, প্রিয় কঙ্কা!”
____________
ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে রাখা দুটো হাই বেঞ্চে মুখোমুখি বসে আছি আমি-রাহী ও নৌশি-চিত্রা। তিনজনেই উৎসুক নেত্রে আমার পানে চেয়ে আছে, এদিকে আমি নির্বিকার। আধাঘণ্টা ধরে এভাবেই বসে আছি। চোখের সামনে এখনও সকালের ঘটনাটা হুবহু ভেসে উঠছে। এর আগে কুঞ্জ ভাইকে কখনও স্মোক করতে দেখিনি। বাদামি চোখের এমন জ্বলজ্বলে দৃষ্টি চোখে পড়েনি। আচ্ছা! ওটা আমারই কুঞ্জ ভাই তো!
নিরবতা ভেঙে রাহী বলে উঠল, “ওখানে কেন গিয়েছিলি?”
আমি আমার শান্ত দৃষ্টি ডানে ঘুরিয়ে রাহীর পানে নিবদ্ধ করে শীতল কণ্ঠে বললাম, “জানিস না?”
রাহী হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলে বলল, “ভাইয়া তোকে ওখানে যেতে মানা করেছিল। করেনি কি?”
আমার ঠোঁটের কোণে তেরছা হাসি ফুটে উঠল। এদিক-সেদিক চোখ ঘুরিয়ে বললাম, “সে তো প্রেমে পড়াতেও তীব্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অবাধ্য মনটা শুনল কই? তাঁর প্রেমেতেই মজল!”
“তবুও..”, রাহী থামল। কিছুক্ষণ ভেবে ইতস্তত করে বলল, “ওখানে কিছু হয়েছে… ঘটেছে? না মানে, ভাইয়াকে দেখেছিস?”
আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম। চাপা হাসি ঠোঁট কামড়ে থামিয়ে বললাম, “কী দেখার কথা মিন করছিস? স্পেসিফিক কিছু? তোর ভাইকে না কি তোর ভাইয়ের অন্য রূপকে?”
রাহী আমতা আমতা করতে লাগল। আমি হাসি থামিয়ে ফেললাম। ধরা গলায় বললাম, “তুই জানতিস?”
রাহী মাথা নিচু করে ফেলল। চিত্রা নাক ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোরা দু‘জন কী ফুসুরফুসুর করছিস? আরও দু‘জন আছি আমরা এখানে। আমাদেরও বল!”
নৌশি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আজ বড্ড চুপচাপ। আমি আবারও সামান্য হাসলাম। যে বেঞ্চে বসে আছি, তার দুই পাশে হাতের ভর দিয়ে সামান্য পিছে ঝুঁকলাম।
আকাশের মাঝে ঘুরে বেড়ানো অশান্ত ঢেউয়ের ন্যায় অস্থির হৃদয় আমার শুধিয়ে উঠল, “শালার কোন দুনিয়ায় বাস আমার? হে, প্রকৃতি! তোমরা বলতে পারো, কেন আমি এত অবুঝ? যাকে নিজের গোটা পৃথিবী ভাবি; আমি বাদে তোমাদের পৃথিবীর সবাই জানে, আমার পৃথিবীর আসল পরিচয়। আমিই এত অবুঝ কেন? কোথায় ছিলাম আমি? দর্পণের ওপারে? যা সম্মুখে রাখা থাকবে, তা ছাড়া গোটাটাই আমার অজানা থাকবে!”
আমার মনের অবস্থা বুঝেই চিত্রা আর নৌশি দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন শুধাল না। এরই মাঝে চিত্রার ফোনে কল এলো, ওর মায়ের কল। মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে আমাদের বলল, “অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল, বাসায় যাই।”
আমি বড্ড ঠান্ডা আওয়াজে বললাম, “যেতে ইচ্ছে করছে না। তোরা যা।”
নৌশি বলল, “আমারও যেতে হবে। তুই রাইয়ের সাথে ফিরিস। এ্যাই, রাই! ওর সাথে থাক।”
চিত্রা আর নৌশি চলে গেল। আমি বেশ কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহীকে বললাম, “বাসায় কী হয়েছে?”
“ফুপার ছোটোবেলার কোন বন্ধু যেন নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে।”
“ওহ্, আচ্ছা! এরপর? তা তোর ফুপা রাজি?”
“কী যে বলিস না! ফুপা বা ফুপি, কেউ রাজি না।”
“তো ঝামেলা কীসে?”
“তারা না-ও করতে পারছে না। হেসিটেট ফিল করছে। তাই তাদেরকে বলেছে, ‘মেয়েতো ছোটো, এখন ওসব ভাবছি না। তাছাড়া বড়ো মেয়ের আগে ছোটোটাকে কী করে দিই?’ তারা ইন্ডিরেকটলি এই রিফিউজটা বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল, ‘সমস্যা নাই। ছেলেও কমবয়সী। অপেক্ষা করবে।’ ফুপা আর কিছু বলতে পারেনি। দুপুরে তোদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করবে। ফুপি তোকে খুঁজছিল সকালে। আমার বাসার কথা বলে এসেছিস, এটা আমাকে জানাবি না? তোর কথা জিজ্ঞেস করতেই, আমি ফুপিকে বলে দিয়েছি, ‘ও নেই’। ভাবতে পারছিস?”
“এরপর?”
“এরপর আবার কী? ম্যানেজ করতে বড্ড কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।”
“কীভাবে করলি ম্যানেজ?”
“বলেছি, তুই চিত্রার বাসায়। সকালে আমিই কল দিয়ে ওখানে যেতে বলেছি। এরপর চিত্রাকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়েছিলাম; যাতে ফুপি কল দিয়ে বাহানা দেয়, তুই ওয়াশরুমে। ফুপি ঘণ্টাখানেক পর চিত্রাকে কল দিয়েছিল। ও নার্ভাস ছিল। বলেছে, তুই ঘুমাচ্ছিস। অ্যান্ড আ’ম্ ড্যাম শিউর– ফুপি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনি। তুই বাড়ি যা। গেলেই ধরবে তোকে।”
“বাসায় তোর ভাইয়ের ব্যাপারে জানে?”
“কী? কোনটা?”
“আজ যা দেখলাম!”
“জানে। আবছা জানে।”
“আর আমার সাথে তোর ভাইয়ের ব্যাপারটা?”
“জানে।”
“আপি?”
“সবার আগে জানে।”
“আম্মু-আব্বু?”
“জানে তারা।”
“মামা-মণি?”
“জানে।”
“তুই কবে জানলি?”
“এসবে খেয়াল রাখতাম না। ভাইয়া তোকে পছন্দ করে– এইটা জানতাম। কিন্তু তোর জন্য যে এত পাগলামিও করে, তাও তোর সামনেই! এটা অজানা ছিল। আনএক্সপেকটেড ছিল।”
আমি রাহীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও কেমন মিইয়ে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোর ভাইয়ের সাথে মামার ঝগড়ার কারণ কি এই নিয়েই হয়েছে?”
রাহী আমার দিকে তাকাল। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, “এটা বলিস না যে, তুই জানিস না।”
“জানি।”
“এটাই কারণ?”
“আংশিক।”
“হুঁ?”
“কিছুটা। বাকিটা তুই।”
“মানে?”
আমি অবাক হয়ে রাহীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাহী বলল, “বাকিটা পরে বলব। এখন এটা বল, আকিব নামের ছেলেটাকে কী করবি?”
“আকিব কে?”
“ফুপার বন্ধুর ছেলেটা; যার জন্য তোর কাছে বিয়ের প্রপোজাল এলো।”
“ওহ্!”
“ওহ?”
“হুম। তোর ভাইয়ের বিষয়টাকে হজম করে নিতে দে। তারপর, এই নয়া মালটাকে পরে দেখছি।”
রাহী পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না আমার। কিচ্ছু না। নবনীদের অনেক দুঃখ থাকে.. অনেক দুঃখ। কিন্তু তাদের আশা ছাড়তে নেই।
চলবে…